মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে... এক.
আমার বাবা শক্ত সামর্থ্য নীরোগ ধরনের মানুষ।
তেমন কোন রোগবালাই তার হয়েছে বলে মনে পড়েনা। ধবধবে ফরসা মেদহীন শরীরে চওড়া বুকের ছাতি। বাবা প্রীতি বেশী বলেই কিনা জানিনা হলিউড অভিনেতা রাসেল ক্রো-কে দেখে প্রায়ই আমার বাবার কথা মনে হয়! আমরা ভাই বোনরা মিলে অনেক সময়ই মা’কে খেপাই যে তার ‘সাত জনমের ভাগ্য’ আমার বাবাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছেন। কথা সত্য না।
বরং উল্টোটাই সত্যি হবার কথা। মাকে পেয়ে বাবা বর্তে গেছেন। তার শূন্য জীবন কানায় কানায় না হোক গলা অবধি পূর্ণ হয়েছে। যদিও তিনি কখনোই তা স্বীকার করেন না। নানা কারণে আমার মায়ের আক্ষেপেরও শেষ নেই।
কিন্তু তিনি তা বুকে চেপে রাখতে জানেন। সেই আক্ষেপগুলো সযতেœ বাইরের আলো থেকে দূরে রাখতে জানেন। তিনি জানেন, তাকে অনেক কিছুই বুকে চেপে রাখতে হয়। ২০০৬ সালে বাবা স্ট্রোক করলেন। পুরোপুরি অবশ হয়ে গেল শরীরের বা পাশটা।
স¤পন্ন ঘর থেকে মা এসেছিলেন আমার বাবার চালচুলোহীন সংসারে। তাই শখের কানের দুল, সোনার গয়না কিংবা একখানা ভালো শাড়ীর আক্ষেপ দিনের পর দিন কাঁটা হয়ে ছিল বুকের ভিতর। সেই মা আজ হঠাৎ টের পেলেন তার বুকের ভেতর আর কোন আক্ষেপ নেই, আছে অসুস্থ স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা, গভীর মমতা আর প্রার্থনা।
বাবার সুস্থতা ছাড়া তার আর কিছু চাওয়ার নেই, কিচ্ছুনা!
২.
২০০৬ সালের ঈদ। আমাদের ঘর জুড়ে শ্মশানের অন্ধকার।
ঘরের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি বাবা অসুস্থ। এই প্রথম ঈদ, আমাদের কারো নতুন জামা হবেনা! আমার সাত বছরের ছোট বোন যেন এই কদিনেই জীবন অভিজ্ঞতার বয়সে অনেক বড় হয়ে গেছে। সে ঈদ নিয়ে কোন কথা বলেনা। তার গত বছরের ঈদের জামাটা সে মা’র কাছে নিয়ে বলে, ‘দেখছো মা, জামাটা এখনো কত্ত সুন্দর! এইবার ঈদেও দিব্যি চলে যাবে!!’
মা আমার বোনকে বুকের সাথে চেপে রাখেন। নিজের ঠোট কামড়ে চেপে রাখেন আকণ্ঠ ঊথলে ওঠা কান্না।
যেমন করে চেপে রেখেছিলেন জীবনের সকল না পাওয়ার আক্ষেপ। সারাদিন মুখ হাসি হাসি করে রাখেন। মধ্যরাতে যখন সবাই গভীর ঘুমে তখন সেই হাসিমুখী মা অন্ধকারে জায়নামাজ পেতে বসেন।
তার বুকের ভেতর চেপে থাকা কান্নারা মুক্তি পায় প্রার্থনায়।
৩.
জীবনের প্রথম চাকুরীর টাকায় মা’র জন্য শাড়ী কিনলাম।
সবুজ জমিনে লাল পাড় জামদানী শাড়ী। সেই শাড়ী মা পড়লেন না। সারাটা সময় দু’হাতে বুকে চেপে ধরে রাখলেন। ক্ষণে ক্ষণে তার চোখের জলে ভিজে শাড়ির লাল পাড় আরো লাল হয়ে উঠলো, সবুজ হয়ে উঠলো গাঢ় সবুজ। যেন একটুকরো বাংলাদেশ! দিনশেষে মা তার জং ধরা পুরনো ট্রাংক খুললেন।
ন্যাপথেলিনের গন্ধ ভরা সেই ট্রাংক থেকে মা একখানা যত্নে ভাজ করে রাখা শাড়ি বের করলেন। জামদানী! প্রায় ত্রিশ বছর আগে নানা মাকে জীবনে প্রথম শাড়ী কিনে দিয়েছিলেন। সেই শাড়ির নিচ থেকে আরো একখানা শাড়ী বেরুলো। সেটিও জামদানী! পঁচিশ বছর আগে বিয়ের সময় বাবা মাকে দিয়েছিলেন। মা তিনখানা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছেন।
বাবা, স্বামী, সন্তানের তিন উপহার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভালোবাসায় মোড়ানো উপহার। তিনখানা জামদানী! তিন সময়ের, তিন জীবনের। কিন্তু উপহার একই। সেই জামদানী।
আমার মায়ের জীবনের আরাধ্যতম তিন মুহূর্তের স্মারক।
আর জামদানী শাড়ির জন্য?
