শান্তির জন্য সংগ্রামী এ্দেশ বরাবরই জটিল আর জটিল তার মানুষের ভিতরটাকে বোঝা। তবে একটু ইতিহাস ঘেটে দেখলেই পরিষ্কার চোখে অনেক কিছুই দেখা যায়।
শিরোনামে উল্লিখিত দুটি রাজনৈতিক দলের নাম বর্তমানে এদেশের প্রতিটি মানুষের অত্যান্ত সুপরিচিত। কারন এদেশের মানুষ অনেকদিন থেকেই এই দুটি দলকেই ক্রমান্বয়ে তাদের ভাগ্যের পরিবরতন হওয়ার আশায় একের পরিবরতে অন্যকে সমর্থন ও ভোট দিয়ে তাদের শাসন করার সুযোগ দিয়ে আসছে। এবং অসংখ্য নেতা ও কর্মী এই দুটি দলের রাজনীতির সঙ্গেও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।
কিন্তু সেই দুটি দলের প্রত্যক্ষ অনেক কর্মীরাই জানেনা কারা এবং কী উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অথবা তাদের সত্যিকার রাজনীতি শেখার ও বোঝার জন্য ঐতিহাসিকভাবে কে সমৃদ্ধ ও সমর্থন প্রাপ্তির দাবীদার। এই লক্ষ্যেই আমার এই ব্লগটি লেখা।
খেয়াল করলে দেখা যাবে সাংগঠনিক ভাবে ব্রিটিশ ভারতে প্রথম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জন্মলাভের মধ্য দিয়েই মুলত রাজনৈতিক দলের উৎপত্তির শুরু। ক্রমান্বয়ে মুসলিম লীগ ব্রিটিশ ভারত বর্ষে ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়। এর আগে ভারত বর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে বা রাজ্যে অনেক আঞ্চলিক দল বা সমিতি বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছিল।
সেগুলোর একত্রকরনেই মুলত কংগ্রেস জন্ম নেয়।
নিখিল ভারতের একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস যখন বিভিন্ন দাবি দাওয়ার প্রশ্নে ব্রিটিশ সরকারকে হুমকীর সম্মুখীন করে তুলছে তখন ব্রিটিশরা লর্ড মিন্টোর মাধ্যমে উগ্র মুসলিমদের দিয়ে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠন করালেন নিখিল ভারতীয় মুসলিম লীগ, এরপর ক্রমান্বয়ে গদর পারটি, নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভা, সাউথ ইন্ডিয়ান পিপলস এসোসিয়েশন, রুশ বিপ্লবের পরে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি(সিপিআই), অকালী দল, স্বরাজ পার্টি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, খুদা-ই খিদমতগার ও আনজুমান-ই-নওজোয়ান-ই-সরহাদ, খাকসার আন্দোলন, কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি, নিখিল বঙ্গ ক্রিষক প্রজা পার্টি, ফরোয়ারড ব্লক, রেভলিউশনারী সোস্যালিস্ট পার্টি, র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী হিন্দ এরকম আরও অনেক পার্টিই ব্রিটিশ ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে যুক্তবাংলায় 'অনুশীলন' ও 'যুগান্তর' নামে দুটি গোপন বিপ্লবী গ্রুপের অস্তিত্বও পাওয়া যায়। এইসব জাতীয়তাবাদী, কমিউনিস্ট, ধর্মভিত্তিক যারাই যে উদ্দেশ্য গঠন হয়ে থাকুক ২/১টি দল বাদে অন্যসব দলই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। কেউ সরাসরি ইংরেজের বিরুদ্ধে আবার কেউ ইংরেজের সঙ্গে সমঝোতায়।
কেউ কেউ ইংরেজের বিরোধীতাকারী দলের বিরোধীতা করতে গিয়ে ইংরেজের সঙ্গেও আতাত করেছিল। এহেন ঘটনা পরিক্রমায় ১৯৪৭ সালের আগস্টে ইংরেজ ভারত বর্ষ ছেড়ে বিদায় নেয়, কিন্তু রোপন করে যায় 'দ্বিজাতি তত্বে'র বিষবাষ্প।
১৯৪৭ সালে তথাকথিত 'দ্বিজাতি তত্বে'র ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্থান বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করলে সেইসব রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাই রাজনৈতিক অবস্থান ও আবাসস্থল পরিবরতন করে।
যেমন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ একসময় হিন্দু মহাসভা নামের আড়ালে পরবর্তীতে বিজেপি নামে সংগঠিত হয় এবং জামায়াতে ইসলামী হিন্দ পরিবর্তন হয়ে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্থান এরকম নামের পরিবর্তনও অনেকেই করে।
