পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
রামোজী ফিল্মী দুনিয়ার সামনে আমি
লাল টুকটুকে বাসে চড়ে পুরো রামোজীর পথে পথে ঘুরে শেষ হলো সিনেমা তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় বেশীরভাগ সেট দেখা। গাইড এবার আমাদের নিয়ে আসলো রামোজী এক কমপ্লেক্সে, নাম ফিল্মী দুনিয়া। টয় ট্রেনে চেপে আমরা দেখবো লন্ডন থেকে প্যারিস, নিউইয়র্ক, মাউন্ট রাশমোর হয়ে ব্যাংকক। পুতুলের মুখে শোনাবে সেই কাহিনী। এরপর ছোট ছোট টয় ট্রেনে চেপে শুরু হবে অন্ধকার গুহায় আমাদের যাত্রা।
টয় ট্রেনে চেপে যাত্রা শুরু
এখানে এসে আবার সিরিয়াল দিতে হলো। বেশ লম্বা লাইন ১৫ মিনিটের এই শো দেখতে আমাদেরকে আরো ১৫ মিনিট লাইনে অপেক্ষা করতে হলো। ট্রেনে উঠার আগে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তারা সবার ছবি তুলছে যা আমরা বের হয়ে আসার সাথে সাথে ডেলিভারি দিবে। দুজন দাড়ালাম ছবি তুলতে।
এরপর টয় ট্রেনে চেপে যাত্রা শুরু হলো, ট্রেন লাইনের দুপাশে স্টেজের উপর কৃত্রিম ভাবে তৈরী সিনেমায় দেখা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বহুল পরিচিত সব শহরগুলোর ল্যান্ডমার্ক।
এক এক করে পার হলো ....
নিউয়র্কের মাইলস্টোন স্ট্যাচু অব লিবার্টি
স্ট্যাচু অভ লিবার্টি পার হয়ে ঘোড়ায় টানা গাড়ি করে কোন শহরে আসলাম বুঝতে পারলাম না তারাহুড়ায়।
ফিল্মী দুনিয়ায় ঘোড়ার গাড়ি চলছে
প্যারিসের বিখ্যাত মলিন রুয়া থিয়েটার হল এর রেপ্লিকা
হলিউডে সিনেমার শ্যুটিং চলছে
রামোজী গ্রুপ অব কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতাদের চেহারা রাশমোর পাহাড়ে
আমেরিকার এই জাতীয় সৃতিস্তম্ভটি তাদের অংগরাজ্য দক্ষিন ডাকোটার রাশমোর পাহাড়ের গায়ে গ্রানাইটে খোদাই করা। এই ভাস্কর্য্যে রয়েছে আমেরিকার চারজন বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, থিওডর রুজভেল্ট আর আব্রাহাম লিংকনের মুখ।
অরিজিনাল মাউন্ট রাশমোরের ছবি নেট থেকে নেয়া।
ফিল্মী দুনিয়া দেখে মনে হলো এটা মুলতঃ বাচ্চাদের জন্যই বেশী উপভোগ্য।
তবে চেহারা দেখে মনে হলো বড়রাও বাদ যায় নি মজা পেতে।
সে দুনিয়া থেকে বের হয়েই দেখি আমাদের ছবিগুলো ডেলিভারী দিচ্ছে। লোকজনের ভীড় ঠেলে কাছে গিয়ে দাড়ালাম। কম্পিউটারে দেখে যুবকরা বলছে কোনটা নেবেন ? সেকেন্দ্রাবাদ না রামোজী ব্যাকগ্রাউন্ড? তবে তারা জানালো সেকেন্দ্রাবাদ ব্যাকগ্রাউন্ডে যথারীতি আমার চোখ বন্ধ। শুনে রামোজী ব্যাকগ্রাউন্ডটাই নিলাম।
তবে জানালো সফট কপি দেয়ার কোন উপায় নেই। সেখানে সবাই উদগ্রীব তাৎক্ষনিক ভাবে নিজেদের চেহারা দেখার জন্য,আমিও ছিলাম বটে।
এরপরের প্রোগ্রাম হলো এ্যাকশন থিয়েটার রামোজী ম্যুভি ম্যাজিক বিল্ডিং এ ।
রামোজী ম্যুভি ম্যাজিক বিল্ডিংএর সামনের অংশটুকু
