আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের দেশে কবে এরকম একজন ইমরোজ হবেন ১৯৭১ থেকে শুরু করে এপর্যন্ত ঘটা সব গুম-খুনের হিস্যা নিতে?

এপ্রিল ২০১০। এক সিক্ত সন্ধ্যায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪ রাজপুতানা রাইফেলের এক মেজর দূরবর্তী এক পুলিশ পোস্টে পৌঁছলেন, যেখানে ভারতের সর্বউত্তরের রাজ্য কাশমিরের কাছাকাছি পর্বতমালা এক অর্ধবৃত্তে মিলিত হয়েছে। দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্য সেই সময়টার কথা স্মরণ করে বললেন, ‘মেজর অপিন্দার সিংকে দেখে মনে হচ্ছিলো তার তাড়া আছে। ’ পির পাঞ্জাব রেঞ্জের যে চূড়া থেকে মেজর নেমেছিলেন, সেখানে তুষারপাত হচ্ছিলো এবং তার বুট পানিতে ঢুকে যাচ্ছিলো। পুলিশ সদস্য তার স্মৃতি থেকে বললেন, ‘অফিসার জানালেন যে, আগের রাতে তার লোকেরা তিন পাকিস্তানী সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে, যারা আমাদের মাচিল সেক্টর পার হয়ে ভেতরে আসার চেষ্টা করেছিলো।

অপরাধী অনুসন্ধানের রিপোর্ট পূর্ণ করতে গিয়ে পুলিশ সদস্য জানতে চেয়েছিলেন, ‘লাশগুলো কোথায়?’ মেজর তার জিপে দ্রুত উঠতে গিয়ে জানালেন, ‘যেখানে তাদেরকে গুলি করা হয়েছে সেখানেই তাদেরকে সমাহিত করা হয়েছে। ’ পুলিশ সদস্যকে পরবর্তীতে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিলো, তিনি কেন সেনাদলটিকে দেখার অথবা তাদের পরিচয় যাচাই করার ব্যাপারে জোর দিয়ে বলেননি, এর জবাবে তিনি তদন্তকারীদেরকে বলেছিলেন, ‘এটা অস্বাভাবিক কিছু ছিলো না। ’ ১৯৪৭-এর বিভাজনের পর থেকে কাশমির একটি গোলযোগপূর্ণ অবস্থা এবং গত দুই দশক ধরে একটি অপ্রকাশ্য যুদ্ধের মধ্যে আছে, যাতে আনুমানিক ৭০ হাজার লোক নিহত হয়েছেন। ক্ষুরতার এবং মিসাইলবিধ্বংসী জালে আটকানো এই রাজ্যটিকে পৃথিবীর শীর্ষ যুদ্ধগ্রস্ত স্থানে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এখানে প্রতি ১৭ বাসিন্দার জন্য একজন আধাসৈনিক কিংবা সৈনিক নিয়োজিত আছে।

পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিভাগ এবং সেনাবাহিনী অনিয়মিত একটি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ এবং অর্থের যোগান দিচ্ছে। এরা ১৯৮৯ সালে ভারতশাসিত মুসলিমপ্রধান অংশকে স্থায়ীভাবে আলাদা করা জন্য পর্বতের ওপর থেকে পুরোপুরি হাঁফিয়ে ওঠা একটি বিদ্রোহী জাতিকে গতিসঞ্চারিত করেছিলো। ভ্রমণপিয়াসী এবং সকল ধর্মের মরমীদের তীর্থস্থান হিসেবে একসময়ের নিখুঁত ছবি কাশমির পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। মাচিল নামের যে সেক্টরে সিং তার অপারেশন চালিয়েছিলেন, সেটা ছিলো বিশেষভাবে প্রবঞ্চক স্থান। কন্ট্রোল লাইনের সাথে যুক্ত গ্রামগুলোর নিয়ন্ত্রণযন্ত্র এখানে।

