আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আত্মঘাতী ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরুন----প্রথম আলো

আগে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে এক জেলা পর্যায়ের শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে দেখা। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় চার দশক। জানতে চাইলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কী খবর। বিশ্ববিদ্যালয় মানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, আমার প্রায় তিন দশকের কর্মক্ষেত্র। এর সঙ্গে বর্তমানে আমার একমাত্র সম্পর্ক, আমি এই বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের একজন সদস্য।

সিন্ডিকেট সভা হলে যাই, না হলে নয়। সুতরাং আমার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব খবর জানা এবং জানানো সম্ভব নয়। তার পরও তাঁকে বলি, সব ঠিকঠাক চলছে বলে মনে হয়, তবে সমস্যা করে ছাত্রলীগ নামধারীরা, যাদের কারও কারও দুর্বৃত্তপনায় ক্যাম্পাসে অনেকেই অতিষ্ঠ। হেন অপকর্ম নাই, যাতে তারা জড়িত নয়। চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে দোকান আর ডাইনিং হলে ফাও খাওয়া—কোনোটাই বাদ যায় না।

আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়, যখন তারা প্রতিনিয়ত অন্তর্কলহে লিপ্ত হয়ে একজন আরেকজনের মাথা ফাটায়। এমনটা চলতে থাকলে কোনো প্রশাসনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে চালানো সম্ভব নয়। সেই নেতার একটা ছোট মন্তব্য, প্রধানমন্ত্রীকে বলুন না ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে দিতে! তাঁর কথা শুনে আমি কিছুটা অবাক। যে কথা তাঁর পর্যায়ের একজন নেতা বলতে পারেন না, তা আমি বলি কী করে? আমার বলার সুযোগও বা কোথায়? আর বললেও প্রধানমন্ত্রী শুনবেনই বা কেন? তিনি তো তাঁর ভালোমন্দ বিচার করে সিদ্ধান্ত নেবেন। তাঁর বর্তমান সরকারের প্রথম দিকে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তপনায় বিরক্ত হয়ে তাদের অভিভাবক পদ থেকে তিনি নিজেই অব্যাহতি নিয়েছিলেন।

তাতে লাভ হলো কী? আর ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা ভাবারও কি কারণ আছে? শুরুতেই একটা কথা বলে রাখা ভালো। বছর দেড়েকের মাথায় যখন বর্তমান সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হবে, সরকার যদি নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে (ধরে নিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে না), তখন সবার আগে সব ক্যাম্পাস থেকে হাওয়া হয়ে যাবে ছাত্রলীগ নামধারী এই সোনার ছেলেরা। অভিজ্ঞতা কিন্তু তাই বলে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন বলতে গেলে ছাত্রলীগের এক সোনালি যুগ। নেতৃত্বে ছিলেন খালেদ মোহাম্মদ আলী, আবদুর রউফ প্রমুখ।

পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজরা। এঁরা সবাই ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের নায়ক। এঁরা শুধু যে একটি ছাত্র সংগঠনেরই নেতৃত্ব দিয়েছেন তা নয়, সংগঠিত করেছেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে, একেকজন মহানায়কের মতো ফিরে এসেছেন স্বাধীন বাংলাদেশে। কেউ কেউ পরবর্তীকালে দেশের রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। দ্বিমত থাকতে পারে কারও কারও, তবে আমার মতে, ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের সোনালি যুগের অবসান হয়েছে।

বর্তমানে এই সংগঠনকে আর কেউ দেশের ছাত্ররাজনীতি বা আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির জন্য অপিহার্য মনে করে না। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, বাহাদুর ব্যাপারী, সুভাষ সিংহ রায় প্রমুখের তাদের পূর্বসূরিদের মতো হয়তো নেতৃত্ব দেওয়ার তেমন উল্লেখ করার মতো যোগ্যতা ছিল না; তবে তাদের নামে বর্তমান ছাত্রলীগের ‘নেতাদের’ মতো দুর্বৃত্তপনার অভিযোগ শোনা যায়নি। সুলতান মোহাম্মদ মনসুরকে এখন আর রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় দেখা যায় না। বাহাদুর ব্যাপারী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। সুভাষ সিংহ রায় প্রতি রাতে বিটিভিতে টকশো সঞ্চালন করে এবং সবকিছুতেই রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে।

পরের নেতাদের তেমন একটা খোঁজ পাওয়া যায় না। শুনেছি অনেকে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। তা-ও ভালো। অন্তত বলা যাবে যে কারও পকেটে হাত দিচ্ছেন না বা আর দশজনের মতো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য, চাকুরি-বাণিজ্য করছে না। বর্তমানে কোনো ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের তেমন আওয়াজ পাওয়া যায় না।

শুনেছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির এখন একটু লো-প্রোফাইলে আছে। এটি কিছুটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর কিছুটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কৃতিত্ব। তবে সময়মতো যখন তারা তাদের আস্তানা থেকে বের হয়ে আসবে, তখন কিন্তু ছাত্রলীগ নামধারী কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজশাহী আর সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরও একই অবস্থা। ঢাকা আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল বেশ শক্তিশালী, তবে বর্তমানে ক্যাম্পাসে তাদের তেমন কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না। বছরে একবার তারা তাদের নেত্রীর ‘জন্মদিনে’ কেক কাটে। আর আছে কিছু বাম ছাত্রসংগঠন। এরা অনেকটা তাত্ত্বিক ও কিছুটা আদর্শবাদী, তবে বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। কদিন আগে তারা ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে তালা লাগাল।

