আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলায় সুফিবাদ: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ আমার বাবা আলহাজ আলী/ যাঁর কাছে মারাফতের কলি ... Sufism is not concerned with knowledge. Its whole concern is love. Bhagwan Shree Rajneesh. ইসলামী সাম্যবাদে উজ্জীবিত হয়ে মধ্যযুগের বাংলার বর্ণবাদী হিন্দুর ভেদ-বিধিতে প্রচন্ড আঘাত হেনেছিলেন বাতেনি সুফিগণ। এরই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তৎকালীণ বাংলায় অবহেলিত অচ্ছুত মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছিল সুফিদের প্রতি প্রবল শুদ্ধা এবং ভক্তি। অন্যদিকে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজেও সুফিদের সাম্যবাদী দর্শনের প্রতিক্রিয়াও কম হয়নি ।

জাতপাতে বিভক্ত হিন্দুসমাজের অভ্যন্তর থেকে একটি সংস্কার আন্দোলন অনিবার্য হয়ে পড়ে। সেই সংস্কার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হয়ে উঠলেন শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৪) । ওই মহান বৈষ্ণবগুরুর সেই জাতবিরোধী মানবিক আন্দোলনের পিছনে সক্রিয় ছিল সুফিবাদী ধ্যানধারণা। বাঙালি সমাজের ওই মানবিক উত্তোরণের পর্বটিই বাংলার ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। যে কারণে আমরা সুফিবাদের উদ্ভব, স্বরূপ ও বাংলায় এই মরমী মতবাদটির প্রভাব সম্বন্ধে কৌতূহলী হতেই পারি।

আমরা জানি, ইসলামে খিলাফতের উত্তরাধিকার নিয়ে শিয়া এবং সুন্নীদের মধ্যে বিভেদ একটি বহুল আলোচিত বিষয়। সুন্নীরা খেলাফতের প্রশ্নে নির্বাচনের পক্ষে ছিল; পক্ষান্তরে শিয়ারা খিলাফতের উত্তরাধিকারী হিসেবে একমাত্র হজরত আলী (র)-র পরিবারকেই যোগ্য মনে করত । ইসলামের এই ভাঙনকালের অব্যবহিত পরে মুসলিম বিশ্বে কিছু ধর্মীয় তরিকার (সম্প্রদায়) উদ্ভব হয়েছিল। এদের মধ্যে সুফি সম্প্রদায়ের প্রভাব বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছিল। সুফি মতবাদের মূলে রয়েছে শিয়া মতবাদ।

শিয়া মতবাদের কেন্দ্রে রয়েছেন-হজরত আলী (র) আজও বাংলার একটি মারফতি গান এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয় - আমার বাবা আলহাজ আলী/ যাঁর কাছে মারাফাতের কলি ... সে যাই হোক। শিয়ারা, অর্থাৎ যে ধর্মীয় সম্প্রদায়টি থেকে সুফিমতবাদের উদ্ভব, তারা আরবদের সিন্ধ বিজয়ের সময়ই ভারতবর্ষে এসেছিল। এ কারণে শিয়ারা সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চলে শক্তিশালী ভিত গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিল। পরাক্রমশালী গজনির সুলতান মাহমুদ মুলতানে শিয়া শক্তি ধ্বংস করতেও উদ্যত হয়েও পারেননি । ইসলাম যখন ভারবর্ষে এল ... সে সময় তৎকালীন মুসলিম শাসকবর্গ অমুসলিম ভারতীয়দের কাছে একটি অভিন্ন এবং ঐক্যবদ্ধ ইসলাম উপস্থিত করতে চাইলেও - শিয়া-সুন্নীর বিভেদটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল।

ক্ষমতায় আসীন সুলতানগণ সুন্নী। সুন্নী উলেমাগন তাদের নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়। সুন্নী উলেমাগন শিয়াদের মতবাদকে বাতিল মনে করে। সে যাই হোক। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে তুর্কি শক্তির উত্থান শিয়া ক্ষমতার বলয়কে চূর্ন করে দেয়।

