আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশ থেকে দুর্ভিক্ষের চির বিদায়-------ড. নিয়াজ পাশা

বাংলায় কথা বলি,বাংলায় লিখন লিখি, বাংলায় চিন্তা করি, বাংলায় স্বপ্ন দেখি। আমার অস্তিত্ব জুড়ে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ। বাংলাদেশ একটি অমিত সম্ভাবনার, সাহসী, সংগ্রামী ও পরিশ্রমী মানুষের দেশ। সাফল্য আমাদের অনেক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন তারমধ্যে অন্যতম।

ক্রিকেটে অর্জন, শিক্ষা, নারীর মতায়ণ, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় ও গৌরবোজ্জল সাফল্যতা রয়েছে। সামপ্রতিক সমুদ্র ও এভারেষ্ট বিজয় আমাদের উজ্জিবিত করেছে। অতীতে আমরা এ দেশ থেকে গুটি বসন্ত কে নির্মূল করেছি, পোলিও মুক্ত বাংলাদেশ গড়েছি, মঙ্গাকে আমরা বিদায় দিয়ে ডিকশনারিতে পাঠিয়ে দিয়েছি। ক্ষুধা মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে দুর্ভি কে চিরতরে বিদায়ের, শবযাত্রার সকল আয়োজন সুসম্পন্ন হয়েছে। আমাদের ধান/শস্য উৎপাদন ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, আর কখনো এদেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করবে না, দুর্ভিক্ষ আর ফিরে আসবে না।

অচিরেই আমরা একে যাদুঘরে পাঠিয়ে দিতে সম হবো, ইনশাল্লাহ্ । এক সময়ের খাদ্য আমদানির দেশ থেকে খাদ্য রপ্তানী দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। এক ঝাক টগবগে তরুণের দেশ বাংলাদেশ, জ্ঞানে, গরিমায়, বুদ্ধিতে যাঁরা পৃথিবীর অন্য যে কোন উন্নত দেশের সমতুল্য। কোন বাধাঁয় যাঁদের দমিয়ে রাখতে পারবে না, পারে না। জয় আমাদের সুনিশ্চিত।

এ দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রমী, আত্নপ্রত্যয়ী, দৃঢ় চেতা ও অসাধ্য সাধন কারি দলের প্রতিভু, বাস্তব উদাহরণ ও মডেল। বিভিন্ন ঘটনায়, বিপর্যয়ে, সংগ্রামে ও দেশ গঠনে তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে সব সমস্যার মোকাবেলা করেছে। সোনা ফলা এ দেশের সম্পদ লুন্টনে বর্গি, মগ, মারাটা, ফিরিঙ্গি, ইংরেজ সকল দস্যুর আক্রমণ তাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছে। ণিকের জন্য কৌশলগত কারণে পিছপা হলেও পরণে তা ভন্ডুল করে দিয়েছে। শুধু মানব সৃষ্ট বিপর্যয়ে নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাংলার শার্দুলরা সাফল্যের সাথে আয়ত্বে এনে অভাবনীয় ও অন্য দেশের জন্য অনুকরণীয় সফলতার পরিচয় দিয়েছে।

ফিনিশ পাখির মতো তাঁরা বার বার জেগে উঠেছে। ধবংস স্তুপের মাঝেও তাঁরা হেঁসেছে পুস্পের হাসি। বহুমূখী লুন্টন, অবহেলা, শোষণ আর প্রাকুতিক দুর্যোগ- বন্যা, খরা ও রোগবালাই এর আক্রমনে ফসল হয়েছে বিপর্যস্থ। মাটি খুড়ে কষ্টের ধন, সোনা ফলানো ফসল হারিয়ে তাঁরা তির সম্মুখিন হয়েছে। সে সাথে ভাল বীজ, জাত, পৃষ্টপেষকতা, পরামর্শ ও প্রযুক্তির অভাবে ফলন হতো অনেক কম।

