আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাশুড়ির মোরগের সাইজ আর শেখ হাসিনার সমুদ্র জয়

এক মা তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, তোর শাশুড়ি যে মোরগটি জবাই করেছিল তার সাইজ কেমন ছিল রে বাপ? ছেলে বুঝতে পারে, মোরগের সাইজ মেপে মা তার শাশুড়ির আদর মাপতে চাচ্ছে। তাই এক হাত কোমরে রেখে অন্য হাতটি যথাসম্ভব মাথার ওপরে তুলে ধরে ছেলে বলে, মা এ....ত্তো বড়। দুই চোখ কপালে তুলে মা প্রশ্ন করে, এত উঁচু কখনো মোরগ হয় রে বাবা? লজ্জিত ভঙ্গিতে ছেলে জানায়, অন্য হাতটি নিচে রাখতে ভুলে গেছি মা। এ দেশের রাজনীতিতে এক হাতে মোরগের সাইজ দেখানোতে আওয়ামী লীগের জুড়ি নেই। অবশ্য কোনোকালেই তা ছিল না।

এ ধরনের অনেক ঐতিহাসিক ভেলকির মাঝে অন্যতম সেরা ভেলকিটি হলো তথাকথিত সমুদ্র জয়। ডা. দীপুমনি এক হাত ওপরে তুলে মোরগের (সমুদ্র জয়!) এই সাইজটি জাতিকে দেখিয়েছেন। ওপরের হাতটি (সালিসি আদালতে আমাদের পক্ষের রায়) ঠিক জায়গাতেই রাখা ছিল। তবে নিচের হাতটি (বিপক্ষের রায়সমূহ ) যথাস্থানে বসানো হয়নি। ফলে এই মোরগের উচ্চতাটি হাতির উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

সালিসি আদালতের সাদামাটা রায়টি হয়ে পড়েছে দীপুমনি আর শেখ হাসিনার সমুদ্র জয়। কিছুদিন আগে সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান জানিয়েছিলেন, দেশ আজ বাজিকরদের হাতে। দিন কয়েক আগে ব্যারিস্টার রফিক বললেন, বেকুবরা আজ দেশ শাসন করছে। চারদিকে তাকালে এই দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা কষ্টকর। নিজেরা যা-ই হোক, এরা জনগণকে কত বড় বেকুব মনে করে তথাকথিত সমুদ্র জয়ের উল্লাসেই তা স্পষ্ট হয়েছে।

সত্যিই সে এক হুলস্থুল ব্যাপার। লাদেনকে হত্যা করার মুহূর্তটিতেও হিলারি তার সরকারপ্রধানকে জড়িয়ে ধরেননি। যদিও সুখের মুহূর্তটি আমেরিকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ মাত্রার ছিল। কিন্তু আমাদের আদুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন। জেন্ডারগত সমস্যা না থাকলেও প্রটোকলগত সমস্যাটি অবশ্যই ছিল।

ডাক্তার ও ডক্টরের সেই আবেগঘন উষ্ণতায় কিংবা ক্ষণিকের বিভ্রান্তিতে পড়ে বিরোধীদলীয় নেতাও অভিনন্দন জানিয়ে বসেন। তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। টেনেটুনে পাস করে যদি কেউ ফাটাফাটি রেজাল্টের উল্লাস প্রকাশ করে তখন আশপাশের শ্রোতা আর দর্শকদের বিভ্রান্ত হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। রেজাল্ট শিটে দৃষ্টি বোলানোর পর সংগতকারণেই মির্জা ফখরুল সেই অভিনন্দনটি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তবে অভিজ্ঞ মহল থেকে সমালোচনা শুরু হলে ডা. দীপুমনি তার অন্য হাতটি আলগোছে বের করে আনেন।