সুলতানা রাজিয়ার (১২০৫-১২৪০) সময় শিয়ারা বিদ্রোহ করে ব্যর্থ হয়। এরপর শিয়ারা আর সুন্নী শাসকবর্গকে চ্যালেঞ্জ করতে সমর্থ হয়নি। যদিও ভারতে সুন্নী শাসকদের প্রতি শিয়ামতবাদ থেকে উদ্ভূত সুফি মতবাদের চ্যালেঞ্জ দীর্ঘকাল অব্যাহত ছিল। নবম-দশম শতকের পারস্যের মুসলিম সমাজে সুফিবাদ এক নতুন ধর্মীয়-দার্শনিক মতবাদ রূপে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। সুফিদর্শনের পরিভাষা প্রতীকবহুল এবং নিগুঢ় হলেও এর মূলে ‘ইশক’ বা গভীর প্রেম থাকায় মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকে।

(হয়তো সাধারণ মানুষ conformist সুন্নী উলেমাদের ব্যাখ্যাবয়ানে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল!) ... যাক। ভারতীয় ধর্মগুরু Bhagwan Shree Rajneesh তাঁর The Secret Discourses on Sufism বইতে সুফিবাদের স্বরূপ সম্বন্ধে লিখেছেন: La Illaha Ill Allah ...there is no god but God. This is the fundamental essence of the way of the Sufis. This is the seed. Out of this seed has grown the Bodhi Tree of Sufism. ... Sufism is not concerned with knowledge. Its whole concern is love, intennse, passonste love; how to fall in love with the whole, how to bridge the distance between the creation and the creator. (page,7) একাদশ শতক থেকে সুফিরা তাঁদের ‍"ইলম আল তাসাউফ" অর্থাৎ সুফিমতাদর্শ নিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করতে থাকে। ভারতবর্ষের যে সুন্নী উলেমাদের প্রত্যক্ষ মদদে সুফিদের পূর্বপুরুষ শিয়াদের উৎখাত করা হয়েছিল এবার সেই কট্টরপন্থি সুন্নী ওলেমাদেরই কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হল সুফিদের । হয়তো অনেকটা এ কারণেই নির্জনতাপ্রিয় সুফিগণ মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার বলয় থেকে অনেক দূরে বসে নির্জনে ধ্যান এবং ধর্মপ্রচার করতেন। এই সময়ে সুফিবাদী ধ্যানধারণায় অনিবার্যভাবেই ভারতীয় দর্শনের প্রভাব পড়েছিল।

এর মধ্যে বেদান্ত ও যোগদর্শন উল্লেখযোগ্য। Bhagwan Shree Rajneesh -এর লেখায় এই প্রভাবের স্বরূপ পাওয়া যায়-There is no god but God. This statement makes God synonymous with existence. God is the very isness of all that is. God is not separate from his creation . The creator is in his creation; there is no duality, there is no distance, so whatsoever you come across is God. (The Secret Discourses on Sufism. page,7) সুফিবাদের ওপর আরও কিছু ভারতীয় জীবনধারার প্রভাব পড়েছিল। যেমন, ভারতবর্ষে গুরুশিষ্য পরম্পরার ঐতিহ্য বৈদিক যুগে উদ্ভূত। সুফিবাদের নানা তরিকায় শায়ক বা পীর এবং ফকির/দরবেশ লক্ষ করা যায়। বিশিষ্ট বেদান্ত দার্শনিক শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০) অদ্বৈতবাদ প্রচার করেছিলেন।

সে প্রভাবও সুফিধারায় পড়েছিল। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক Romila Thapar লিখেছেন, Shankara maintained that the world we see around us is an illusion (maya), for the reality lies beyond and cannot be perceived through existing human senses. Asceticism alone enables one to control these senses and direct them in a manner which permits of a glimpse of the Reality. (A History of India (vol.1) page,185) ভারতীয় দর্শনের প্রভাব ছাড়াও ভারতবর্ষে সুফিবাদ চিশতিয়া, সুহরাওয়ার্দি, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া, কলন্দরিয়া ইত্যাদি নানা তরিকায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে শরফউদ্দীন আলী কলন্দর প্রতিষ্ঠিত কলন্দরিয়া তরিকাটি অবশ্য চৌদ্দ শতকে বিকাশ লাভ করেছিল। নকশবন্দিয়া তরিকাও চতুর্দশ শতকে বিকাশ লাভ করে। নকশবন্দিয়া তরিকার প্রাণপুরুষ ছিলেন খাজা বাকিবিল্লাহ।

