সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ মৃত্যুপূরী থেকে ফিরেঃ-২
করাচী কায়দে আযম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর
পাকিস্তানে ব্যাবসায়ীক কাজ ছাড়াও শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতালে আমার চেক আপের ব্যাবস্থা করে আমার পাকিস্তানী বিজনেস এজেন্ট নাসের মাহমুদ। নাসের মাহমুদের নিকট আমার বাড়তি রিকোয়েস্ট ছিল-সম্ভব হলে এবোটাবাদে লাদেনের বাড়ি ভিজিট করানোর ব্যাবস্থা করা। আমার ২য় ইচ্ছায় ইডি সাহেবের মোটেই সম্মতি ছিলনা। এছাড়া শিয়ালকোটেই জাবির কোরায়শী নামক একজন তরুন ব্যাবসায়ীকে খুঁজে বের করাও আমার চিন্তায় আছে।
PIA-214’'র এই ফ্লাইট ঢাকা-করাচী-জেদ্দা-আর্মস্টার্ডাম যাবে।
আমরা যথা সময়ে করাচী কায়দে আজম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছি। এই ফ্লাইটে ২৮৪ জন যাত্রীর মধ্যে আমরা প্রায় দেড়শ জনেরমত বাংলাদেশী যাত্রী থাকলেও করাচীতে ১৬ জন বাংলাদেশী নামি-বাকীরা অন্যকোনো দেশে যাবে। করাচীতে নেমে যাওয়া ১৬ বাংলাদেশী যাত্রীদের মধ্যে ৪ জন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন-যারা পাকিস্তান ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে সেনাবাহিনীর উচ্চতর কোর্স করতে গিয়েছিলেন। আমরা করাচী থেকে অন্য একটি ফ্লাইটে যাবো লাহোর। করাচী এয়ারপোর্টে প্রায় ৪ ঘন্টা যাত্রা বিরতি-তার উপরে ৪৫ মিনিট ডমেস্টিক ফ্লাইট লেট।
বাসায় স্ত্রী সন্তানদের কথা দিয়ে এসেছি-করাচী, লাহোর, শিয়ালকোট পৌছেই ঢাকায় কল করে আমার অবস্থান, কুশলাদি জানাবো। করাচী বিমান বন্দরে আমাদের দুজনের কারোরই গ্রামীন ফোন ইন্টারন্যাশনাল রোমিং অজ্ঞাত কারনে কাজ করছিলনা! তাই পে-ফোন থেকে ফোন করার জন্য ইতিউতি করছি-কিভাবে কল করতে পারি।
করাচী এয়ারপোর্টে যেখানে ফোন কার্ড কিনে প্রতারিত হয়েছিলাম
উপমহাদেশে রাস্ট্রীয় ও বেসরকারী বিভিন্ন এয়ালাইন্স কোম্পানীগুলোর মধ্যে PIA অত্যন্ত সুনামের সাথে দুনিয়াব্যাপী সার্ভিস দিয়ে আসছে-যদিও এখন আমেরিকার ৬টি অন্যতম প্রধান বিমান বন্দর PIA'র জন্য নিষিদ্ধ এবং অন্যগুলোতে যেতে নানান জটিল প্রকৃয়া সম্পন্ন করতে হয়। আন্তর্জাতিক এয়ার লাইন্স স্টান্ডার্ড অনূযায়ী যেখানে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার অনেকগুলো দেশের এয়ার লাইনস বি ক্যাটাগরী-সেখানে PIA এখন পর্যন্ত এ ক্যাটাগরী স্টান্ডার্ড বজায় রেখে আসছে-যা পাকিস্তানেরমত বিশৃংখল দেশের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ না। একই সংগে করাচী এয়ারপোর্ট অনেক পুরনো হলেও অভিযাত-যা সকলেই স্বীকার করবেন।
এই এয়ারপোর্ট এমন অভিযাত করার পিছনে আমাদের বাংগালীদের ট্যাক্সের পয়সাও আছে মনে করে মনে মনে পাকিস্তানীদের মুন্ডুপাত করছি।
