সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ মৃত্যুপূরী থেকে ফিরেঃ(চেনাবকোট)-৬
জাবিরদের বাড়িতে নাসের কল বেল পুশ করার বেশ কিছুক্ষণ পর জানালা খুলে এক কিশোর পরিচয় জানতে চায়। নাসের কিশোরের হাতে আমার একটা নেম কার্ড দিয়ে বলে-"বাংগাল মুলুকসে কবির সাহাব আয়া-জাবির সাবছে কর্জকা রুপীয়া আদায়ে মাংতা….."!
কিশোরটি ঘরের মধ্যে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর সেই কিশোর দড়জা খুলে বসতে বলে। তখন মাগরিবের আযান চলছিল। আমি নামাজ আদায় করব বললে- আমাকে যায়নামাজ এনেদেয়।
নামাজ শেষে ড্রইং রুমে ঝোলানো সেনা কর্ম কর্তার ছবির সাথে জাবির পরিবারের একাধিক বাঁধানো ছবি দেখি। একটা ছবিতে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন সেনা অফিসারকে সনদ দিচ্ছেন, অন্য একটা ছবিতে অনেকজন দেশী বিদেশী সেনাকর্মকর্তাদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিছুক্ষণপর ৪৩/৪৪ বছর বয়স্কা এক মহিলা সাথে সেই কিশোর ও এক কিশোরীকে নিয়ে সালাম দিয়ে বসেন এবং পরিচয় দেবার আগেই আমি বলি-“ I confirmed that you are Jabir’s mother and the kids are younger brother and sister of Jabir by seeing those photograph which are hang on the wall. ভদ্র মহিলা উত্তরে বললেন-yes, I’m Jabir’ mom.
আমি যে ভুল-ভাল পান্ডিত্যে উর্দুও বলতে পারি -তা দেখানোর জন্য বলি-"জাবির আঁখো অর বাচ্চাকো আঁখো একহি আচ্ছা লাগতা"- ঐকথাগুলো বলে একই স্টাইলে আমার পরিচয় দিচ্ছিলাম। আমার কস্টকর "ছহি উর্দু" বলা দেখে তিনি ইংরেজীতে বলেন- I know english, you can speck english-no problem.
আপশোশ আমি উর্দু বলার প্রমান রাখতে পারলামনা ! আমি আমার পরিচয়,জাবিরের সাথে পরিচয় এবং জাবিরের দুইবার ঢাকায় যাওয়ার বিশয় বলি।
জাবিরের আম্মা কিছুটা সন্দেহের সুরে বলেন- "জাবির কয়েকবার ঢাকা গিয়েছিল কিন্তু কার কাছে এবং কেন গিয়েছিল তা জানায়নি"।
আমি ল্যাপটপে জাবিরের সাথে আমার যোগাযোগের ইমেইল, ছবি দেখাই...
আমার সাথে জাবিরের ছবি ও ইমেল যোগাযোগের বিষয়ে নিশ্চিত হলে তিনি বলেন- তাঁর স্বামী কর্নেল জাফর কোরেশী বাংলাদেশের National Defence College and Defence Services Command and Staff College থেকে ২০০৯ সনে PSC করেছিলেন...আমি বলি-বিশয়টা আমাকে জাবির জানিয়েছিল।
আমিও বলি-"আমার আব্বা পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের অফিসার ছিলেন,আমার মা অনেকদিন পাকিস্তানে ছিলেন,আমার বুবুর জন্ম পাকিস্তানের কোয়েটা এয়ার বেইস হস্পিটালে এবং সিক্টি ফাইভ ইন্ডো-পাক ওয়ারে আমার আব্বা সারগোদা সেক্টরে যুদ্ধ করে খেতাব জিতেছিলেন.... কিন্তু ৭১ সা্লে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার আব্বা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন ........আমার কয়েকজন চাচা, কাজীন পাকিস্তান সেনা, বিমান ও নৌ বাহিনীর অফিসার ছিলেন-তাঁদেরও অনেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বন্দী শিবিরে বন্দী ছিলেন, যারা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে সফল সার্ভিস দিয়ে উচ্চ পদে অবশর নিয়েছেন। "
আমাদের পরিচয় পর্বে এতক্ষণে মহিলা আমাকে খুব আপন ভেবে কথা বলছেন-তা তাঁর চেহারা দেখেই বোঝা যায়! এটা হলো আর্মী রেশন খাওয়ার সিমপ্যাথীক রিয়্যাকশন!
