কিছু মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিছু মানুষ স্বপ্নটা সত্যি করার জন্য ঘুম থেকে জেগে উঠে। জীবন আপনার কাছে সেভাবেই ধরা দিবে আপনি যেরকম থাকবেন। আমার ব্যাঙ্কের জমাদার সালাম ভাইয়ের মধ্যে কিছু কিছু দৃষ্টি আকর্ষক ব্যাপার স্যাপার আছে। সব কিছু লিখে বুঝানো যাবে বলে মনে হচ্ছেনা।
কারন তার মুখের যে মজার এক্সপ্রেশন সেটা লেখালেখিতে আনা কঠিন। আমি যখন দুপুরে লাঞ্চ করা শুরু করি তখন আমার হটপটের কিছু অংশ তার দিকে যাবে। এটা পূর্ব নির্ধারিত। বাসা থেকে বলা আছে সালাম ভাইয়ের জন্য বেশি দিতে। আবার সালাম ভাইকে লজ্জা দিতেও রাজী না।
তাই বলি সালাম ভাই খাইতে ভাল লাগতেছেনা, নিয়ে নেন তো।
সালাম ভাইয়ের মধ্যে কিছু ব্যাপার খুব মজার। তার একটা বৈশিষ্ট্য কথায় কথায় জাতির জনকের ভাষণে ঢুকে যাওয়া। যেমন হয়ত ম্যানেজার স্যার আমাকে ডাকছেন। সালাম ভাই এসে বললেন, স্যার আপনার যা কিছু আছে তা নিয়ে তৈরি হন।
ম্যানেজার স্যার তার নির্দিষ্ট স্থান থেকে বের হলেই সালাম ভাইয়ের তলব- আপনাদের যার কাছে যা কিছু আছে তা নিয়ে তৈরি হন। একবার সালাম ভাইকে হেড অফিস পাঠানো হল। ৫ ঘন্টা পর সেখান থেকে তিনি ফিরে এলেন। আমাকে দেখেই বলা শুরু করলেন- স্যার দেখেন দিখি কি অবস্থা!! আমি স্যারকে বললাম আমাকে তখন না পাঠাতে, কিন্তু তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা, আমি ৩ ঘন্টা ধরে বাইরে দাঁড়ানো। এখানে ভুট্টো সাহেবটা কে সেটা নির্দিষ্ট না।
কিন্তু বলার ভঙ্গিটা এমনই চমৎকার যে খুবই মজা লাগে।
ভাল কথা, সালাম ভাইয়ের নাম আসলে ছালাম ভাই। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে দেখেছি যে কোন অফিস হোক বাসা বাড়ি হোক দারোয়ান বা জমাদার শ্রেনীর লোকজন ভাল ব্যবহার পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। অনেকের অবস্থা এমন হয় যে সেটা পেলেও তাদের মধ্যে তেমন পরিবর্তন হয়না। কিন্তু সত্যি কথা হল এই একমাত্র জায়গা যেখানে ভাল ব্যবহারের কৃতজ্ঞতা অনেক বেশি পরিমানে পাওয়া যায়।
আরেকটা ব্যাপার হল এই লোকটাকে খেয়াল করলাম আমাকে বেশ পছন্দ করে। অর্থবিত্ত ওয়ালা লোক যদি আমাকে পছন্দ করে সেটাকে গুরুত্ব দিব কিন্তু সামান্য জমাদারের পছন্দকে এড়িয়ে যাব এমন মানুষ এখনও হই নাই। তবে পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে। মানুষ পরিস্থিতিতে অনেক সময় বদলে যায়। পরিস্থিতি নিয়ে ছালাম বা সালাম ভাইয়ের একটা মজার ডায়লগ আছে, "স্যার কি একটা পরিস্থিতির মধ্যে যে আছি"।
এটা তার মুদ্রা দোষ। এটা খুব সাধারন একটা কথা কিন্তু তিনি কিভাবে জানি টেনে টেনে বলেন শুনতে খুব ভাল লাগে। পরিস্থিতি শব্দটা তার মুদ্রা দোষ। এই যেমন বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া চিংড়ি মাছ তাকে খাওয়ানোর পর সে বলে, "স্যার, ১৯৮৮ সালের পর এমন চিংড়ি খাইলাম, কি একটা পরিস্থিতির মইধ্যে যে থাকি"। কোন ফাইল খুঁজতে হলে, "কি একটা পরিস্থিতিতে যে আছি!!"