উল্লেখ্য, নিয়ানূযায়ী আমাদের এই ভ্রমনে পাকিস্তানের ভিতরে যাবতীয় ট্রান্সপোর্ট, লজিং, ফুডিং পাকিস্তানী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই বহন করবে। তারপরেও এয়ারপোর্ট মানি চেঞ্জারে আমরা কিছু ডলার চেঞ্জ করে নেই। একটা ফোন বুথের কাছে যেতেই এক যুবক ইংরেজী/উর্দুতে প্রশ্ন করলেন- Do you want Oversies call? আপ ওভারসীজ কল করনা চাহিয়ে? (গালায় ঝোলানো একটি আইডি কার্ড দেখে আমি ভেবেছি গাইড) আমি হ্যা বলি। যুবকটি জানালো-বাংলাদেশে প্রতি মিনিট কল চার্জ্ ২৫ রুপী।
তবে একটা ১০০ মিনিটের কলিং কার্ড ১০০০ রুপীতে কিনে নিতে পারি-সেটা লাভজনক। আমরাও ভেবে দেখলাম-১০০ মিনিট কথা বলার জন্য ১০০০ রুপীর কার্ড কিনলে পাকিস্তানের যেকোনো যায়গা থেকে যখন খুশী লোকাল/ওভারসীজ কথা বলা যাবে। যুবককের নিকট থেকেই একটা কার্ড কিনে আমি ও ইডি সাহেব বাংলাদেশে কথা বলি ৫/৭ মিনিট। সেই সাথে লাহোরে আমাদের জন্য অপেক্ষমান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নাসের মাহমুদের সাথেও ৩/৪ মিনিট কথাবলি। ইডি সাহেব ফোন করে জেনেছেন ওনার বৃদ্ধা আম্মার বার্ধক্য জনিত অসুস্থ্যতা বেড়েগিয়েছে-যা শুনে তাঁর মন স্বাভাবিক ভাবেই খারাপ।
যথা সময়ে আমরা করাচী থেকে লাহোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। এই ফ্লাইটে আমরা দুইজন বাংলাদেশী এবং জনাতিনেক ইজিপ্সিয়ান ভিন্ন অন্যকোনো বিদেশী যাত্রী নেই।
যখন লাহোর আল্লামা ইকবাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণ করি-তখন স্থানীয় সময় রাত দশটা। এয়ারপোর্টে নেমে হয়রানীর শেষ নাই। আমাদের ভিসা কনফার্মেশন/ইনফর্মেশন টেলেক্স কপি লাহোর ইমিগ্রেশনে নেই।
অনেক হাংকীপাংকী করারপর ইমিগ্রেশন অফিসার বলে-“"পাসপোর্টকা জেরোক্সকপি, দো দো কপি তাসবীর"-” আরো কি কি ডকুমেন্টস’র দিতে হবে। আমরা বলি-সব ডকুমেন্টসই তোমাদের হাতে-যা কিছু দরকার তোমরা ফটোকপি করে রাখো। কিন্তু হবেনা! ফটোকপি আমাদেরকেই করে এনে দিতে হবে।
* ফটোকপিয়ার কাহা?
** ইমিগ্রেশন বাহারমে!
প্রশ্ন করি-ইমিগ্রেশনের বাইরে আমরা কিকরে যাবো?
তখন কাউন্টারের বাইরে আমাদের পাশে দাঁড়ানো একটা টাউটমতো জিরাফ মার্কা লোক দেখিয়ে বলে-মুদাব্বীরছে রুপীয়া দে দো, ও ভী করদেউংগা-উসকো কুচ ইনাম দেজিয়ে।
* কিতনা রুপীয়া চাহিয়ে? মেরি পাছ একশ রুপীয়া নোট হ্যায়।
** জো আচ্ছা একশ রুপীভি দেজিয়ে- জোভি লাগতা বাদছে ফির লেউংগা।
আমরা বসে আছি-যে লোক ফটোকপি করতে গিয়েছে তার দেখা নেই! এই ফাঁকে আমি কার্ড ফোনে গিয়ে কার্ড পাঞ্চ করে আমাদের জন্য বাহিরে অপেক্ষমান নাসের মাহমুদকে কল করি। একমিনিট কথা নাবলতেই ফোন লাইন কেটে যায় এবং এম্পটি ব্যালান্স শো করে! বুঝলাম-এক হাজার টাকার কলিং কার্ড কিনে প্রতারিত হয়েছি!
লাহোর আল্লামা ইকবাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের বাহির এলাকা
এই ফ্লাইটে আসা আমরা ছাড়া সব যাত্রীরা চলে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পর ইমিগ্রেশনের লোকটা নিজেই গেলো-মিনিট পাঁচেক পরে এসে আমাদের পাসপোর্টে Exit সীল মেরে ডকুমেন্টস ফেরত দিলো-কিন্তু ভাংগতি টাকা ফেরত দিলোনা। এমনকি আমাদের “তাসবীর” চাচ্ছেনা, ফটোকপি করিয়েছে তেমন কোনো প্রমানও দেখলামনা।
আমি বেকে বসি! সোজা বাংলায় বলি-“"আমার সাথে ভুংভাং চলবেনা, ফটোকপির বিল দাও"”!
