আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধের তিনটি লোমহর্ষক গল্প

আমি মুক্ত, আমি স্বাধীন। মুক্ত চিন্তা আমার ধর্ম। #এক বীভৎস যৌন নির্যাতনের কথা# কোতায়ালী থানার ভেতরে হলেও মোহনপুর গ্রাম দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় বার মাইল দক্ষিন-পূর্বে। জয়নাল আবেদীন এই গ্রামেরই একজন খেটে খাওয়া গেরস্থ। স্ত্রী, কিশোরী মেয়ে আর শিশুপুত্র নিয়ে তার সংসার।

আর দশজন শ্রমজীবি মানুষের মতই, 'সুখে-দুঃখে লেপটে থাকা বছর মাসের বছর জয়নালের। জয়নালরা রাজনীতির সুফলের অংশীদার হয় কদাচিৎ,কিন্তু রাজনীতির ভোগান্তির সবটুকুই ভোগে। একাত্তরেও এর ব্যতিক্রম রইলো না। ছোট্ট ভুবন জয়নালের। এক প্রস্থ ভিটার উপর এক রত্তির এক ঘর।

তথাকথিত ইসলামী উম্মাহর ধ্বজাধারী পাকিস্তান নামক দেশের অখন্ডতা রক্ষায় মাথায় টুপি আর জানুর নিচে নামানো আলখেল্লায় আবৃত ইসলামের খেদমতগাররা (?) পাকিস্তানী সেনাদের গ্রামে গ্রামে নিয়ে যায়। ... ... এক সকালে এই সেবাদাসরা পাকিস্তানী বাহিনী নিয়ে এল মোহনপুরে। জয়নাল এর কিছুই জানতো না। সব লন্ড-ভন্ড হয়ে গেল। দু'কোঠার ঘরের এক কোঠায় ধর্ষন করা হলো জয়নালের স্ত্রীকে; অপর কোঠায় কিশোরী কন্যাকে।

কিশোরী মেয়ে ভালভাবেই জানতো পাশের ঘরে তার স্নেহময়ী মায়ের অসহায় অবস্থা এবং তার মাও জানতো অপর ঘরে তার আদরের কণ্যার করুণ পরিণতি। কারো কাছে অভিযোগ করলো না মেয়ে,অনুযোগও করলো না কোন। গ্লানি ঢাকলো সে গলায় দড়ি দিয়ে। লজ্জাটুকু রেখে গেল আমাদের জন্যে। ============ হায় নিয়তি।

কালের আবর্তে পাকিস্তানের সেই সেবাদসদের গাড়ীতে ওঠে মন্ত্রীত্বের পতাকা, আর জয়নালের মত চরম মূল্য দেওয়া মানুষদের ছুঁড়ে ফেলা হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। সূত্রঃ জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা (মেজর কামরুল ইসলাম ভুঁইয়া) ছবিঃ কিশোর পারে #এক মা এবং তার সন্তানের অসম সাহসিকতা এবং ত্যাগের অনন্য ইতিহাস# ঢাকা নিউ মার্কেটের উত্তর পাশে ঢাকা কলেজ এবং টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। সামছুন নাহার ইসলাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। দুই ছেলে এবং এক মেয়ে। বড় ছেলে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের(বর্তমানে চুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের এবং ছোট ছেলে ওয়াকার হাসান রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বর্তমানে রুয়েট) প্রথম বর্ষের ছাত্র।

২৫ শে মার্চের বর্তরতার পর সাহসী মা ছোট ছেলে ওয়াকারকে নিয়ে বের হয়েছিলেন রাস্তায়। দেখলেন সায়েন্স ল্যাব,এলিফ্যান্ট রোডসহ প্রতিটি রাস্তায় পড়ে আছে বাঙ্গালীদের মৃতদেহ। বায়ান্নর শহীদ মিনার ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানীরা। ক্ষুব্ধ,বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ওয়াকার। এরপর গিয়ে তারা দেখলেন জগন্নাথ হলের গণহত্যার পর তাড়াহুড়ো করে মাটী চাপা দেওয়া কবর।

বেরিয়ে আছে কারো হাত,কারো পা। মা এবার জিজ্ঞেস করলেন, 'কী দেখলে?' ক্ষুব্ধ ওয়াকার ব্যথিত হৃদয়ে প্রকাশ করে পাকিস্তানীদের প্রতি তার ঘৃণার কথা। এবার মা জিজ্ঞেস করেন,"কী করবে?" ওয়াকার নিচুস্বরে প্রত্যয়ী কণ্ঠে উত্তর দেয়, "এ হত্যা আর নির্যাতনের প্রতিশোধ নেব,দেশ স্বাধীন করবো"। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় মা ঠিক এখানেই আনতে চেয়েছিলেন তার ছেলেকে। বললেন,"আমার দুই ছেলে।

তোমাকে আমি দেশের জন্য ত্যাগ করতে পারি। " ওয়াকার তার নির্দেশ পেল। রিকশা এগিয়ে চলে, কিন্তু মা-আর ছেলের আর কথা হয়না। মা দিগন্ত পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নির্দেশ আসে মায়ের কাছ থেকে, 'যুদ্ধের মাঠে যেন পিঠে গুলি না লাগে।

যুদ্ধ করবে বীরের মত। মরতে হলে মরবেও বীরের মত। ফেরত আসলে তাও আসবে বীরের মত। ' এর ঠিক দু'দিন পর মা নিজহাতে গুছিয়ে দেন ছেলের ব্যাগ। নিঃশব্দে ওয়াকার বাড়ী ত্যাগ করেন যুদ্ধে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে।