তবে ভারতবর্ষে চিশতিয়া তরিকাই সবচে জনপ্রিয় । আজও। চিশতিয়া তরিকার প্রধান ছিলেন খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (১১৪২-১২৩৬) । ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে ইনি ‘খাজাবাবা’ নামে পরিচিত। কথিত আছে, খাজা বাবা আজমীরের এক দরিদ্র কৃষকের ‘পিটিশন’ নিয়ে সুদীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে দিল্লীর সুলতানের দরবারে পৌঁছেছিলেন।

Sufism is not concerned with knowledge. Its whole concern is love. যা হোক। সুলতান শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া (১১৬৯-১২৬৬) ছিলেন সুহরাওয়ার্দি তরিকার পীর। সয়খ আবদুল কাদির জিলানী (১০৭৮-১১৬৮) ছিলেন কাদিরিয়া তরিকার পীর। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে ইনি বড়পীর নামে পরিচিত। বড়পীর আবদুল কাদির জিলানীর মাতৃভক্তি মধ্যযুগের মাতৃতান্ত্রিক বাঙালির হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল।

Sufism is not concerned with knowledge. Its whole concern is love. বাংলায় সুফিবাদ বিকাশ লাভ করার পিছনে এইসব সুফিসাধকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তেরো শতকের গোড়ায় মুসলিম শাসকগোষ্ঠী বাংলার শাসনদন্ডটি অধিকার করে। অবশ্য এরও একশ বছর আগে সুফিধারা বাংলায় প্রবেশ করেছিল । এ প্রসঙ্গে এ কে এম শাহনাওয়াজ লিখেছেন, ‘বাংলায় আগত সুফিদের মধ্যে শাহ সুলতান রুমীকে সর্বপ্রাচীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহে আসনে।

বর্তমান নেত্রকোনার মদনপুরে তাঁর সমাধি রয়েছে। কিংবদন্তি অনুযায়ী সমসাময়িক কোচ রাজা শাহ সুলতান রুমীর আধ্যাত্মিক শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহন করেন এবং । মদনপুর গ্রামটি তাঁকে দান করেন। (বাংলার সংস্কৃতি বাংলার সভ্যতা। পৃষ্ঠা,১১১) সুতরাং একাদশ শতকই বাংলায় মুসলিম সমাজ গঠনের প্রাথমিক প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল।

অবশ্য সমসাময়িক লিপিতাত্ত্বিক প্রমাণ না পাওয়ার কারণে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা সম্ভব নয়। একাদশ-দ্বাদশ শতকের বাংলায় সেন আমলে জাতপাতের কাঠিন্য বৌদ্ধদের ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কোণঠাসা করে ফেলেছিল। সুতরাং বাংলার সামাজিক ঐক্যে ফাটল ধরেছিল। এই বিভেদ বাংলায় সুফিদের আগমনের প্রথটি সুগম করেছিল। কিন্তু বাংলার জনগন কেন এত সহজে সুফিধারার প্রতি ঝুঁকেছিল? এর প্রথম কারণটি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

বর্ণবাদী সেন শাসকগোষ্ঠী দ্বারা সমাজের প্রান্তিক মানুষের শোষন ও বঞ্চনা। দ্বিতীয় কারণটি সুফিবাদের তত্ত্বীয় দর্শনেই নিহিত। স্রষ্টার প্রতি তীব্র ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষের আত্মিক উন্নতিই সুফিবাদের মূলকথা। সুফিবাদের পরম লক্ষ হল আল্লাহর সত্তায় নিজেকে লীন করে দেওয়া। এবং এই পথটি সামাজিক অনুশাসন মেনে নয়, বরং পথটি বিকল্পধারার পথ।

এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক Romila Thapar লিখেছেন, Some of the order(অর্থাৎ সুফি তরিকা) evolved a special ritual, often hypnotic in character, such as dancing until a state of trance is experienced. (A History of India (vol.1) page,306) এ কারণে বাংলার সাধারণ মানুষের সুন্নী উলেমাদের গুরুগম্ভীর বয়ানের চাইতে নৃত্যরত সুফিদের আকার্ষন ছিল বেশি। মনে রাখতে হবে ... বাংলাদেশ বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ। এে দেশে আশ্বিন মাসের ঢাকের আওয়াজে বাঙালির আদিম নিষাদ রক্তে টান ধরে ... তাছাড়া তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম এবং তান্ত্রিক বৈদিক ধারার প্রভাবে বাংলায় সুফিবাদও পরিবর্তিত হয়েছিল। সুফি মতবাদের ওপর শঙ্করাচার্যের প্রভাবের কথা আগেই বলা হয়েছে। ফলে, বাংলার মানুষ তাদের ঐতিহ্যগত শিক্ষার সঙ্গে সুফিদর্শনের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিল।