ডাকসু নির্বাচন অবশ্যই হওয়া উচিত, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় যদি তা হয়, তাহলে ক্যাম্পাসের কী অবস্থা হবে, সে সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ছাত্রলীগ তিন ভাগে বিভক্ত—এমন একটা খবর কদিন আগে আমাকে দিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রগতিশীল সিনিয়র শিক্ষক। বাম ছাত্রসংগঠনগুলো হুমকি দিয়েছে, সত্বর ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা না দিলে আবার নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে তালা পড়বে। এই নির্বাচন হলে তাদের কী লাভ, তা বোঝা মুশকিল। তবে ওই শিক্ষক আমাকে বলেছেন, এদের কয়েকজন নেতা মনে করে, নির্বাচন হলে তারা নব্বই ভাগ শিক্ষার্থীর সমর্থন পাবে! জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রদল থাকলেও নিষ্ক্রিয়।

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কখনো ছিল না। শুধু বেগম জিয়ার প্রথম শাসনামলে একটি টেন্ডারকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত বন্দুকযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সনি নিহত হয়েছিল। এখানকার কিছু শিক্ষার্থী বর্তমান শিক্ষকদের একাংশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ভিসি, প্রো-ভিসি হঠাও আন্দোলনে জড়িত, যদিও শিক্ষকদের এই আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কী স্বার্থ জড়িত, তা পরিষ্কার নয়। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের উপস্থিতি না থাকলেও ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড কিন্তু থেমে নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা একাধিক দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে নিয়মিত খুনখারাবিতে লিপ্ত থাকে।

সম্প্রতি এমন খবর সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। কদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হোটেলে ফাও খাওয়াকে কেন্দ্র করে ওই হোটেলে তারা তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। আবার দুই গ্রুপে মারামারি শুরু করলে পুলিশ তা থামাতে গেলে উভয় পক্ষ সম্মিলিতভাবে পুলিশের মাথা ফাটিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ইংরেজি বিভাগের জুবায়ের খুন হয়েছে গত জানুয়ারিতে। পদ্মা সেতুর নামে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে খুন হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র আবদুল্লাহ আল হাসান।

একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, ছাত্রলীগ নামধারী এসব নেতা প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জিম্মি করে ফেলেছে এবং আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এই নেতাদের কেউ কেউ আবার একশ্রেণীর শিক্ষকদের অপরাজনীতির শিকার হয়েছে এবং হয়তো কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য এদের তাঁরা ব্যবহার করছেন অথবা ব্যবহার করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এসবের সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে যত নতুন নতুন আবদার। ঢাকায় কোনো একটি সম্মেলনে যেতে দুটি বাস দিতে হবে। শহরে যেতে হবে, মাইক্রোবাস চাই। সংগঠন চালানোর মতো তহবিল নেই, ঠিকাদারের কাছ থেকে চাঁদার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

একজন ছাত্র তার ছাত্রজীবনে কট্টর ইসলামী ছাত্রশিবির করত। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরির জন্য আবেদন করল। খুব সহজেই সে একটা সনদ জোগাড় করতে পারে যে সে ছাত্রলীগের কর্মী ছিল। মোটা দাগের অর্থ খরচ করলেই সনদ মিলবে। উপাচার্যের কাছে তার হয়ে তদবির করতে আরও কিছু অর্থ খসাতে হবে।

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়ে দিলে এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বরং উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই সোনার ছেলেরাই তো ছাত্র সংসদের নেতা নির্বাচিত হবে। নির্বাচিত হলেই কি তাদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র হয়ে যাবে? ভুল ধারণা। বরং তারা তখন সব ধরনের অপকর্ম করার লাইসেন্স পেয়ে যাবে।

বড় প্রশ্ন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? প্রথমে ছাত্রলীগ নামক এই সংগঠনের খোল-নলচে পাল্টাতে হবে। এখন বাংলাদেশের অবস্থা এমন হয়েছে যে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ—সবকিছুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হয়। হয়তো এখানেও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হবে। যে সংগঠনটি বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া, সেই সংগঠনকে তো কিছু দুর্বৃত্তের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। সাম্প্রতিক কালে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের তেমন কোনো ক্ষতি করতে না পারলেও ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে যা ক্ষতি হয়েছে, তারপর তো বিরোধী দলের আর কিছু করার প্রয়োজন নেই ।

বর্তমানে ছাত্রলীগে চেইন অব কমান্ড বলে কিছু নেই। এই যে কদিন আগে সিলেট এমসি কলেজের শত বছরের পুরোনো ছাত্রাবাসটি তারা পুড়িয়ে দিল, তাতে লাভ হলো কার? ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় সিলেট শহরের মানুষ যত না ক্ষুব্ধ হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে এই ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনায়। এর জন্য তো ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকেই চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। সিলেটের এ ঘটনা একটি উদাহরণ। এমন ঘটনা সারা দেশে ছড়িয়ে আছে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, শুরুটা কোথা থেকে হবে? হতে পারে ছাত্রলীগ নামের বর্তমান সংগঠনটি (সব শাখা-প্রশাখাসহ) সাময়িক সময়ের জন্য বিলুপ্ত করে সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করা এবং খেয়াল রাখা, কোনো অবস্থাতেই কোনো অছাত্র বা অনিয়মিত ছাত্র যেন আবার সংগঠনে ঢুকে না পড়ে। এই দুরূহ কাজটি অনেকটা সহজভাবে করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। একজন শুভাকাক্ষ্মী হিসেবে এমন একটা প্রত্যাশা তো তাঁর কাছে করতে পারি। ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো এখনো অনেক যোগ্য ছাত্র সংগঠনে আছে। তারা কখনো সামনে আসতে পারে না।

আত্মঘাতী ছাত্রলীগের লাগাম টেনে না ধরলে বিপদ অত্যাসন্ন। আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তারিখ: ০১-০৮-২০১২ প্রথম আলো ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।