আমাদের দেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিকদল যথাক্রমে-আওয়ামীলীগ ও বিএনপি কার্যত শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মালিকানাধীন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পরিনত হইয়াছে । তাই এই দুইটি দলকে জনগনের সেবা করার মানসিকতা সম্পন্ন রাজনৈতিকদল হিসাবে বিবেচনা করার কোন যুক্তি আমি অন্তত খুজে পাই না । এই দুইটি দলে যে সকল বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী রয়েছেন, তাদেরকে আসলে নেতা তো দূরের কথা ঐ দুইটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বলতেও আমি দ্বিধাবোধ করি । কারন, এদের পক্ষে জনগনের অধিকারের কথা বলা তো দূরের কথা, দলীয় প্রধানের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কোন কাজ করার বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন এখতিয়ার দলে দ্বিতীয় আর কোন ব্যক্তিরও নেই । দলীয় প্রধানের মনোভাব বুঝেই সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা চলতে বাধ্য ।
এর অন্যথায় হলেই দল থেকে আউট- কোন কারন দর্শানো ছাড়াই । এর প্রতিকার পাওয়ারও কোন সুযোগ নাই । আপনি দলের জন্য যতই ত্যাগ স্বীকার বা জেল জুলুম সহ্য করুন না কেন বা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল কর্তৃক নির্যাতিত হউন না কেন বা দলে আপনার যতই অবদান থাকুক না কেন এর কোনই মূল্য নেই, যদি আপনি দলীয় প্রধানের কটূ দৃষ্টিতে পড়ে যান । আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিকদল দুটিতে দলীয় প্রধানগনের বাইরে আর যারাই নিজেদের ছোট-বড় নেতাকর্মী মনে করুন না কেন, দলে তাদের প্রকৃত অবস্থান কৃতদাসের ন্যায় । কারন, বাড়ির চাকর-বাকর বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা তো কাজ করেন মাসিক বেতনের ভিত্তিতে যা সম্পূর্ন হালাল উপার্জন কিন্ত দলীয় নেতা কর্মীরা কি অনুরুপ কোন বেতন ভূক্ত কর্মচারী ? নিশ্চয়ই না ।
তারা তো বেতন পানই না, বরং অনেককে নিজের পকেটের টাকা খরচ করেও রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করতে দেখা যায়। কিন্ত দল সরকারে গেলে তারা কি কোন বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ পায় ?অবশ্যই না । তাদেরকে তখন নানা অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করতে হয়,যেমন-চাঁদাবাজি,টেন্ডারবাজি,মাদকব্যবসা,জোর-জুলুমের মাধ্যমে অন্যের জায়গাজমি দখল করা এবং যাদের ছত্রচ্ছায়ায় এই সকল অপকর্ম চালায়, তাদের নির্দেশে খুন-খারাবি পর্যন্ত তাদেরকে করতে হয় । আর এই সব করতে গিয়ে যে কত নিরীহ ছেলের জীবন চলে গিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই । আর অন্যদিকে যারা প্রকৃতপক্ষে জনগনের সেবার নিমিত্তে নেতা হতে চান বা নেতৃত্বে দিতে চান, তাদেরতো মনোনিত হতে হয় একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে ।
উদ্দেশ্য-তার নেতৃত্বে রাষ্ট্র থেকে ঐ জনগোষ্ঠীর জন্য আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করা । কিন্ত প্রকৃতপক্ষে আমরা কি দেখি ? কথিত ঐ দলদুটির প্রধানগন তাদের অধিনস্থ বিশ্বস্থ কিছু লোককে দায়িত্ব প্রদান করে থাকে তৃনমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্ব নির্বাচন করার জন্য । ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঐ সকল ব্যক্তিরা তাদের পছন্দমত এবং একান্ত অনুগত লোকদেরকেই বাছাই করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা নির্বাচন করার জন্য । এই প্রক্রিয়ায় নেতা হওয়ার জন্য ঐ সকল ব্যক্তিদের যোগ্যতা বা জনসমর্থন থাকা বা না থাকা কোন বিবেচ্য বিষয় হিসাবে কাজ করে না । এই প্রক্রিয়ায় নেতা বনে যাওয়ার জন্য নির্বাচকদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে দেওয়ালে দেওয়ালে সাটাতে হয় বড় বড় ছবিওয়ালা পোষ্টার, যাতে থাকে নির্বাচকদের ও দলীয় প্রধানদের ছবির সাথে নেতা হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদেরও ।