সেচ ও কর্ষণ যন্ত্রের অভাবে অনেক জমি থাকতো পতিত। জমি থেকে শুধু আহরণই করা হতো, জমিতে খাদ্য সরবরাহ করা হতো না ঠিক মতো। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করলেও তাঁরা আশানুরূপ ফসল পেতো না। ফল স্রুতিতে অভাব, অনটন ও খাদ্যাভাব ছিল নিত্য ঘটনা। রাজনৈতিক কুটকৌশলের কারণে খাদ্য অস্ত্র প্রয়োগ, যুদ্ধাবস্থা, মজুদদারী, কালো বাজারি, অসম বণ্টন ব্যবস্থা ও অতি মুনাফা লোভীর কারণে এ অভাব দুর্ভিক্ষের রূপ নিতো।

আমার কৃষকের স্বাস্থ্য কেড়ে নিতো মহাজন আর বেনিয়াদের কাঁচা পয়সা; রোগবালাই, অপুষ্টি, অনাহারে মানুষের কষ্ট বেড়ে যেতো হাজার গুণ; ঘটতো অকাল ও অনাঙ্খাখিত মৃত্যু। সারাদিন একবেলা, আধাবেলা, না খাওয়া, অখাদ্য-কৃখাদ্য খেয়ে রোগবালাই এ ভোগা ছিল তাঁদের সাথী। হাড্ডিসার, নিংটি পরা উদোম দেহই বলে দিতো তাঁদের অভাবের কথা। অতীতে সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও গভীর মনোযোগের অভাব, অবজ্ঞা, প্রায়োগিক প্রযুক্তির অভাব এবং উদাসিনতায় কৃষি তার পূর্ণ উৎপাদনশীলতা প্রদর্শন করতে পারে নাই। স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তি বিধ্বস্থাবস্থা, ’৭৪ এর মহা প্লাবন এবং আন্তর্জাতিক খাদ্য অস্ত্রের কারণে দুর্ভিরে পর বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন।

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আত্ন মর্যাদাশীল জাতি হিসাবে বাচঁতে হলে নিজস্ব খাদ্যে উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ছাড়া আমাদের অন্য কোন বিকল্প নাই। পরমূখাপেক্ষি জাতির নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না। এক ইঞ্চি জমিও পতিত না রাখার তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে জীবনে প্রথম বারের মতো উফশি ধান চাষে অংশ নেই। বিএডিসি’র সেচ পাম্পের জন্য আবেদন লিখে দেয়া আমাদের নিত্য কাজ ছিল। যে মাঠে/হাওরে/বাতানে আমরা হাজার হাজার গরু চড়িয়েছি, সে মাঠে, ঐ সময় হাওর এলাকায় হাজার হাজার হেক্টর পতিত জমি প্রথমবারের মতো সেচের মাধ্যমে উফশী ধান চাষাধীনে আনা হয়।

সার, কীটনাশক ও বীজের সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত । বিমান থেকে কীটনাশক স্প্রে করা হতো। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে উন্নত প্রযুক্তি ও অধিক ফলনশীল বীজ উদ্ভাবণের যাত্রা শুরু করেন। নদীগুলো খননের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর পদ মর্যাদা প্রদাণ, অন্যান্য বাস্তবমূখী পদপে ও উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কৃষিকে তার যথাযথ গুরুত্বে আসীন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সোপানে উত্তরণ ঘটান।

তাঁরই পথ ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ১৯৯৬ সালে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। এ জন্য সম্মান জনক ’সেরেস পুরষ্কার’ এ ভুষিত হন । এ বার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম কেবিনেট মিটিংএ সারের দাম অর্ধেকের চেয়েও বেশী কমিয়ে আনেন। ল্য ২০১৩ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জণ। কৃষির প্রতি এত দরদ ও গুরুত্ব এর আগে কোন সরকার দেয় নাই।