শুরু হল ওয়াকারের এক অনির্দিষ্ট গন্তব্য। তবে হ্যাঁ,সেই ওয়াকার কিন্তু মায়ের নির্দেশ পালন করেছিল। সে ফিরে এসেছিল যুদ্ধ করে, বীরের বেশে বীর প্রতীক হয়ে। স্যালুট হে বীর যোদ্ধা ওয়াকার হাসান, হে রত্নগর্ভা জননী সামছুন নাহার। তোমাদের মত অজস্র মায়ের আত্মত্যাগের ফলেই আজ আমরা পেয়েছি মুক্ত স্বাধীন একটি দেশ।

# বাবা রাজাকার হওয়া সত্ত্বেও দেশের টানে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন কন্যা সায়েরা# অপারেশন মুকুন্দপুর ছিল একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত সফল অপারেশনের একটি। সেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৮ রাজপুত ব্যাটালিয়নের সহযোগীতায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা দখল... করে নেয় পাকিস্তানীদের সুরক্ষিত ঘাঁটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার মুকুন্দপুর। সেদিনের মুকুন্দপুর যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা কিছুদিন আগে আয়োজন করেছিলেন এক পুনর্মিলনীর। সেখানে বেরিয়ে আসে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মা সায়রার কথা। অদ্ভুত ব্যাপার হল তার পিতা রাজাকার হওয়া সত্ত্বেও একাত্তরে সায়রা বেগম দেশের টানে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মত দুঃসাহসিক এক কাজে জড়িয়ে পরেন যা হার মানায় যেকোন গল্প,উপন্যাসের কাহিনীকেও।

অথচ এই বীরাঙ্গনা মাকেই আমরা দিতে পারিনি তার যোগ্য সম্মান,দিয়েছি অপবাদের কথা। এই মুক্তিযোদ্ধা মাকে নিয়ে বাংলানিউজ২৪ডট কমে প্রকাশিত হয় একটি প্রতিবেদন যার চুম্বাংশ এখানে প্রকাশ করা হল। ============ জেনারেল সায়ীদের বক্তব্যের পর মঞ্চ থেকে মুকুন্দপুর যুদ্ধে অংশ নেওয়া বেঁচে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধারা নেমে আসছিলেন। তাদের সঙ্গে নামছিলেন সায়রাও। মিডিয়াকর্মীরা দৌড়ে গেলেন তার সঙ্গে কথা বলতে।

নানা প্রশ্নের মাঝে সবার কমন প্রশ্ন ছিল- `একজন রাজাকারের মেয়ে হয়েও কীভাবে আপনি এতটা দুঃসাহসী কাজ করার সাহস পেলেন?` সায়রার উত্তর মেশানো প্রশ্ন, ‘এটা আমার দেশ না? আমি আমার দেশের জন্য কাজ করেছি। ’ ‘আপনার বাবা রাজাকার ছিলেন। তারপরও...’ সায়রা সাফ জানিয়ে দেন, ‘তার কাজ তিনি করেছেন। আমি আমার কাজ করেছি। ’ জানা গেল, সায়রার বাবা রাজাকার আজিজ মারা গেছেন বেশ ক`বছর আগে।

তবে আসল যে কথাটা শুনে আমিসহ অন্যরা চমকে গেলাম, তা হলো যুদ্ধের পর নিজ এলাকায় থাকাটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল তার জন্য। কেন? কারণ, লোকমুখে ছড়ানো বদনাম। সায়রা মুখ ফুটে কিছু না বললেও বোঝা গেল কী কারণে তাকে নিজ এলাকা বিজয়নগর ছেড়ে সিলেট চলে যেতে হয়েছিল। কথায় কথায় সায়রা বললেন, `৩৫ বছর পর এলাকায় ফিরতে পেরেছি। এখনও লোকজন বাজে কথা বলে।

` বছর ছয়েক আগে মুকুন্দপুরে ফিরে এসে বাড়ি করেছেন। তার স্বামীর নাম শহীদুল্লাহ। জানতে চাইলাম, ‘শহীদুল্লাহ সাহেব বেঁচে আছেন?’ সায়রা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলেন, ‘জি। ’ জানা গেল, এখানে এসে তার বিষয়ে ছড়ানো বদনামগুলো জানার পর স্বামীর সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য স্বাভাবিক হয়।

আমি একথা জানার পর এই অসাধারণ মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধাবনত সালাম জানালাম মনে মনে। জানি না, জনাব শহীদুল্লাহ এ লেখা পড়বেন কী না। কিন্তু তিনি আমাদের এই অসম সাহসী বীর বোনটিকে গ্রহণ করেছেন, এজন্য জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এসময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লাল মিয়া বললেন, যুদ্ধের সময় সায়রার পুরো ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ আমাদের পক্ষে। আহ, সায়রা যদি অন্য কোনও দেশে জম্মাতেন আর সেখানকার মুক্তিযুদ্ধে অমন ভূমিকা রাখতেন!লাতিন আমেরকায় হলে তাকে নিয়ে ক্ল্যাসিক সাহিত্য রচিত হত, ইউরোপে হলে হয়ত তাকে নিয়ে সৃষ্টি হত অমর কোনও শিল্পকর্ম আর আমেরিকানরা কমপক্ষে একটি হলিউডি মুভি তো বানাতো।

আর আমরা করছি সবচেয়ে সহজ কাজটি...অপবাদ সংগ্রহঃমুক্তিযুদ্ধের গল্প শোন  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.