৪.
জাতী হিসেবে আমরা আবেগপ্রবণ।
আবেগকে খাটো করে দেখবার সুযোগ নেই। এই অস্থির সময়তো নয়ই। বরং অন্য যেসকল পরিচয়সমূহ জাতী হিসেবে আমাদের পরিচিতি ক্রমশই সঙ্কীর্ণ করে তুলছে, কোণঠাসা করে তুলছে তার চেয়ে এই আবেগপ্রবণ পরিচয় বরং ঢের ভালো।
আবেগ হেলা ফেলা করবার মতো কোন বিষয় নয়। আবেগ শক্তিশালী পরিপুষ্ট বীজের মতো। এই ক্ষুদ্র বীজ থেকে বিশাল মহীরুহের জন্ম হয়। ইতিহাস যার জ্বলন্ত সাক্ষী। আবেগের এই ক্ষুদ্র বীজ থেকেই বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তরের মত মহিরুহের জন্ম।
জন্ম বাংলাদেশের। নতুন করে জন্ম বাংলাভাষার। প্রতিটি জাতীরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, ঐতিহ্য থাকে, যা বিশ্বব্যাপী তার পরিচয়কে মহিমান্বিত করে। আমাদেরও আছে। এর প্রত্যেকটিতে আমরা মিশে আছি আকণ্ঠ।
কিন্তু আমাদের এই আবেগ আর ঐতিহ্যের পরিচয়ে যে সর্বনাশা আঘাত হয়ে গেল তা যেন আমার মায়ের মতো অজস্র মানুষের অগোচোরেই থেকে গেল। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এমন গভীর আবেগে জড়িয়ে থাকা জামদানীর মালিকনা আজ হাত ছাড়া হয়ে যেতে বসেছে। প্রাচীন ঢাকার তাঁতিদের নিপূণ বুননের সু² বস্ত্র ঢাকাই মসলিনের উত্তর সংস্করণই হল ঢাকাই জামদানি। যা একান্তই আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য। প্রাচীন বাংলার প্রায় ২০০০ বছরের বস্ত্রশীল্পের ফসল হলো এই জামদানী।
বাংলাদেশের ঢাকা জেলা এবং এর আশেপাশেই জামদানি চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক এক আইনের কারণে আমাদের জামদানী, নকশিকাঁথা, ফজলি আম বিশ্ব বাজারে পরিচিত হতে যাচ্ছে ভারতীয় পণ্য হিসেবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এক চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৯ সালে ভারত অনৈতিকভাবে বাংলাদেশের এই পণ্যসমূহের পেটেন্ট নিজেদের নামে করে নিয়েছে। যার ফলে এই পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী পরিচিত হবে ভারতীয় পণ্য হিসেবে। এমনকি এর বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং রপ্তানী করতে হলে ভারতকে বাংলাদেশের দিতে হবে রয়্যালটি।
আমদের হাতে এখনো সময় আছে ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে হবে।
‘আমার মায়ের সোনার নোলক’ কোথাও হারিয়ে যেতে দেয়া যাবেনা।
৫.
জামদানী আমাদের। নকশীকাঁথা আমাদের। এগুলো কেবল শাড়ী কিংবা কাঁথাই নয়।
এগুলো জীবনের গল্প। জীবনের বুনন। এর পরতে পরতে জীবনের কথা, এই মাটির কথা, এই মানুষের কথা। যে মাটির মানুষ তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্তে, তার কথা বুকে ধারণ করে আছে, এমন কিছুর স্পর্শ চায় সেই মানুষের কাছ থেকে এই জামদানী কেউ কেড়ে নিতে পারেনা, পারবেনা।
আমার মায়ের ভালোবাসা আর মমতার্দ্র চোখের জলে যে লাল পাড় জামদানীর লালরঙ আরো গাঢ় হয়, যে সবুজ আরো সবুজ হয়, হয়ে ওঠে একটুকরো বাংলাদেশ।
সেই বাংলাদেশ কেড়ে নেয় সাধ্য কার!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।