এই প্রক্রিয়ায় নেতা নির্বাচিত হওয়ার ফলে তারা অবশেষে পরিনত হয় দলীয় ক্যাডার বা ব্যক্তিগত লাঠিয়ালে । নির্বাচকদের হুকুম তামিল করাই হয় তাদের একমাত্র কাজ-হউক তা ভালো বা মন্দ । আর তাদের উপরস্থ নিয়ন্ত্রনকারীরাও তাদের উপর নিয়ন্ত্রন বজায় রাখার জন্য ঐ সকল ক্যাডার বা লাঠিয়ালদের নানা অবৈধ কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দেয়, যার একটা অংশ আবার নিয়ন্ত্রনকারীরাও পেয়ে থাকে । আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির তৃনমূল থেকে সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত অনুরুপ পদ্ধতিতেই নেতা নির্বাচিত হয়ে থাকে । ফলে প্রকৃতপক্ষে কোন ভাল মানের নি:স্বার্থবান, জনগনের জন্য কাজ করতে পারে বা জনগনের পক্ষে কথা বলতে পারে এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্ব তৈয়ার হওয়ার কোন সুযোগই থাকে না ।
কারন, চামচাগিরি বা হুকুমতামিল করা আর যাই হোক আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কোন বিবেকবান ব্যক্তির পক্ষে কখনও সম্ভব নয় । আর আত্মসম্মানবোধহীন ও বিবেকহীন-স্বার্থপর লোকের পক্ষে জনগনের নেতা হওয়া সম্ভবপর না । কারন, অনুরুপ চরিত্রের লোকদের সাধারন মানুষ প্রকাশ্যে বিরোধীতা না করলেও তলে তলে খুবই অপছন্দ করে এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের সময় ঠিকই তার বিরুদ্ধেই সিদ্ধান্ত প্রদান করে থাকে । এইভাবে দলীয়প্রধানদের খেয়াল খুশীমত নেতাকর্মী নির্বাচনের ফলে আস্তে আস্তে দলগুলি সরকার পরিচালনা করার উপযোগী যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে ক্রমশ অক্ষম হয়ে পড়ছে যার জ্বলজ্যান্ত উদাহরন বর্তমান সরকারের মন্ত্রীসভা । বর্তমান সরকারীদলে অনেক যোগ্য ও অভিজ্ঞ নেতা থাকা সত্বেও শুধুমাত্র দলীয়প্রধানের আজ্ঞাবহ না হওয়ার কারনে দলীয় গুরুত্বপূর্ন পদ হারানোর সাথে সাথে মন্ত্রীপরিষদেও তাদের জায়গা হয়নি ।
তাদের মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের পরিবর্তে দলীয় প্রধানের আজ্ঞাবহ হওয়াই যাদের একমাত্র যোগ্যতা, সেইরকম আনকোড়ারাই বর্তমান সরকারের মন্ত্রীপরিষদের সৌন্দর্য্য বর্ধন করছে । যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে সরকার চরম হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়েছে । এই জন্য তো দলীয়প্রধান তথা সরকারপ্রধানদের “দেশের চেয়ে নেতা বড়” নীতিই একমাত্র দায়ী । এই নীতিটা শুধুমাত্র বর্তমান সরকারীদলের জন্যই প্রযোজ্য নহে, বর্তমান প্রধান বিরোধীদলও একই নীতিতে চলমান আছে । উভয় দলই এই নীতির কারনে বর্তমানে চরম নাজেহাল অবস্থায় আছে ।
নেতাকে দলের ও দেশের উর্ধ্বে স্থান দিতে গিয়ে একাধারে তারা শুধু দেশের ক্ষতিই করছে না, সেই সাথে তারা নিজ দলেরও বারোটা বাজানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এনেছে ,যেদলই কিনা তাদেরকে রাজনীতিবিদ হিসেবে বর্তমানে দলের ও দেশের শীর্ষ স্থানে নিয়ে এসেছে । দুইটি প্রধান রাজনৈতিকদলই ক্রমশ অভিজ্ঞ ও দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ছে, দলে তাদের একক কর্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে । আর অভিজ্ঞ ও দক্ষ রাজনীতিবিদদের জায়গা দখল করছে শীর্ষ নেতৃত্বের একান্ত অনুগত ব্যক্তিত্বহীন,বিবেকহীন, জনগনের জন্য যারা ভীতিকর, দূর্নীতিপরায়ন ও লম্পট চরিত্রের অধিকারী সন্ত্রাসী প্রকৃতির অপেক্ষাকৃত কমবয়সী ছেলেপুলেরা । ফলে এই দুইটি প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগনের দৃষ্টিভংগির ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে । যার দুইটি নমুনা আমরা নিকট অতীতে প্রত্যক্ষ করেছি শাহবাগের জনজাগরনে ও মতিঝিলের শাপলাচত্বরের হেফাজতে ইসলামের বিশাল সমাবেশে ।
