বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসের আলোকে সুফিবাদ- এর পর্যালোচনা করছি। গত পর্বে আমরা দেখেছি ১১৯২ সনে সংঘটিত তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুহম্মদ ঘুরীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম সৈন্যবাহিনীর কাছে রাজা পৃথ্বীরাজ পরাজিত ও নিহত হন। এরপর উত্তর-ভারত তুর্কি মুসলিমদের অধিকারে চয়ে যায়;এভাবে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের গোড়া পত্তন হয়।
কাজেই তরাইনের ২য় যুদ্ধটি ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তরাইনের ২য় যুদ্ধের পর মুহম্মদ ঘুরী গজনীতে ফিরে যান। কিন্তু তার আগে তিনি তাঁর সুদক্ষ সেনাপতি কুতুবউদ্দীন আইবক কে উত্তর ভারতের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। পরবর্তীকালে বঙ্গবিজয়ী ইখতিয়ারউদ্দীন মহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী কুতুবউদ্দীন আইবক-এর সুনজরে পড়েছিলেন। ইখতিয়ারউদ্দীন মহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী জাতিতে তুর্কি ছিলেন।
তাঁর জন্ম হয়েছিল আফগানিস্থানের গরমসীর (বর্তমান দশত-ই-মার্গ) প্রদেশে। বখতিয়ার খলজী দিল্লির শাসনকর্তা কুতুবউদ্দীন আইবক -এর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন ‘এবং বিশেষভাবে খলজী সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে তিনি একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন। ’ (ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান। বাংলার ইতিহাস (১২০৪-১৭৬৫); পৃষ্ঠা; ৭৫) এই সৈন্যবাহিনী নিয়ে বখতিয়ার খলজী গৌড় আক্রমন করেছিলেন। গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, ‘বখতিয়ার খিলজি যে -মুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন, তাতে সংস্কৃতে লিখেছিলেন,‘গৌড় বিজয়।
’ (হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি;পৃষ্ঠা; ১৯) সে যাই হোক। গৌড় বিজয় বাংলায় ইসলাম তথা সুফিবাদ প্রচারের পথটি প্রশস্ত করেছিল। যে কারণে ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে মুসলিম বিজয় ইসলাম সম্প্রসারণে সহায়ক হয়। অবশ্য মুসলিম সৈন্যগণ ধর্মপ্রচার করেননি। বস্তুত মুসলিম বিজয়ের পূর্বেই বহু সুফি-সাধক বাংলাদেশে আগমন করেন।
তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বখতিয়ার খলজীর বঙ্গ বিজয়ের ফলে ধর্ম ও সংস্কৃতি হিসেবে ইসলাম সুদূরপ্রসারী হয়। (বাংলার ইতিহাস; ১২০৪-১৭৬৫; পৃষ্ঠা; ৭৮)
তবে এই পর্বে আমরা বাংলায় সুফিবাদের বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করব না। তার কারণ হল উত্তর ভারতের সুফিদের সঙ্গে বাংলার সুফিদের সর্ম্পক অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিল। ড.মুহম্মদ এনামুল হক তাঁর ‘বঙ্গে স্বূফী প্রভাব’ বইয়ে লিখেছেন: ‘উত্তর ভারতের সুফিদের সঙ্গে বাংলার সুফিদের সর্ম্পক যত ঘনিষ্ট, ভারতের আর কোন প্রদেশের স্বূফীদের সহিত ততটা নহে। ভারতের বাহির হইতে উত্তর ভারতে যেমন স্বূফীরা আগমন করিয়াছিলেন, বঙ্গদেশেও যে তেমনই আসেন নাই তাহা নহে।