তিনি জানান, এই মামলায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়েরই জয় হয়েছে। সমালোচক, সাংবাদিক ও সচেতন জনগোষ্ঠীকে মোরগের প্রকৃত সাইজটি বললেও সাধারণ জনগণকে হাতির মতো সাইজটি এখনো প্রদর্শন করে চলছেন। আর এসব কাজের জন্য আওয়ামী লীগের কখনোই লোকের বা স্ট্যামিনার অভাব হয় না। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান, চিত্রকর কাইয়ূম চৌধুরীর মতো অনেক বড় মাপের সুশীল এগিয়ে এসেছেন। এই বুদ্ধিজীবীদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, অধিকাংশ মানবিক বিভাগের ছাত্র হলেও বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে আল্লাহ-খোদা বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বোধ-বিশ্বাসের বিরোধিতায় জীবন পার করেন।

তারা বাক স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাস করেন। তবে ময়মনসিংহের খ্যাপা বালিকা তসলিমা নাসরিন সব্যসাচী লেখক সম্পর্কে কিছু রসময় লেখা শুরু করলে খোয়ানো ইজ্জত ফিরে পাবার জন্য ২০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন। তারা জাতে প্রগতিবাদী (সমাজতন্ত্রী); কিন্তু তালে দুর্গতিবাদী (পুঁজিবাদী)। তাদের সাবজেক্ট আর অবজেক্টের গরমিল সর্বত্র। সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত আইনের কোনো কিছু না বুঝলেও এটা বুঝেছেন যে, শেখ হাসিনা সমুদ্র জয় করে ফেলেছেন।

আমি নিশ্চিত, তারা কখনোই সেই রায়ের কপিটি নিজেরা পড়ে দেখেননি। কাউকে তা পড়তে উৎসাহও দেননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নৃত্যগীতের মাধ্যমে সমুদ্র ¯রাতের আমেজ ফুটিয়ে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছেন। জ্ঞানভিত্তিক একটা সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা মুখে বললেও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকা-ের আড়ালে একধরনের অসহিষ্ণুতা ও অন্ধত্ব বিস্তারেই ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। এই বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় গত টার্মে শেখ হাসিনা স্থলভাগের প্লুটো, অ্যারিস্টটলের সারিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন।

এই টার্মে তাকে ঠেলে দেয়া হয়েছে জলভাগের কলম্বাস, ক্যাপ্টেন কুক, ভাস্কো-দা-গামার সারিতে। সংবর্ধনার তোড়ে ভেসে গেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই জ্ঞানী-গুণীদের কথা শুনলে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা হয়। বাপ জয় করেছিলেন ৫৬ হাজার বর্গমাইল। আর বেটি জয় করেছেন এক লাখ বর্গমাইল! সংগতকারণেই এই খেতাব গ্রহীতা ও খেতাব দাতাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতা ও সাংস্কৃতিক মান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।

সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক জটিল আইনগুলো বুঝতে না পারলে এই জ্ঞানী-গুণীদের খুব বেশি দোষ দেয়া যায় না। খটকা লাগে ভাব ও ভাষাসংক্রান্ত একান্ত নিজেদের বিষয়েও ভাব ও ছন্দের জাদুকরদের জ্ঞানের এই বহর দেখে। এদের প্রচারণা দেখলে মনে হবে শেখ হাসিনার জন্ম না হলে এই এক লাখ বর্গমাইল এলাকা আমরা কখনোই পেতাম না। এই সমুদ্র অঞ্চলটি কখনোই অজানা ছিল না, যা শেখ হাসিনা ডিসকভার বা নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। এই সমুদ্র অঞ্চলটি অন্য কারো দখলে ছিল না, যা শেখ হাসিনা এসে দখলমুক্ত করেছেন।

কথিত এই লাখ বর্গমাইলের বড় একটা অংশ আগে থেকেই বাংলাদেশের স্পষ্ট জল সীমানা হিসেবে নির্ধারিত ছিল। কিছু অংশ নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ ছিল। আন্তর্জাতিক আদালত ভাগাভাগি করে আমাদের কিছু দিয়েছেন। বাকিটা মিয়ানমারকে দিয়েছেন। লাভ-ক্ষতির হিসাবে এখনো মিয়ানমারের পাল্লাটাই ভারী।