কন্ট্রোল লাইনটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সুউচ্চ যুদ্ধবিরতিরেখা, যেটি কাশমিরকে ১৯৭২ সালে বিভক্ত করেছে। ভারত এখানে তৈরি করেছে এক ভীতিকর বাধা। ইসরাইলী প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি এই বাধাটি হচ্ছে পরস্পরসংযুক্ত প্রাণঘাতী বিদ্যুৎবাহী বেড়া। বেড়ার সাথে আছে মোশন’স ডিটেক্টর। এগুলো আবার মাইনপোঁতা নো-ম্যান’স ল্যান্ডে ঘেরা।

২০১০ সালের ৩০ এপ্রিল কাশমিরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরে সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল জেএস ব্রার এই কাহিনীর সত্যতা নিশ্চিত করেন। একে-৪৭, একটি পাকিস্তানী পিস্তল, গোলাবারুদ, সিগারেট, চকোলেট, খেজুর, দুই বোতল পানি, একটি কেনউড রেডিও এবং ১০০০ পাকিস্তানী রুপি উদ্ধারের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি জানান, ‘গুলি করে তিন বিদ্রোহীকে হত্যা করা হয়েছে। ’ যাই হোক, এর কয়েকদিন পর মাচিল থেকে ৩০ মাইল দূরের পানজালা পুলিশ স্টেশনে একটি গুমের মামলা সবার জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। স্টেশনের কাছের গ্রাম নাদিহাল থেকে তিন পরিবারের তিন ছেলে হারিয়ে যায়। তারা হলো : ১৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ, ২০ বছর বয়সী রিয়াজ এবং ২৭ বছর বয়সী শাহজাদ।

পরিবারগুলো পেশায় যথাক্রমে আপেলচাষী, রাখাল এবং শ্রমিক। ২৮ এপ্রিল থেকে তারা এদের খোঁজ পাচ্ছিলো না। গোয়েন্দারাও তাদেরকে সান্ত¦নামূলক কিছু বলতে পারছিলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের বিচারপ্রার্থনা কাশমিরের মানবাধিকার বিষয়ে সবচেয়ে নাছোড়বান্দা আইনজীবী পারভেজ ইমরোজের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আর তার সাড়াদানই হয়ে যায় মাচিল এনকাউন্টার।

কাশমিরে এটা এক সন্ধিক্ষণ সৃষ্টি করে। এই আইনজীবী গত দুই দশক ধরে শ্রীনগরের হাইকোর্টে নিখোঁজদের পরিবারের পক্ষে সহস্র হেবিয়াস কর্পাস দায়ের করেছেন, যাতে নিখোঁজদেরকে সশরীরে হাজির করতে বলা হয়েছে। পরিবারগুলোর অভিযোগ, তাদের আত্মীয়রা নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে থাকাকালীন উধাও হয়েছেন। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো সামান্যই সফল হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী বেশ জোর দিয়ে বলে আসছে, নিখোঁজরা কন্ট্রোল লাইন পার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে গেছে।

এক্ষেত্রে তারা বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সময়ের দৃশ্য টেনে আনছেন, যখন দশ হাজার তরুণ কাশমিরী বাসের ওপর উঠে চিৎকার করে বলছিলো, ‘পাকিস্তান পাকিস্তান! আমার এখানে আসছি। ’ কিন্তু রিটের বিপরীতে ইমরোজ তার দলিলে আনুমানিক ৮০০০ বেসামরিক কাশমিরীর নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম হওয়ার প্রমাণ দিতে সক্ষম হয়েছেন। আর সেটা ঘটেছে আয়ারল্যান্ডের আকৃতির সমান একটি রাজ্যে; কিন্তু চিলিতে পিনোশের অধীনে যে পরিমাণ নিখোঁজ হয়েছে, এখানে নিখোঁজের সংখ্যা তার চার গুণ। গার্ডিয়ানকে তিনি জানিয়েছেন, সামরিক থাবা তাদেরকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে এবং রক্তপাতের চেয়ে আরো ভয়ঙ্করভাবে গুম করেছে। ইমরোজ তার পেশার বেশিরভাগ সময়ই বিশেষ আইনে সুরক্ষাপ্রাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনীর মোকাবেলা করে কাটিয়েছেন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো বিচারের ব্যবস্থা না করলে সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনী বিশেষ সামরিক আইনে সম্পূর্ণ দোষমুক্তির সুবিধা ভোগ করে। নতুন তথ্য অধিকার আইনের সাহায্যে ইমরোজ নিশ্চিত হয়েছেন যে হাজারো সৈন্য খুন, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের অপরাধে অভিযুক্ত হলেও এগুলোর একটি মামলারও কোনো অগ্রগতি নেই। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থার মতে জম্মু-কাশমির জনননিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে কাশমিরী জনগণকে জেলে নেয়া হচ্ছে এই অভিযোগে—তারা ভবিষ্যতে অপরাধ করতে পারে। এরকমভাবে জেলে আটক আছেন আনুমানিক ২০ হাজার নাগরিক। ইমরোজের অভিযানে আরো একটা জিনিস অর্জিত হয়েছে।

