বাঙালী নারী যখন বালিকা হবার আগেই বিয়ের পিড়িতে বসে। হিন্দু ধর্মে পাঁচ পেরিয়ে ছয় হলেই পাত্র দেখার তোড় জোড় শুরু হয়ে যেত। সাত পেরুলেই পাপের ভাগী হতে হয় অভিভাবককে, আইবুড়ো মেয়ের অপবাদ পরে ঘাড়ে। কুষ্টি টিকুজী মিলিয়ে বংস মিলিয়ে পাত্র পাওয়া কঠিন ব্যাপার বিশেষত ব্রাহ্মণ পাত্রীর ভাগ্য দু চার স্ত্রীর ঘর করা বরই জুটতো।
মুসলমান পরিবারেও একই অবস্থা।
শিশুকাল কাটার আগেই সংসারের ভার ঘাড়ে চাপে। খেলার কোন বয়স নাই। বাচ্চা মেয়েগুলোই বিশাল গিন্নি বান্নী।
এমন যখন সামাজিক অবস্থা লেখা পড়ার করার চিন্তাও মেয়েরা করে না। তারা ধর্ম শিখে, সেলাই, রান্না বান্না শিখে।
গৃহকর্মে নিপুনা হয়ে উঠে। মেয়েদের জন্য কোন শিক্ষালয় ছিল না। তেমনি সময়ে মুসলিম বনেদী পরিবারে জন্ম নিয়েও মেয়েটার পড়ার শখ ভীষণ। তবে মেয়েটার সুযোগ হয় গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়ার। পড়া শিখে আপন মনে আগ্রহ নিয়ে।
হয়ে উঠে পারদর্শী বাংলা, ইংরেজি?, আরবী, উর্দু, হিন্দি, ফার্সী ভাষায়। মাত্র সাত বছর বয়সে তার দেখা হয় আরেক মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার সাথে কলকাতায়। মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনের আলোকবার্তা ছড়িয়ে পরে আগ্রহী মেয়েটার মনে।
মাত্র এগারো বছর বয়েসে বিয়ে হয়ে যায় সমাজের প্রথা অনুযায়ী। প্রথম কন্যা সন্তানের জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় তার মৃত্যু হয়।
কিছু দিনের মধ্যে স্বামীর মৃত্যু। দ্বিতীয় বার বিবাহ হয়। চারটি সন্তান নিয়ে ঘরকন্যা। এমন সব ঘটনার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেও তার প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে তার লেখার মাধ্যমে।
বরিশালের সায়েস্তাবাদ শহরে বিশে জুন উনিশ এগার, যে মেয়েটি জন্ম নেয়।
তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা কবি সুফিয়া কামাল। ১৯২৩ সনে তাঁর প্রথম কবিতা সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রথম বই সাঁঝের মায়া প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সনে । ১৯৪৭ সনে প্রথম মহিলা সম্পাদক বেগম পত্রিকার। বেগম প্রত্রিকাটি শুরু করেন তিনি মেয়েদের লেখার বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
জীবনের শত বাঁধা বিপত্তি, উত্থান পতন তার সাহিত্য চর্চার দুয়ার বন্ধ করতে পারেনি। তিনি পথ চলার সুযোগ পেয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়ার মতন গুণী মানুষের সাথে আর নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নিয়েছেন বারেবারে।
কাজ করে গেছেন মেয়েদের উন্নতির জন্য। সারা বাংলাদেশব্যাপী মহিলা পরিষদ নামে সংঘটন তৈরী করেন। গরিব মেয়েদের কাজ করার সুযোগ তৈরীর উদ্দেশ্যে এই সংগঠন করা হয়।
তাকে প্রথম দেখি তেয়াত্তর সনে। আমাদের শহরে মহিল পরিষদের কাজ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন।
আমার মা আরেক একনিষ্ঠ সমাজ কর্মী সব সময় মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন। মহিলা পরিষদের সাথে জড়িত ছিলেন। দুঃখি মানুষের উন্নয়নের জন্য নিজের সময় ব্যয় করে সাহায্য সহযোগিতা করে যেতে দেখেছি সব সময় মাকে।
সুফিয়া কামালকে আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় কবিতা উৎসবে শুরুর দিকে। সকল সম্মান দিয়ে বর্ষীয়ান্ এই কবিকে দিয়ে কবিতা উৎসবের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করা হয় শুরুর দিকে বেশ কয়েক বছর। শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক দেশের বরণ্য সব কবি পাশাপাশি দাঁড়াতেন সে এক নান্দনিক দৃশ্য। বয়স বাঁধা দিয়ে ঘরে বেঁধে রাখতে পারেনি। প্রাণের টানে কবিতার কাছাকাছি চলে আসতেন বয়সকে পদদলিত করে।
সেই দিনগুলোতে তাঁর জন্ম দিনে তার বাড়িতে শুভেচ্ছা জানাতে যেতাম। আলাপ পরিচয়ে জ্ঞানী মানুষটির নিরহংকার ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছি বারবার।
অন্ধকার পশ্চাদপদ সমাজ, ধর্ম কোন ভাবেই দমন করে রাখতে পারেনি ভিতরের ইপ্সিত আগ্রহ। পৌঁছে গিয়েছেন এবং ছড়িয়ে দিয়েছেন তার ভিতরের সম্পদ। আমাদের এমন সব গুণিজনের উদাহরণ আজকের অগ্রসরমান সমাজে অনুকরণ করা দরকার।
যে সব নারী শিক্ষা দীক্ষার সমস্ত সুযোগ পেয়েও ধুকে ধুকে নিঃশেষ হচ্ছেন প্রতিদিন পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মের নানান শৃঙ্খলে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।