সেই ম্যাজিক থিয়েটারে ঢোকার সময় বাচ্চাদের চেঁচামেচিতে গেটের পাশেই উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি এক প্রমান সাইজ স্পাইডারম্যান বসে আছে। তার এ্যকশন দেখে মনে হলো এখনি ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়বে।
এখানে দেখাবে একটা সিনেমা তৈরী করতে গেলে যে শ্যুটিং ডাবিং থেকে এডিটিং হয় তার যাবতীয় গোপন রহস্য ।
স্পাইডারম্যান
অনেক পর্যটকদের সাথে সারিবেধে আমরা দুজন ঢুকলাম একটা প্রশস্ত রুমে। সেখানে দেখি এক দিকের দেয়ালের উপরের দিকে একটা মোটামুটি বড় স্ক্রীন। সেখানে আমাদের সাধারন একটা ব্রিফিং দেয়া হলো রামোজীর প্রতিষ্ঠা, সিনেমার উন্নতি নিয়ে তাদের চিন্তা ভাবনা, আকর্ষনীয় শ্যুটিং স্পট তৈরী, একটা ম্যুভি তৈরীর জন্য অত্যাধুনিক সুযোগসুবিধার পরিবেশ তৈরী এসব। ঘাড় উচু করে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে শুনতে শুনতে ভাবছি আজ আমার সারভ্যাইক্যাল স্পন্ডেলাইসিসের ব্যাথা বাড়ার হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
এভাবে যদি লোকে লোকারন্য রুমে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সিনেমা বানানো দেখতে হয় !
এমন সময় শুনটে পেলাম ইংরাজীতে এক ভদ্রলোক তার অসাধারন মার্জিত আর আকর্ষনীয় গলায় আমাদের মাঝ থেকে দুজন ভলেন্টিয়ার আহ্ববান করছে। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। দুজন অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়ে এগিয়ে গেল। ভাবছি এখন কি হবে?
এমন সময় মাইক্রোফোনে ঘোষনা হলো আমরা যেন পাশের রুমে গিয়ে আসন গ্রহন করি কৃপা করে। বিস্মিত নয়নে চেয়ে দেখি সেই স্ক্রীনের নিচের প্লেন দেয়ালটিতে এক পাল্লা এক পাল্লা করে মোট পাঁচটা দরজা আড়াআড়ি ভাবে চিচিং ফাকের মত খুলে গেল।
তার ওপাশে বিশাল এক অডিটোরিয়াম। আমরা সবাই গিয়ে আসন গ্রহন করলাম থাকে থাকে নেমে আসা সেই গ্যালারীতে।
সামনে তাকিয়ে দেখি একটা স্টেজ তাতে কাঠের একটা টাংগার উপরের অংশটুকু। অর্থাৎ চাকা ছাড়া টাংগাটি একটি মোটা লোহার রডের উপর রাখা। আর এক কোনে এডিট আর সাউন্ড মিক্সিং মেশিন।
সুন্দর কন্ঠস্বরের অধিকারই সেই হ্যান্ডসাম উপস্হাপক জানালো তারা আমাদের বিখ্যাত ম্যুভি শোলের একটি দৃশ্য তৈরী করা দেখাবে।
আমার স্বামী নড়ে চড়ে বসলো। এই ভদ্রলোক অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দেখতে কখোনো ক্লান্ত বোধ করে না। টিভি ছাড়লে সেটা যেখান থেকেই শুরু হোক। আর শোলে মনে হয় হাজারবার দেখা।
টাংগার সামনে দুটো মোটা দড়ি রাখা যার এক মাথা স্টেজের সাথে আটকানো, আর পাশে একটা চাবুক । এবার আমাদের থেকে বেছে নেয়া দুজন অমৃতা আর রাজেন কে ডাকা হলো স্টেজের পেছন থেকে। জীনসের প্যান্ট আর ফতুয়া পড়া অমৃতা হলদে লেহেংগা আর মেকাপে বাসন্তী সেজে স্টেজে আসলো।
উপস্থাপক বল্লো 'অমৃতা টাংগায় বসে দড়ি দুটো ধরে টান দাও, এবার চাবুক মারো, ওকে এবার পেছন ফিরে তাকাও'