তবে, তাঁহাদের সংখ্যা এতই নগন্য যে, আপাততঃ তাঁহাদের কথা ছাড়িয়া দেওয়া যাউক। ’ (পৃষ্ঠা;৩৭) আসলে পারসিক-তুর্কি-আফগান সুফিরা প্রথমে উত্তর ভারতে এসে উত্তর ভারতের সুফিসমাজে কিছুকাল অবস্থান করে তারপর বাংলায় যেতেন। এসব কারণে উত্তর ভারতের সুফিদের সঙ্গে বাংলার সুফিদের সর্ম্পক কেবল অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলই না, উত্তর ভারতের সফি বৈশিষ্ট্যের প্রভাব অনিবার্য ভাবেই বাংলার সুফিবাদের ওপর পড়েছিল। কাজেই বাংলার সুফিবাদের বৈশিষ্ট্য এবং স্বরূপ উপলব্দি করতে হলে আমাদের উত্তর ভারতের সুফিবাদের বৈশিষ্ট্য এবং স্বরূপ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানা দরকার।
তৃতীয় পর্বে আমরা দেখেছি যে, আনুমানিক খ্রিস্টীয় একাদশ শতক থেকে ভারতবর্ষে সুফিদের প্রভাব পড়তে থাকে।
তখন থেকেই ভরতবর্ষজুড়ে ভ্রাম্যমান সুফিদের দেখতে পাওয়া যায় । যদিও তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই অল্প। ভারতবর্ষে সুফিবাদ প্রচারের প্রথম যুগে সুফিবাদ অবশ্য জনসাধারণের কাছে সেভাবে গ্রহনযোগ্য হয়নি ঠিকই তবে ভারতীয় জনগণ এই মতবাদের সর্ম্পকে সচেতন হয়েছিল। কাজেই বলা যায় প্রাথমিক যুগের সুফিসাধকগণ যে মরমি বীজ বপন করেছিলেন তা দেরি হলেও আধ্যাত্বিক নবান্নের সুস্বাদ লাভ করেছিল। তাদের উত্তরসূরিরা সমৃদ্ধশালী হয়েছিল।
ত্রয়োদশ হইতে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অর্থাৎ দুশো বছরে চিশতীয়া এবং সুরওয়ার্দী সম্প্রদায় দুটি ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ভারতবর্ষের জনগণ কাছে সমাদর লাভ করে। সুতরাং, ভারতবর্ষের মাটিতে এই সম্প্রদায়গুলির ভাবধারা একটা শক্ত ভিত্তি পায়। এর পিছনে সক্রিয় ছিল এই সম্প্রদায়ের সুফিদের ঐকান্তিক মরমি সাধনা। অসম সাহসী তুর্কি বীর যা করতে পারেনি নিঃস্ব সুফিসাধকগণ তাই করতে পেরেছিলেন; তারা ভারতীয় জনগণের মন জয় করতে পেরেছিলেন। ষোড়শ শতকে ভারতবর্ষজুড়ে ছিল চিশতীয়া এবং সুরওয়ার্দী সম্প্রদায়ের জয়জয়াকার।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কাদেরিয়া এবং নকশাবন্দিয়াসহ আরাও কয়েকটি সম্প্রদায়ের প্রবল উচ্ছ্বাস।
তবে এটিও সত্যি যে-ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ধর্মীয় আবহের কারণেই সুফি তরিকাগুলি (সম্প্রদায়) অনেকখানিই ‘ভারতীয় ভাবাপন্ন’ হয়ে পড়েছিল। এর ফলাফল অবশ্য বিস্ময়করই হয়েছিল। ‘ভারতের প্রাণের সহিত আরব ও পারস্যের প্রাণের ত্রিবেণী -সঙ্গম ঘটিয়া গেল’-লিখেছেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক (বঙ্গে স্বূফী প্রভাব। পৃষ্ঠা; ৪২)
এই তিনটি ধারা যিনি হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন তাঁর নাম কবীর (১৩৯৮-১৪৪৮খ্রিস্টাব্দ)
কবীর ভারতীয় যোগসাধনা এবং সুফিবাদের মিলনমেলায় পরিনত হয়েছিলেন।
ভারতীয় সুফিগণ কবীর-এর মধ্যে ভারতীয় বেদান্ত দর্শন এবং ভারতীয় সাধকগণ কবীর-এর মধ্যে সুফিবাদের মূলতত্ত্ব দেখতে পেয়েছিল। এই কারণে ভারতে সুফিবাদের ইতিহাসে কবীর-এর স্থান অনন্য। কবীর মূলত সাধক রামানন্দের শিষ্য বলে পরিচিত হলেও বস্তুত কবীর ছিলেন চিশতিয়া তরিকাভুক্ত একজন সাধক । রামানন্দ এবং শায়খ তকী সুরওয়ার্দি উভয়ই তাঁর মুরশিদ (গুরু) ছিলেন। কবীর হিন্দি ভাষার মাধ্যমে গুরু রামানন্দের কাছ থেকে বেদ-বেদান্ত শিক্ষালাভ করেছিলেন, পাশাপাশি শায়খ তকী সুরওয়ার্দি কাছ থেকে সুফিতত্ত্বের মূলবাণী সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ ধারণা লাভ কিেছলে।
এর পর কবীর শায়খ ভিকা চিশতির কাছে ‘খিরকাহ-ই-খিলাফত’ বা ‘আধ্যাত্ব উত্তরাধিকারী’ লাভ করে নতুন মন্ডলী (ঘরানা? ) প্রতিষ্ঠা করেন। কবীরই প্রথম ভারতীয় কোনও ভাষায় (হিন্দি ভাষায়) নিজস্ব ঢংয়ে সুফিমতবাদ প্রচার করেন। কবীর- এর প্রাণের সঙ্গে যে আরব ও পারস্যের প্রাণের ত্রিবেণী -সঙ্গম ঘটে গেল সেই ত্রিবেণী সঙ্গমে ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে আনন্দচিত্তে অবগাহন করল।
