আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূনের দাফনের অন্তরালের ঘটনা

বেঁচে থেকেও আমি মৃত; কিছু না লিখতে জেনেও কবি............ একটি শিশুর মাতৃত্বের দাবি নিয়ে দুই নারী বিচারালয়ে গেছেন। দু’জনই নিজেকে শিশুটির মা হিসেবে দাবি করছেন। আসল মাকে চিহ্নিত করতে হাকিম হুকুম দিলেন, শিশুটিকে কেটে দুই ভাগ করে তাদেরকে দিয়ে দেওয়া হোক। সঙ্গে সঙ্গে পিছু হটলেন এক নারী। বললেন, শিশুটিকে কাটার দরকার নেই।

আমি তার মা নই। বিচক্ষণ হাকিম বুঝতে পারলেন, এই নারীই শিশুটির আসল মা। কারণ সত্যিকারের মা যে কোনো মূল্যে তার সন্তানকে বাঁচাতে চায়। অধিকার তার কাছে বড় নয়। হাকিম শিশুটিকে তার আসল মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলেন।

অনেক অনেক দিন আগের গল্প এটি। গল্পের মতো এতো সুন্দর সমাধান বাস্তবে হয় না। তবে গল্পটির মর্মবাণী শ্বাশত, যা মানুষকে আলোকিত করে। এবার সত্যিকারের গল্প ২৩ জুলাই, সোমবার গোটা বাংলাদেশের মানুষ যখন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন, তাঁকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে যখন ঢল নেমেছে, তখন তাঁর দাফন নিয়ে পর্দার অন্তরালে চলছে ঘৃণ্য নাটক। সকালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে হুমায়ূনের লাশের সঙ্গে ফেরা দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন সাংবাদিকদের জানান, নুহাশপল্লীতে দাফনই ছিল হুমায়ূনের শেষ ইচ্ছা।

তবে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পক্ষের তিন সন্তান নোভা, শিলা ও নুহাশ, হুমায়ূনের মা আয়েশা ফয়েজসহ পরিবারের সদস্যরা চাচ্ছিলেন ঢাকায় দাফন করতে। তারা সম্ভাব্য স্থান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় কবির সমাধি চত্বর, মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও বনানী কবরস্থানের কথা বলেছিলেন। রাজধানীতে দাফন হলে মানুষ সহজে কবর জিয়ারত করতে পারবে। কিন্তু নুহাশপল্লীর ব্যাপারে গোঁ ধরে থাকেন শাওন। বেলা যত বাড়তে থাকে এই দ্বন্দ্ব স্পষ্ট ও প্রকট হতে থাকে।

দুপুর আড়াইটার দিকে ঈদগাহ ময়দানে হুমায়ূন আহমেদের জানাজা শেষে তার লাশ বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়। লেখকের ছোট ভাই জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের জানান, সন্ধ্যায় পারিবারিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পারিবারিকভাবে বিষয়টির সমাধান চেয়েছিলেন দেশবাসীও। কিন্তু তা হয়নি। পর্দার অন্তরালে শাওনের তরফে শুরু হয় রাজনৈতিক যোগাযোগ।

জানা যায়, শাওনের বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফকে টেলিফোন করেন। তিনি বলেন, নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদকে দাফনের ব্যাপারে আপনারা সহযোগিতা করুন। হুমায়ূনের প্রথম পক্ষের সন্তানরা, তাঁর মা, ভাই, বোনসহ পুরো পরিবার চাচ্ছে ঢাকায় দাফন করতে। কিন্তু শাওন নুহাশপল্লীতে দাফন করতে চায়। আপনারা সহযোগিতা করুন।

মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, আমি যতটুকু জানি, পারিবারিকভাবে হুমায়ূন আহমেদকে দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সেখানে আপনারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন। এ ব্যাপারে আমাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না। এক পর্যায়ে মরীয়া মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা দুজন ব্যারিস্টারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। তারা বলেছেন, আদালতের সিদ্ধান্ত শাওনের পক্ষেই যাবে।

আপনারা সহযোগিতা করুন। এ সময় মাহবুব হানিফ বলেন, এর মধ্যে আইন-আদালত টানছেন কেন। বিষয়টি পারিবারিকভাবেই সমাধান করুন। এরপর বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফোনটি কেটে দেন। শাওনের মা আওয়ামীলীগের এমপি তহুরা আলীও বসে ছিলেন না।

বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিবের কাছে ফোন করে শাওনের ইচ্ছানুযায়ী নুহাশপল্লীতে হুমায়ুনকে দাফনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বলতে বলেন। সন্ধ্যায় গণভবনে কূটনীতিক, সরকারি কমকর্তা ও বিচারপতিদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার পার্টিতে প্রধানমন্ত্রী সবার সঙ্গে সাক্ষাতের এক পর্যায়ে এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর নানককে বলেন, হুমায়ূন আহমেদের জানাজা হয়ে গেছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব দাফন করা প্রয়োজন। তিনি এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রীকে দুই পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত দাফনের তাগিদ দেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে হুমায়ূনের প্রথম পক্ষের তিন সন্তান নোভা, শিলা আর নুহাশ মিরপুরে চাচা আহসান হাবীবের বাসায় সাংবাদিকদের জানান, তারা বাবার কবর নুহাশপল্লীতে চান না।

তারা এমন কোনো জায়গায় বাবাকে দাফনের কথা বলেন, যেখানে সবাই সহজে যেতে পারে। এরপর থেকেই শুরু দফায় দফায় বৈঠক। হুমায়ূন আহমেদের ভাই জাফর ইকবাল, তাঁর স্ত্রী ইয়াসমীন হক, নোভা, শিলা, নুহাশ, ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ ও নাসিরুদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু সংসদ ভবনে এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রীর বাসায় যান। সেখানে হুমায়ূন পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় দাফনের সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করেন। রাত পৌনে এগারটায় সেখান থেকে জাফর ইকবাল, ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ ও নাসিরুদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানককে নিয়ে ধানমন্ডির ‘দখিনা হাওয়া’য় হুমায়ূনের দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের কাছে যান।

দুই ঘন্টার বেশি সময় ধরে আলোচনার পর কোনো সমাধানে না আসতে পেরে তারা আবার এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রীর বাসায় ফিরে আসেন। তারা পরিবারের সদস্যদের জানান, শাওন তার সিদ্ধান্তে অটল। তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে আদালতে যাবেন। রায় না হওয়া পর্যন্ত মরদেহ হিমঘরেই থাকবে। এ কথা শোনার পর নোভা, শীলা ও নুহাশ চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

তারা ঢাকায় দাফনের কথাই বলতে থাকেন। এসময় জাফর ইকবাল, ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ, নাসিরুদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক তাদের বোঝান। তারা বলেন, লাশটা দাফন হওয়া প্রয়োজন। অবশেষে হুমায়ূনের প্রথম পক্ষের সন্তানেরা তাদের আবেগ চেপে ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, বাবা হিমঘরে পড়ে থাকবেন, এটা হয় না। তারা নুহাশপল্লীতেই বাবার দাফনে সম্মত হন (এসব তথ্য নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিরা নিশ্চিত করেছেন)।

অবশেষে ২৪ জুলাই দুপুর দেড়টার দিকে অঝোর ধারায় বৃষ্টির সময় নুহাশপল্লীতে দাফন করা হয় বৃষ্টিপাগল হুমায়ূন আহমেদকে। ১৯ জুলাই নিউইয়র্কে মৃত্যুবরণ করার পাঁচ দিন পর মাটির ঘরে শেষ আশ্রয় হলো তাঁর। এর আগে শাওন অশ্রুসিক্ত নয়নে সবাইকে বলেনহুমায়ূন বলে গেছেন, তাঁকে নুহাশ পল্লীতেই দাফন করার কথা(টিভি চ্যানেলগুলো এই ফুটেজ বারবার প্রচার করেছে)। আর এদিকে এখন জানা যাচ্ছে, নিউইয়র্কে শাওন হুমায়ূনের দাফন প্রসঙ্গে ভিন্ন কথা বলে এসেছেন। শাওনের সেই বক্তব্য অনুযায়ী হুমায়ূন তার দাফন বিষয়ে কিছুই বলে যাননি।

এনিয়ে আমেরিকায় বাঙালি কমিউনিটিতে এখন তোলপাড় চলছে। শাওনের দুই ধরনের বক্তব্যে বিস্মিত সবাই। হুমায়ূন আহমেদের সত্যিকারের আপনজনেরা তাকে ঢাকায় দাফন করার ন্যায্য দাবি থেকে সরে দাঁড়ালেন। তারা প্রমাণ করলেন, হিমঘরে লাশ রেখে দাফনের স্থান ঠিক করার জন্য আইন-আদালতে যাওয়াকে ভালবাসা বলে না। গল্পের মা যেমন নিজের সন্তানকে বাঁচাতে তার মাতৃত্বের অধিকার ছেড়ে দিয়েছিলেন, হুমায়ূনের মা, তিন সন্তান ও ভাইবোনেরা ঢাকায় তার দাফনের দাবি ছেড়ে সত্যিকারের আপনজনের পরিচয় দিলেন।

জেদ আর কূটকৌশল করে শাওন জিতে গেলেন। তবে প্রকৃত বিচারে কে জিতল- বিশ্বজুড়ে হুমায়ূনের কোটি কোটি ভক্তরা একদিন তা অনুধাবন করবেন নিশ্চয়ই। আবু তাহের খোকন: প্রধান ফটো সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রতিদিন ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।