আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্মানী ভ্রমণ (তিন)......নীলাঞ্জনা নীলা

আনন্দবতী মেয়ে আমি হাওয়ায় উড়াই চুল,চোখের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ মনের ভেতর নীল ঘাসফুল হেঁটে এসে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইলাম । কিন্তু গন্তব্য দেখাচ্ছিলো একদিকে প্যারিস , অন্যদিকে জার্মা্নীর অন্য জায়গার নাম । আমাদের ট্রেন ৮টা বেজে ২৪ মিনিটে । চিন্তা কি ! এখনো ৪০ মিনিট বাকী । জার্মা্নীর ওই ট্রেনটা চলে গেলো এখন বোর্ডে উঠবে আমাদের ট্রেনের নাম ।

কিন্তু তা না দেখে একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম । ঘটনা কি ? এমনিতেই আমাদের অনেকবার ট্রেন বদল করতে হবে । ট্রেন মিস করার শাস্তি যেখানে একবার বদল সেখানে আমাদেরকে করতে হবে পাঁচবার । এদিকে যদি আবার মিস করি আর কি আমাদের টিকেট দেবে ? এক পরিবারকে পেয়ে আবার জানতে চাইলাম তোমরা কি লিয়েজের ট্রেন ধরবে ? সেই লোক বললো এটা তো লিয়েজ যাবার ট্রেন না । বললো তুমি নীচে গিয়ে বোর্ড দেখো ।

আবার নীচে নামলাম । সেখানে গিয়ে দেখি সেখানেও কিছু লেখা নেই । কি ভাগ্য ট্রেনের দুজন লোককে পেয়ে গেলাম । কিন্তু তারা অনেকটাই দূরে । ছেলেকে বললাম বুবুল যাও দৌঁড়ে ওদেরকে থামাও ।

ছেলে আমার দৌঁড়ে তাদের কে থামালো । আমি মাঝে-মধ্যে অবাক হয়ে যাই তীর্থ কি করে ইংরেজীতে কথা বলে ? ওকে তো এখন সেই ভাষা শেখানো হচ্ছে না । পুরোপুরি ফ্রেঞ্চে কথা বলে । আর আমায় অবাক করে দিয়ে খুব সুন্দর করে উচ্চারণ করে । ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ কিন্তু খুব কঠিন এ আমরা সবাই জানি ।

আমি একেবারেই ফ্রেঞ্চ জানি না । ছেলে আমাকে সাহায্য না করলে একেবারে ভেসে যেতাম । সেই লোকটা দাঁড়িয়ে গেলো আমি টিকেট দেখালাম সে আমাকে নিয়ে গেলো সেই জায়গায় । অবশেষে ট্রেনে উঠলাম । একেবারেই প্রায় লোকাল ট্রেনের মতো ।

কোনো রকমে সিট খুঁজে নিলাম । এক ঘন্টার জার্ণি । সারাটি রাত একেবারেই ঘুম কম হয়েছে আর ভোরে উঠে এমন করে দৌঁড় চোখ যেনো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো । ছেলে আমার বারবার ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে দিচ্ছিলো । মাম লিঁয়েজ এলে আমি বুঝতে পারবো না আবার ট্রেন মিস হয়ে যাবে ।

প্লিজ তুমি ঘুমিয়োনা । কি করে যে চোখ খুলে রেখেছি সে আমি জানি । অবশেষে লিঁয়েজ এসে পৌঁছালাম । লিঁয়েজ হলো বেলজিয়ামের শেষ ষ্টেশন জার্মানী যাবার পথে । সেখানে তেমন যন্ত্রণা হয়নি ।

বিপরীত প্লাটফর্মে ট্রেন আসবে সেখানে বসে রইলাম প্রায় পনেরো মিনিটের মতো । ট্রেন এলো উঠলাম । যেতে হবে আখেন(যদি ইংরেজীতে উচ্চারণ করা হয় তবে হবে আচেন আর ফ্রেঞ্চে বলা হয় আসেন) ষ্টেশনে । পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ভ্রমণ । ঘুম যেনো ছাড়ছেই না ।

কিন্তু কোনোভাবেই ঘুমানো যাবে না । আখেন ষ্টেশনে এসে আবার প্লাটফর্ম খোঁজা । কোলনের ট্রেন ধরতে হবে । হাতে সময় মাত্র দশ মিনিট । এদিকে আমাদের এস-এ প্লাটফর্মে যেতে হবে ভুল করে আমরা এস-বি তে চলে যাচ্ছিলাম , কিন্তু একটা মেয়েকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এই ট্রেনটা কি এস-এতেই আসবে ? সে বললো দাঁড়াও দেখছি ।