১৯৪৭ সালের পর সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী ও চেতনাগত পরিবর্তন হয় পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্থান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে।
১৯৩০ ও ১৯৪০ এর দশকের তরুন ছাত্র যুবক শ্রেনী যারা স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখে রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল তাদের খুব অল্প সংখ্যক কমিউনিস্ট পার্টিতে ও কংগ্রেসে এবং ব্যপক সংখ্যক যোগ দেয় মুসলিম লীগে। কেননা, তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বাংলায় বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক(স্বল্প সময়), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী, আবুল হাশিম ও মওলানা ভাসানী। এদের বিশেষত সোহরাওয়ারদী ও আবুল হাশিমের উদার রাজনৈতিক মনোভাব ও তার প্রতিফলনে বাঙালি মুসলমান তরুন ছাত্র, যুবক ব্যপকভাবে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পাকিস্থান স্বাধীন হওয়ার পরে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র। একদা পাকিস্থান আন্দোলনে যেসব নেতা ও ব্যক্তি নিজের জীবন যৌবন বিসর্জন দিয়ে সংগ্রাম করেছে তারাই নিজেদের আবিষ্কার করেছে স্বাধীন পাকিস্থানে পরাধীনরুপে।
একদা যারা পাকিস্থান আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্যায়ে স্বাধীন যুক্ত বাংলার জন্য দাবি তুলেছিল তারাই নিজেদের আবিষ্কার করেছে ক্ষমতায় আসীন লুটেরা শ্রেনী গোষ্ঠীর পদানত রাজনৈতিক শ্রমিক হিসেবে।
এইসব ঘটনার প্রেক্ষিতে পাকিস্থানের স্বাধীনতা লাভের অল্পদিনের মধ্যেই পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ভিতরে ঘটে তুমুল রাজনৈতিক পরিবর্তন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সাংস্কৃতিক সংগঠন তমুদ্দুন মজলিশ গঠিত হয়। কিন্তু মুসলিম লীগের সমর্থক প্রগতিশীল ছাত্ররা রাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করার অভিপ্রায়ে ১৯৪৮ সালে গঠন করে ছাত্রলীগ। যে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনটি কোন অবিভাবক ছাড়াই নিজেরা পরিচালিত হয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রদান কর্মসুচীর মধ্য দিয়ে।
আগেকার মুসলিম লীগ দখল করে জমিদার ও সামন্ত শ্রেনীর ক্ষমতালোভী গোষ্ঠীটি। কমিউনিস্ট পার্টিও নতুনভাবে কাজ শুরু করে। ১৯৪৯ সালে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করে গঠিত হয় আওয়ামী লীগ। ‘৫১তে গনতান্ত্রিক যুবলীগ এবং ছাত্রলীগ থেকে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি বেরিয়ে আগেকার কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশন নতুনভাবে জন্ম নেয় ছাত্র ইউনিয়ন নামে। মুসলিম লীগের ইসলামী জাতীয়তাবাদীরা গঠন করে খেলাফতে রব্বানী পার্টি।
আওয়ামীলীগ অসাম্প্রদায়িক দলে উন্নীত হওয়ায় প্রথম ভাঙ্গনের মুখোমুখি হয়। মধ্য পঞ্চাশের দশকে ছাত্রলীগ থেকে একদল ছাত্র বেরিয়ে গঠন করে ছাত্রশক্তি নামক ছাত্র সংগঠন। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাপ(ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি)। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুরোধা সংগঠন আওয়ামী লীগের ভিতরে বাস করা কমিউনিস্টরাই মুলত ন্যাপে চলে যায়। আইয়ুব ক্ষমতায় এসে মুসলিম লীগকে ভাগ করে নিজের দখলে রাখেন কনভেনশন মুসলিম লীগ ও আরেক অংশ কাউন্সিল মুসলিম লীগ নামধারন করে।