ভাল কথা এই ফাইল খোঁজার কাজটা তার জন্য সহজ করে দিয়েছি।
ছালাম ভাই চোখে কম দেখেন। একটা ফাইল খুঁজতে ২ ঘন্টা লাগায় দেন। তাই কিছু কিছু ফাইল আমি নিজে প্রিন্ট করে নাম্বার বসিয়ে আঠা লাগিয়ে দিয়েছি। সালাম ভাইকে খালি বলি সালাম ভাই এত নম্বর ফাইল। তিনি জবাব দেন, কি একটা পরিস্থিতির মধ্যে যে আপনি ফাইলটা খুঁজতে দিলেন।
অফিসে কারেন্ট যায়- সালাম ভাইয়ের আওয়াজ পাওয়া যায়- কি একটা পরিস্থিতিতে যে স্যার কারেন্টটা গেল।
ব্যাঙ্কে চাকুরী নেওয়ার পর একদিন এবিএস গননা শুরু করলাম। এই জিনিসটা এখানে এখনো ম্যানুয়াল। এবিএস হিসাব মিলেনা। বিরাট গন্ডগোল।
পোস্টিং এ ভুল। বিরাট লেজারে ১৩২ টা এবিএস চেক করার পর পাওয়া গেল সালাম ভাইয়ের একাউন্টে ১০০০ টাকার বদলে ১০,০০০ টাকা যোগ হয়ে গিয়েছে। সালাম ভাই সেই থেকে পিছে লেগেই আছে- স্যার কি একটা পরিস্থিতি করলেন। টাকা বাড়ায় দিয়ে মনটা খুশি করছিলেন এখন আবার কমায় দিলেন।
বিকালের দিকে সালাম ভাই ডেস্কের ধারে কাছে মাঝেই মাঝেই আসেন।
বলেন স্যার আপনার মধ্যে যে পরিবর্তন হইতেছে তা মোটে ভাল লাগতেছেনা, কি একটা পরিস্থিতি হইল!! আমি বললাম, কি পরিবর্তন। স্যার আগে ৫ টা বাজলে সিঙ্গারা কিনে আমারে ২ টা দিতেন তা আপনি এখন কেমন পরিবর্তন হয়ে গেলেন!! বুঝলাম পরিস্থিতি গুরুতর। কোন ভাবে তার বলার ভঙ্গির ফ্যান আমি হয়ে গেছি। তার সিঙ্গারার ব্যবস্থা করলাম। সালাম ভাই মাত্র এইট পাস হলেও তার বুদ্ধি শুদ্ধি ভাল।
আমার ধারনা পড়ালেখার পরিবেশ পেলে এই লোক ভাল করত। রোমান সংখ্যা তার চিনার কথা না। এই নাম্বারিং টা আজকে সে ধরে ফেলল হঠাৎ করে। XIX যে ঊনিশ হতে পারে এটা বুঝতে পারা তার কাছ থেকে আশা করা কঠিন।
হঠাৎ সালাম ভাইকে নিয়ে ব্লগ লেখার কারনটা ঠিক স্পষ্ট আমার কাছেও না।
অফিস শেষ করে এমবিএ ক্লাস করে বাসায় এসে দেখি আমার ফেসবুক ওয়ালে একজন লেখালেখির অনিয়ম নিয়ে গুরুত্বর অভিযোগ এনেছে। দাবী মিটাতে হয়। ছালাম ভাইকে নিয়ে লেখার স্পষ্ট আরেকটা কারন আছে।
অফিসে দুই দিন ল্যাপটপ নিয়ে গিয়েছি। এমবিএ এর প্রেজেন্টেশন বানানোর জন্য।
গিয়ে এবিএস টাও এক্সেলে মিলায় ফেললাম। সরকারী ব্যাঙ্কের একটা নমুনা দেই। ১৩২ টা মান তোলার পর অনেকেই সন্দেহ করল যে যোগফল আমি এফেয়ার্স দেখে বসিয়েছি। কারন তারা আমাকে ক্যালকুলেটরে যোগ দিতে দেখেনি। এক্সেলে অটোমেটিক যোগ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মানতে রাজী না।
সালাম ভাই ঘুর ঘুর করে দেখল। স্যার আপনার ল্যাপটপ টা কেমন? আমি বললাম, জ্বি ভাল। স্যার আমার ছেলের জন্য একটা কিনতাম যদি একটু দেখে দিতেন। অবাক হলাম। সালাম ভাই আপনার ছেলের কি করে? স্যার সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