আসলেই এখানকার বোর্ডগুলো খুব ঝামেলার । কিচ্ছু বোঝা যায়না । তা নইলে কি এতোবার ভুল করি ? জীবনে কম তো একা ভ্রমণ করিনি , আর যতোটা ঝামেলা এমন উন্নত দেশেই এসে ? আবার দৌঁড় যাক ট্রেনে উঠতে পারলাম । ঐ ট্রেন হলো আই.সি ট্রেন । দূরপথে এটি যাওয়া-আসা করে ।

উঠেই দেখি সব এক টাইপের চেয়ার এবং তা একেবারে প্রথম শ্রেণীর মতো দেখতে । চিন্তায় পড়ে গেলাম এখানে যদি বসি তবে তো আবার টিটি এসে ধরবে । ও ভালো কথা এখানেও কিন্তু আমাদের দেশের মতো ট্রেনের ভেতর টিকেট চেকার টিকিট চেক করে । যা আমি জাপানে দেখিনি । জাপানে টিকেট পাঞ্চ না করলে কোনোভাবেই ট্রেনে ওঠা যায়না ।

সেখানে ট্রেনে ওঠার আগে মেশিনে টিকেট পাঞ্চ করা লাগে । আসলে আমাদের দেশের অনেক কিছুর সাথে ইউরোপের মিল আছে । হয়তো ইয়ুরোপের রাজত্ব আমাদের দেশকে বেঁধে রেখেছিলো , তাই । যা বলছিলাম ওখানে গিয়ে জানলাম এটা দ্বিতীয় শ্রেণী । বসে পড়লাম ।

এখন নিশ্চিন্ত , পুরোপুরি পাঁচ ঘন্টার যাত্রা । সুতরাং ঘুমাতে পারবো । ওখানে বসার পর পরই একজন ওয়েটার এসে জানতে চাইলো আমরা কি খাবো । আমি বললাম কিচ্ছু লাগবে না । তীর্থ বললো সে খাবে ।

শেষ পর্যন্ত চকোলেট মিল্ক অর্ডার করলাম । হঠাৎ মনে হলো এটা কি সার্ভিস নাকি পে ? তারপর ভাবলাম অসম্ভব এ কোনোভাবেই সার্ভিস হতে পারে না । আমি ডেকে জানতে চাইলাম ওয়েটার বললো পে করতে হবে । তা কতো টাকার মিল্ক এটা ? সে বললো চার ইউরো । বলে কি এইটুকু ছোট্ট একটা মগের চকোলেট দুধ চার ইউরো ! মানে আমাদের দেশের টাকায় প্রায় চারশত টাকা ।

অথচ বাইরে এর দাম বেশী হলে এক ইউরো । যাক ছেলে খাবে বলে কথা । আমি বললাম বুবুল আমি একটু ঘুমাই । অনেকক্ষণ ট্রেন চলবে । তখন ছেলে আর কিচ্ছু বললো না ।

আমি ঘুমিয়ে পড়লাম দশ মিনি্টের মধ্যেই । এর মাঝে একজন ওয়েটার এসে আমায় উঠিয়ে বললো এখানে ঘুমানো যাবে না । ঘুমাতে চাইলে সামনের কম্পার্টমেন্টে যেতে হবে । অতোগুলো ব্যাগ নিয়ে আবার সিট খোঁজা । দুটো সিট পাওয়া যাচ্ছিলো না ।

একজায়গায় দুটো সিট পেয়ে বসেই ঘুমিয়ে পড়লাম । এবার টিটি এসে ডাকলো তোমার সিট না এটা । অবশ্য শেষে দেখা গেলো যে মহিলা নিজের সিট বলে দাবী করছিলো সেটা তার না । ও এখানে মাত্র পয়েন্ট পাঁচজন মানুষ সিট রিজার্ভ করে । বাকীরা ফাঁকা জায়গায় বসে আর বেশীরভাগ সিট খালি-ই থাকে ।

কিন্তু আমাদের ভাগ্য সেদিন খারাপই ছিলো তা নয়তো এতো ভোগান্তি হবে কেন ? কোলনের উদ্দেশ্যে ট্রেন ছুটে চলছিলো । খাবার বগিতে নাকি ঘুমানো যায় না । টেবিলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করার পরে এক ওয়েটার এসে বললো কিছু মনে করোনা এখানে ঘুমানো নিষেধ । হায়রে জ্বালা শেষ পর্যন্ত উঠে অন্য কামরায় গেলাম । সেখানেও বিপত্তি ।

ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলো এক পরিবার এটা নাকি তাদের সিট । এরপর দেখি আসলেই তাই । আবার সিট বদল । এখানে সিটের ঠিক উপরে যেখানে হ্যান্ড ব্যাগ রাখা হয় , তার নীচে লেখা থাকে কোন ষ্টেশন থেকে কে উঠবে । আমার জানা ছিলো না তাই রিজার্ভ সিটে চারবার বসলাম আর উঠলাম ।

হঠাৎ ট্রেনের এক লোক কে পেয়ে গেলাম । তাকে অনুরোধ করলাম আমার কোনো সিট নেই ছেলে কে নিয়ে বসার জায়গা করে দেবে কি ? সে আমায় সাথে করে দুই কামরা পার করে ফার্ষ্ট ক্লাশে দুটো সিট ম্যানেজ করে দিলো । ওই সময় ট্রেনে নাকি অতোটা ভীড় থাকে না , কিন্তু আমার এমনই ভাগ্য পুরোটা ট্রেন একেবারে ভরা । এমনকি দাঁড়িয়েও আছে লোকেরা । এখানেও লোকজন দাঁড়িয়ে যায় অনেক দূরের পথ ।

টিকেট রিজার্ভেশনে পাঁচ ইউরোর বেশী লাগে তাই কেউ রিজার্ভ করে না শুধু মাত্র বুড়ো-বুড়ী ছাড়া । আরো মজার ব্যাপার যারা সিট পায়না নীচেই বসে যায় । অবশ্য সেখানে নীচে বসতে খারাপ লাগে না । এতোটাই পরিষ্কার যে ওখানে শুতেও খারাপ লাগবে না । যাক আমি তো সিট পেয়ে ওখানে ব্যাগ একটা রেখে এলাম ছেলে কে নিতে ।

বেচারা দেখি ভয়ে কাঠ হয়ে আছে । তার মাম কোথায় গেলো সেই চিন্তায় । আমায় বললো পাপা কেন সিট বুকিং দিলো না ? এমন করে মাম তোমার কতোবার ব্যাগ টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে । আমারও আসলে ভালো লাগছিলো না । এতোটাই অসহায় লাগছিলো যে কি বলবো ।

যাক এবার আর উঠতে হবে না কোলন না পৌঁছানো পর্যন্ত । আখেন থেকে কোলন এক ঘন্টার পথ । দ্রুতগামী ট্রেন পেড়িয়ে যাচ্ছিলো একেকটি শহর-নগর-গ্রাম । এতো ফাঁকা জায়গা মানুষ নেই , আহ আমাদের দেশে যদি এমন হতো ! আমাদের দেশের সব মানুষের যদি এমন কিছু জায়গা থাকতো ! আর প্রতিটা ক্ষেতের মাঝে অনেকগুলো উইন্ডমিল । ক্লাশ নাইন-টেনে পড়া উইন্ডমিল প্যারাগ্রাফ বাপি পড়াতো ।

আমাকে নোট করে দিতো বাপি ইংরেজীর । আর তাই হয়তো ইংরেজীতে অল্পের জন্য যখন লেটার মিস করলাম খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি আর বাপি । সেই উইন্ডমিল প্যারাগ্রাফ আমার মোটেও ভালো লাগতো না । বাপি কে বলতাম এটা যে কেন দিলো , কি লাভ হবে এটা পড়ে ? সেই বিরক্তিকর উইন্ডমিল কে চোখের সামনে দেখে এতোটাই উপভোগ করেছি কি বলবো ! অবশ্য এটাই প্রথম উইন্ডমিল দেখা না , হল্যান্ডের বিখ্যাত টিউলিপ গার্ডেন (যেখানে অমিতাভ বচ্চন আর রেখা অভিনীত হিট সিনেমা "সিলসিলা"র গানের স্যুটিং হয়েছিলো) দেখতে যাবার পথে প্রথম উইন্ডমিল দেখা । আর সেখানে তো গণনা করেও তল পাওয়া যায়না যে কতোটা তিনটি চিকন পাখা ঘুরছে সারাটি আকাশ জুড়ে ।

জার্মানীতে অবশ্য অতোটা নেই । তারপরেও প্রতিটি জমিতে ঘুরছে "বাতাসের পাখা" । বেশীক্ষণ আর দেখতে পারলাম না চোখ বন্ধ হয়ে গেলো । ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.