তিনি জাতিসঙ্ঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ক্রিস্টোফ হেইনস ভারতকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, এ ধরনের কোনো নির্মম আইনের স্থান একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে থাকতে পারে না এবং এগুলো অবশ্যই রহিত করতে হবে। তারা নিরাপত্তা এবং সামরিক বাহিনীর মোকাবেলা করতে গিয়ে যে মূল্য দিয়েছেন তা খুবই মারাত্মক। ১৯৯৬ সালের একদিন ইমরোজের বন্ধু এবং সহআইনজীবী জলিল আন্দ্রাবীর মৃতদেহ নিখোঁজ হওয়ার তিন সপ্তাহ পর পাওয়া যায় বিকৃত অবস্থায়। তিনি বিয়ে করতে এমনকি সন্তান নিতেও ভয় পাচ্ছিলেন—হয়তো তাদেরকে টার্গেট করা হবে।

২০০২ সালে তার হেফাজতে থাকা কাশমিরী গ্রাজুয়েট খুররম পারভেজ মারাত্মকভাবে আহত হন; সাথে তার ড্রাইভার এবং সহকর্মী আয়েশা নিহত হন। এর দুবছর পর মক্কেল সেজে আসা এক লোক ইমরোজের আরেক সহকারী আইনজীবীকে হত্যা করে। ২০০৫ সালে ইমরোজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পুরস্কার খঁফড়ারপ-ঞৎধৎরবীঁ গ্রহণ করতে যেতে পারেননি ভারত তাকে পাসপোর্ট দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে। কিন্তু পল্লী এলাকায় ইমরোজের খ্যাতি বাড়তে থাকে। ২০০৮-এ এসব এলাকার গল্পগুলো আইনজীবীদেরকে তার বিরাট আবিষ্কারের ব্যাপারে সাহায্য করে।

বারোমুল্লা নামের যে গ্রাম থেকে ৩ নাদিহাল যুবক নিখোঁজ হয়েছিলেন সেই গ্রামসহ দুই কাশমিরের ২৩ জেলায় তারা জরিপ করতে গেলে গ্রামবাসী তাদেরকে অদ্যাবধি অজানা এবং অচিহ্নিত গণকবরগুলো দেখায়। গণকবরগুলো রয়েছে মূলত মাটির গর্ত, শেওলা পড়া ঢিবি, গায়ে ছোট ছোট গর্ত সৃষ্টি হওয়া পাইনগাছের জঙ্গল এবং ফলবাগানের মধ্যে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে এগুলো খোঁড়া হয়েছে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর উপস্থিতিতে এবং সবগুলো কবরেই আছে স্থানীয় বাসিন্দাদের লাশ। কিছু লাশ একদম তাজা; কিছু ক্ষয়ে গেছে—যেগুলো বহুবছর আগে ঘট গুপ্তহত্যার ইঙ্গিত দেয়। ইমরোজ প্রায় ১০০০ স্থান নির্দিষ্ট করে তার অনুসন্ধান বৃদ্ধি করতে থাকেন।

ঘটনাগুলো তাকে প্রচ-ভাবে আঘাত দেয়। ভারতীয় আইন অনুযায়ী প্রতিটি সহিংস মৃত্যুর তদন্ত করা এবং লাশ শনাক্ত করা পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু বাইমিয়ার গ্রামে চুল পেকে যাওয়া বৃদ্ধ আতা মোহাম্মদ খান এগিয়ে এসে বর্ণনা করলেন, কীভাবে তাকে রাতের আঁধারে ২০৩টি অশনাক্ত লাশ সমাহিত করতে বাধ্য করা হয়। এসব ব্যক্তির পরিচয় এবং ‘অপরাধ’-এর কোনো বর্ণনা দেয়া হয়নি। আর লাশ বিকৃত করে ফেলার ঘটনা কিচামা গ্রামে ছিলো অহরহ।

