ভালো কাজে বাড়াবাড়ির ভালো একটি উদাহরণ হলো তাবলীগ জামায়াত। ‘তাবলীগ’ মানে পৌঁছে দেয়া, আল্লাহর ইচ্ছা মানুষকে জানানো। মূলত কাজটি তাঁদের, যাঁরা ওহীর সূত্রে আল্লাহর বাণী গ্রহণ করতেন। তাঁদের থেকে পাওয়া ঐশীবার্তা কালপরম্পরায় যাঁরা অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে থাকেন তাঁদের তাবলীগ হলো রিসালাতের তাবলীগের ওপর নির্ভরশীল এবং এরই স্থলবর্তী। তাই দুনিয়ার যেখানে যাঁরাই তাবলীগের কাজ করছেন, তাঁরা সবাই সাধারণভাবে প্রশংসিত হলেও তাঁদের কাজকর্মের ঠিক ততোটুকুই ইসলামী তাবলীগ বলে গণ্য হবে যতোটুকু রাসূল সা. ও তাঁর সাহাবাদের হুবহু অনুকরণে সম্পন্ন হবে।
রিসালাতের শিক্ষার কোনো অংশকে ব্যক্তি বা পরিস্থিতির প্রতিকূলতার অজুহাত দেখিয়ে প্রচার না করা অথবা তার সঙ্গে নতুন কোনো প্রথা-পদ্ধতি যোগ করা হলে সেই তাবলীগ অবশ্যই অসম্পূর্ণ বা বিকৃত তাবলীগ। তাবলীগকে পুরোপুরি এ নিরিখেই বিচার করতে হবে এবং এখানে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই। কেননা তাবলীগ হলো ইসলামের প্রতিষ্ঠাশক্তি। আল্লাহর রাসূল সা. জীবনভর তাবলীগ করেছেন, তাবলীগের মাধ্যমেই তাগূতের ওপর ইসলামকে বিজয়ী করেছেন এবং জীবন-সায়াহ্নে আরাফার মাঠে লক্ষাধিক জনতার সামনে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘হাল বাল্লাগতু?’– আমি কি আমার তাবলীগ শেষ করতে পারলাম অর্থাৎ তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেবার গুরুদায়িত্ব কি পালন করতে সমর্থ হলাম? আওয়াজ উঠলো, ‘নিশ্চয়ই’। এভাবে আমরা দেখি যে, গোটা ইসলামই তাবলীগভিত্তিক এবং রাসূল সা.-এর আদেশ ‘তোমরা উপস্থিতরা অনাগতদের কাছে এ শিক্ষা পৌঁছে দিয়ো’ এর মাধ্যমে সমস্ত মুসলিম জাতির ওপর তাবলীগের কাজ বাধ্যতামূলকভাবে অর্পিত হয়েছে।
তাই বলা যায় মুসলিম জাতি হলো একটি তাবলীগী জাতি। অতএব মুসলিম জাতির মধ্যে বিশেষ এক জামায়াত গঠন করে একে ‘তাবলীগ জামায়াত’ বলে অভিহিত করা, অতঃপর এ জামায়াতের জন্যে নতুন করে নির্দিষ্টসংখ্যক উসূল ও নতুন কর্মকৌশল তৈরি করা এবং এ জামায়াতের সঙ্গে যাঁরা সংশ্লিষ্ট নন তাঁদেরকে তাবলীগ-বহির্ভূত ভাবা এসব নিতান্তই হাস্যকর ও প্রশ্নবিদ্ধ ব্যাপার। ভারতে ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত তাবলীগ জামায়াত নামক দলটি একটি সন্দিগ্ধ ও বিতর্কিত দল। এদের কর্মপদ্ধতি রাসূল সা. ও সাহাবা কিরামের কর্মপদ্ধতি থেকে অনেকাংশেই ভিন্ন। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সন্ন্যাসীদের মতো এরা গৃহত্যাগী ও কৃচ্ছ্রসাধক।
চরমপন্থার নিদর্শন হলো এরা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য সব মুসলিমকে ‘বহুৎ ফায়দা’ থেকে বঞ্চিত ও ক্ষেত্রবিশেষে পাপী মনে করে। যেমন দলটির প্রতিষ্ঠাতার লেখা ‘মালফূযাতে ইলিয়াস’ কিতাবের ৪২ নং মালফূয হলো – ‘যারা তাবলীগ করে না এবং তাবলীগ করতে সাহায্য করে না তারা মুসলমান নয়। ’ এখানে বিবৃতিকারী ‘তাবলীগ’ শব্দ দ্বারা নিজের দলের বদলে নবী-রাসূলদের আনীত ও প্রচারিত ইসলামী তাবলীগ উদ্দেশ্য করে থাকতে পারেন, তবু কথাটি দ্ব্যর্থবোধক ও যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, তাবলীগ জামায়াতের গোঁড়া সদস্যরা এর দ্বারা তাদের দলকেই বোঝে ও বুঝিয়ে থাকে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকেও ঠিক একইভাবে বিভিন্ন হাদীসে ইতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত ‘জামায়াত’ শব্দকে দ্ব্যর্থবোধক কৌশলে ব্যবহার করতে দেখা যায়।
আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তাবলীগ জামায়াত এমন এক জামায়াত যাকে ইসলামের ভয়ঙ্কর শত্রুরাও শত্রু গণ্য করে না এবং প্রতিরোধের প্রয়োজন মনে করে না। এমনকী ইসলামের চিরদিনের শত্রু অভিশপ্ত ইহুদিদের কুখ্যাত সন্ত্রাসীরাষ্ট্র ইসরাইলেও তাবলীগ জামায়াত কাজ করতে পারে – অথচ তা ইসলামের শত্রুদের এমন এক সংরক্ষিত দুর্গ যেখানে যাওয়া দূরের কথা, বাংলাদেশ থেকে টেলিফোন করা বা একটি চিঠি পর্যন্ত পৌঁছানোর উপায় নেই। আমেরিকা যাদের কথায় ওঠ-বস করে তারা এতো ভদ্রলোক নয় যে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে কাউকে তাদের অন্দরমহলে ঢুকে পড়তে দেবে। অথচ ইসলামী দাওয়াতের বৈশিষ্ট্য হলো বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়া। নবী-রাসূল থেকে শুরু করে যুগ যুগ ধরে সকল দা’য়ী ইলাল্লাহকে তাগূতিশক্তির নানারূপ নির্যাতন ও কঠিন বাধা মোকাবেলা করতে হয়েছে।
শোনা যায়, ইহুদি মালিকানাধীন ‘বাটা’ জুতো কোম্পানি প্রতিবছর তাবলীগের বিশ্ব ইজতিমায় মোটা অঙ্কের আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। অধিকন্তু মৌলভী শিব্বির আহমদ দেওবন্দীর লেখা ‘মাকালাতুস সাদরাইন’ ও ঐতিহাসিক মেহের আলি রচিত ‘দেওবন্দী মাযহাব’ পুস্তক দু’টিতে স্বীকার করা হয়েছে যে, তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস ব্রিটিশ সরকার হতে নিয়মিত মাসিক ভাতা গ্রহণ করতেন। বলা আবশ্যক যে, তাবলীগ জামায়াতের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আমার নিজের প্রস্তুতকৃত নয় বরং বিভিন্নজনের লেখা থেকে সংগৃহীত এবং আমার পক্ষে এগুলির সত্যমিথ্যা যাচাই করবার সুযোগ এখনো হয়ে ওঠে নি। সে কারণেই তাবলীগ জামায়াতকে আমি ‘সন্দিগ্ধ’ বলেছি, বিভ্রান্ত বলে দাবি করি নি। যদিও তাবলীগ জামায়াতের ওপর এমন কয়েক শো অভিযোগ আছে।
কেউ মুক্ত মন নিয়ে এসব পর্যালোচনা করলে এ জামায়াতের পক্ষ-বিপক্ষ সবাই উপকৃত হবেন। ব্যক্তিগতভাবে তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হলো, এরা সাধারণ মানুষকে নামায ও আল্লাহর স্মরণে উদ্বুদ্ধ করে। তাই পাঠ ও আচরণগতভাবে যারা ইসলামচর্চার খুব একটা সুযোগ পান নি তাদের জন্যে এটি একটি কল্যাণকর প্রথা। প্রথাটি আরো ফলপ্রসূ হবে যদি তারা শুধু ‘ফাযায়েলে আমল’-এ সীমিত না রেখে জনসাধারণকে প্রতিদিন কিছু পরিমাণে কুরআন-হাদীস পড়া ও বোঝার সুবিধা করে দেয়। এছাড়া আমার ধারণা মাদরাসার ছাত্র ও কর্মব্যস্ত যুবকদেরকে তাবলীগ জামায়াতে বেশি সময় ব্যয় করা থেকে নিরুৎসাহিত করা উচিত।
কেননা এ জামায়াত হলো প্রধানত অর্ধচেতন, অদক্ষ, অকর্মণ্য ও মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন কিছু মানুষের জামায়াত। এদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে ছাত্রদের ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্ন ও মেধা এবং উদ্যমী যুবকদের কর্মস্পৃহা ঝিমিয়ে পড়তে পারে। আল্লাহই সকল শুদ্ধতার উৎস।
(অসমাপ্ত। )
─────────────────
ভালো কাজে বাড়াবাড়ি ভালো নয় : ১
ভালো কাজে বাড়াবাড়ি ভালো নয় : ২
ভালো কাজে বাড়াবাড়ি ভালো নয় : ৩
ভালো কাজে বাড়াবাড়ি ভালো নয় : ৪
─────────────────
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।