এবার চক্ষু হল আখগাছ। আপনার ছেলেকে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ান!! কি করব স্যার ঢাবিতে তো টিকেনায়। সালাম ভাই বসেন। মনে মনে অনেক কিছুই চিন্তা করলাম। একজন জমাদারের বেতন কত? মনের জোর কতটা থাকলে ছেলেকে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ানোর মত অবস্থা নেয়!! মনে আছে ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার সময় আমার বাসার অবস্থা।
কোনভাবে সরকারীতে না টিকলে এই ছেলের কি হবে!! আর প্রথম জীবনের কম্পিউটার কিনার সময় ৩ মাস ঘ্যান ঘ্যান করা। সব বন্ধুর কম্পিউটার আছে আমার নাই। সালাম ভাইয়ের ভাষায় কি একটা পরিস্থিতির মধ্যেই না ছিলাম। সালাম ভাইয়ের অনুরোধে কয়েকটা জায়গায় ফোন দেওয়া হল। কিনা হইল ল্যাপটপ তার ছেলের জন্য।
সালাম ভাই তার ছেলের জন্য আমার ল্যাপটপটার মত ল্যাপটপ কিনতে পেরেছে কিনা এখন সেই গবেষনায় আছেন। স্যার আপনার ল্যাপটপটার দাম কত? দাম দিয়া হবে টা কি!! না স্যার কেমন কিনে দিলেন ঠকলাম না জিতলাম বুঝলাম না তো- যেই পরিস্থিতিতে কিনলাম। আপনার ছেলে কি খুশি? ছেলে খুবই খুশি স্যার, যেই একটা পরিস্থিতি হইল। তাহলে আর কি চান!! আর আপনার ছেলেরটা আমার ল্যাপটপটার থেকে অনেক ভাল। আমারটা সাদা, সাদা তাড়াতাড়ি ময়লা হয়।
আপনার ছেলেরটা হবেনা। আর আমারটায় বাংলা নাই আপনার ছেলেরটায় আছে। বলেন কি আপনারটায় বাংলা নাই, কি পরিস্থিতিতে এই ল্যাপটপ কিনলেন!! সেটাই তো আপনাকে বলতেছি। একজন জমাদার তার সঞ্চয় ভেঙ্গে নিজের ছেলের জন্য ল্যাপটপ কিনল এই ঘটনায় আমি খুবই মুগ্ধ। আমার ম্যাক ল্যাপটপ এই জমাদার বাবার তার ছেলের প্রতি টানের কাছে কিছুই না।
আর ভুল কিছু বলিনাই। এই ম্যাকের কারনেই এখন ব্লগ কম লেখা হয়।
পরিস্থিতি অবশ্য কিছুটা পরিবর্তন। ইদানিং সালাম ভাইয়ের মুদ্রা দোষ হইছে এন্টি-ভাইরাস। কারন ৪৫০০০ টাকা দিয়ে ছেলের জন্য ল্যাপটপ কিনার পর সে আমার মুখে শুনল এন্টি-ভাইরাস কিনার কথা।
স্যার এই পরিস্থিতির কথা আপনি আমাকে আগে কবেন না!! আপনি ৪৫০০০ দিয়ে যখন ল্যাপটপ কিনছেন আর ১০০০ টাকা দিয়া এন্টি-ভাইরাসটাও কিনে দেন।
ইদানিং সালাম ভাই সব কথা বার্তাতেই এন্টি-ভাইরাস শব্দটা আনেন। ফাইল খুঁজতে গেলে- আর ওটা কি পাওয়া যাবে!! ওখানে কি আর এন্টি ভাইরাস দেওয়া। ভাউচারে সিল না থাকলে- স্যার এইখানে এন্টি-ভাইরাস দেন। কোথাও সাইন দিতে ভুলে গেলে- স্যার এন্টিভাইরাস লাগায় দেন।
কি একটা পরিস্থিতিতে যে আছি!! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।