ড.মুহম্মদ এনামুল হক লিখেছেন, ‘তাঁহার (অর্থাৎ কবীর এর) দিগন্ত-বিস্তারী ভাবস্রোত ভারতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্তকে বিপ্লবিত করিয়া দিয়াছিল; বাঙ্গালা দেশ তাহার প্রভাব এড়াইতে পারিয়াছিল কি? ষোড়শ শতাব্দীর চৈতন্যদেবের ধর্মমতের মধ্যে কবীরের মতবাদের কোনও প্রতিধ্বনি নাই কি? (বঙ্গে স্বূফী প্রভাব; পৃষ্ঠা, ৪৩) এ কারণেই সম্ভবত আশির দশকে বিশিষ্ট ভারতীয় ভজনগায়ক অনুপ জালোটার গাওয়া কবির- এর একটি ভজন বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সেই গানের ছত্রে ছত্রে কবীর এর মরমি সুফি-উপলব্দির সূক্ষ্ম নিদর্শন স্পষ্ট।
গানটির এমপি থ্রি লিঙ্ক এবং গানের বাণী বোঝার সুবিধার জন্য রোমান হরফে হিন্দি টেক্সট এবং তার মূল ইংরেজি অনুবাদ দেওয়া হল।
http://www.mediafire.com/?hxtig7o3bftq485
http://kksongs.org/songs/c/chadariyajhini.html
আমরা ভারতীয় সুফিবাদের ইতিহাসে কবীর এর ভূমিকা সম্পর্কে জানলাম। এখন প্রশ্ন হল ঠিক কতগুলি সুফি-তরিকা ভারতবর্ষে সুফি মতবাদ প্রচার করেছিল। ভারতে সুফিবাদ প্রবেশ করার আগে সুফিদের মধ্যে অসংখ্য তরিকা উদ্ভব হয়েছিল। এর কারণ অবশ্য ছিল।
প্রথম দিককার আরবের সুফি আন্দোলন একেবারেই সংগঠিত ছিল না। কেননা, সুফিদের মরমিসাধনা ছিল একান্তই ব্যক্তিগত। সুফিরা নিজস্ব ধারণা অবলম্বন করে সাধনা করতেন। এই জন্যেই বিশিষ্ট সুফিদের সাধনপদ্ধতি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। কাজেই যে প্রসিদ্ধ সুফিকে কেন্দ্র করে যে মন্ডলী গঠিত হয়েছিল, সেটি প্রতিষ্ঠার নামেই পরিচিত হয়েছিল।
ভারতে এমনই কতগুলি সুফি মন্ডলী সুফিবাদ প্রচার করেছিল। তবে এই বিষয়ে তথ্যের অভাবে বিস্তারিত জানা যায় নি। এর এক কারণ হতে পারে প্রথমে বেশ কয়েকটি মন্ডলী প্রভাবশালী হলেও পরবর্তীকালে অন্যান্য মন্ডলী প্রভাবিত হয়ে উঠলে তারা বিস্তৃত হয়ে পড়ে ছিল। তবে সব মিলিয়ে চৌদ্দটি সুফি মন্ডলীর কথা জানা গেছে। এগুলি হল:
১ হবীবী - খাজা হাবীব আজমী (মৃত্যু ৭২৮ খ্রিস্টাব্দ)
২ ত্বয়ফরী -বায়োজীদ বোস্তামী ত্বয়ফর শামী (মৃত্যু ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ)
৩ করখী - মারূফ করখি (মৃত্যু ৮১৫ খ্রিস্টাব্দ)
৪ সক্বত্বী-হাসান সূরী সক্বত্বী (মৃত্যু ৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ)
৫ জুনয়দী- জুনয়দ বাগদাদী (মৃত্যু ৯১০ খ্রিস্টাব্দ)
৬ গাযরূনী- আবু ইসহাক গাযরূনী (মৃত্যু ১০৩৪ খ্রিস্টাব্দ)
৭ তূসী - আলাউদ্দীন তূসী (তারিখ অজ্ঞত)
৮ ফিরদৌসী - শায়খ নাজমুদ্দীন কুবরা ফিরদৌসী (মৃত্যু ১২২১ খ্রিস্টাব্দ)
৯ সুরওয়ার্দী - শায়খ দ্বিরাউদ্দীন আবু নজীব সুরওয়ার্দী (মৃত্যু ১১৬৭ খ্রিস্টাব্দ)
১০ যয়দী - শায়খ আবদুল বাহিদ বিন যয়দী (মৃত্যু ৭৩৪ খ্রিস্টাব্দ)
১১ অয়য়াদ্বী -খাজা ফুদ্বয় বিন অয়য়াদ্ব (মৃত্যু ৮০৩ খ্রিস্টাব্দ)
১২ অদহমী- খাজা ইব্রাহীম বিন অদহম বলখী (মৃত্যু ৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ)
১৩ হুবয়রী -খাজা হুবয়রতুল বসরী (মৃত্যু ৯০০ খ্রিস্টাব্দ)
১৪ চিশতী -আবু ইসহাক চিশতী (মৃত্যু ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ)
চলবে ...
প্রথম পর্বের লিঙ্ক
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।