এটা তাকে কয়েকবার করতে বল্লো ভদ্রলোক। সেই সাথে রাজেন কে বল্লো 'তুমি লোহার রডটা ধরে টাংগাটা দোলাতে থাকো'।
এভাবে কিছুক্ষন করার পর আবার আমাদের পাশের রুমে এমনই একটি অডিটোরিয়ামে নিয়ে গেল। সেখানে টাংগাটি নেই কিন্ত এডিট করার যন্ত্রটি রয়েছে। এখানে উনি দেখালো একটু উপর থেকে মুঠি করে বালু ছেড়ে দিলে মাইক্রোফোনে কেমন ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ হয়, দুটো লোহার বাটি একটার সাথে আরেকটা বাড়ি দিয়ে ঘোড়ার খুরের ক্লপ ক্লপ শব্দ করে শোনালো,পাতলা একটা টিন নাড়ালে ঝড়, আর একটা গোল মেশিন ঘুরিয়ে শো শো বাতাসের শব্দ শোনালো। এরপর আমাদের থেকে চারজন ছেলেকে ডেকে নিয়ে উনি এই শব্দগুলো করালেন। উনি ছিলেন এডিট মেশিনের সামনে।
পেছনের স্ক্রীনে দেখলাম সেই ঘোড়া ছাড়া আমাদের অমৃতার টাংগা আর তার পেছনে তিন চার জন দস্যু ঘোড়াসওয়ার তাকে খুজে বেড়াচ্ছে।
আবার পাশের রুমে যাবার আমন্ত্রন। সেখানে এবার বিরাট স্ক্রীন। ভদ্রলোক তাৎক্ষনিক ভাবে ঘোড়াবিহীন টাংগায় চড়া অমৃতাসহ চারটি ছেলের করা সেই শব্দগুলো জুড়ে দিয়ে আমাদের পর্দায় দেখালো কি ভাবে অমৃতা জংগলের মধ্যে এক সাদা ঘোড়ায় টানা টাংগা করে দ্রুত পালাচ্ছে আর তার পেছনে সেই দস্যুগুলো ঝড় বৃষ্টির মধ্যে তাকে অনুসরণ করছে।
অসাধারণ সেই ম্যুভি ম্যাজিক।
এগুলোর কোন ছবি দিতে পারলাম না কারন মনে করতে পারছি না ছবি তোলা নিষেধ ছিল নাকি আমরাই মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম।
এর ফলে একটাই ক্ষতি হয়েছে আমাদের। আর তাহলো এখন সিনেমা দেখতে বসলেই মনে হয় কিসের আমেরিকা কিসের সুইজারল্যান্ড এগুলো সবই মনে হয় রামোজী অর্থাৎ স্টুডিউতে করা।
ক্ষিদায় পেট চোঁ চোঁ করছে। ব্রোশিওরে কয়েকটা রেষ্টুরেন্টের নাম রয়েছে।
এক একটায় এক এক ধরনের খাবার।
আমার স্বামীর ইচ্ছা সুপার স্টার যেখানে মাল্টি কুইজিন ।
সুপার স্টার রেষ্টুরেন্ট
কিন্ত ঐ গরমে আমার মনে হলো দক্ষিনী খাবারটাই ভালোলাগবে। টক দই সাথে ভেজিটেবল খাবার। মাছ মাংস আর ভালোলাগছিল না।
তাই আমার পছন্দ মত ঢুকলাম দিল সে রেষ্টুরেন্টে। যতদুর মনে ১৫০ টাকা করে পারহেড। ব্যুফে সিস্টেম। দারুন পরিষ্কার পরিছন্ন সেই সাথে অত্যন্ত উচু মানের রান্না এবং পরিবেশ ও পরিবেশনা।
সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারের রেষ্টুরেন্ট দিল সে
খাওয়া শেষে কিছুক্ষন বসে রইলাম ইউরেকা কমপ্লেক্সে ছাতার নীচে লম্বা মতন চেয়ারগুলোয়।
এমন সময় একটি মেয়ে এসে আমার স্বামীর হাতে একটা ফর্ম দিয়ে অনুরোধ করলো রামোজী ফিল্ম সিটির ব্যাপারে তার ফিডব্যাক জানাতে। আমার স্বামী সবই ভালো বল্লো, সবকিছুই সুন্দর মোহনীয়, যথাযথ, অত্যাধুনিক এবং পরিস্কার টয়লেট থেকে শুরু করে সবকিছু ভালো। কিন্ত একটাই খারাপ সেটা হলো লেগ গার্ডেন দেখতে না পারা। এরপর আমরা নিজেরা নিজেরা ঘুরে বেড়ালাম।