দুইটি সমাবেশেই সাধারন মানুষের অংশ গ্রহন ছিল স্বত:স্ফূর্ত । দুইটি সমাবেশেই আমি প্রত্যক্ষ করেছি আমাদের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দলের প্রতি সাধারন মানুষের চরমবিরক্তিকর মনোভাব । সাধারন মানুষ যেকোন মূল্যেই চায় একব্যক্তির শাসনের অবসান হউক । একব্যক্তি কেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থায় জনগনের আকাংখা চরমভাবে অবহেলিত হয় । একব্যক্তি যিনি দলের ও সরকারের প্রধান থাকেন, তাকে তুষ্ট করতেই দলের সকল নেতাকর্মী ও পুরা রাষ্ট্রযন্ত্র সবসময় ব্যস্ত থাকায়, জনগনের জন্য কোন কিছু করার ফুসরত তাদের থাকে না ।
আর জনগন যেহেতু অনেক প্রত্যাশা নিয়ে কোন একটি রাজনৈতিকদলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মসনদে বসায়, সেহেতু একবার দু,বার তাদের প্রত্যাশার নূ্ন্যতমও যদি পূরন করা না হয়, তবে কেন তারা বার বার ঐ সকল দলগুলিকে সমর্থন দিবে ? এতোটুকু বাস্তবতা যদি কোন দলের প্রধানগন না বুঝেন, তবে কিভাবে তাদের দলের প্রতি থাকা বিপুল জনসমর্থন তারা ধরে রাখবেন ? বিগত চারটি নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে সরকারীদল প্রতিবারই হারে । শুধু হারে বললে ভূল হবে কারন, প্রথমবার যে ব্যবধানে হারে দ্বিতীয়বার তার চেয়ে অনেক বেশী ব্যবধানে হারে । এর থেকে কি পরিলক্ষিত হয় ? দলদুটির প্রতি জনগনের অনাস্থার মাত্রা দিনকে দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে । জনগন আর এখন রাজনৈতিকদলের মেনোফেস্টো দেখে ভোট দেয় না । ভোট দেয় সরকারীদলের ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক কার্যকলাপকে দমাতে ।
কারন, আমাদের দেশে সরকারীদল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জনগনের আশা আকাংখা পূরনের লক্ষ্যে যেখানে কোন ভালো কাজের ধার ধারে না, সেখানে বিরোধীদলের তো কোন সুযোগই থাকে না জনগনের জন্য ভালো কিছু করার । আবার বিরোধীদলের জন্য যেটুকু ভূমিকা রাখার নিতান্তই প্রয়োজন, সেটুকুও তারা সংসদ বর্জনের মাধ্যমে জনগনকে বঞ্চিত করে থাকে । সুতরাং তারপরও কেন সেই বিরোধীদলকেই ভোট দিয়ে আবার ক্ষমতার মসনদে বসায় ? কারন জনগনের সামনে আর কোন বিকল্প থাকে না । শুধুমাত্র এই কারনেই আমাদের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল এখনও টিকে আছে এবং এরাই পালাক্রমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ-দখল করছে । কিন্ত এইভাবে আর কতকাল ? কারন একব্যক্তির কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গিয়ে পুরোদলটাই দেশ পরিচালনার মতো নেতাশূন্য হয়ে পড়ছে ।
একব্যক্তি দিয়ে তো আর পুরো সরকার চালানো সম্ভব নয়, যার নজীর আমরা বর্তমানে প্রত্যক্ষ করছি । সুতরাং এর অবধারিত পরিনতি -দলদুটির ক্রমশ সাইনবোর্ড সর্বস্ব রাজনৈতিক দলে পরিনত হওয়া অর্থ্যাৎ একদলের একনেতা যেমন-জাসদের হাসানুল হক ইনু,ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদীদলের দিলীপ বড়ূয়া আর অদূর ভবিষ্যতে হয়ত বলব- শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ, খালেদা জিয়ার বিএনপি যদি না তারা তাদের এই নীতি বদলায় যে, “দেশের চেয়ে নেতা বড় । ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।