ক্ষমতাসীন কনভেনশন মুসলিম লীগের ছত্রছায়ায় গঠিত হয় ছাত্র সংগঠন এনএসএফ(ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন)। আওয়ামী লীগ আবার বিভক্ত হয়ে পিডিএম(পাকিস্থান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট)পন্থী নামধারন করে যা পরবরতীতে পাকিস্থান ডেমোক্রেটিক পার্টি নাধারন করে যেখানে আওয়ামীলীগ ও মুসলিম লীগের অনেকেই আশ্রয় নেয়। এই সময় গনতান্ত্রিক পার্টি নামেও একটি দল গঠিত হয়। ব্রিটিশ আমলের কংগ্রেস ক্ষীনকায় চলতে থাকে, ধর্মভিত্তিক জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম দল গুলোও ক্রীয়াশীল ছিল। জুলফিকার আলী ভুট্টো আইয়ুবের কনভেনশন মুসলিম লীগের সাধারন সম্পাদকের পদ থেকে বেরিয়ে গঠন করে পিপিপি।
কমিউনিস্টদের মধ্যে মস্কো ও চীনাপন্থী এই দুইভাবে বিভক্ত হয়ে মুল ন্যাপে(ভাসানী) থেকে যায় চীনাপন্থীরা বেরিয়ে আরেকটি ন্যাপ(মোজাফফর) গঠিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরের চিনাপন্থীরাও বিভিন্ন উপদলে ভাগ হয়ে যায়। চিনাপন্থী উগ্র মাওবাদীরা গঠন করে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি(মতিন-আলাউদ্দিন), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি(দেবেন-বাশার), কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, পূর্ব বাংলার সরবহারা পার্টি(সিরাজ সিকদার) ইত্যাদি। ছাত্র ইউনিয়নেও ভাঙ্গন আসে চীনা ও মস্কোপন্থী এই দুই ধারায়। ছাত্রলীগের ক্ষুদ্র একটি অংশ পিডিএম পন্থীদের ছত্রছায়ায় গঠন করে বাংলা ছাত্রলীগ।
এইসব রাজনৈতিক দলের অনেকগুলোই পাকিস্থান আমলেই তাদের জীবিত সত্ত্বা হারিয়ে ফেলে। এরই মধ্যে বিভিন্ন ঘটনা পরিক্রমায় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুস্টিত হয় পাকিস্থান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন। এই নির্বাচনেই '৬৬ এর ঐতিহাসিক ছয় দফা এবং '৬৯ এর গন অভ্যুত্থানের সফল নেতৃত্বদানের ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্থানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয় আওয়ামী লীগ। শুর হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে পরিচালিত মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক দলই যোগ দেয়।
এদের মধ্যে দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকা মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি, মস্কোপন্থী ন্যাপ(মোজাফফর) এবং কংগ্রেস সর্বতোভাবে যোগ দেয়। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের শুধু ভাসানীর অনুসারীরা আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব মেনে যুদ্ধে যোগ দেয়। কিন্তু ভাসানী ন্যাপের একটী বৃহৎ অংশসহ অপরাপর সকল রাজনৈতিক দলই আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধে যোগদিতে অস্বীকার করে। চীনাপন্থী কমিউনিস্টদের অন্যান্য দলগুলোও যুদ্ধ করে তবে শুধু পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, তাদের যুদ্ধ ছিল মুক্তিবাহিনী, গেরিলা বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে। জনগন রায় দিয়েছিল আওয়ামীলীগের পক্ষে কিন্তু চীনাপন্থী ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো সেই জনমতকে অস্বীকার করে।
এদের মধ্যে জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পিডিপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, কনভেনশন ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ, মুসলিম লীগ প্রভৃতি সরাসরি যুদ্ধের বিরোধীতা করে। কমিউনিস্টদের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের নিজেদের সুত্রানুযায়ী বহুমুখী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
এধরনের নানাবিধ সমস্যার মধ্যদিয়েই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভিতরের সকল বাঙালি শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ। জয়লাভ করে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে পরিচালিত মহান মুক্তিযুদ্ধ ও এদেশের জনতা।