তৎক্ষনাৎ তোলা ছবি হাতে নিয়ে আমি
শুনলাম ওখানে ব্যাক্তিগত অনেক অনুষ্ঠানও করা যায়।
কোটি কোটি পতিরা হয়তো করে সেসব । সেখানে থাকার জন্য রয়েছে অত্যন্ত উচূ মানের কিছু হোটেল নাম সিতারা, তারা এসব নামের। সিতারায় সব বড় বড় ফিল্ম স্টাররা উঠে।
সান ফোয়ারার সামনে সবচেয়ে দামী হোটেল সিতারা
বাচ্চাদের জন্য রয়েছে ফান্ডাস্তান। যার ভেতরে তাদের মনরন্জনের জন্য নানা রকম ম্যাজিক, গুহার মধ্যে ওদের প্রিয় ভয়ংকর সব চরিত্র।
ওগুলো আর আমরা দেখি নি।
ফান্ডাস্তানের প্রবেশপথে আমি
সবশেষে ছিল আরেকটি শো, ওয়াইল্ড ওয়েস্টার্ন শো। একসময়ে আমেরিকার পশ্চিমে কাউবয়দের জীবন যাত্রা । এটা আমি থাইল্যান্ডের সাফারী পার্কে দেখেছি বলে খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না। কিন্ত সেখানে পরিচিত এক দম্পতির আহব্বানে এড়াতে পারলাম না ।
ওয়াইল্ড ওয়েষ্ট শো এর অডিটোরিয়াম আর স্টেজে সাজানো সে সময়ের আমেরিকার পশ্চিমের একটি শহরের দৃশ্য।
এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে প্রায় যাবার সময় হয়ে আসলো। অপেক্ষা করছি ক্লোজিং শো এর। ইউরেকার বিশাল চত্বরে রামোজীর সব নৃত্য শিল্পী যাদুকর, এক্রোবেটের সন্মিলনে শুরু হলো সেই বিশাল শেষের অনুষ্ঠান। সাথে বিভিন্ন উপজাতীয় নাচ।
রামোজী ফিল্ম সিটির সমাপ্তি অনুষ্ঠান
কখন যে সময় হয়ে গেল বাসে চড়ার টেরই পেলাম না। আমাদের সাথে হায়দ্রাবাদ থেকে আসা এক পর্যটকের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। ওহ বাস ছাড়ার সময় তো হয়ে এসেছে, দৌড়ে এক বোতল পানি কিনে চড়ে বসলাম আমার সেই পছন্দের সামনের সীটে।
বাস চলতে শুরু করলো, আস্তে আস্তে পার হয়ে আসলাম রামোজীর গেট
একদম মেইন রোডের উপর মেইন গেটের কাছে এসে বাস দাড়ালো। অনেকে নেমে গেল তাদের জমা রেখে যাওয়া জিনিস আনতে।
আমার স্বামী নামলো বেনসনের প্যাকেটটা ফেরত আনতে আমি বাস থেকে নেমে ছবি তুল্লাম আমার প্রিয় তালগাছের ফাকে সূর্যের বিদায় মুহুর্তের।
তালগাছের ফাকে সূর্যের বিদায়
বিদায় রামোজী ফিল্ম সিটি। এখানে না আসলে এই আলো ঝলমল জগতের অনেক কিছুই অজানা থাকতো। কেউ কেউ হয়তো বলবেন টিভিতে অনেক দেখেছি এসব, যা কিনা আমিও দেখেছি। কিন্ত নিজ চোখে দেখার আবেদনই অন্যরকম।
ধন্যবাদ অসাধারন একটি দিন উপভোগের সুযোগ করে দেয়ার জন্য । ধন্যবাদ যারা আমাদের রামোজী দেখার জন্য প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল।
চার পর্বে লেখা আমার এই পোষ্ট আমি সামহোয়্যার ইন ব্লগের একজন সিনেমা পাগল ব্লগার মাষ্টারকে উৎসর্গ করলাম।
সামুর প্রবলেমের কারনে আরো কিছু ছবি দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
ছবিগুলো সব আমাদের ক্যামেরায় তোলা শুধু অরিজিনাল মাউন্ট রাশমোরের ছবিটা ছাড়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।