মত প্রকাশের স্বাধীনতা কোন সুযোগ নয়, অধিকার। যমুনা সেতু নির্মাণের তৎলীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ শুধু বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি; সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৯৪ সালের ১০ এপ্রিল তারা হরতালও ডেকেছিল।
দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর চুক্তি বাতিল করার পর থেকে বর্তমান সরকারের কয়েকজন নেতা ও প্রতিমন্ত্রী এই চুক্তি বাতিলের পেছনে বিরোধী দল বিএনপির হাত আছে বলে অভিযোগ করেছেন। কয়েকজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবিও এ প্রসঙ্গে যমুনা সেতু বিষয়টিকে সামনে এনেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পদ্মা সেতুর ব্যাপারে সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, যমুনা সেতুর মতো এই সেতু নির্মাণে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।
একজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবি লিখেছেন, যমুনা সেতু নির্মাণের কৃতিত্ব 'জাপা-বিএনপি-আওয়ামী লীগ' এই তিন সরকারকেই দিতে হবে। আরেকজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবি লিখেছেন, বিএনপি এখন দুইটি পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলছে, তারা ১০ বছর ক্ষমতায় ছিল তখন একটা পদ্মা সেতুও নির্মাণ করল না কেন? বিএনপি ক্ষমতায় গেলে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে বিএনপি নেতাদের এমন ঘোষণা প্রসঙ্গে গত কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ধোঁকাবাজির একটা সীমা আছে। প্রধানমন্ত্রী, কয়েকজন প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের কিছু নেতাদের বক্তব্য শুনলে যাদের বয়স ২৫ বছরের কম অথবা যারা ১৯৯৪-৯৬ সালের সেসব ঘটনাবলি ভুলে গেছেন তারা যমুনা সেতুর উপর দিয়ে কোথাও গেলে তাদের মনে হতে পারে যমুনা সেতু সহ সব বড় বড় সেতুগুলো আওয়ামী সরকারের হাত ধরেই হয়েছিল এবং আওয়ামী বুদ্ধিজীবিদের লেখাগুলো পড়লে তাদের মনে হতে পারে যমুনা সেতু নির্মাণে আওয়ামী লীগ তৎকালীন বিএনপি সরকারকে সহায়তা করেছিল অথবা এই সেতুতে আওয়ামী লীগের অনেক অবদান ছিল। কিন্তু প্রকৃত সত্যটা সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টায়ই আজকের এই পোষ্ট।
সূচনা:
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ১৯৫৩ সালে যমুনা নদীর উপর সেতুর কথা প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন।
তিনি বলতেন যমুনা নদীর ওপর সেতু হলে উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের দুরবস্থা ঘুচে যাবে। দু’ আনার পটল ঢাকায় দু’টাকায় খেতে হতো না। ১৯৫৪ সালে তিনি যমুনা সেতুর কথা প্রকাশ্যে জনসভায় বলেছেন। এরপর ১৯৬৪ সালে তত্কালীন পার্লামেন্টে সাইফুর রহমান নামে একজন সদস্য যমুনা সেতুর কথা উচ্চারণ করেন। পরে শেখ মুজিব ও জিয়া এ সেতুর কথা চিন্তা করেন।
কিন্তু যমুনা সেতু বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলঃ
জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের সময় ১৯৮৫ সালের ৩ জুলাই জারিকৃত অধ্যাদেশ বলে যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। এ সেতুর নামে সারচার্জ ও লেভি প্রবর্তন করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা উঠানো হলেও এ টাকা এরশাদ সরকার সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিয়ে তা খরচ করে ফেলেন। (সারচার্জ ও লেভি প্রবর্তনের ফলে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মোট ৫৭০ কোটি টাকার মতো সংগ্রহ হয়েছিল। ) তখন যমুনা সেতু প্রকল্পের ওপর সমীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে আলোচনা হয়।
কিন্তু বিশ্বব্যাংক এতে দ্বিমত পোষণ করে। তাছাড়া ওই সময় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সন্তোষজনক না থাকায় উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো এই ব্যয়বহুল প্রকল্পে অর্থায়নে সম্মত হয়নি।
বিএনপির শাসনামলঃ (১৯৯১-১৯৯৬)
১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে বিএনপি তার নির্বাচনী ইশতেহারে যমুনা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকার করেছিল। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর জনগণকে দেয়া তার নির্বাচনী অঙ্গীকার মোতাবেক যমুনা সেতু নির্মাণের যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। সরকারে আসার তিন মাসের মধ্যেই ১৯ মে ’৯১ জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী পরিষদ (একনেক) বৈঠকে যমুনা সেতু প্রকল্পের ছক (পিপি) অনুমোদন করা হয়।
সেতু প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ত্রি-বার্ষিক আবর্তক বিনিয়োগ কর্মসূচিতে কোর প্রকল্প হিসেবে একে অন্তর্ভুক্ত করে এবং চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এ প্রকল্পের জন্য মোট ২,২৫০ কোটি টাকার সংস্থান রাখে সরকার। তখন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সাথে চুক্তিঃ
যমুনা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ জোগানের জন্য উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোকে রাজি করাতে বিশেষ উদ্যোগ নেয় সরকার। তত্কালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ও যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বিশেষ দূত মোরশেদ খান বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন; বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট মি. লুই প্রেস্টনকে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, যোগাযোগমন্ত্রী অলি আহমদ এবং প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের বৈঠক হয়।
তিনি যমুনা সেতু এলাকাও পরিদর্শন করেন। সরকারের আমন্ত্রণে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপানের একাধিক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। যমুনা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কয়েকবার সমীক্ষা চালানো হয়। এ প্রকল্পে জাপানকে রাজি করাতে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ও বিশেষ দূত মোরশেদ খান ১৩ নভেম্বর, ১৯’৯৩ থেকে ১৯ নভেম্বর, ’১৯৯৩ পর্যন্ত জাপান সফর করেন। তারা জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন এবং প্রকল্পের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করেন।