অনেক্ষণ কাইজ্যা করার পর একশ টাকার নোট ফিরিয়ে দিয়ে মুখ বিকৃত করে বলে- “বাংগাললোগ বহুতী কঞ্জুস ঔর হুজ্জতী হ্যায়”(বাংগালী খুব কৃপণ ও ঝগড়াটে)!
একেতো ফোন কার্ড কিনে প্রতারিত হয়েছি-তার উপর এতক্ষণ যাবত এখানে হয়রানীর পর কোনো ফটোকপি নাকরেই ১০০ রুপী মেরে দেওয়া-উপরন্তু তাচ্ছিল্ল করে ‘"বাংগাললোগ"’ সম্বোধন মেনে নিতে পারছিলামনা! আমিও দ্বিগুণ তেড়েগিয়ে আমার “নিজস্ব” বাংলা উর্দু মিশিয়ে বলি-“"বাংগাল লোক বহুতী শেরিফ হ্যায়। লেকিন পাকিলোগ বহুত বজ্জাত হ্যায়! বহুত হারামী মিসকিন অউর টাউট বাটপার হ্যায়-পাকিস্তানী বুইড়াগুলো বেশী খতরনখ!"”-বলে বেড়িয়ে আসি। আমার নিজস্ব “ককটেল” ভাষার গালাগালি শুনে ইডি সাহেব হেসেই খুন!
বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন ডেমসেল কোং’র পরিচালক-মিঃ নাসের মাহমুদ ও তাঁর ছোট ভাই ওয়াকাস মাহমুদ। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
এভাবেই কঠোর নিরাপত্তা বেস্টনীতে লাহোর এয়ারপোর্ট
লাহোর থেকে আমরা শিয়ালকোট যাব-বাই রোড নাসের মাহমুদের মাইক্রোবাসে। লাহোর থেকে শিয়ালকোট যেতে তখন দুটো ওয়ে ছিল। যার এক পথে দূরত্ব ১৩০ কিঃমিঃ আর অন্যটিতে ২৯৮ কিঃমিঃ। পরিস্থিতিগত কারনে সেনাবাহিনী যখন যে পথে গ্রীন সিগনাল দেয়-তখন সেই পথ ব্যবহার করতে হবে। ব্যাবসায়ীক কাজে ২০০০ ও ২০০২ সনে আমি করাচী থেকে বাই এয়ার সরাসরি শিয়ালকোট গিয়েছি।
কিন্তু এখন শিয়ালকোট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তার জন্য বন্ধ! গাড়িতে ওঠার সময় দেখি নাসের মাহমুদের গাড়িতে দুইজন মহিষমার্কা চেহারার অস্রধারী লোক। নাসের পরিচয় করিয়ে দিলেন-জুম্মন ও হিকমত প্রাইভেট বডি গার্ড(ওরা বলে “রাজাকার/মুজাহিদ”)! ওদের হাতে অত্যাধুনিক আর্মস-যা আমাদের র্যাব ফোর্স ব্যবহার করে। নাসের-ওয়াকাস ভ্রাতৃদ্বয়ের কোমড়েও রিভলভার!
পাঠক, পাকিস্তানের অনেকগুলো সিটি/প্রদেশে স্মল আর্ম ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স লাগেনা-শুধু কে কিধরনের আর্মস ব্যবহার করে তা স্থানীয় থানায় জানিয়ে রাখতে হয়। স্থানীয় পুলিশ-আর্মী আমাদের পরিচয় নিশ্চিত হলে আমাদের নিয়ে গাড়ি ছুটছে শিয়ালকোট......। উল্লেখ্যযে-আমাদের ইডি সাহেব একজন অবঃ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, যিনি পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমী থেকে কমিশন্ড হয়ে ক্যাপ্টেন হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন এবং ১৯৭৩ সনে রিপেট্রিয়েশনে বাংলাদেশে ফিরে যথারিতী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে রেগুলার হন এবং ব্রীঃজেঃ হিসেবে অবশর গ্রহন করেন।
২০০৭ সন থেকে আমাদের কোম্পানীর এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর হিসেবে জব করছেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে পাকিস্তানী সেনা অফিসারগন যথেস্ট সম্মান করেছে এবং পথে একটি সেনা ছাউনীতে সেই গভীর রাতেও আমাদেরকে ভেড়ার রোস্ট, খুজব(ভূট্টার তৈরী মোটা রুটি) আর ব্লাক কফি দিয়ে আপ্যায়ন করেছিল......।
প্রথম পর্বের লিংক- Click This Link
(পরের পর্বে.........) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।