স্বাধীন বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করা বিভিন্ন দলকেই নিষিদ্ধ করা হয়।
বন্ধ করা হয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার ব্যক্তিগত নেতৃত্বের দ্বন্ধের বিরোধ থেকে জন্ম নেয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তকমাধারী জাসদ। যেখানে সমাজতন্ত্র নিজেই বিজ্ঞান সেখানে ‘বৈজ্ঞানিক’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে হাসরসের সৃষ্টি করলেও তারা অনেকটাই সংগঠিত হতে থাকে।
স্বাধীন বাংলাদেশে গোপন রাজনৈতিক খেলা শুরু হয় এখান থেকেই। একঝাক তরুন মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে গঠিত জাসদের ভিতরে গোপনে আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেতে থাকে স্বাধীনতা বিরোধী বিভিন্ন দলের নিষিদ্ধরা।
জাসদও তাদের নিকট থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিজেদের কালিমালিপ্ত করতে থাকে। সি আই এ'র টাকায় পরিচালিত হয় তাদের গোপন গানবাহিনীর প্রশিক্ষন কেন্দ্রের কর্মসুচী।
বিভিন্ন ঘটনা পরিক্রমায় স্বাধীন বাংলাদেশে রচিত হয় রক্তের হোলি উৎসব। দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রে হত্যা করা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে। হত্যাকরা হয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া বীরদের।
ক্ষমতায় আরোহন করে আওয়ামীলীগের ভিতরে বাস করা বাঙালি জাতীয়তাবাদীর লেবাসধারী খন্দকার মোশতাক গং। খালেদ মোশাররফের হঠকারীতায় ক্ষমতায় স্থায়ী আসনে বসে জাসদের তথাকথিত বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান। ক্ষমতা দখল করেই জিয়া তার পূর্বহিসাব অনুযায়ী এবং চীনাপন্থী কমিউনিস্টদের পরামর্শে জেলে ভরতে শুরু করে জাসদের নেতা কর্মীদের। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে মোশতাককেও জেলে ভরে বোঝানোর চেস্টা করে সে আওয়ামীলীগের শত্রু নয়। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতির ময়দানে আওয়ামীলীগের প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্ধী ও শত্রু ছিল জাসদ এবং ’৭৫ পরবর্তী সময়ে মোশতাক গং।
এই দুই পক্ষকেই ধরাশায়ী করে জিয়া আওয়ামী লীগকে বোঝানোর চেস্টা করে সে আওয়ামী লীগের মিত্র। সেই ধারাবাহিকতায় জিয়া দল গঠনের লক্ষ্যে সারাদেশ সফরের নামে বিভিন্ন জেলা ও থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের সার্কিট হাউজে ডেকে বৈঠক করে তাকে সহযোগিতা করার জন্য বোঝানোর চেস্টা করে। কিছু কিছু নেতা বিভ্রান্ত হয়ে তার সঙ্গে যোগও দেয়। সার্বিকভাবে আওয়ামী লীগকে কাছে টানতে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করে। মিলিটারী ডিক্টেটররা আওয়ামী লীগকে ভেঙ্গে ফেলে।
রাজনীতির ময়দানে, সংবিধানে এবং বহিবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেও গ্রহন করে পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া স্বিদ্ধান্তের বিপরীত স্রোতে। দৃশ্যত সে সফলও হয়। গঠন করে জাগদল পরে নাম বদলিয়ে জাতীয়তাবাদী দল। জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা এই তকমাকে কাজে লাগায় ব্যপকভাবে। দীর্ঘদিন গোপনে থাকা মাওবাদী সমাজতন্ত্রীদের একটি প্রকাশ্য গ্রুপ মশিউর রহমান জাদু মিয়ার নেত্রিত্বে যোগ দেয় জিয়াউর রহমানের দলে এবং মাওবাদীদের অন্যরাও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।
যারা ’৭০ এর নির্বাচনে পিডিপি, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম অর্থাৎ আওয়ামী লীগের স্বায়ত্বশাসন তথা স্বাধীনতার দাবির বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করে গ্রাম গঞ্জের সেই অংশটাও উঠেপড়ে লাগে জিয়ার দল গঠনে। গর্তের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুসলীম লীগ এবং ধর্মভিত্তিক জামায়াতে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতা দখল করে এরশাদ। সেও প্রথমে জিয়ার পদাংক অনুসরন করে আগায়। জিয়া ছিল আওয়ামীলীগের শত্রু এই তত্বকে সামনে নিয়ে প্রথমেই হাত বাড়ায় আওয়ামীলীগের দিকে কিন্তু ব্যর্থ হয়।
