১৯৭২ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বিমান এর পথ চলা শুরু । অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বার ১৯৭১ আমাদের বিজয় এর মাত্র ১৯/২০ দিন পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর প্রতিষ্ঠা । নাম রাখা হয় এয়ার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল কিন্তু বোঝা গেল একটু ভুল হয়েছে নাম টি ইন্ডিয়ার ফ্লাগ কেরিয়ার এয়ার ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের ফ্লাগ কেরিয়ার পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স এর সাথে মিলে গেছে । যা হোক পরিবর্তন করে রাখা হল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স । এবং প্রিয় পটুয়া কামরুল হাসান এর আকা বলাকা লোগো যোগ হয়ে গেল বিমান এর সাথে ।
Douglas DC-3 Dakota: বহরে প্রথম যে প্লেনটি যুক্ত হল সেটি একটি Douglas DC-3 Dakota. ভারতের যোধপুর রাজ্যের মহারাজা এই প্লেনটি প্রবাসী সরকারকে উপহার দিয়েছিলেন। ২৮ সেপ্টেম্বার ১৯৭১অথাৎ ১৬ ডিসেম্বার বিজয়ের আগে বাংলাদেশ এয়ারফোর্স গঠনের সময় প্লেনটি তাদের অধিনে দেওয়া হয় । এই প্লেনটি সহ মোট দুটি প্লেন এবং একটি হেলিকপ্টার নিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশ এয়ারফোর্স। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র তদারকিতে এবং কিছু অপারেশনে এই প্লেনটি ব্যাবহারিত হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বার ১৯৭১ আমাদের বিজয় এর মাত্র ১৯/২০ দিন পর যখন বিমান ( বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স) এর প্রতিষ্ঠা হয় তখন এয়ারফোর্স প্লেনটি বিমান কে গিফট করে।
বিমান ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালু করে। প্রাথমিক ভাবে ঢাকা টু সিলেট, যশোর এবং চট্টগ্রামে ফ্লাইট চালনার প্লান করা হয় । কিন্তু দুর্ভাগ্য ঢাকা-চট্টগ্রামের কয়েকটি ফ্লাইট চালানোর পর মাত্র ৬ দিন এর মাথায় ১০ ফেব্রুয়ারি একটি ট্রেনিং ফ্লাইটে গিয়ে প্লেনটি বিধ্বস্ত হয় ।
DC-3 পিস্টন ইঞ্জিনের প্লেন। এটির সর্বউচ্চ গতি ২৩০ মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং (উচ্চতায় উড়তে পারে) ২৩২০০ ফিট ।
যাত্রী ধারনক্ষমতা ২১-৩২ জন।
Douglas DC-6: DC-3 প্লেনটি বিধ্বস্ত হবার কয়েকদিন পরই অর্থাৎ ৭২ এর সেই ফেব্রুয়ারি তে World Council of Churches এর কাছ থেকে একটি Douglas DC-6 লোন নেওয়া হয় তবে মাত্র কয়েকদিন পর সেটি ফেরত দিয়ে Troll-Air এর কাছ থেকে একই রকম একটি Douglas DC-6B লিজ নেওয়া হয় মাত্র কয়েক মাসের জন্য । Douglas DC-6B পিস্টন ইঞ্জিন প্লেন। এটির সর্বউচ্চ গতি ৩১৫ মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং ২৫০০০ ফিট। যাত্রী ধারনক্ষমতা ৫৪ জন।
Fokker F-27: অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এ ব্যাবহার করার জন্য বিমান মোট ৮ টি Fokker F-27 বহরে যোগ করে । প্রথম বছরে অথাৎ ৭২ এ ইন্ডিয়া এবং নেদারল্যান্ড থেকে চারটি । পরের বছর অথাৎ ৭৩ এ যেয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং নেদারল্যান্ড থেকে চারটি। মোট ৮ টি Fokker F-27 প্লেন সংগ্রহ করা হয় । এর ভেতর নেদারল্যান্ড থেকে পাওয়া S2-ABJ টি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে PIA এর জন্য অর্ডার দেওয়া ছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর নেদারল্যান্ড প্লেনটি বাংলাদেশ কে গিফট দিয়ে দেয়। Fokker F-27 টার্বোপ্রপ ইঞ্জিনের প্লেন। এটির সর্বউচ্চ গতি ৩১৬ মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং ২৯৫০০ ফিট । যাত্রী ধারনক্ষমতা ৪৮-৫৬ জন।