এখানে আইনজীবীরা ২৩৫টি নিদর্শনহীন কবর পেয়েছেন। বিঝামায় আরো ২০০ পুঁতে ফেলা অশনাক্ত লাশ পাওয়া গেছে। শ্রীনগরে ইমরোজের দল সরকারী মানাবাধিকার কমিশনকে হুঁশিয়ার করে দেন। ‘আমরা সন্দেহ করছি কাশমিরের নিখোঁজ ব্যক্তিদেরকে এসব গোপন স্থানে পুঁতে ফেলা হয়েছে’—ধামাচাপা দেয়া বিষয়টির রিপোর্ট প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি একথা বলেন। দুমাস পরে, ২০০৮ সালের ৩০ জুন ঠিক রাত দশটার পরে দায়ী এক কর্মকর্তা আসেন।

এতদিনে ইমরোজ বিয়ে করেছেন একজন ব্যবসায়ী মহিলাকে। তার নাম রুখসানা। তাদের এখন দুই সন্তান। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। মেয়ের নাম জেনিশ, বয়স ১২ এবং ছেলের নাম তৌকির, বয়স ৭।

তারা বাস করেন শ্রীনগর সিটি সেন্টার থেকে ৮ মাইল দূরে গাছের সারিতে ঘেরা উপশহর ক্রালপোরায়। এরকম দূরবর্তী এলাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার ধারণা কেউ করেনি। রুখসানা দরজায় মৃদু কারঘাতের আওয়াজ শুনে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলেন তাদের নিরাপত্তাবাতি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘এর মানে আমি বুঝে ফেললাম। ’ দরজায় করাঘাত তখন নিহত বন্ধুদের কাকুতির স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো।

ইমরান দৌড়ে বাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে তার ভাই শেখ মুশতাক আহমাদকে চিৎকার করে ডাকলেন। তার বাড়ির পরের বাড়িটাই তার ভাইয়ের। আহমাদ যখনি একটা টর্চ নিয়ে এলেন, একটা গুলি হলো। তার ছেলে নিহত হলো। এক আগন্তুক চিৎকার করে বলে উঠলো, আলো নিভিয়ে ফেলুন।

তখনি একটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো। গ্রেনেডের টুকরোগুলো সামনের দরজা ছিদ্র করে ফেললো। এর পরপরই কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হলো। যে প্রতিবেশীরা গ্রামের মসজিদের দরজা আটকাচ্ছিলেন তাদেরকে এই অবস্থা জাগিয়ে তুললো। ইমাম সাহেব এলাকাবাসীকে ইমরোজের বাড়ির চারপাশে চলে আসতে বললেন।

কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স এবং স্পেশাল টাস্কফোর্সের একটি সাঁজোয়া যান এবং দুটো জিপ চলে গেলো। রুখসানা বললেন, ‘তারা আমাদেরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে এসেছিলো। ’ আমরা তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনারা কার কাছ থেকে নিরাপত্তা আশা করেন?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘অবশ্যই আমাদের জংলী আইনের সরকারের কাছ থেকে। ’ এই হামলার পরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ভারতকে এই বলে আহ্বান জানায়, ‘পুরস্কারবিজয়ী মানবাধিকার আইনজীবী পারভেজ ইমরোজকে নিরাপত্তা দিন। ’ তার বিষয়টা ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ওঠে।

তার পরিবার তাকে ক্ষান্ত দেয়ার অনুরোধ করে। তিনি স্বীকার করেছেন, ‘আমি ভয়ের মধ্যে ছিলাম। আমি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। কিন্তু চুপ করে থাকাও তো এক ধরনের অপরাধ। ’ ইমরোজ এবং তার দল তাদের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করলেন।