আমরা কথা বলতে বলতেই জাবিরের মায়ের নির্দেশে দুই ভাই-বোন বারবার মোবাইল ফোনে জাবিরের সাথে কথা বলার চেস্টা করছে-কিন্তু নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিলনা-"হ্যালো জাবির ভাইয়া আম্মীছে বাতবলিয়ে..."--কিন্তু বাতচিত আর হয়না-লাইন কেটে যায়। অপর প্রান্ত থেকে জাবির কল ব্যাক করে-কিন্তু নেটওয়ার্ক ভাল নাথাকায় লাইন কেটে যায়। আমি জাবিরের নম্বর নিলাম।
একজন বয়স্কা মহিলা (হয়ত আত্মীয় কাম কাজের বুয়া) আমাদের সবার সামনে অনেক প্রকার ফ্রুটস, মিস্টি,কুলসন নুডলস(পাকিস্তানে কুলসন নুডলস খুব জনপ্রিয়) দিয়ে চলে যায়। জাবির’র আম্মা নিজে উঠে আমাদের প্লেট এগিয়ে দিয়ে সন্তানদেরকে দিয়ে নিজেও নিলেন। ড্রাইভার ও গার্ডদেরও নাশতা পাঠালেন। আমরা কথা শুনছি/ বলছি-আর নাশতা পর্ব শেষ করছি।
জাবির’র আম্মা বলেন-"জাবিরের আব্বার কর্মস্থল মূলতানে আমরা স্বপরিবার থাকতাম।
তখন তালেবান বিরোধী অভিযান চালিয়ে অনেক সাফল্য পেয়েছিলেন। কর্নেল জাফর সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অফিসার হিসেবে তালেবান বিরোধী অফিসার হিসেবেও সেনাবাহিনীতে পরিচিত ছিলেন এবং অত্যন্ত ডিসিপ্লীন মেন্টেন করতেন, যা অনেক উচ্চ পদস্থ্য সেনা কর্ম কর্তারও অপছন্দ ছিল। "
"কর্নেল জাফর তালেবানীদের আত্মঘাতি হামলায় অকাল মৃ্ত্যুরপর তাদের বড়ছেলে জেলাল চেনাবকোট ফিরে পারিবারিক পুরনো ব্যাবসা চালিয়ে নিচ্ছিল। ক্যাডেট কলেজ থেকে HSC পাশ করারপর জাবিরকে সেনা অফিসার হিসেবে রিক্রুট করা হয়েছিল কিন্তু জাবির সেনা চাকুরীতে আগ্রহি ছিলনা। ইংল্যান্ডে পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিল।
বাবার অকাল মৃত্যুরপর পড়া শেষ নাকরেই দেশে ফিরে বড় ভাই জেলালের সাথে ব্যাবসা শুরু করে। জেলাল লাহোর ফাইন আর্টস কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেছিল। সরকার এই বাড়িটা কিস্তিতে পরিশোধ যোগ্য নামমাত্র মূল্যে আমাদের দিয়েছে মৃত সেনা অফিসারদের কোটায়। একদিন তালেবানরা জেলালকেও ওর অফিসে গুলি করে হত্যাকরে, আল্লাহর ইচ্ছায় জাবির ও জাবিরের দাদাজান বেঁচে যায়। জাবিরের দাদা পংগু হয়ে বেঁচে আছেন এবং আমাদের সাথেই থাকেন।
"
"জাবির কারখানার প্রডাক্ট, মেশিনারীজ কোথায় কিভাবে বিক্রি করে কিছুটাকা সংগ্রহ করে চলে যায় দুবাই মামার কাছে। মামার সাথে তাঁর ব্যাবসা দেখে! জাবিরের পাঠানো টাকা ও সরকার থেকে পাওয়া ভাতায় সংসার চলছে। জেলাল ব্যাবসা শুরুর সময় অনেক টাকা লোন করেছিল, জেলালের মৃত্যুর পরে জাবিরও অনেক টাকা লোন করেছে। মৃত স্বামীর প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা পেয়ে সেই লোন কিছু শোধ করেছি। ঢাকাতে গিয়ে জাবির কি আপনার নিকট থেকে টাকা লোন নিয়েছে? আপনি কতটাকা পাবেন?"