এসব কারণে সুফি মতবাদ বাংলার মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি চলে এসেছিল। এগারো শতক থেকেই সুফিবাদ বাংলার জনমানসে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। যা মধ্যযুগের বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ন ঘটনা। কাব্য ও সংগীতের সমঝদার মধ্যযুগের তান্ত্রিক বাঙালি সুফিবাদের প্রভাব এড়াতে পারেনি। এড়াতে চায়ও নি।

সুফিদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে- মধ্যযুগীয় বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে এরকম একটি বিশ্বাসের প্রচলন ছিল। প্রাচীন যুগের বাংলায় তন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। তন্ত্রমন্ত্রের প্রতি বাঙালির আকর্ষন সহজাত । মধ্যযুগের বাঙালি তার জাগতিক কল্যাণের আশায় সুফিদের অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। উত্তরবঙ্গে মুসলিম বিজয়ের পূর্বে অথবা এর পরপরই বাংলায় সুফি শাহ সুলতান মাহিসওয়ারের আগমন ঘটেছিল।

মহাস্থানগড়ে তাঁর সমাধি রয়েছে। এর আগে সেনযুগে বিক্রমপুরে এসেছিলেন বাবা আদম শহীদ। ১১১৯ খ্রিস্টাব্দে বল্লাল সেনের হাতে তিনি নিহত হন। এর অবশ্য বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। এ কে এম শাহনাওয়াজ লিখেছেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুফিদের মধ্যে ধর্মীয় স্বার্থের সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত হতে দেখা যায়।

সুহরাওয়ার্দি সম্প্রদায়ের সুফিগন ধর্মপ্রচারে শক্তি প্রয়োগে বিশ্বাসী ছিলেন। ’ (বাংলার সংস্কৃতি বাংলার সভ্যতা । পৃষ্ঠা, ১১৩) সে যাই হোক। সুফিদের মারেফাতী দর্শনের প্রচার ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যযুগের বাঙালি সমাজের একেবারে অন্দরমহলে । সাধারণ মানুষ সুফিদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিল।

সুফিদের আস্তানাকে বলা হয়- ‘খানকাহ’। সুলতান ও রাজকর্মচারীদের সহায়তায় বাংলার প্রত্যন্ত লোকালয়ে খানকাহ প্রতিষ্ঠিত করা হত। একটি আদর্শ খানকায় মসজিদ, মাদ্রাসা, লঙ্গরখানা, মুসাফিরখানা, চিকিৎসালয় এবং গ্রন্থাগার থাকত। খানকায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল এই খানকাগুলোতে। মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এবং খানকাহর সুফিসাধকগণ ধর্ম প্রচার করতেন।

খানকায় দুস্থ ও দরিদ্রদের ভিড় থাকত। এরা ছিল একাধারে অর্থনৈতিকভাবে শোষিত এবং সেনআমলের বৈদিক বর্ণবাদের শিকার। খানকাগুলি কখনও পরিনত হয়েছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে। কেননা, খানকা ছিল রাজশক্তির সঙ্গে সুফিদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। সুলতান খানকায় যথেষ্ট অনুদান দিতেন।

কোনও কোনও সুলতানের সঙ্গে সুফিদের ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে। কোনও কোনও দরবেশ মুসলিম সুলতানদের অনুকূলে যুদ্ধও করেছিলেন। সোনারগাঁওয়ের সুলতান ফখরউদ্দীন মুবারক শাহের সেনাপতি কদল খাঁ গাজী যখন চট্টগ্রাম জয় করেন তখন পীর বদর আলম ও তাঁর শিষ্যগণ সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহন করে মগবিতরণে সাহায্য করেছিলেন। দক্ষিণ বঙ্গে ইসলাম প্রচারকারী বাগেরহাটের খানজাহান আলী সেনাপতিরূপে নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহের সময়ে (১৪৩৭-১৪৫৯) এই অঞ্চল জয় করেছিলেন। তবে অধিকাংশ সুফিই ধর্ম প্রচার করতেন শান্তিপ্রিয় উপায়ে।