তিন জেলার ৫৫ গ্রামে তাদের অভিযান শুরু করলেন। গ্রামগুলো হলো বান্দিপুরা, বারোমুল্লা এবং কূপওয়ারা। স্বেচ্ছাসেবীদের পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিক তদন্ত চালানো হলো। তারা ২৭০০ গণকবর খুঁজে পেলেন। সেগুলোর মধ্যে ২৯৪৩টি লাশ ছিলো।

সেগুলোর ৮০%-ই ছিলো অশনাক্ত। ইমরোজ বললেন, ‘এটা এমন এক যুদ্ধের নারকীয় ছবি, যে ব্যাপারে কেউ আজ পর্যন্ত কোনো রিপোর্ট করেনি। মৃতরা কারা? তারা কীভাবে নিহত হয়েছে? কাদের হাতে নিহত হয়েছে? কে তাদেরকে পুঁতে ফেলেছে?’ শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার কমিশন SHRC একটা তদন্ত চালাতে রাজি হলো। এরা তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলো। রাইট টু ইনফরমেশন বা RTI আইন ব্যবহার করে পুলিশকে স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়েছে যে, তারা শুধু ৩ জেলায় গোপনে সমাহিত করে ফেলার ২৬৮৩টি মামলা করেছে।

ইমরোজের মাঠকর্মীদের পেশ করা নতুন আরেকটি সাক্ষ্যবিববরণীতে রাজুরি এবং পুঁচ জেলায় আরো ৩৮৪৪টি অশনাক্ত গণকবরের কথা যুক্ত হয়েছে। এতে মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০০০-এর বেশি। এখনো ১৬টি জেলা জরিপ করা বাকি আছে। তাহলে কী পরিমাণ সহিংস হত্যা এবং গোপনে সমাহিত করার ঘটনা পুরো কাশমির জুড়ে ঘটানো হয়েছে? শেষ পর্যন্ত গত সেপ্টেম্বরে SHRC ঘোষণা করেছে যে, ইমরোজের আবিষ্কার সত্য। তারা বলেছে, ‘প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সম্ভাবনা আছে যে, অশনাক্ত মৃতদেহগুলো অচিহ্নিত গণকবরে সমাহিত করা হয়েছে...এগুলোতে জোর করে ধরে নিয়ে উধাও করে ফেলা হতভাগারা থাকতে পারে।

’ জাতিসঙ্ঘ এবছর ভারতের SHRC-কে একটি রিপোর্ট দিয়ে মানবাধিকার চুক্তি এবং আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। কাশমিরী পরিবারগুলোর অধিকার ’সত্য জানার’ অধিকার আছে এবং ‘যখন গুম হওয়া ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যাবে, ...তখন তাকে নিজেদের কাছে ফিরিয়ে আনতে এবং নিজস্ব রীতি অনুযায়ী তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে পারবে। ’ ইমরোজের এক নাদিহালী মাঠকর্মী পারভেজ মাত্তা নিখোঁজ হওয়ার পর তিনি গ্রামে যান। তিনি ফায়েজ ওয়ানী নামের একজন সাক্ষী পান, যে ছিলো পারভেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওয়ানী শেষ পর্যন্ত জানান যে, এসপিও পদমর্যাদার পুলিশের এক দালালের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী সুনাম রক্ষার্থে তাদেরকে দূরের এক সামরিক ক্যাম্প মাচিলে নিয়ে যাওয়ার আগে তাদের প্রত্যেককে ৭ পাউন্ড করে দেয়।

বশির লোন নামের ঐ এসপিওর বিরুদ্ধে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলো মামলা করে। মাত্তা জানান, ‘লোকটা তার ভূমিকার কথা স্বীকার করে ভেঙে পড়ে। সে দাবি করে দূরবর্তী ঐ ক্যাম্পে নয়জন সৈন্য তিন ব্যক্তিকে গুলি করে। ’ (যারা ‘বিদ্রোহীদের’কে হত্যা করে, তাদেরকে সেনাবাহিনী নিয়মিত আর্থিক পুরস্কার দেয়। ) ২০১০ সালের ২৮ মে ক্যাম্পের নিকটবর্তী অচিহ্নিত কবরগুলো থেকে মৃতদেহগুলো তুলে আনা হয়।