Boeing 707: ৪ ঠা মার্চ ১৯৭২, বিমান প্রথম লন্ডনে অন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করে আর এ কাজে ব্যাবহারিত বিমানটি ছিল Boeing 707 কিন্তু সেটি শুধু মাত্র ভাড়া করা হত সপ্তাহে একদিন এর জন্য।
এভাবে বিভিন্ন সময় বেশ কিছু Boeing 707 ভাড়া করা হয় তবে বিমানের নিজস্ব ৫ টি Boeing 707 ছিল । এর ভেতর চারটি ক্রয় করা হয়েছিল এবং একটি যেটির নম্বর ছিল S2-ABQ সেটি পাকিস্তান গিফট দিয়েছিল। Boeing 707 এর 120,220,320A মডেল টার্বোজেট এবং 320B,320C,420 মডেল গুলো টার্বোফ্যান ইঞ্জিনের প্লেন। এটির সর্বউচ্চ গতি টার্বোজেট মডেলে ৬২১ মাইল/ঘন্টা, টার্বোফ্যান মডেলে ৬০৭ মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং টার্বোজেট মডেলে ৪৩০০০ ফিট ও টার্বোফ্যান মডেলে ৩৬০০০ ফিট। যাত্রী ধারনক্ষমতা ১৪৭ জন।
Douglas DC-8: ১৯৭৮ এর আগস্ট থেকে অক্টোবার পযন্ত একবার এবং আরেকবার ১৯৮০ সালের নভেম্বার থেকে ৮ মাসের জন্য একটি লীজ নেওয়া হয় । DC-8 এর ও Boeing 707 এর মত টার্বোজেট ও টার্বোফ্যান মডেল ছিল। তবে বিমান যে দুইটি ব্যাবহার করেছে দুটিই টার্বোফ্যান মডেল এবং এর সর্বউচ্চ গতি ৫৯৬ মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং ৩৫০০০ ফিট। যাত্রী ধারনক্ষমতা ১৪৪-১৭৯ জন।
McDonnell Douglas DC 10-30: ১৯৮৩ সালে বিমান DC-10 কেনা শুরু করে এবং এই পর্যায় ৪ টি পুরানো Boeing-707 বিক্রি করে দেওয়া হয় এবং একটি সিঙ্গাপুরে দুর্ঘটনায় পড়ে নষ্ট হয়ে যায় ফলে সেটিকে স্ক্র্যাপ করা হয়।
প্রথমে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে তিনটি এরপর ১৯৮৯ সালে আরো একটি এবং শেষমেশ ১৯৯৬ সালে লিজে আনা আরও একটি উড়োজাহাজ কিনে টোটাল ৫টি DC-10 বহরে যোগ করা হয় । DC-10 টার্বোফ্যান ইঞ্জিনের প্লেন। এর সর্বউচ্চ গতি ৬১০মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং ৪২০০০ ফিট। যাত্রী ধারনক্ষমতা ৩১৪ জন।
BAe ATP: প্রথম ATP কেনা হয় ১৯৯০ এর আগস্টে ।
Fokker F-27 এর জায়গায় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এ ব্যাবহার করার জন্য টোটাল তিনটি ATP কেনা হয় । এবং F-27 ব্যাবহার বন্ধ করা হয়। ATP টার্বোপ্রপ ইঞ্জিনের প্লেন। এর সর্বউচ্চ গতি ৩০৮মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং ২৫০০০ ফিট। যাত্রী ধারনক্ষমতা ৬৪ জন।
Airbus A310: বিমান বহর বড় করার জন্য ১৯৯৬ সালে বিমান Airbus A310 কেনা শুরু করে। টোটাল ৬ টি এয়ার বাস বিমানের বহরে এসেছে। ৩ টি লীজ ৩ টি কেনা । এর ভেতর নতুন কেনা একটি দুবাই তে দুর্ঘটনায় পড়ে নষ্ট হয়ে যায় ফলে সেটিকে স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। লীজ এর দুইটি ফেরত গেছে ১ টি নষ্ট হয়ে বসে আছে।
বাকি কেনা দুইটি একটিভ আছে। Airbus A310 টার্বোফ্যান ইঞ্জিনের প্লেন। এর সর্বউচ্চ গতি ৫৬০মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং ৪১০০০ ফিট। যাত্রী ধারনক্ষমতা ২২৩ জন।
Fokker F-28: ১৯৯৯ সালের দিকে এসে দুটি Fokker F-28 কেনা হয় এবং পরে ২০০৪ এ আরও একটি কেনা হয়।
এটিও মুলত অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এ ব্যাবহার করার জন্য কেনা হয়। Fokker F-28 টার্বোফ্যান ইঞ্জিনের প্লেন। এর সর্বউচ্চ গতি ৫২৩ মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং ৩৫০০০ ফিট। যাত্রী ধারনক্ষমতা ৮৫ জন।
Boeing 737: বিমান ২০০৩ এ দুইটি Boeing 737-300 ব্যাবহার করেছে।
