আমি একজন অলস মানুষ। কথা বেশি বলি। কাজ করি কম। তবে নিজের পায়ে হাটি। অভ্যাসটা বেশি দিনের না।
বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়া অবস্থায়। ৩য় বর্ষে পড়ি তখন। এর আগে ছিলাম পার্ট- টাইমার। বন্ধুদের টানতে দেখলে মাঝে মধ্যে দুই এক টান দিতাম। আর মাঝে মধ্যে কোন অনুষ্ঠান এ অথবা কারো জন্মদিন পালন করতে গেলে দুই একটা খাওয়া হত।
যাই হোক এর কিছু দিন পর আর একটু উন্নতি হল। আমার রুমমেট হিসেবে পেলাম এক বন্ধুকে । ও আবার নিয়মিত সিগেরেট খেত। তো মাঝে মধ্যে মাঝ রাতের দিকে ওর সাথে শেয়ার করতাম। যদিও ও কখনও খেতে বলত না, কিন্তু আমি ভাবতাম আরে আমার নিজের উপর কন্ট্রোল অনেক বেশি।
তাই মাঝে মধ্যে দুই এক টান দিলে, একটু উপভোগ করলে খারাপ কি? কিছুই হবেনা।
এর কিছু দিন পর আরেকটু উন্নতি হয়েছে। কোন উপলক্ষ পেলেই হত। যেমন ধরেন ক্লাস টেস্ট একটু খারাপ হল, বাসায় কোনও বিষয়ে একটু ঝামেলা হল, কোনও বন্ধুর সাথে কোনও বিষয় এ ঝামেলা হলে অর্থাৎ যেকোনো নেগেটিভ ঘটনার সাময়িক সমাধান ছিল সিগেরেট। আবার সন্ধ্যায় নাস্তা করতে গেলে দুই জনে/তিন জনে একটা সিগেরেট শেয়ার করে খেতাম (রতন এ রতন চিনে, আর আমি পার্ট-টাইমার দের চিনতাম !!!) ।
রাত জেগে কার্ড খেলতে বসলে ও খাওয়া হত নিয়মিত। আবার রাত জেগে পড়াশুনা করলে অথবা প্রোগ্রামিং করলে একটা সিগেরেট খেলে ভালো লাগত (অনেকে বলত, সিগেরেট না খেলে নাকি ভালো প্রোগ্রামার হওয়া যায় না। তো মাঝে মধ্যে কোনও কোড না মিললে, দোকান থেকে একটা সিগেরেট এনে, এক হাতে সিগেরেট টানতাম আর কোড করতাম)। তখন আস্তে-আস্তে নিয়মিত যারা খায় তাদের সাথে চলাফেরা বাড়তে লাগলো। মাঝে মধ্যে তাদের হাত থেকে নিয়েও খেতাম।
অনেকে আবার লজ্জা দিত। আবার কেউ কেউ উৎসাহ দিত (যাক আমি নাকি পুরুষ হচ্ছি)। এভাবেও চলল কিছু দিন।
এভাবে কিছুদিন কাটার পর জব এ জয়েন করলাম। সারা দিন অফিস করে বাসায় ফেরার পথে, আর অফিস এ ঢোকার আগে একটা সিগেরেট না খেলে কি হয়? তাও আবার সারা দিন প্রোগ্রামিং করা ।
একটু তো রিলাক্স এর দরকার নিজের আয় করা টাকা বলে কথা (এর মধ্যে একটু বলে নেই, আমি কিন্তু পাশ করে বের হওয়ার আগেই নিজের পায়ে হাঁটতে শিখেছি!!!)। এবার শুরু হল রিলাক্স এর জন্যে সিগেরেট খাওয়া। কিছু দিন পর আরেকটু উন্নতি হল। দুই তিন ঘণ্টা টানা কাজ করে একটা সিগেরেট না-খেলে তো আর এনার্জি-ই আসতো না। আবার অফিসের কাজে ক্লায়েন্ট এন্ড এ গেলে সেখানেও সিগেরেট দিয়ে আপ্যায়ন করাত।
এভাবেও চলতে থাকল কিছুদিন। আগে বাড়ি গেলে সিগেরেট খাওয়া হত না। এখন দেখি সারাদিন তেমন খাওয়া হয় না। কিন্তু সন্ধার পর থেকে টানা ৫/৬ টা খেয়ে পরে বাড়ি ফিরতে হয়। আর সারা দিন ২/৩ টা দিয়ে কাটানো যায়।
অফিস এ আমরা যারা পার্ট-টাইমার /ফুল-টাইমার সিগেরট খাই সবার একটা কোরাম ছিল। মেসেঞ্জার এ সবাইকে নক করে একসাথে সিগেরেট খেতে যেতাম। দিনের মধ্যে ৫/৬ বার মিট করতাম। এভাবে চলতে চলতে রুটিন যা দাঁড়াল তা হল- সকালে অফিসে ঢোকার আগে ১ টা, আবার ১০ টার মধ্যে মাথা গরম (!) হয়ে গেলে ১ টা, দুপুরের আগে ১২ টার দিকে কিছু খেতে গেলে ১ টা, দুপুরের খাবারের পর ১ টা না খেলে তো মনে হয় মহাভারত অশুধ্ব হয়ে যেত, ৪ টা-৫ টার দিকে ১ টা, অফিস থেকে নিচে নেমে-ই ১ টা (না হয় মাথা ধরে থাকত!!! [কে যে ধরত আল্লাহই ভালো জানে]), বাসার কাছে গিয়ে ১ টা, আর রুম এ ঢোকার আগে ২/৩ টা নিয়ে যাওয়া (না হলে তো আবার রাতের খাবের এর পর কিছু যেন না খাওয়ার অনুভুতি !!!)। এভাবেই চলতেছিল আমার সিগেরেট অধ্যায়।
আগে যেটা হত- উপলক্ষে খেতাম, আর এখন খাওয়ার জন্যে উপলক্ষ খুজি!!!
