আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যুপূরী থেকে ফিরেঃ-৪

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ মৃত্যুপূরী থেকে ফিরেঃ-৪ পাকিস্তানীদের প্রতি বাংলাদেশীদের অনেক ক্ষোভ, অনেক ঘৃণা সংগত কারনেই-আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানীদের উপরে ভালো ধারনা খুব কম দেশেই আছে। তবে সব পাকিস্তানীই যেমন খারাপ নয়-তেমনি সব বৃটিশ-আমেরিকান, ইন্ডিয়ান, নওরোজিয়ান, বাংলাদেশী কোথাও সবাই ভাল/খারাপ নয়। বিদেশে পাকিস্তানীদের অনেকেই “পাকি” সম্বোধন করে মূলত খারাপ অর্থে-তার জন্য যতটা না পাকিস্তানীরা দায়ী তার থেকে অনেক বেশী দায়ী ইহুদী নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এবং সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয়রা। এই যে আলীম সাহেব,মিঃ বাট, নাসের মাহমুদ পরিবার এবং পাকিস্তানী বর্তমান শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম-প্রত্যেকেই পাকিস্তানী বর্তমান-পূর্বা-পর শাসকগোষ্ঠীর প্রতি অসন্তুস্ট।

তাঁরা এখনও অনূশোচনায় ভোগে-১৯৪৭-১৯৭১ পর্যন্ত একই রাস্ট্রভূক্ত হয়েও পাকিস্তান রাস্ট্রযন্ত্রের বাংগালীদের উপর অমানবিক নির্যাতন আর শোসনের বিষয়ে, কারন ওরা নিজেরাও পাঞ্জাবীদের দ্বারা শোসিত। পাকিস্তানের সকল শাসকগোষ্ঠীই বদ-কিন্তু সাধারন পাকিস্তানীদের বেশীর ভাগই খারাপ নয়। অন্তত নতুন প্রজন্মের পাকিস্তানীদের বাংলাদেশীদের প্রতি অনেক সমীহ, সম্মান। পাকিস্তানীরাও কিন্তু বাংলাদেশীদেরমত অত্যন্ত অতিথি পরায়ন। তা যেকোনো অতিথিই হোক- অতিথিদের আপ্যায়ন করে ওরা খুশী হয়।

পাকিস্তানীরা এক কথায় খাদক। ওরা নিজেরা প্রচুর খেতে পছন্দ করে এবং অতিথিদেরও খাওয়াতে পছন্দ করে। সিলভারস্পুন রেস্টুরেন্ট(ছবিটা পোস্টার থেকে নেয়া) নাসের মাহমুদ আমার থেকে বয়সে ১০ বছর ছোট হলেও আমাদের আন্ডারস্টান্ডিং চমতকার। তাঁর সাথে আমার ৮ বছরের ব্যাবসায়ীক সম্পর্ক। আমার অসুস্থ্যতার বিষয়ে নাসের পরিবারের আন্তরিক উদ্ববিগ্নতা একেবারেই মানবিক-যেখানে কোনো ব্যাবসায়ীক স্বার্থ নেই।

তাই আমি পাকিস্তান আসার আগেই আমাকে শওকত মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতালে “অন্তত একবার চেক আপ”র জন্য নিজেই এপয়েনমেন্ট করে রাখেন-কিন্তু সেই এপয়েনমেন্ট ক্যান্সেল হয়ে যায় যথা সময়ে শিয়ালকোট থেকে লাহোর ফিরে যেতে নাপারার জন্য। নাসের মাহমুদ পাঞ্জাব/লাহোর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী নিয়ে পেশাগত উতকর্ষতার জন্য জার্মানী থেকে কেমিক্যাল এন্ড মেটাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ উচ্চতর ডিগ্রী নেন। নাসেরের ছোট ভাই ওয়াকাস মাহমুদ মহা বাউন্ডুলে, কলেজের গন্ডি পার হতে পারেনি। এখন বাধ্যতামূলক ফ্যাক্টরী দেখাশুনার দ্বায়িত্বে। ইয়া লম্বী জুলফুওয়ালা ওয়াকাস কখনও আমাকে স্যার, কখনও চাচাজী আবার কখনও ভায়াও সম্বোধন করে বলে।

