আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিচার



 লোনা জলে জীবিকার সন্ধান এম জসীম উদ্দীন দুপুর গড়িয়ে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে একঝাঁক শিশু নেমে পড়েছে নদীতে। ওদের হাতে একদণ্ড সময় নেই। কারণ, বিষখালী-পায়রা নদীতে জোয়ার এসে গেছে। জোয়ারের নোনা জলে ভেসে আসবে অসংখ্য বাগদা চিংড়ির রেণু।

এতক্ষণ নদীর তীরে বাঁধের ওপর শিশুর দল ডাংগুলি আর মার্বেল খেলছিল জোয়ারের অপেক্ষায়। জোয়ারের জলে ভেসে আসবে সুতার মতো চিকন কালো ডোরাকাটা চিংড়ি পোনা। এ পোনা ধরে বিক্রি করে খাবারের সংস্থান করবে ওরা। বরগুনার তালতলী থানার একেবারে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষা গ্রাম জয়ালভাঙ্গা এলাকায় গিয়ে এ দৃশ্যই চোখে পড়ে। বঙ্গোপসাগর মোহনায় বিষখালী, পায়রা, বলেশ্বর—তিন নদীর মিলনস্থলের এ গ্রামে প্রায় দেড় হাজার পরিবারের বাস।

প্রধান জীবিকা নদী ও সাগরে মাছ ধরা। বই-খাতা নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা যে শিশুদের, কঠিন দারিদ্র্যের নিগড়ে বাঁধা উপকূলের সেই শিশুরা যাচ্ছে জীবিকার সন্ধানে। তাদের হাতে বই-খাতার বদলে নীল রঙের মশারির কাপড়ে তৈরি চিংড়ি পোনা ধরার জাল। জীবনের শুরুতেই তাদের কাঁধে চেপেছে সংসারের বোঝা। ছোট্ট রাজুর (১২) চোখে খুশির ঝিলিক।

তার সঙ্গী রফিককে (১৩) নিয়ে মাথা নুইয়ে তীক্ষ দৃষ্টি আর গভীর মনোযোগে সুতার মতো সরু একেকটি বাগদা রেণু ঝিনুকের খোলে তুলে আনছে আর গুনছে। —‘কী করো?’ মাথাটা ঘুরিয়ে ওপরের দিকে চেয়ে রাজু বলল, ‘মাছ গুনি। আইজ ভালোই পাইছি। গাঙ্গে নুন পানি বাড়ছে। চিংড়ির পোনারাও হেইতে কল কল কইর্যা গাঙ্গে আইতে শুরু করছে।

’ ‘তোমরা স্কুলে যাও না?’ ‘মোগো আবার স্কুল, প্যাডে খাওন না থাকলে স্কুলে যাওন যায়?’ রফিকের সহজ-সরল জবাব। স্থানীয় বড়বগী ইউনিয়ন পরিষদের হিসাবে, জয়ালভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সাত হাজার। এর মধ্যে স্কুলে যাওয়ার মতো শিশু কমপক্ষে দুই হাজার। জানা গেল, এসব শিশুর বেশির ভাগই স্কুলে যায় না। তারা পোনা মাছ শিকার, জেলে নৌকার শ্রমিক অথবা অন্য কাজে নিয়োজিত।

এলাকার জেলে আবদুর রহমান বলেন, ‘স্কুলে পাডামু না প্যাডের খাওন জোগামু। আর পড়াইয়া কী অইবে, গরিবের গুড়াগাড়া আর কতদূর মানুষ অইবে। ’ এলাকার একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় জয়ালভাঙ্গা কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহ আলম জানালেন, বর্তমানে এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪৫। অনেকেই নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে না। পোনা মাছ ধরার মৌসুমে (অক্টোবর-জানুয়ারি) উপস্থিতি অর্ধেকের বেশি কমে যায়।

অভিভাবকেরাও চান না, আয়ের পথ ছেড়ে তাঁদের ছেলেমেয়েরা ওই সময় বিদ্যালয়ে যাক। এখানে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যাও অনেক। জয়ালভাঙ্গার জেলে কাদেরের তিন ছেলেমেয়ে। বড় মেয়ে কারিমা এবার পঞ্চম, ছেলে মনির চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। এ অবস্থায় বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন ওদের বাবা।

লেখাপড়া বন্ধ করার কথা জানতে চাইলে কাদের বলেন, ‘সামর্থ্য নাই, পড়ামু ক্যামনে?’ জয়ালভাঙ্গা থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে তেঁতুলবাড়িয়া গ্রাম। তেঁতুলবাড়িয়া থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা নলবুনিয়া চর। জয়ালভাঙ্গা থেকে নলবুনিয়া পর্যন্ত হাঁটা মেঠোপথই সম্বল। এ পথও তেমন মসৃণ নয়। ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা বেশ দুর্গম।

সেই পথ ধরে নলবুনিয়া যেতে চোখে পড়ে চরের বাসিন্দাদের কুঁড়েঘর, দারিদ্র্যের মলিন চেহারা। স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, ‘নলবুনিয়ার চরে বাস করে প্রায় ৭০০ পরিবার। লোকসংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। শিশু আছে কমপক্ষে ৮০০—৯০০। ’ স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, তালতলী থানায় এমন কমপক্ষে আটটি চর আছে।

এসব চরের কয়েক হাজার শিশুর মধ্যে বেশির ভাগই বিদ্যালয়ে যায় না। বরগুনার স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন ২০০৬ সালে জেলার তিনটি উপজেলার ১৭টি চর ও নদীতীরবর্তী এলাকায় শিশুদের ওপর এক সমীক্ষা চালায়। ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এলাকার লোকসংখ্যা ৩২ হাজার ৬২১। এর মধ্যে চার থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা আট হাজার ৫৮৫। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে যোগাযোগ করে জানা গেছে, জেলায় বিদ্যালয়ে যাওয়ার মতো শিশুর সংখ্যা এক লাখ ৩০ হাজার ১৯৬।

এর মধ্যে বর্তমানে বিদ্যালয়ে যায় এক লাখ ২৫ হাজার ৪৬৫। বরগুনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অমল কৃষ্ণ মজুমদার বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের নানা সমস্যা আছে। এর মধ্যে দারিদ্র্য, পারিবারিক অসচেতনতা, যোগাযোগসংকট, শিক্ষকস্বল্পতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিচালনা পরিষদ নিয়ে নানা ঝামেলা আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা। ’

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।