বর্তমানে আরও ২ টি Boeing 737-800 লীজে ব্যাবহার করছে । অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এ ATP এবং Fokker F-28 ব্যাবহার অনুপযুক্ত হয়ে গেলে এই উড়জাহাজ গুলো লীজে নেওয়া হয়। ATP তিনটি বিক্রি করে দেওয়া হয় আর Fokker F-28 গুলো স্ক্র্যাপ হবার অপেক্ষায় রয়েছে। Boeing 737 টার্বোফ্যান ইঞ্জিনের প্লেন। এর সর্বউচ্চ গতি ৫৪৪ মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং ৪১০০০ ফিট।
যাত্রী ধারনক্ষমতা ১৬২ জন ।
Boeing 747: বিমান এযাবৎকাল মোট চারটি Boeing 747 ব্যাবহার করেছে। সবগুলোই মুলত হজযাত্রী পরিবহন এর জন্য লীজে নেওয়া। বর্তমানে কোন Boeing 747 বহরে নাই। Boeing 747 টার্বোফ্যান ইঞ্জিনের ডবল ডেকার প্লেন।
এর সর্বউচ্চ গতি ৬১৪ মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং ৪১০০০ ফিট। যাত্রী ধারনক্ষমতা ৪৯৬-৫২৫ জন।
Boeing 777: বিমান হজযাত্রী পরিবহন এর জন্য আগে তিনটি Boeing 777-200 ব্যাবহার করেছে। তবে বর্তমানে বিমানের নিজস্য নতুন দুইটি Boeing 777-300 সার্ভিসে রয়েছে। Boeing 777-300 সুপরিসর এবং আধুনিক উড়জাহাজ।
Boeing 777 টার্বোফ্যান ইঞ্জিনের প্লেন। এর সর্বউচ্চ গতি ৫৯০মাইল/ঘন্টা এবং সর্বউচ্চ সিলিং ৪৩১০০ ফিট। যাত্রী ধারনক্ষমতা ৪৫০ জন।
টিকাঃ
বিমানের ফ্লিট বিষয়ক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ দুইটা Boeing 777-300 লীজে নেওয়া হবে পাচ বছর এর জন্য এবং পুরা DC-10 বাদ দেওয়া হবে। দুইটা ছোট উড়জাহাজ লীজে নেওয়া হবে আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য।
দুইটি নিজস্য Boeing 777-300 এর অডার দেওয়া আছে ২০১৪ নাগাদ রেডি হবে। চারটি Boeing 737-800 এর অডার দেওয়া আছে ২০১৫ নাগাদ রেডি হবে তখন লীজ গুলো ফেরত যাবে। চারটি Boeing 787-8 এর অডার দেওয়া আছে ২০১৬-২০ নাগাদ রেডি হবে।
টেইল নম্বরঃ আমাদের যেমন প্রতিটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নং থাকে প্রতিটা প্লেনের তেমনি রেজিস্ট্রেশন নং থাকে একে টেইল কোড বা টেইল নম্বর বলা হয় । ICAO প্লেনের রেজিস্ট্রেশন বা টেইল কোড এর নিয়মনীতি নির্ধারন করে থাকে।
দেশভেদে রেজিস্ট্রেশন নম্বর এর প্রথম এক বা দুইটি অক্ষর নিদিষ্ট থাকে। যেমন বাংলাদেশে রেজিস্ট্রেশন করা নম্বর গুলোর প্রথমে S2 থাকে।
ICAO: International Civil Aviation Organization ইউনাইটেড নেশন এর অধিনের একটি সংস্থা আন্তরজাতিক বিমান চলাচল এর সকল বিষয় গুলো নিয়ে ডিল করে । UN এর ১৯৩ মেম্বার এর ভিতর ১৯০ টি দেশ ICAO মেম্বার । অর্থাৎ এর মেম্বার বিমানসংস্থা ভিত্তিক না বরং দেশ ভিত্তিক।
যে দেশ টি এর মেম্বার তার সকল বিমানসংস্থা কে আলাদা আলাদা কোড প্রদান করে কিন্তু মেম্বার হিসাবে শুধু ওই দেশ টির নামই থাকে । অর্থাৎ বাংলাদেশ ICAO মেম্বার কিন্তু আলাদা আলাদা ভাবে বাংলাদেশ বিমান এবং ইউনাইটেড এয়ার এর মেম্বার না । ICAO এ পযন্ত ৫৫৮১ টি বিমানসংস্থা কে কোড নং দিয়েছে যে গুলো বন্ধ হয়ে গেছে সে গুলো সহ।
IATA: আর IATA হল International Air Transport Association একটি প্রাইভেট ট্রেড অর্গানাইজেশন । IATA এর মেম্বার হল ১১৫ টি দেশের ২৪১ টি বিমানসংস্থা ।
IATA কোড গুলো ইন্টারন্যাশনালি বেশি ব্যাবহারিত হয় যেমন আমাদের বিমানের IATA কোড BG এবং ICAO কোড BBC। অপর দিকে ঢাকা এয়ারপোর্ট এর IATA কোড হল DAC এবং ICAO কোড VGHS. এবং আমরা জানি BG এবং DAC কোড টিই বেশি ব্যাবহারিত হয়।
সর্বশেষ বিমানের আরও কিছু আকর্ষণ:
এই ছবিটা রাশিয়ান বিমানের সুপার ইকনমি কেবিনের।
সুত্রঃ উকি এবং গুগল ইমেজ সার্চ ।
সবাইকে ধন্যবাদ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।