মজার ব্যাপার হল, আপনাদের সবার দোয়ায় কিছু দিন আগে আমার জ্বর হয়েছিল। সে জ্বর এর উচিলায় আমি সিগেরেট ছেড়ে দিয়েছি (গত ৯ই মে থেকে, দোয়া করবেন সবাই)। আরেকটা মজার বিষয় হল এখন ১০/১২ ঘণ্টা টানা কাজ করলেও আমার মাথা গরম হয়না। কাউকে মেসেঞ্জার এ ডাকতে ও মন চায় না। দুপুরের খাবারের পরও আলাদা কিছু মনে হয় না।
আবার সন্ধার পর অফিস থেকে বের হলেও কেউ ধরে রাখেনা !!!
আমি টানা অনেক দিন সিগেরেট খেয়ে ছেড়ে দেয়ার পর আমার যে অভিজ্ঞতা হল–
১) এটা পুরটাই মানসিক ব্যাপার। আপনি মানসিক ভাবে ঠিক হলে সব ঠিক।
২) পরিবেশ, বন্ধু , রুমমেট, কলিগ এদের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই আপনাকেই ঠিক করতে হবে কাদের সাথে মিশবেন। যদি এর কোনটা আপনার হাতে না থাকে তাহলে ১ নং এর উপর অনেক বেশি জোর দিতে হবে।
৩) কেউ পার্ট-টাইম (মাঝে মধ্যে) সিগেরেট খায় এটা বলতে কিছু নেই। হয় খায় না-হলে খায় না। এতে আপনি খুব সহজে নিজের অবস্থান বুজতে পারবেন। আর আপনি খেতেও চাইবেন-না অথবা কেউ কেউ আপনাকে খেতে বলবেন ও না।
৪) অনেকে বলে অমুক দিন থেকে ছেড়ে দিব, তমুক দিন থেকে ছেড়ে দিব- এগুলা সব ভুল।
ছাড়ার ইচ্ছা থাকলে এখন কেন পারবনা?
৫) আমি উপরে কয়েক জায়গায় লিখেছি, সিগেরেট না-খেলে আমার মাথা গরম হয়ে যেত, এটা সেটা হত, এগুলো সবই ছিল ভুল। আমার মন তখন একটা সিগেরেট খেতে বলছিল। আসলে ধূমপান আমাদের ব্রেইন সেল গুলকে উজ্জবিত করে। আমরা যখন একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধূমপান না করি, তখন এই ব্রেইন সেল গুলো নিস্তেজ হয়ে যায়। তখন আমাদের কাছে মনে হয় মাথায় কাজ করছেনা।
আবার আমি যেটা বললাম ঐ যে, নিজেই উপলক্ষ বানিয়ে নিতাম। আসলে আমরা সবাই তাই করি। আপনি একবার লজিক্যালি ভাবুন, আগে যখন সিগেরেট খেতেন-না তখন মাথা গরম হয়নাই কেন? আবার যারা মোটেই খায়না তাদের মাথা গরম হয়না কেন?হলেও এর সমাধান সিগেরেট কেন হবে?
৬) আমার জ্বর হয়েছে, আর আমি ছেড়ে দিলাম সিগেরেট। কেন? কারণ আগে একবার ব্যর্থ হয়েছি। এবার সুযোগটা নিয়েছি যাতে পরিবেশটা ঠিক থাকে।
কলিগদের সাথে নিচে যাওয়ার সময় হলে বলতাম যে ভাই আমার প্রচুর কাশি (আসলেও কাশি ছিল)। তারাই বলত না থাক যাওয়া লাগবেনা। আবার মাঝে মধ্যে যেতাম সংগ দিতে,কিন্তু খেতাম না। এখানে মনবলের বিষয়টা একবারে স্পষ্ট।
৭) ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব।
আমি যদি নির্ধারণ করতে না পারি আমি কি খাবো, আর কি খাবনা, কি করব আর কি করব না – তাহলে বুজতে হবে আমার নিজের উপর আসলে কন্ট্রোল নাই। তাই নিজেকে কন্ট্রোল করাটাই হল আসল।
৩১ই মে, বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস। এদিন নিজে তামাক মুক্ত তা ভেবে খুব গর্ব হচ্ছে, যদিও এটা গর্ব করার মত কিছুইনা। আমরা যারা ধূমপান ছেড়ে দিতে চাচ্ছি , বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারনে পারছিনা, আসুন না একটু চেষ্টা করে দেখি।
আমি আশা করি প্রচুর ইচ্ছা শক্তি আমাদের ধূমপান মুক্ত হতে সাহায্য করবে। ইনশাল্লাহ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।