বাংলায় সুফিবাদের ধারার সঙ্গে উত্তর ভারতের সুফিবাদের ধারার পার্থক্য রয়েছে। উত্তর ভারতে শহর ও প্রশাসনিক কেন্দ্রে সুফিরা ধর্ম প্রচার করতেন। বাংলায় গ্রামাঞ্চলে। সুফিদের উদ্যেগের ফলে বাংলার নানাপ্রান্তে শিক্ষা ও ধর্মচর্চার নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। এসব কেন্দ্র ধীরে ধীরে শহরে পরিনত হয়।

বিহার শরীফ, পান্ডুয়া, সোনারগাঁও ও শ্রীহট্ট এসব শহর সুফিদের কার্যক্রমে গড়ে উঠেছে। । এই কেন্দ্রগুলি সুফিদের মূলকেন্দ্রে পরিনত হয়েছিল। যেখানে ইলম আল তাসাউফ বা সুফিতত্ত্ব চর্চা হত। মনে থাকার কথা- সুফি মতবাদের মূলে রয়েছে শিয়া মতবাদ।

এবং শিয়া মতবাদের কেন্দ্রে রয়েছেন-হজরত আলী (র)। আজও বাংলায় আলীপন্থী মারাফত চর্চা অব্যাহত রয়েছে দয়াল বাবা কেবলাকাবা আয়নার কারিগর/ আয়না বসায়া দে মোর কলবের ভিতর/আমার বাবাআল হাজ আলী/ যার কাছে মারাফাতের কলি/কলব হইয়া যায় নূরাণী চাইলে এক নজর/ আয়না বসায়া দে মোর কলবের ভিতর ... বাংলায় সুফিদের এই বিজয়কে ঐতিহাসিকগণ দেখেছেন: রক্ষণশীলতার ওপর উদারনীতির বিজয় হিসেবে। বাংলার পদদলিত অন্ত্যজ মানুষ এই বিজয় মিছিলে শরিক হয়েছিল। একটি বর্ণবাদী সমাজে বিপন্ন ছিল বলেই এরা ইসলামের আগমনে আলোড়িত হয়েছিল । মনুর ভেদনীতি ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের বিপরীতে সুফিদের আহবানে ছিল মানবিকতার সুর।

যে সুরটি, ড. আহমেদ শরীফ মনে করেন - বাংলার বাউল দর্শনের ভিতও রচনা করেছিল। সুফিদের প্রভাবেই শ্রীচৈতন্যদেব মধ্যযুগের বাঙালিকে প্রেমরসে সিক্ত করে বাঙালি হিন্দুকে সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে তুলে আনেন। বাংলার বাউলগণ একতারা হাতে বাংলার পথে পথে আজও গাইছেন- বাউল হয় না পরিলে গেরুয়া/ অন্তরে না থাকে যদি প্রেমরসের ধোঁয়া ... সুফিগণ Ultimate Reality স্বরূপ আল্লার পরম নৈকট্য লাভের জন্য প্রেমরসের মার্গকেই উপজীব্য করেছেন। আজও ... সুফিবাদের আলোচনায় আল্লার কথা হল, হজরত আলীর (র) কথাও হল- অথচ সুফিবাদে ইসলামের মহানবীর (সা) কথা কোথায়? সুফিবাদের কেন্দ্রে মহানবীও (সা) দিব্যরূপেই বিরাজ করছেন। ফিরোজ শাঁইয়ের কন্ঠে ছোট বেলায় শোনা একটি মারফতি গানের উল্লেখ করে শেষ করছি: কামেলিরা কাম করিয়া/ কোথায় জানি লুকাইছে/ দুই পাহাড়ের মাঝে মওলা/ মসজিদ বানাইছে/ মসজিদে তিনটি দরজা/ চারটি খিরকি তার/ আফায়াতে* (!) রাখছে /পানি অজু করিবার/ সেই মসজিদে দ্বীনের নবী/ সদাই নামাজ পড়তাছে .... *গানটির কিছু শব্দ আমার কাছে আজও পরিস্কার নয়।

তথ্যনির্দেশ: এ কে এম শাহনাওয়াজ; বাংলার সংস্কৃতি বাংলার সভ্যতা Romila Thapar; A History of India (vol.1) Bhagwan Shree Rajneesh; The Secret Discourses on Sufism (part -1) Click This Link Click This Link http://en.wikipedia.org/wiki/Adi_Shankara ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.