ভদ্র মহিলা কথা বলছেন আর চোখ মুচছেন।
আমিও অনেকটা বাকরুদ্ধ! জাবির আমাকে কখনও জানায়নি ওর ভাইয়ের মৃত্যুর কথা, পারিবারিক ও ব্যাবসায়ীক বিপর্যয়ের কথা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলি- জাবির আমার থেকে লোন নিয়েছিল সত্য। কিন্তু সেই লোন এবং আপনাদের এক্সপোর্ট গুডসে আমার ইনভেস্টমেন্ট কেটে রেখেও জাবিরের পাঠানো পণ্যের মুল্যবাবদ আমার কাছে '- - - - - - ডলার' সমমূল্যের টাকা আছে-যার মালিক জাবির। জাবির আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করছেনা গত ১০ মাস যাবত। আমি সেই টাকা দেবার জন্য অনেক চেস্টা করেও জাবিরের সন্ধান পাইনি।
আমি ব্যাবসায়ীক কাজে এসেছি-এবং জাবিরের খোঁজ নিতে চেনাব কোট আপনাদের বাড়ি এসেছি।
" ইয়া আল্লাহতায়ালা, ইয়া খুদাতায়ালা! - - - - - - ডলার!!!" টাকার অংকটা শুনে জাবিরের আম্মা নিজেই অবাক! ভদ্রমহিলা এবার শিশুদেরমত মুখ ঢেকে শব্দকরে কান্না করছে। বাচ্চা দুটোও কান্না করছে-ওদের আম্মীর কান্না দেখে। কারো চোখে পানি দেখলে আমারও চোখ ভিজে যায়...চোখের পানি লুকাতে জাবিরের আম্মা ডাকদিলেন-“ "নুরী বহিন,টেবিল ছাফ করদো”"।
জাবিরের আম্মা আমাদের জিজ্ঞেশ করলেন- চা, কফি,দুধ কি খেতে চাই? পরিস্থিতি আরো একটু হালকা করতে আমি কড়া দূধ-চা খেতে অভ্যস্থ জানাই, নাসের ব্লাক কফি।
তিনি নুরী বহিনকো-আমার জন্য কড়া দূধ-চা আর নাসেরের জন্য ব্লাক কফি দিতে বলেন। কিছুক্ষণ পর নুরী বহিন অর্ডারমতো বড় মগভর্তি চা-কফি আর জগ ভর্তি দুধ নিয়ে আসে।
আমি জানাই-জাবিরের এক্সপোর্ট ডুকুমেন্টসে কিছু ভুল ছিল-যা শিয়ালকোট চেম্বার, এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো ও জাবিরের ব্যাংক থেকেই সংশোধন করে দিতে হবে। সংশোধিত ডকুমেন্টস ঢাকা পৌঁছালে কিছু অফিশিয়াল ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে জাবিরের টাকা ফেরত পাঠানোর ব্যাবস্থা করবো-তাতে কিছুটা সময় লাগবে। জাবিরের আম্মা এখন ইংরেজী ভুলে উর্দুতে বারবার বলতে লাগলেন-"শোকরিয়া! শোকরিয়া!! খুদাকে লিয়ে বহুতী শোকরিয়া।
খুদা বহুতী মেহেরবান!আপ বহুতী বহুতী মেহেরবান ভাইসাব!!
রাত তখন আটটা-আমরা ফিরে আসার অনুমতি চাই। কিন্তু জাবির পরিবারের কেউ রাতের খাবার নাখেয়ে আসতে দিবেনা। কিন্তু এখানে আমাদের ডিনার করা চলবেনা। কারন, শিয়ালকোট চেম্বার অব কমার্স’র সৌজন্যে আমাদের ডিনার নির্ধারিত।
শেষ পর্যন্ত উনি বললেন-এক শর্তেই উনি টাকা নিবেন-তাহলো "কাল তাঁর ছেলেমেয়েদের সাথে লাঞ্চ/ডিনার করতে হবে।
"
আমরা জানাই-শিয়ালকোট থেকে লাহোর ফেরার আগে যেকোনো একদিন একত্রে খাব-তবে দিনক্ষণ এখনই বলা যাচ্ছেনা। হোটেলে পৌছে আমাদের প্রোগ্রাম জানাবো। তিনি আমাদের হোটেলের নাম, ফোন নম্বর লিখে নিলেন।
আমার হাতে গচ্ছিত জাবিরের আমানত ফিরিয়ে দেবার সুযোগ পেয়ে আমার বুকটা হালকা লাগছে। এক অনাবিল প্রশান্তি নিয়ে শিয়ালকোট ফিরছি......ফেরার পথে গাড়িতেই জাবিরের ফোন পাই ...............
আগের পর্বের লিংক-http://www.somewhereinblog.net/blog/jullvern/29636951
(পরের পর্বে.........)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।