আন্তর্জাতিক আইনের বদৌলতেই প্রতিটি সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ তাদের ভূ-সংলগ্ন বিশাল একটা সমুদ্র এলাকার স্বত্ব আপনা-আপনি পেয়ে যায়। যেমন ইউএসএ পেয়েছে ২৮ লাখ ৩১ হাজার ৪০০ বর্গ নটিকেল মাইল (এক বর্গ নটিকেল মাইল সমান ৩.২৪ বর্গমাইল)। ফ্রান্স পেয়েছে ২০ লাখ ৮৩ হাজার ৪০০ বর্গ নটিকেল মাইল। ইন্দোনেশিয়া পেয়েছে ১৫ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩৩ বর্গ নটিকেল মাইল। নিউজিল্যান্ড পেয়েছে ১৪ লাখ ৯ হাজার ৫০০ বর্গ নটিকেল মাইল।

অস্ট্রেলিয়া পেয়েছে ১৩ লাখ ১০ হাজার ৯০০ বর্গ নটিকেল মাইল। রাশিয়া পেয়েছে ১৩ লাখ ৯ হাজার ৫০০ বর্গ নটিকেল মাইল। জাপান পেয়েছে ১১ লাখ ২৬ হাজার বর্গ নটিকেল মাইল। ইন্ডিয়া পেয়েছে পাঁচ লাখ ৮৭ হাজার বর্গ নটিকেল মাইল। এটা কারো কৃতিত্বের অবদান বা সমুদ্র জয় বলে গণ্য হয় না।

আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, এটাকে সমুদ্র জয় বলে এমন স্টাইলে হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছি। এসব আন্তর্জাতিক সালিসের সর্বোচ্চ ফলাফল হয় উইন-উইন বা জয়-জয়। প্লাস-মাইনাস করে সবার মনেই তৃপ্তির পাশাপাশি কিছু অতৃপ্তি কাজ করে। এসব সালিস থেকে ফিরে এসে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার সুযোগ খুব কম থাকে। আমরা কতটুকু ছেড়েছি আর কতটুকু পেয়েছি তার একটা হিসাব টানলে আমার মনে হয় না কোনো বঙ্গসন্তান এটা নিয়ে এমন ধরনের উল্লাস করতে পারবে।

এই সংক্ষিপ্ত লেখায় পুরো রায়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। বিরোধের মূল বিষয়গুলো ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার আশা রাখছি। আলোচনার মাঝে মাঝে ব্রাকেটে রায়ের অনুচ্ছেদগুলো দেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেট থেকে রায়ের কপিটি ডাউনলোড করে আগ্রহীগণ সহজেই তা যাচাই করে নিতে পারেন। ১. ২০০ নটিকেল মাইলের বাইরে কনটিনেন্টাল সেলফের সীমারেখার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার প্রসঙ্গে (সালিস রায়ের অনুচ্ছেদ ৪১ থেকে ৫০) এ বিষয়ে বাংলাদেশ দাবি করেছে, এটি ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারে।

মিয়ানমার সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার মেনে নিলেও জানায় যে, এই বিরোধের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের দাবিটি খুবই ঠুনকো। ফলে আমাদের দাবিটি সহজেই টিকে যায়। মিয়ানমার এই দাবিটি করেছে তা টেকানোর জন্য নয়। বরং তা করেছে সালিসি আদালতে বিরোধের সংখ্যা বাড়িয়ে গিভ অ্যান্ড টেক ফর্মুলা থেকে বিশেষ সুবিধা আদায়ের উদ্দেশে।

মিয়ানমারের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। আর এই পয়েন্টে গাণিতিক জয়ের মাল্যটি পড়েছে আমাদের গলে। ২. টেরিটরিয়াল সি (অনুচ্ছেদ ৫৬ থেকে ১১৮ দ্রষ্টব্য) বাংলাদেশ উপস্থাপন করে এ বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের একটা সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল। মিয়ানমার পাল্টা যুক্তি দেখায়, এটা ছিল শুধু জাহাজ চলাচল বিষয়ক চুক্তি, বাংলাদেশ টেরিটরিতে মিয়ানমারের জাহাজ নির্বিঘেœ চলাচলের চুক্তি। এটা সমুদ্রসীমা নির্ধারণের চুক্তি নয়।