তত্ত্বাবধায়ক আমলের-’শুধু টাকা থাকলেই খাদ্য কিনতে পাওয়া যায় না’, এ অভিজ্ঞতা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ’জেদ’কে তেজ দিয়ে কার্যক্রমকে বেগবান করেন-তিনি। স্বয়ংসম্পূর্ণতার ল্য অর্জনে অনমণীয়, দৃঢ় চেতা ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী অনেকের বাঁধা উক্ষো করে সেদিন হাইব্রিড ধানের বীজ আমদানি ও চাষের উদ্যোগ আজ হাতে নাতে ফল দিয়েছে। এখানেই ভবিষ্যৎ স্বপ্নদ্রষ্টা ও কান্ডারি নেতার মহত্ব। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঠিক সিদ্ধান্তই জাতিকে সাফল্যের চূড়াই নিয়ে যায়। এ সরকারের আমলে ’মানুষ সারের পিছনে নয়, মানুষের পিছনে সার ঘুরবে’ , নন-ইউরিয়ার দাম কমিয়ে সুষম সার ব্যবহারে উদ্ধুদ্ধকরণের মাধ্যমে অধিক ফলন নিশ্চিত করা, সেচে ভূর্তুকি প্রদাণ, ভুর্তকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, শহরে কমিয়ে সেচের জন্য নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করা, ১০ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার মাধ্যমে কৃষি ঋৃণসহ যাবতীয় সহায়তা গ্রহণ, সকল প্রকার উপকরণ প্রাপ্তি কার্ডের প্রবর্তন করা হয়েছে।

বিএডিসি কর্তৃক মান সম্পন্ন পর্যাপ্ত বীজ সরবরাহ করা হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে ই-তথ্য সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কৃষির বিভিন্ন তথ্য কৃষকের দোর গোড়ায় পৌছে দেয়া হয়েছে। ফল স্রুতিতে পরপর তিন বছর বাম্পার ফলন হয়েছে। গত ১৩ জুন, ’১২ ইং, জাতীয় সংসদে মানণীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা চালে স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জনের যুগান্তরকারি আতœ প্রত্যয়ী ঘোষণা দেন। যা, তাঁর সরকারের কৃষির প্রতি ল্য অর্জনের অতি যতেœরই ফল।

ধানই ধন, এত ধান হয়েছে যে, সর্বত্র ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা। তাঁর সরকারের উপর আল্লাহর এ অশেষ রহমত । কিন্তু কৃষক তাঁর ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। অধিক ফলনের আনন্দ, ধানের কম মূল্যের সংবাদে হরষে বিষাদে পরিণত হয়। খোদার এ আর্শিবাদ, দাম না পাওয়া তিগ্রস্থ মজলুম কৃষকের হাহাকারে অভিশাপে পরিণত হওয়ার আগেই ভুর্তকি দিয়ে হলেও ধান কেনা উচিত।

কৃষি ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষিত জনবল ও বিনিয়োগ এগিয়ে এসেছে। এদের ধরে রাখতে হবে। ’কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু পুরস্কার’ নামে জাতীয় পর্যায়ে একটি পুরষ্কার থাকলেও এর নেই তেমন প্রচার, প্রচারণা। অন্য জাতীয় পদক প্রাপ্তগণ সর্বত্র যে সম্মান, মর্যাদা পান, কৃষি ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রাপ্তগণ তা পান না। আমাদের এর মনে রাখতে হবে, ষড় ঋতুর দেশের মানুষ আমরা, যেখানে প্রতি দুই মাস অন্তর আকাশের রঙ বদলায়।

তাঁদের আনন্দে আমি হাসি, দুঃখে কাঁদি এবং তিতে, অসনী সংকেতে আমি শংকিত ও উদ্বিগ্ন হই। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ ফেরার পর প্রথম বত্তৃতায় বলেছিলেন,”... কবি গুরু দেখে যাও, তোমার বাঙালি মানুষ হয়েছে। ” আমি বলি ”বঙ্গবন্ধু দেখে যাও, তোমার দেশ এখন আর তথাকথিত তাচ্ছিল্যপূর্ণ উক্তি ’তলা বিহিন ঝুড়ি নয়’; খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ, আত্ন প্রত্যয়ী উদীয়মান ব্যাঘ্র। ” এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে কৃষি বিজ্ঞানীদের আলাদিণের চেরাগ সম উন্নত, অধিক ফলনশীল বিভিন্ন জাতের ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবণ। দেশের ১১ টি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় এক হাজার ছয় শত কৃষি বিজ্ঞানী, যাঁদের অধিকাংশই উচ্চ শিতি-প্রশিণপ্রাপ্ত কর্তৃক বিভিন্ন ফসলের প্রায় ৫ শতাধিক অধিক ফলনশীল জাত উদ্ভাবণ করেছে।

