প্রতিদিন ঘুমোতে যাবার আগে আমি আমার মার সাথে কথা বলি। এটা আমার প্রবাস জীবনের এক অলিখিত নিয়ম। আমি যত ব্যাস্তই থাকি না কেন মার জন্য এই সময়টা আমার বরাদ্ধ থাকবেই। আমার মাও তার পুত্রের মতই। আমার সাথে কথা না বললে তার দিন কাটে না।
দিন কাটেতো তার রাত কাটে না। আমি জানি আমার মত আর সব প্রবাসীদের জীবনেও মাকে নিয়ে আছে প্রায় একই রকম গল্প। বরাবরের মত সেদিন মাকে তার সেল ফোনে কল করলাম। রিং টোন বেজেই চলছে কিন্তু ওপাশ থেকে আমার সেই প্রিয় ”হ্যালো বাবা” ডাক শুনতে পাই না। বুকে ভেতর ধরাক করে কিসের যেন আতংকের বাজনা বাজে! তাহলে কি মা-টাও সেই বাবার মতই আমাকে ফাঁকি দিল? হায়রে প্রবাস জীবন!! আর কত আমার কাছ থেকে তুই নিবি? আমি আর কত দিব? জীবনের সব স্বাদ-আহলাদ জলাঞ্জলি দিয়েছি, দেশের মানুষ, মাটি ত্যাগ করেছি, আত্বিয়-স্বজন, প্রিয় মানুষ সবাইকে সেই কোন সে দূরে রেখে এসেছি।
প্রবাস জীবনে বাবাকে হারিয়েছি। এখন হারাধনের এনমাত্র সম্বল এই মাকেও হারাবো? হাবিজাবি অনেক ভয়ানক খারাপ কিছু ভেবেটেবে ভয়ে ভয়ে ছোট ভাইকে কল করলাম। না, মা আছেন। তবে হাসপাতালে। অনেক অসুস্থ।
শারিরিক ভাবে খুবই দর্বল। বার বার নাকি আমার কথাই বলছিলেন। হায়রে আমার মা। মা জননী আমার।
মা আমার অবাল্য বন্ধু।
এক অসাধারন বন্ধু বলতে যা বোঝায় তিনি ঠিক তাই। একটা ঘটনা এখনো মনে আছে। তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমার মা যাবেন আমার নানা বাড়ি বেড়াতে। তিনি যাবেন একা একা।
আমরা ভাইবোন আর বাবা যাব সপ্তাহ দুয়েক পরে। আমি আর আামার বাবা আমরা দুজন মাকে নিয়ে যাচ্ছি কমলাপুর রেল স্টেশনে তাকে ট্রেনে তুলে দিতে। মা বসলেন জানালার ধারে একটা সিটে। চোখ মুছে যখন মাকে বিদায় জানাতে যাবো তখন মাতো আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবা কোন রকম আমাকে মায়ের আঁচল থেকে মুক্ত করলেন।
বাবার সেই আশার বাণী, ” কিছুদিন পরতো আমরা সবাই কত মজা করতে করতে যাব”। আমরা ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। মা একা একা চললেন আমাদের মামা বাড়ির পথে। এদিকে ট্রেনটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। আমার বুকের ভেতরটা কে যেন হাতুরী দিয়ে দুমরে-মুচরে ভেঙ্গে দিয়ে গেল।
আমার কেন যানি মনে হল আমার মা আমার কাছ থেকে অনেক দুরে চলে যাচ্ছেন। আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে সেই যে আমি চিৎকার দিয়েছিলাম তখন আমার সেই চিৎকারে কমলাপুর স্টেশনে লোক জড়ো হওয়ার উপক্রম। ধীরে ধীরে নিষ্ঠুর ট্রেনটা আমার চোখের সামনেই আমার মাকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু আমার ঝাপসা চোখে আমার মায়ের মুখটা গেঁথে রইল। বাড়িতে আসার পর আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম।
গায়ে প্রচন্ড জ্বর। দুুদিন পরই দেখি একটা অফ হোয়াইট শাড়ি আমার নাকের খুব কাছে এসে আমার কপালে হাত রাখেেছ। আর সেই শাড়ি জুরে আমার মায়ের ঘ্রাণ। আমার কপালে হাত রেখে শুধু বললেন, ” এত বোকা কেন তুই? আমি কি মরে গেছি?”। আমি তখন এক লাফে মাকে জড়িয়ে আরেক প্রস্থ কান্না।
সেই কান্নার দাগ আমার মনে এখনো লেগে আছে। আমরা সব প্রবাসীরাই সেই কান্নার দাগ নিয়ে সামনের দিকে হাটি। কারন আমাদের হাটতে হবেই। থেমে থাকাতো আমাদের কাজ না। বুকে পাথর বেঁধে আমরা ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে যাই।
আমাদের শোক, দুঃখগুলো কে অজানা শহরের চিক চিক বাতির আলো দিয়ে ঢাকতে চেষ্টা করি। কিন্তু সত্যি কি পারি? প্রবাসীর হৃদয়ের এই গহীন কূপে জমে থাকা এই কান্নার দাগ মনের অজান্তেই আমাদের সবারই জন্ম দাগের মতই চির সাথী হয়ে যায়।
শুনতে পেলাম আমার মাকে আইসিইউ তে নেওয়া হবে। মা, তুমি কি খুব কষ্ট পাচ্ছ? তোমার কষ্ট আমাকে দাও। তোমার এই দুর প্রবাসী ছেলেটা তোমার কষ্ট নিয়ে সারা জীবন বাঁচতে চায়।
তুমি খুব তাড়াতাড়ি সেড়ে উঠো। বাবার মত আমাকে ফাঁিক দিয়ে কিন্তু চলে যাবে না। তুমিতো জান, কত মহত গুরু দায়িত্ব নিয়ে আমি এই তোমার ছেলে কত্ত দুর এই দেশে এসেছি। আমাকে আর কটা দিন সময় দাও, প্লিস। আর আমাকে ক্ষমা কর।
আমি তোকে অনেক ভালোবাসিরে মা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।