(পাঠক, পাকিস্তানী তরুনেরা ফ্যাশন বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে তিন যুগ পিছিয়ে। ছোট্ট একটা উদাহরণ-আমরা লম্বা চুল রাখতাম আজ থেকে অন্তত ৩০ বছর পূর্বে-কিন্তু পাকিস্তানীরা সেই ফ্যাশন করছে বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর ১০ বছর পেরিয়ে!বাংলাদেশী শিক্ষিত তরুনদের মধ্যে যখন প্রচন্ড ইন্টারনেট আসষক্তি সেখানে পাকিস্তানী তরুনরা এখনও "লাইলী-মজনু" মার্কা সিনেমা ভিত্তিক )! ওদের পিতা শিয়ালকোটের নামী ব্যাবসায়ী,২০০৮ সনে তালেবানী বোমা হামলায় একটি পা হারিয়েছিলেন। ওদের আম্মা নওয়াজ শরিফের আপন খালাত বোন। শিয়ালকোটে রি-রোলিং মিলস,টেক্সটাইল মেশিনারীজ/স্পেয়ার্স ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রীজ, সার্জিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ আর লাহোরে মাতুল পরিবারের উত্তরাধিকারসূত্রে বিশাল টেক্সটাইল ব্যাবসা-যা আমি আগেই দেখেছি। আমাকে নিয়ে একবার লাহোরে নওয়াজ শরীফের ইত্তেহাদ গ্রুপের(ইত্তেহাদ গ্রুপ পাকিস্তানের অন্যতম বৃহত শিল্প গোষ্ঠী) অফিসে গিয়েছিলেন তখন নওয়ায শরীফের ছোট ভাই শাহবাজ শরীফের(তিনিও একসময় পাঞ্জাবের মূখ্য মন্ত্রী ছিলেন) সাথে পরিচিত হয়েছিলাম।

ওরা মামাকে “মামু” ডাকে। আমিও শাহাবাজ শরীফকে “মামু” সম্বোধন করেছিলাম-“মুন্না ভাই এমবিবিএস” ছবির স্টাইলে! নাসের মাহমুদের বাড়ি নাসের মাহমুদের বাড়িতে আজ আমাদের দু’জনের পারিবারিক ডিনারের দাওয়াত। নাসের মাহমুদের বাড়িটি ওল্ড শিয়ালকোট। অসাধারন দৃষ্টি নন্দন সুন্দর একটি বাড়ি। নাসের মাহমুদের দৃষ্টি নন্দন বাড়িটির কথা আমি আগেই ইডি সাহেবকে বলেছিলাম।

তিনিও বাড়িটি দেখার আগ্রহ ব্যাক্ত করেছিলেন। আসলে যায়গা বেশী থাকলেই নিজের পরিকল্পনামত সুন্দর বাড়ি বানানো যায়-আমাদের দেশেতো পর্যাপ্ত যায়গাই নেই! পাকিস্তানে প্রচুর যায়গা-তাই ওরা পরিকল্পনামত বাড়ি বানাতে পারে। পুরনো শিয়ালকোট কিন্তু অনেকটা আমাদের পুরনো ঢাকার একসময়ের অভিযাত ওয়ারী-গেন্ডারিয়া এলাকারমত হলেও পুরনো শিয়ালকোট আর আধুনিক শিয়ালকোটের মধ্যে একটা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের যোগসূত্র বিদ্যমান। আধুনিক শিয়ালকোট অনেক বেশী আধুনিক -যা উদাহরণ নাসেরদের বাড়িটি! এই বাড়ি, বাড়ির আসবাবপত্রে মোঘল-বৃটিশ-পাক মিশেল ঐতিহ্য লক্ষনীয়। বিশাল একটি ডাইনিং টেবিলে এক সাথেই সকল খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেকটা ব্যুফে স্টাইলে।

