বসে আছি পথ চেয়ে.... নালিশ বা অভিযোগ করাটা আমাদের স্বভাব। এই দুনিয়ার কারো বিরুদ্ধে কখনো নারিশ করেনি- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে এই সংসারে আমাদের মনের মতো করে সবকিছু ঘটেনা। আর তা না ঘটলেই আমরা ক্ষেপে যাই। এর ওর ওপর ঘটনার দায় চাপাই।
কাউকে না কাউকে অভিযুক্ত করি; তার বিরুদ্ধে নালিশ জানাই। প্রতিবাদ করি। এটা আমাদের বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা নালিশ নেই- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
নালিশ করার অভ্যাসটা আমরা ছোটবেলা থেকেই আয়ত্ত করি।
যদিও সে সব নালিশের বড় বেশি প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ছোটবেলায় আমরা ‘নালিশ করে বালিশ পাওয়া’ ধরনের একটি কথা প্রায়ই শুনতাম। কেউ হয়তো কারো নামে অভিভাবক বা শিক্ষকের কাছে কোনো অভিযোগ করেছে, কিন্তু তিনি ব্যাপারটি তেমন গুরুত্ব দেননি। তখন অভিযোগকারীকে প্রশ্ন করে ‘কয়টা বালিশ পেয়েছে’ জানতে চেয়ে ক্ষ্যাপানো হতো। ছোটবেলার নালিশের ধরনই অবশ্য আলাদা- ও আমাকে ভেঙ্গিয়েছে, আমাকে খেলায় নেয়নি, আমাকে বকেছে ধরনের নালিশই অহরহ শোনা যেতো।
এসব নালিশের আর কি প্রতিকার হয়?
সব নালিশের প্রতিকার কখনোই হয় না। কিন্তু তবু নালিশের মতো জিনিস নেই। ইংরেজিতে কথাই আছে, যে চাকাটা সবচাইতে বেশি কিচকিচ আওয়াজ করে, সেই চাকাই সবচাইতে বেশি তেল বা গ্রিস পায়।
তবে নালিশের স্বভাব আছে যার, সে চিরদিনই সব কিছুতে নালিশ করে। তবে এ ব্যাপারে মহিলাদের বদনাম বেশি।
একদিন মধ্যরাতে এক ভদ্রমহিলা ঘুমন্ত স্বামীকে ঘুম থেকে তুলে অবিযোগ জানালেন- ওগো আমার ফ্ল্যাটটা না ইঁদুরে ভরে গেছে। দেখো খাটের নিচে কয়টা ইঁদুর কিচকিচ করছে। নিন্দ্রাজড়িত কন্ঠে সদ্য ঘুমভাঙা বিরক্ত স্বামী খেঁকিয়ে উঠলেন, ইঁদুর কিচকিচ করছে তো আমি কি করবো? আমি কি গিয়ে ইঁদুর ধরে ধরে তেল লাগাবো?
এই নালিশ বা অভিযোগ সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তা দুএকটা উল্লেখ করা যাক। গল্পটা নিউইয়র্কের এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের।
এই দোকানের ম্যানেজারের কাছে গিয়ে এক খেদ্দের কি একটা বিষয় নিয়ে অভিযোগ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার ভদ্রলোক রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে এক কর্মচারিকে ডেকে পাঠালেন এবং সেই কর্মচারিকেই দায়ী করলেন। বললেন,‘তোমার কাজে অবহেলার জন্যই এ রকম হয়েছে। এজন্য তোমাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। এরকম অভিযোগ আসা দোকানের জন্য কতো বড় অসম্মানের, তা তুমি জানো?’