এর সাথে রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নবেদিত প্রাণ ২৪ হাজারেরও অধিক কৃষি কর্মকর্তা/কর্মী, যাঁদের তত্ত্বাবধানে কৃষি বীজ ও প্র“যুক্তি আনাচে কানাচে ছড়িয়ে উৎপাদন ব্যবস্থাকে বেগবান করেছে। প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে উফশী ধানের ৭০, হাইব্রিড-৪, গমের-২৭টি, আলুর-৩০টি, আখের-৪০টি, পাটের-৪২টি, সব্জির ৬৫টি, ফলের-১২৭টি, তেলের-৩৬, ডালের-২৭টি জাত উদ্ভাবণ করেছে। প্রতিষ্ঠানিক হিসাবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনাস্টটিউট-৩০৫ টি, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনাস্টটিউট-৬১টি, বাংলাদেশ পরমাণ কৃষি গবেষণা ইনাস্টটিউট-৫৭ টি, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনাস্টটিউট-৩৬ টি জাত উদ্ভাবণ করেছে। নন-কমোডিটি প্রযুক্তির সংখ্যা হবে হাজারেরও অধিক। মিডিয়ার ভূমিকা এখানে অনুঘটকের, অনস্বীকার্য ।

মাটি ও মানুষের শাইখ সিরাজ, জীবন্ত কিংবদন্তি, কৃষি মিডিয়ার আত্ন নিবেদিত প্রাণ , রোল মডেল বা বাংলাদেশ বেতারের ’মজিদের মা’র আসর’ কৃষিকে সমৃদ্ধ করেছে। ২০০৭ সালের পর থেকে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া কৃষিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনাস্টটিউট, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনাস্টটিউট, বাংলাদেশ প্রাণীসম্পদ গবেষণা ইনাস্টটিউট, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনাস্টটিউট, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনাস্টটিউট, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ণ ইনস্টিটিউট স্ব স্ব ক্ষেত্রে গবেষণায় গৌরবোজ্জল সাফল্য রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ছাতাসম ছায়া দিয়ে গবেষণার সমস্বয় করছে। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এ ক্ষেত্রে কাজ করছে।

স্বাধীনতার পর আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ। মাথা পিছূ ১৫ (পনের) শতাংশেরও কম চাষাবাদযোগ জমি হতে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। সবই গবেষণা ও সম্প্রসারণের ফসল। এ দেশে দৃশ্যমাণ গবেষণা যদি কিছু হয়ে থাকে, সেটা হয়েছে কৃষি ক্ষেত্রে। এক ঝাক তরুণ প্রজন্মের বাংলাদেশ, যাঁরা জ্ঞানে গুণে গরিমায় কোন অংশেই কম নয়।

প্রযুক্তি পরিবর্তন ঘটায়। নতুন একটা প্রযুক্তি বা জাত ব্যবহার করে তাঁরা জাতির অবস্থা পাল্টিয়ে দিতে পারে, দিয়েছেও বটে । বিনাধান-৭, ব্রিধান-৩৩ উত্তর বঙ্গের গরীবী চেহারাটা আমূল পাল্টিয়ে মঙ্গাকে যাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। ব্রিধান-২৯ এর অধিক ফলনশীলতা সারা দেশের কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। দেশের অন্য কোন উন্নয়ন/ সফলতা/অর্জনের সাথে এর তুলনা করবেন??? কিন্তু কৃষি বিজ্ঞানীদের আপদে, বিপদে সাহয্যের জন্য অদ্যাবদি সরকারি কোন কল্যাণ তহবিল গঠিত হয় না।