চুক্তিটি যথাযথ কর্র্তৃপক্ষ দ্বারা করা হয়নি... ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক আদালতও চুক্তিটির আইনগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং মিয়ানমারের দাবিটি মেনে নেয়। উক্ত চুক্তিতে সীমানা নির্ধারিত না হলে মিয়ানমারের জাহাজের বাংলাদেশ সীমানায় নির্বিঘেœ প্রবেশের ‘প্রশ্নটি’ আসে কেন? ১৯৭৪ ও ২০০৮ সালে সম্পাদিত চুক্তিগুলোতে টেকনিক্যাল দুর্বলতাগুলো তুলে ধরা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৯৬ থেকে ৯৯)। ১৯৭৪ সালের চুক্তিটিকে জাতির পিতার ভিশন হিসেবে প্রচারণা চালানো হয়েছে। কিন্তু সেই চুক্তিটি নিয়ে মিয়ানমারের অবজ্ঞা ও তাতে আন্তর্জাতিক আদালতের সম্মতি ভেতরের কলিজাটি শুকিয়ে দেয়।

মিয়ানমার আরো যুক্তি দেখায় (অনুচ্ছেদ ৬৮), ১৯৭৪ সালের সমঝোতা চুক্তিটি দুই দেশের কেউই সংবিধানের আওতায় অনুমোদন করে নেয়নি ( Were not approved in conformity with the constitutional provisions in force in either of the two countries). এই অভিযোগগুলো সত্য হলে এটাকে কি আদৌ ভিশনারি পদক্ষেপ বলা যায়? জাতির পিতাসহ পুরো জাতির এই পয়েন্টে পরাজয় হয়েছে। চাটুকাররা বুঝতে পারেনি চুপ থাকলে এখানে জাতির পিতার কতটুকু উপকার হতো। ৩. সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অস্তিত্ব বা ইফেক্ট (অনুচ্ছেদ ১৩১ থেকে ১৫২) আমাদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটিকে পরিপূর্ণ দ্বীপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে (as an integral part of the general coastal configuration) এবং তার বদৌলতে ঋঁষষ বভভবপঃ আদায়ে আমরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছি। বিষয়টি ছিল অনেকটা চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে আমাদের বাড়ি, নাকি আমাদের বাড়ির সামনেই চেয়ারম্যানের বাড়ি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের এ ধরনের একটা দ্বন্দ্ব ছিল।

মিয়ানমার প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে যে তাদের সামনেই আমাদের সেন্ট মার্টিন (১৩১-১৩৬)। আমাদের সেন্ট মার্টিনের সামনেই যে তাদের মিয়ানমার এ কথাটি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। এ রায়টি থেকে স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের বোকা কিসিমের পরিচয়টি ভালোভাবেই ছড়িয়ে গেছে। মিয়ানমার আরো যুক্তি দেখিয়েছে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি আমাদের চেয়ে তাদের মূল ভূ-খ-ন্ডের কাছাকাছি। এই যুক্তিটি সঠিক হলে আন্দামান দ্বীপ পুঞ্জগুলো কোন যুক্তিতে ইন্ডিয়ার টেরিটরিতে পড়ে? ওটা তো হওয়ার কথা ছিল ইন্দোনেশিয়া কিংবা মিয়ানমারের, কোনোভাবেই ইন্ডিয়ার নয়।