কর্মচারীটি অভিযোগ শুনে আমতা আমতা করতে লাগলো; কিন্তু ম্যানেজার তাকে মোটেও ক্ষমা করলেন না, তাকে একেবারে চরম দণ্ড অর্থাৎ বরখাস্তের ঘোষণা দিলেন।
লঘু পাপে এতা গুরুদণ্ড দেয়া হবে, তা অভিযোগকারী ভদ্রলোক কল্পনা করতে পারেননি। তিনি অনুতপ্ত হলেন এবং এবারের মতো কর্মচারীটিকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য ম্যানেজারকে অনুরোধ করলেন। কিন্তু ম্যানেজারের মোন কিছুতেই নরম হলো না। সে তার সিদ্ধান্তে অটুট রইলেন। এর কয়েক মাস পর সেই খদ্দের আবার সেই দোকানে গেছেন।
কেনাকাটা করে ম্যানেজারের ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সেই পরিচিত দৃশ্যটি দেখতে পান। সেই যে কর্মচারীটিকে তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে ছাটাই করা হয়েছিলো, সেই কর্মচারিচি আগের মতোই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে অছে। ঘরে সেই কর্মচারীর পাশে অন্য এক ব্যক্তি, সে-ই বোধ হয় কোনো অভিযোগ করেছে। দেখা গেলো, এবারো ম্যানেজার কর্মচারীটিকে কর্তব্যে অবহেলার জন্য বরখাস্ত করছেন। ব্যাপারটা মুহূর্তের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেলো।
এই কর্মচারীটির চাকুরিই হলো বরখাস্ত হওয়া। যখনই কোনো অভিযোগ আসুক, সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডেকে এনে খদ্দেরের সামনে বরখাস্ত করা হয়। এতে গ্রাহকের দৃষ্টিতে দোকানটির মর্যাদা বৃদ্ধি হয়।
অভিযোগ বিষয়ে এবার একটি ভিন্ন গল্প। এক বাড়িতে একটা পার্টি ছিলো।
রাত বারোটা বেজে গেছে, কিন্তু কয়েকজন অভ্যাগতের ভ্রূক্ষেপ নেই। তারা নিশ্চিন্তে বসে হানি-ঠাট্টা, পান-গান চালিয়ে যাচ্ছে। অস্থির হয়ে গৃহকর্তা মত্ত অভ্যাগতদের অগোচরে চুপিসারে পাশের বাড়িতে গিয়ে বললেন- ভাই, মিনিট পাঁচেক পরে এসে আমার বাড়িতে কড়া নেড়ে বলুন, এতো রাতে হইহল্লায় খুব ডিস্টার্ব হচ্ছে।
প্রতিবেশী বললেন, আমি আপনার কাছে এ রকম অভিযোগ করতে যাবো কেনো? আমার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ভদ্রলোক বললেন আপনার হচ্ছে না ঠিক; কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি ভাই, আমার ভীষন অসুবিধা হচ্ছে।
কিন্তু আমি তা ওদের বলতে পারছি না। আপনি রাগারাগি করলে ওরা বুঝতে পারবে আমোদের ষোলআনা পূর্ণ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কেটে পড়বে।
বাস্তবে অবশ্য সবকিছু এমন ভালয় ভালয় হয় না। অভিযোগ করলেই বরং অনেক ক্ষেত্রে বিপদ বাড়ে।
চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষই কোনো অভিযোগ উত্থাপন করার সাহস পায় না। অভিযোগ করলে সন্ত্রাসীদের হামলার স্বীকার হতে হয়। তাছাড়া যার কাছে অভিযোগ দেয়া হয়, সেই পুলিশও অভিযুক্ত সন্ত্রাসীর চাইতে নিরীহ অভিযোগকারীকে হয়রানি করে বেশি। ফলে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই কিল খেয়ে কিল হজম করার বিদ্যায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তবে কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা এতো কিছুর পরও অভিযোগ আর নালিশ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে যাচ্ছেন।
তারা বিরামহীন এ-ওর বিরুদ্ধে, সে-তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং নালিশ জানিয়ে জাচ্ছেন। যদিো এর কোনো প্রতিকার মিলছে না।
আমাদের দেশে বর্তমানে সরকার নালিশ করছে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। বিরোধী দল নালিশ করছে সরকারের বিরুদ্ধে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের মত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করছে।
সরকারও পাল্টা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে নালিশ জানাচ্ছে।
তবে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা নালিশ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কারণ অন্য যে কারো বিরুদ্ধে আমরা সরকারের কাছে নালিশ জানাই। সবার সব অভিযোগ বা নালিশের প্রতিবিধান করার কথা সরকারের। ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সবার সব ধরনের মানবিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব সরকারের।
কেউ যেন আইন লঙ্ঘন না করে, সবাই যেনো নিয়ম-নীতি ও সংবিধান মেনে চলে, তা নিশ্চিত করা সরকারের কাজ। কোথাও কারো দ্বারা নিয়ম লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলে তা নিদানের দ্বায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে এর উল্টে ঘটনাই ঘটছে। কারো কোনো অভিযোগের প্রতিকার করা তো দূরের কথা, সরকারে বিরুদ্ধেই এখন একের পর এক নিয়ম লঙ্ঘন ও ব্যর্থতার অভিযোগ উঠছে।
সরকার নিজেই যেখানে স্বেচ্ছাচারী, সেখানে অভিযোগ-নালিশ-হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট করে শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো ফায়দা লাভের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
তারপরও যারা নালিশ এবং অভিযোগ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে যাচ্ছেন, তাদের ধৈর্য ও সাহসের প্রশংসা করতেই হয়! আপনারা পারেন বটে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।