ব্রিধান-২৯ এর অধিক ফলনশীলতার জন্য এক বছরের অতিরিক্ত উৎপাদিত ধান দিয়ে পদ্মা সেতু বানাতে ক’বছর লাগবে ? মানুষের আয় , উৎপাদন বেড়েছে, বেড়েছে আয়ুও। বিজ্ঞানী এ. পি. জে. আবুল কালাম পরমাণু বোমা বানালে ভারত তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে সম্মানিত করে, খাদ্য বোমা বানানোর কারিগরদের সাথে আমরা কি করি ? যে জাতি বীরকে সম্মান দেয় না, সে জাতির মধ্যে বীরের জন্ম হয় না। আমার মনের জিজ্ঞাসা, বাংলা কি কখনো খাদ্যে স্বয়ংস্পূর্ণ ছিল ? শায়েস্তা খাঁ’র আমলে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেতো, তখনো কি সবার জন্য খাদ্য পাপ্তি নিশ্চিত ছিল ? বার ভূইয়াদের সময়কাল ছাড়া বাঙালিরা কি কখনো স্বশাসিত ছিল ? বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই ’৭১ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা গত টার্মে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণা অর্জন করেছিলাম, এবার প্রথম দিকেই মঙ্গা নিরসন করা হয়েছে । উচ্চাভিলাশ না থাকলে উচ্চাশনে আসীন হওয়া যায় না।

জাতিকে তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ; ভিশন ২০২১, মধ্য আয়ের ক্ষুধামুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ার ভিশণ ও মিশণের স্বপ্ন দেখান। এখন তাঁর সুদ দিক নির্দেশনায় দুর্ভিকে চিরতরে বিদায় দেয়ার আয়োজন চলছে, ইনশাল্লাহ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অভাবকে ’মঙ্গা’, ’চৈত লাগা’, বা ’কাইতাইন্না’ বলে অভিহিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু কণ্যা শেখ হাসিনার নিবিড় নজরদারিতে এগুলো আজ ডিকশনারিতে স্থান নিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. সাইদুল ইসলাম বলেন, ’গুটি বসন্তকে আমরা বাংলার মাটি থেকে নির্মূল করেছি।

তেমনিভাবে দুর্ভিকেও আমরা চিরতরে নির্বাসনে পাঠাতে সম হবো; বাংলায় আর কখনো দুর্ভি হবে না, ইনশাল্লাহ। ’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ধান চাষকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, এখন প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর ধান কাটা হচ্ছে। একটা ফসল নষ্ট হলেও পরবর্তি ধান আবাদ বৃদ্ধির মাধ্যমে তা পুষিয়ে নেয়া যাবে। কৃষি গবেষণার উৎকৃষ্টতার ফলে এখন সারা বছরই ক্ষেতে কোন না কোন ফসল থাকছে, কাটা হচ্ছে। বহুমূখী ও সারা বছর ব্যাপী বিভিন্ন খাদ্যমান সম্পন্ন ফসল উৎপাদন হওয়ায় মানুষের পুষ্টি চাহিদা অনেকাংশেই মিটিয়ে, রোগ প্রতিরোধক মতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এমতাবস্থায়, একজন কৃষিবিদ হিসাবে আমি অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের সাথে গাইতে পারি, দুর্ভি তোমায় এবার দিলাম ছুটি। বাংলাদেশের মানুষ এখন আর না খেয়ে থাকে না, পেট ভরে খেতে পারছে। খাদ্যাভাবে একজন মানুষও মারা যাচ্ছে না, বাংলার জন্য এ কত বড় অর্জন, ভেবে দেখেছেন কি ? একজন শ্রমিক তাঁর একদিনের মজুরী দিয়ে ১০-১২ কেজি চাল কিনতে পারে, বাংলার ইতিহাসে এ অবস্থা কখনো ছিল না। মানুষের আয় ও স্বমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রুচি ও খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ঘটেছে।

খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার কারিগর হচ্ছেন আমাদের কৃষি বিজ্ঞানী/কৃষিবিদ, কৃষক ও কৃষি কর্মী। যশোরের আয়ুব হোসেন এর মতো নিঃস্বর্থ কৃষক সংগঠকগণই আমাদের সম্পদ। কিšত্ত আপনারা কি মঙ্গা খেকো ’বিনাধান-৭’ এর উদ্ভাবক বিজ্ঞানী ড. আলী আযম, পানির নীচেও বেচেঁ থাকা উপযোগী ’ ব্রিধান-৫২, এর বিজ্ঞানী ড. ইফতেখার, লবণ সহিঞ্চু বিনাধান-৮, ৯ এর বিজ্ঞানী ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম অপু বা বাসমতির চেয়েও ভাল গুণ সম্পন্ন ব্রিধান-৫০ বা বাংলামতি ধানের বিজ্ঞানী ড. তমাল লতার মতো জাতীয় বীরদের নাম শুনেছেন ? শুনেন নাই। এ আমাদের দৈন্যতা। কারণ, এঁদের উপর কখনো ফোকাস করা হয় না।

বলা হয়, এ গুলো তো প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন। সত্যি ! তারপরও যেকোন অর্জনের পিছনে ব্যক্তি/টীমের নিষ্টা, পরিশ্রম ও ত্যাগ রয়েছে। রাষ্ট্র, মিডিয়া বা প্রতিষ্ঠান বিষয়টা এড়িয়ে/ গুরুত্ব বা প্রাণোদণা দিচ্ছে না। সমুদ্র বিজয় আর এভারেষ্ট বিজয়ের চেয়ে দুর্ভি বিজয় কম কিসে ??? কিন্তু আমরা কি আমাদের এ বিজয়ের নায়কদের তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিয়েছি ? এ নিয়ে নেই তেমন কোন মাথামাথি। টেলিভিশনে তাঁদের নিয়ে বিশেষ আলোচনা বা এখানে সেখানে সম্মাননা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় না।

তাঁরা জাতিকে আত্নসম্মান, মর্যাদাশীল জাতি ও স্বপায়ে দাড়াঁনোর স্বকীয়তা দিলেও গাড়ি, বাড়ি বা নগদ অর্থের ঘোষণা তাদেঁর জন্য হয় না। সম্মান, মর্যাদা বা একটু প্রশংসা তাঁদের কাজের গতিকে বাড়িয়ে দেবে শত গুণ। কৃষি, কৃষিবিদ আর কৃষক এখনো অবহেলার পাত্রই রয়ে গেছে ! কৃষিকে উপো করে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় রাখা সহজ কাজ নয়। তবে কেন এ আত্নঘাতী অবহেলা ? জনসংখ্যা বৃদ্ধি, চাষাবাদ যোগ্য জমি কমে যাওয়া, কৃষি গবেষণা, খাদ্য উৎপাদন ও দুর্ভি দূরীকরণ কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। একটির সাথে অপরটির বৈপরিত্য-সাংঘর্ষিক সর্ম্পক।

সমন্বয় অপরিহার্য, বিচ্যুতিতে মহাবিপদ। প্রতিস্রুত ’এনাম’ না পেলেও মহা কবি ফেরদৌসীর মতো মহা কাব্য ’শাহনামা’ রচনায় তাঁরা থেমে নাই। একটি ঘটনা বলেই আজকের নিবন্ধ শেষ করবো। দেশের কোন কোন অঞ্চলে, আগে, শ্বাশুড়ীরা তাঁদেরদর পুত্র বধূদের পিঁড়িতে বসে খেতে দিতো না, বেশী পরিমাণে খাবে বলে। আমি আমার মা কে বলি, তুমি তোমার শ্বাশুড়ীর মতো ব্যবহার করো না, তোমার পুত্র বধূকে ভালটা, বেশী পরিমাণে খেতে দাও।

কারণ, তাঁদের গর্ভেই তোমার ভবিষ্যৎ বংশধর জস্ম নিবে। সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান মা’রা ই সবল ও মেধাবী সন্তান জন্ম দিতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। কারণ, তারাঁই তো নিরাপত্তার পাহারাদার। --------------------------------------------- ড. নিয়াজ পাশা, সার্ক কৃষি কেন্দ্র, বিএআরসি ক্যাম্পাস, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫।

মুঠোফোন- ০১৭২৭ ০৭৪ ৫৮৪; ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.