অবস্থা কতটুকু বেগতিক যে, আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন মিয়ানমারের সঙ্গেও আজ আমরা পেরে উঠি না। আমাদের যত গলাবাজি তা সব দেশের ভেতরেই। ১৯৮২ সালের এলওএস কনভেনশনের ১২১ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট লেখা আছে An Island is a naturally formed area of land, surrounded by water, which is above water at high tide (and it enjoys its territorial sea, EEZ and continental shelf). Rocks which cannot sustain human habitation or economic life of their own shall have no exclusive economic yone or continental shelf. অর্থাৎ আইল্যান্ড বা দ্বীপ হলো চারদিকে পানির মধ্যে সৃষ্টি হওয়া একটা ভূ-খ-, যা জোয়ারের সময়ও ভেসে থাকে। এই দ্বীপগুলো টেরিটরিয়াল ওয়াটার, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং কন্টিনেন্টাল শেলফের ন্যায্য ভাগ উপভোগের অধিকার রাখে। তবে যেসব রক বা ভূ-খ- মানব বসতি বা কোনো অর্থনৈতিক ক্রিয়াকা- চালানোর উপযোগী নয় সেগুলো বিশেষ অর্র্থনৈতিক অঞ্চল বা কন্টিনেন্টাল শেলফ বণ্টনের সময় বিবেচিত হবে না।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি স্পষ্টতই জোয়ারের সময় ভেসে থাকে এবং সেখানে জনবসতি রয়েছে, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ কার্যশীল। তারপরও তাকে গণ্য করা হয়েছে শুধু মানব বসতি ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকান্ডের অনুপযোগী সমুদ্রে ভাসমান একটা শিলাখ- বা রকের মতো। সেন্ট মার্টিনকে ঘিরে টেরিটরিয়াল ওয়াটারের ১২ মাইলের সীমারেখাটি পেয়েই যেন আমরা আত্মহারা। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কন্টিনেন্টাল শেলফ নির্ধারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাগুলোকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে বা উপেক্ষা করা হয়েছে। পুরোপুরি আইল্যান্ডের বিবেচনাটি (Full Effect) না পেলেও এখানে আমাদের দরকষাকষি করে ন্যূনতম মাঝামাঝি জায়গায় (Partial effect) যাওয়ার একটা অবকাশ ছিল।

এটুকুও না করাতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সীমারেখাটি সেন্ট মার্টিনের উত্তরে সরে এসেছে। ফলে তেল-গ্যাসে ভরপুর বিশাল একটি এলাকা আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এই সীমারেখাটি যদি বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ বিন্দু ও তার টেরিটরিয়াল ওয়াটার থেকে আরো কয়েক মাইল দক্ষিণ দিকে সরিয়ে দিতে পারতাম তবে এটা হতো বাপের বেটি শেখ হাসিনার সমুদ্র জয়। সেই বিন্দু থেকে সীমানা শুরু করতে পারলে বা সেন্ট মার্টিনের ঋঁষষ বভভবপঃ ধরে রাখতে পারলে এটা হতো বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা। ঐধষভ বভভবপঃ পেলে বলা যেত, ‘চলে’।

এখন যা পেয়েছি তাকে কী বলা চলে? এমন সর্বনাশা হারার পরেও এটাকে সমুদ্র জয় বলে কোনো স্বাভাবিক মানুষ এমন উল্লাস করতে পারে? ৪. ইইজেড বণ্টনে সমদূরত্ব নীতি বনাম এঙ্গেল বাই সেক্টর একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ইইজেড বণ্টনে উপরোক্ত দুটি পদ্ধতির কোনটি প্রয়োগ হবে তা নিয়েই ছিল আমাদের মূল বিরোধ। মিয়ানমার চেয়েছে সমদূরত্ব নীতিতে ইইজেডের বণ্টন (২১৮ থেকে ২২৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত)। আমরা চেয়েছি এঙ্গেল বাই সেক্টর পদ্ধতির প্রয়োগ করে একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল বণ্টন করা (২১২, ২১৩, ২১৪, ২১৫)। পরস্পর মুখোমুখি দুটি দেশের সমুদ্রসীমা নির্ণয়ে সমদূরত্ব পদ্ধতিটি ন্যায্য হলেও পাশাপাশি দুটি দেশের ক্ষেত্রে এঙ্গেল বাই সেক্টর পদ্ধতিটি অধিকতর ন্যায্য হয়। তা ছাড়া একটি দেশের ইইজেড বলতে তার তটরেখা থেকে ঐ এলাকা বোঝায়, যা ঐ দেশের পলিপাতনের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে অগ্রসর হয়।