কবরগুলোর কিছু কিছু ইমরোজই খুঁজে বের করেছেন। সরকারের অবশ্য বলে এসেছে এসব কবরে বিদেশী যোদ্ধাদের মৃতদেহ আছে। মৃতদের পরিবারগুলো শাহজাদ, রিয়াজ এবং মোহাম্মদকে তাদের পোশাক দেখে শনাক্ত করে। হত্যার জন্য নগদ পুরস্কারের ঘটনা এবং নিশানাহীন গণকবরে সমাহিত অসংখ্য অশনাক্ত ব্যক্তির এই খবর ২০১০ সালে নাদিহালবাসীকে রাস্তায় আন্দোলনে নামতে বাধ্য করে। এভাবে ক্রমশ বাড়তে থাকা ক্রোধ উপলব্ধি করে সেনাবাহিনী এবং নয়াদিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকার একটি অনুসন্ধানের ওয়াদা করে।

কোনো রকম প্রতারণার দিকে না গিয়ে কাশমিরে যেসব লোক সহিংসতা দেখেছেন তাদের সাথে কথা বলার ওয়াদা তারা দেয়। কিন্তু কোনো বাস্তবতা না দেখে কাশমিরীরা গণআন্দোলনে চলে যায়। পাথর দিয়ে যুবকরা অস্ত্রবাহী সৈনিক, পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনীর ওপর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়, যারা মুহুর্মুহু গুলি চালিয়ে যাচ্ছিলো। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে কাশমির পৌঁছলাম। ইতোমধ্যে ১০০’র বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই ছিলো শিশু।

আন্তর্জাতিক সংবাদ চ্যানেলগুলো এতে আগ্রহ দেখালো এই বলে যে, কাশমির হয়তো নিজস্ব আরব বসন্তের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যাচ্ছে। কিন্তু ভীষণ এক অত্যাচারী বাহিনী রাস্তা পরিষ্কার করতে শুরু করায় তাদের ক্যামেরাগুলো খুব দ্রুত জায়গাটা ছেড়ে চলে গেলো। স্বয়ং সরকারী হিসাবেই ৫৩০০ কাশমিরী যুবককে সেদিন গ্রেফতার করা হয়। এদের বেশিরভাগই ছিলো শিশু। ২০১১ সালে ইমরোজ আবার কাজে নামেন।

তিনি অনুসন্ধান করতে চাইলেন, ভারত কীভাবে শান্তি পুনঃস্থাপিত করেছে। আমি তার সাথে সাথে ছিলাম। যারা ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন এবং যারা তখনো কারাবন্দী তাদের বক্তব্য তিনি নিলেন। তিনি বললেন, ‘পুনরায় উৎসাহী না হওয়ার এবং পড়ালেখার জন্য শুধু হলফনামা দেয়া হয়। বেশিরভাগ তরুণই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

’ ব্যক্তিগত মেডিকেল রিপোর্টে দেখা গেছে অনেকেরই হাতের নখ তুলে নেয়া হয়েছে এবং বন্দুকের পাইপ দিয়ে হাড় ভেঙে দেয়া হয়েছে। তারা জানালো, ‘শেষ পর্যন্ত যখন আমাদের চেহারা ওপর দিয়ে কান্নার স্রোত বয়ে যায়, তখন আমাদের টাখনু বেঁধে ঝুলিয়ে আঘাতের জায়গাগুলোতে মরিচ ডলে দেয়া হয়। অন্যরা অভিযোগ করে, তাদের মলদ্বার দিয়ে পেট্রোল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু ছেলে আদালতকে জানায়, তাদেরকে পায়ুকামে বাধ্য করা হয় এবং সেগুলো পুলিশের এক ক্যামেরাম্যান ভিডিও করতো। এবছর ইমরোজ এবং তার মাঠকর্মীরা দেশব্যাপী অনুসন্ধান শুরু করার তাদের গবেষণার আওতা বৃদ্ধি করেন।