এক টেবিলেই খেতে বসেছি-আমরা দুই গেস্ট, নাসের, নাসেরদের আব্বা,আম্মা, ওয়াকাস, নাসেরদের ১০ বছর বয়সী দুই জমজ পূত্র ও ৬ বছরের একমাত্র কণ্যা এবং বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসা নাসেরদের দুই বোন। (পাকিস্তানে এখনও যৌথ পরিবার ব্যাবস্থা ব্যাপক প্রচলিত)। ব্যুফে স্টাইল হলেও এখানে খাবার পরিবেশন করছেন স্বয়ং নাসের মাহমুদের স্ত্রী সাফিয়া মাহমুদ, দুই বোন এবং তাদেরকে হেল্প করছে কয়েকজন পরিচারিকা। ওদের খাওয়ার স্টাইল আমাদের থেকে ভিন্ন। একই সাথে ওরা রুটি, পনির, ভাত বিভিন্ন রকম মাংশ, ডাল, পোলাও, সবজি, দুধ, মিস্টি, ফিরনী, জর্দা ও প্রচুর পরিমান শুকনো ও তাজা ফল খায়।

পাকিস্তানীরা মাছ খুব একটা পছন্দ করেনা। নাসের পরিবারও মাছ পছন্দ করেনা। কিন্তু আমি মাছ পছন্দ করি-তাই আমাদের খাদ্য তালিকায় অনেকগুলো মাছের আইটেম ছিল-কিন্তু মাছ রান্নায় অনভ্যস্ততার জন্যই সেই মাছ সুস্বাদু হয়নি। কিন্তু অন্য সব খাবার সত্যি অত্যন্ত সুস্বাদু। নাসের মাহমুদের বাড়িতে খাবার যদিও পাকিস্তানীরা আয়েশ করে অনেক সময় নিয়ে রাতের খাবার খায় কিন্তু আমাদের আয়েশ করার সময় ছিলনা।

কারন,কয়েকজন ব্যাবসায়ীর সাথে হোটেলে দেখা করার সময় নির্ধারন করা আছে। ফেরার সময় নাসের গিন্নীসহ অন্যরা আমাদেরকে গাড়ি পর্যন্ত এবং নাসের-ওয়াকাস তাদের বডি গার্ড নিয়ে আমাদের হোটেলে পর্যন্ত পৌঁছে দেন। ওদের বাড়ি থেকে বেড় হয়ে ১৫ মিনিট পেরুতেই রাস্তার অপর পাশে বিকট শব্দে একটি পুলিশের গাড়িতে আত্মঘাতি বোমা বিস্ফোড়নে গাড়িটি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে আগুনে পূড়ে যেতে দেখি। আক্রান্ত গাড়ির কিছু টুকড়া এসে আমাদের গাড়ির কাছেই পরে! আমাদের বহনকারী গাড়ি থেকে আছে। মূহুর্তেই বডি গার্ড দুইজন সতর্ক হয়ে যায়-যদিও ওরা সর্বক্ষনই সতর্ক থাকে।