তারপর দৃষ্টি দেয় জাসদের দিকে দৃশ্যত সফল হয় এবং বিএনপিরও একটা সুবিধাবাদী চক্র এরশাদের দলে যোগ দেয়। বাস্তবিক অর্থেই এরশাদ আওয়ামী লীগকে কাছে টানতে না পেরে আওয়ামী লীগের উপর চালায় স্টীম রোলার।
জিয়া এবং এরশাদ উভয়েই আওয়ামীলীগ বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও মাওবাদী তথাকথিত বিপ্লবী শক্তিকে পুরোপুরি কাছে টানে। তাদের সময়েই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমুহ এমনকি বঙ্গবন্ধুর খুনীরাও দল গঠন করে।
উপরোক্ত তথ্যাবলীর উপর নিরভর করে নিশ্চিতভাবেই স্বিদ্ধান্তে পৌছা যায়…
***আজকের যে আওয়ামীলীগ সেখানে স্পস্টতই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামীলীগের নেতা, কর্মী, সমর্থক এবং তাদের উত্তরসুরীরার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
এই দলে অনেক মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাও যোগ দিয়েছে যারা মুলত একাত্তরে আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল তারা এবং তাদেরই উত্তরসুরীরা।
***বর্তমানের বিএনপিতে মাওবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের নেতারা যাদের প্রায় সবাই একাত্তরে আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব মেনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়নি এবং তাদেরই উত্তরসুরীরা। তাদের নিজস্ব নেতা তৈরির কারখানা ছাত্রদলের রাজনীতিতেও জড়িত হয় মুলত একাত্তর পূর্ববর্তী সময়ের মুসলিম লীগার, পিডিপি, নেজামে ইসলাম, ছাত্রশক্তি প্রভৃতি সংগঠনের নেতা, কর্মী ও সমর্থকের সন্তানরাই। এমনকি মোশতাকের সঙ্গে হাত মেলানো সাবেক আওয়ামী লীগারদের অনেকেই যোগ দিয়েছিল। এখনো সারাদেশে খোজ নিলে জানা যাবে সত্তরের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল তারা এবং তাদের উত্তরসুরীরাই বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও নেতৃত্ব দিচ্ছে।
এর বাইরে যেটুকু উদাহরন হিসেবে অনেকেই দেখাবে সেটুকু মুলত ব্যতিক্রম এবং সম্পূর্ণ ব্যক্তি স্বার্থসংশ্লিস্ট কারনে বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অথবা একদা মাওবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত পরিবারের উত্তরসুরীরা ছাত্রদলে নাম লেখায়। এবং একদা শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বগুনের কাছে পরাজিত হওয়া দিশেহারা ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের উত্তরাধীকারগন।
এখানে বললে অত্যুক্তি হবেনা যে, বর্তমানের ছাত্ররাজনীতিতে কর্মী সংগ্রহের ক্ষেত্রে সংগঠনসমুহের নেতারা আদর্শের চাইতে বিভিন্ন রকম সুযোগ সুবিধা দিয়ে আকৃষ্ট করে থাকে। এবং এই প্রক্রিয়া আশির দশক থেকে জিয়াউর রহমানের ছাত্রদল শুরু করলেও দু’দলেই বিষফোড়া হয়ে বেড়ে উঠছে মুলত এরশাদের পতনের পর গনতন্ত্রায়নের সময় থেকে।
যেকারনে বর্তমানের নতুন নতুন ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসা নেতা কর্মীদের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম এখানেও আছে।
উল্লেখ্য যে, বর্তমানে যে জোট গঠনের বিষয়টি অনেকেই আলোচনায় নিয়ে আসেন। এই বিষয়টি সম্পূর্ণই ভোটের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
বি দ্রঃ এই লেখাটি লেখকের বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ ও সম্পূর্ণ নিজ উদ্যেগে মাঠ পর্যায়ে পরিচালিত একটি জরিপ ও গবেষনার ফলাফল মাত্র।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।