তাদের অনুসন্ধানের রিপোর্ট জাতিসঙ্ঘ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে এবছর গ্রীষ্মে যাবে। কিন্তু গার্ডিয়ানের দেখা একটি খসড়ার পরামর্শমতে, এই নির্যাতন কোনো আঞ্চলিক ব্যাধি নয়; এটি নিয়মতান্ত্রিক নির্যাতন। ৫০টি গ্রাম নিয়ে গঠিত একটি গুচ্ছগ্রামে ২০০০ চরম নির্যাতনের মামলা নথিভুক্ত হয়েছে, যেগুলোর কোনোটা মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে যাবে হয়তো; কিন্তু নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি তো শারীরিক পঙ্গুত্ব এবং মানসিক ক্ষত বয়ে বেড়াবে। তাদের নির্যাতনপদ্ধতির মধ্যে আছে ছ্যাঁকা দেয়া, বৈদ্যুতিক শক দেয়া, চুবানো, ক্ষুর দিয়ে মাংস ফালা করে কেটে নেয়া এবং পশ্চাদ্দ¦ারে পাইপের সাহায্যে পেট্রোল প্রবেশ করানো। এই মাঠকর্মের রিপোর্টে দেখা যায়, প্রতি ৬জনে ১জন কাশমিরী এরকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

এই ৫০টি গ্রামেই সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনীর পরিচালিত ৫০টি নির্যাতনকেন্দ্র আছে। নির্যাতনকেন্দ্রগুলোর প্রত্যেকটিরই নির্যাতনের ভাষা এবং পদ্ধতি ভিন্ন। এটা যে কিছু বিপদগামী অফিসার করছে, এমনটা নয়। রাইট টু ইনফর্ম আইনের সহায়তায় জানা গেছে, ১৯৮৯ সাল থেকে এটা চলে আসছে। গার্ডিয়ানের দেখা এসব রিপোর্ট ভয়ঙ্কর নির্যাতনপদ্ধতির কথা ফাঁস করে দিচ্ছে।

স্বয়ং সরকারী ভাষ্যে স্বীকৃতি চলে এসেছে যে, বিএসএফ যাদেরকে সন্দেহ করে গ্রেফতার করেছে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে এবং বন্দীদেরকে নিজের কাটা মাংস খেতে বাধ্য করেছে। গার্ডিয়ান এরকম নির্যাতনের শিকার এক ব্যক্তিকে খুঁজে পেয়েছে। মেষপালক এই ব্যক্তির নাম কালান্দার খাতানা, বয়স ৪৫। ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিনি চলেন। তার পা ব্যান্ডেজে বাঁধা।

তার দুটো পা-ই কেটে ফেলতে হবে। তিনি জানালেন, ‘আমাকে ঝুলিয়ে রাখা হলো। বিএসএফের এক সৈন্যকে একটা ছুরি দেয়া হলো। শরীর থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ’ তার ফাইলে দেখা যায়, এক সরকারী তদন্তকারী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন এবং সাক্ষী সরবরাহ করেছেন।

নাসির শেখ নামে গ্রামের আরেক বাসিন্দা, যিনি তার দুটো পা এবং হাত হারিয়েছেন, তিনি বললেন, ‘দুর্গন্ধগুলো ছিলো মৃত্যুর। পেশাব, পায়খানা এবং ঘামের গন্ধ। আপনি জানেন যে আপনাকে ধীরে ধীরে খুন করে ফেলা হবে। এটা হলো আপনাকে এমন কোনো কুয়ায় নিক্ষেপ করা, যেখানে আপনার চিৎকার কেউ শুনবে না। ’ তার ফাইলেও দেখা গেলো, ঘটনা সত্য এবং তাকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।

১৯৯৩ সালে নির্যাতন বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের দূতকে কাশমিরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। গণতান্ত্রিক শাসন বেআইনী নির্যাতনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইমরোজ প্রশ্ন করেন, ‘সিরিয়ার মতো ভারতকেও বিশ্ব কখন কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করবে? না কি আমরা কাশমিরীরা অলক্ষ্যেই থেকে যাবো?’ [গার্ডিয়ান থেকে] পাদটীকা কাঁটাতার তো সবাই চেনেন। Razor Wire-এর অনুবাদ করেছি ক্ষুরতার। তারের সাথে একটু পরপর ধারালো ব্লেড লাগানো থাকে এই ক্ষুরতারে।

ছবিটি দেখে আশা করি ধারণা পরিষ্কার হবে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.