বিকট শব্দে আমি ভয় পেলেও আমাদের সংগীরা নির্বিকার! শুধু ওয়াকাস বললো-“ছব খতম হোগিয়া! আগ দেখিয়ে বাড়ো ভাই-ছাবধানছে বাড়ো......”(সবাই মারা গেছে, ড্রাইভার আগুন দেখে সাবধানে যাও...)। সব থেকে অবাক ব্যাপার-অমন একটা ঘটনায় সাধারন মানুষেরও কোনো কৌতুহলই নেই-মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য রাস্তায় গাড়ি থেমেছিল! আত্মঘাতি বোমা হামলায় বিধস্ত গাড়ি হোটেলে ফিরে ভিজিটরস স্লিপে দেখি-নির্দিস্ট দুই ব্যাবসায়ী প্রতিনিধি দল ছারাও শিয়ালকোট ক্যান্টমেন্ট থেকে ব্রীঃ জেঃ ফাইয়াজ খোকার-নামে একজনের নাম। যথারিতী ব্রীঃজেঃ ফাইয়াজ ইডি সাহেবকে স্যালুট ঠুকে নিজের পরিচয় এবং অভিপ্রায় জানালেন। শিয়ালকোট পাকিস্তানের ২য় বৃহত্তম ও অন্যতম কৌশলগত ক্যান্টনমেন্ট এবং সন্ত্রাসের স্পর্শকাতর এলাকা। এখানকার সব হোটেলে যেকোনো গেস্ট এলেই তাঁদের নাম ঠিকানা সব স্থানীয় থানা ও সেনা গোয়েন্দাদের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়।

ইডি সাহেবের নাম-পদবী দেখে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য এসেছেন স্থানীয় গ্যারিসন কমান্ডার ব্রীঃজেঃ ফাইয়াজ। আমরা এখানে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করবো জেনে আমাদের একদিন ডিনারের জন্য ইনভাইট করলেন এবং যেকোনো সাহায্য সহযোগীতার জন্য আশ্বাস দিলেন। আমাদের আপত্তি সত্তেও ব্রীগেডিয়ারের পক্ষে এক সেনা আর্ডালী এক কার্টন বিয়ার, দুই বোতল ওয়াইন রেখে যায়! পাঠক, প্রকারন্তরে সেনা শাসিত মুসলিম রাস্ট্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে “পান” অতি স্বাভাবিক বিষয়! ব্রীঃজেঃ ফাইয়াজ চলে যাবার পর ইডি সাহেব বললেন-“এই অফিসার ISI’র লোক-এদের সাথে যত দুরত্ব রাখা যায় ততই মংগল। আমিও তাঁর কথায় সম্মতি জানাই। আমরা ভিজিটরস লাউঞ্জ থেকে এক্সিকিউটিভ বিজনেস রুমে গিয়ে পর্যায়ক্রমে মিঃ আছলাম তাহির ও বাছিত খান নামে দুই ব্যাসায়ীর সাথে আলোচনা করি।

আছলাম তাহির বিশাল বপুর মানুষ-অনেকটা গালিভার টাইপের,সাথে তার ছেলেও আর একজন গালিভার! দুজনেরই চেহারা ‘বলদ’ টাইপের(আমরা ছেলেবেলায় এইধরনের চেহারার কাউকে দেখলে ‘বাবুল মার্কা’ বলতাম)! তিনি আমাদের জন্য বিশাল একটা ফ্লাওয়ার্স বাকেট নিয়ে এসেছেন! দুইজনের কেউই উর্দূ ভিন্ন অন্যকোন ভাষায় কথা বলতে পারেনা। ওরা ফ্যাক্টরী ভিজিট করার আমন্ত্রন জানালেন-সেই সাথে লাঞ্চ কিম্বা ডিনারের ইনভাইট। আমরা ওনার ফ্যাক্টরী ভিজিট করার টাইম জানাবো-বলি। আছলাম তাহির চলে যাবারপর আসেন বাছিত খান ও তার কোম্পানীর অন্য একজন ডাইরেক্টর। তাকেও বলি-আমাদের আগেই কিছু প্রোগ্রাম করা আছে-সেগুলোর ফাঁকে ওনাদের কোম্পানী ভিজিট করবো-টাইম সেডিউল ফোন করে জানাবো।

তৃতীয় পর্বের লিংকঃ- Click This Link (পরের পর্বে.........) ।


আরো পড়ুন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।