বাংলাদেশের এই দাবিগুলোর একটিও গণনায় নেয়া হয়নি (২৩৭-২৩৯)। অর্থাৎ এই রায়ের সবচেয়ে নীতিগত জায়গাটিতেই আমাদের পরাজয় হয়েছে। এভাবে নিক্তির হাতলে আরামসে হাতটি রেখে আমাদের পাল্লাটি আরেকটু দাবিয়ে দিতে চেয়েছিল মিয়ানমার। সদাশয় সালিসি আদালত তা করতে দেয়নি। মিয়ানমার চেয়েছিল এই রেখাটি ২৩২ ডিগ্রি আজিমুথ বরাবর টানতে।

এভাবে টানলে মানে রেখাটিকে উত্তর দিকে সরিয়ে দিলে আমরা স্বাভাবিক প্রাপ্য ২০০ নটিকেল মাইলও পেতাম না অর্থাৎ আমরা কাট অফ ইফেক্টে পড়ে যেতাম। এই কাট অফ ইফেক্ট এড়াতে সমদূরত্ব রেখাটিকে আরেকটু দক্ষিণে সরিয়ে ২১৫ ডিগ্রি আজিমুথ বরাবর করা হয়। এটাকেই আমরা আমাদের বিজয় বলে গণ্য করেছি। ভয়ংকর ব্যাপারটি হলো, বণ্টনের মূল নীতিতে হেরে যাওয়ার অর্থ হলো, আমরা ইন্ডিয়ার সঙ্গেও একইভাবে সমদূরত্ব পদ্ধতিটি মেনে নিতে বাধ্য হব। ব্যাপারটা হয়েছে, বাপ মারা গেছে তাতে তেমন কোনো সমস্যা নেই।

চিন্তার কারণ হলো, ভবিষ্যতে আসার জন্য যমে যে বাড়িটা চিনে গেল। ৫. কন্টিনেন্টাল শেলফ, সত্যিই বুকটা ফাইটা যায় ইইজেড হারানোর পর কন্টিনেন্টাল শেলফেও আমাদের দাবি টেকাতে পারিনি। আমাদের দাবি ছিল, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পলির পাতনে বঙ্গোপসাগরের সাগরতল গঠিত হয়েছে। আনকস কনভেনশনের আর্টিকেল ৭৬ অনুযায়ী ন্যাচারাল প্রলংগেশনের দরুন কন্টিনেন্টাল শেলফে শুধু আমাদের অধিকারই বর্তায়। মিয়ানমারের ল্যান্ড টেরিটরি থেকে ২০০ মাইলের পর বঙ্গোপসাগরে কোনো ন্যাচারাল প্রলংগেশন নেই।

মিয়ানমার দাবি করে, যে অঞ্চলকে আমরা সিএস দাবি করছি তা হলো তাদের ইইজেড এলাকা। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের geophysical characteristic and geomorphology of the ocean floor তুলে ধরেছে। আমাদের এই প্রচেষ্টা বা এফোর্টের প্রশংসা করেছে (অনুচ্ছেদ ৪২৪)। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আদালত আমাদের সব যুক্তিই শুনেছেন কিন্তু তালগাছটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মিয়ানমারকেই দিয়ে দিয়েছেন (অনুচ্ছেদ ৪৬১, ৪৬২)। ফলে ২০০ নটিকেল মাইলের দক্ষিণে ১৫০ মাইলের বিস্তীর্ণ এলাকা আমরা হারিয়েছি।

তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ একটা বিশাল এলাকা বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এই বেলায় আওয়ামী লীগের মহিলা এমপি মমতাজের গানটি মনে পড়ে, আমার বাড়ির সামনে দিয়া...হাঁইটা যায়, বুকটা ফাইটা যায়, বুকটা ফাইটা যায়। অর্থাৎ জনম জনম ধরে আমাদের বুকের ওপর দিয়ে যে পলি হেঁটে যাবে তা দিয়ে মিয়ানমারের সাগরের তল ভরতে থাকবে। সব্যসাচী লেখকগণ ও মমতাজের মতো গায়িকাগণ নিজেদের বুক বা হৃদয়গুলো আওয়ামী লীগের কাছে এভাবে বন্ধক না রাখলে তা আবারও ফাইটা যাওয়ার কথা ছিল। (সংগৃহিত) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.