১৯৯৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও স্বয়ং দ্বিপাক্ষিক সফরে জাপান সফর করেন এবং যমুনা সেতুতে অর্থ জোগান দিতে জাপানকে সম্মত করান। সব প্রচেষ্টার পর বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাপান যমুনা সেতুতে অর্থ জোগান দিতে রাজি হয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি, ’১৯৯৪ তারিখে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে যমুনা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি, ’১৯৯৪ আইডিএ’র সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এডিবির সঙ্গে ১৮ মার্চ ’৯৪ তারিখে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়ার ব্যাপারে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৯ মার্চ , ১৯৯৪ প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জাপান সফরকালে বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের মধ্যে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৮ জুন, ১৯’৯৪ ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার ও জাপানের ওইসিএফএর মধ্যে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
যমুনা সেতুর পূর্বপ্রস্তুতিমূলক কাজ হিসেবে ৪,৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং ১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসেই যমুনা সেতুর পূর্ব তীরে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ কাম রাস্তা নির্মাণ সম্পন্ন হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নঃ
অর্থ জোগান থেকে শুরু করে যমুনা সেতু প্রকল্পের সব আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পর সরকার ২১ মার্চ, ১৯’৯৪ সেতুর জন্য চারটি কন্ট্রাক্ট দরপত্রের সম্মতিপত্র ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করে এবং ২৭ এপ্রিল, ১৯’৯৪ তাদের কার্যাদেশ প্রদান করে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ১০ এপ্রিল, ১৯’৯৪ যমুনা নদীর দুই তীরে যমুনা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আশাবাদ ব্যক্ত করে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইনশাআল্লাহ্ ১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। বিএনপি সরকারের সময়ই সেতুর ৮০ ভাগেরও বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছিল এবং ১৯৯৮ সালের প্রথমার্ধেই সেতুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।
সেতুটির নামকরণঃ
যমুনা সেতুর নামকরণের ব্যাপারে তখন দুটি দাবি ছিল। একটি দাবি হচ্ছে— এ সেতু মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নামে নামকরণ। অন্য দাবিটি ছিল হজরত এনায়েতপুরী (রহ.)-এর নামে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ সংক্রান্ত উভয় দাবির ব্যাপারে আলোচনার পর বলেছিলেন, উনারা দু’জনই সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তাদেরকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখলেই ভালো হয়।
কারণ তাদের একজনের নামে সেতু হলে অপর তীরের মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হবে। তাতে তারা বিতর্কিত হবেন। এর চেয়ে যেহেতু নদীর ওপর সেতু হচ্ছে, নদীর নামে হলেই ভালো হয়। সেদিনই এ সেতুর নামকরণ করা হয় যমুনা সেতু। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন তৎতকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি উদ্বোধন করেই নিজেদের নেতার নামে এ সেতুর নামকরণ করেন।
সেতু নির্মাণে আওয়ামী লীগের বাঁধাঃ
যমুনা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে তত্কালীন সরকারকে অনেক বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হয়। বিএনপি সরকার যাতে এ সেতু নির্মাণে হাত দিতে না পারে সে ব্যাপারে প্রথম থেকেই তত্কালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই নানা বিরোধিতা করে; চালানো হয় নানা ষড়যন্ত্র। স্বার্থান্বেষী একটি মহলকে দিয়ে এ সেতুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছিল- যমুনা সেতুর পরিবর্তে ব্রহ্মপুত্র ব্যারাজ নির্মাণের কৌশলী প্রচার চালানো হয়েছিল। দুটি ইংরেজি পত্রিকার মাধ্যমে যমুনা সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নিবন্ধ ও নিউজ আইটেম প্রচার করা হয়েছিল। এখানেই থেমে থাকেনি তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ।
সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে বাঁধা দেওয়ার জন্য ১৯৯৪ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছিল। তাই ঢাকা থেকে সব রাষ্ট্রদূত, বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি এবং সাংবাদিকদের হেলিকপ্টারে করে যমুনা সেতু এলাকায় নিয়ে যেতে হয়েছিল।
বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর চুক্তি বাতিলের ব্যাপারে বর্তমান সরকারের যেসব নেতা ও প্রতিমন্ত্রী এই চুক্তি বাতিলের পেছনে বিরোধী দল বিএনপির হাত আছে বলে অভিযোগ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলতে হয়- ‘রতনে রতন চিনে; শূয়রে চিনে ঘেচু’।
উল্লেখ্য, যমুনা সেতু নির্মাণের আগে দেশের সবচেয়ে বড় "মেঘনা-গোমতী সেতু"ও বিএনপির ঐ শাসনামলেই নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ১৯৯৪ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া উদ্বোধন করেন।
পদটীকাঃ যে সেতুটি নির্মাণ কাজেও শুরু থেকেই বিএনপি সরকারকে বাধা বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি করল; এতে কোনভাবেই সফল না হয়ে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে বাধা দেওয়ার জন্য ১৯৯৪ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ হরতালও ডাকল; নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর সেই সেতুটিকেই নিজেদের নেতার স্বপ্ন বলে প্রচার চালিয়ে তার নামে নামকরণ করল!! এর চেয়ে নির্লজ্জতা আর কাকে বলে????? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।