আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পিচ্চিকালের প্রিয় কেনা খাবার-দাবার

আম্মার কাছে শুনেছি পিচ্চিকালে নাকি ফ্রুটজুস খেতাম খুব। বাসায় ক্রেট ভরে ফ্রুটজুস কেনা হত। আমার হাতে সব সময়ই ক্যান থাকত, আর সারাক্ষনই জুস খেতে থাকতাম। অবশ্য তখন ছিলাম মরুভূমির দেশে, গলা শুকিয়ে যেত বলে বার বার পানি না খেয়ে জুস খাওয়াটাই ছিল পছন্দের। এই গল্প তো আগেও করে ফেলেছি মনে হয়।

যা হোক, শোনা কথায় কান না দিয়ে যা নিজের মনে আছে তা-ই বলি। একটা পছন্দের খাবার ছিল এক ধরণের মিষ্টি ছোট ছোট বল, যেগুলো বড়রা টিকটিকির ডিম বলত। এসব বলে অবশ্য আমাদের খাওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারত না। এক প্যাকেটে ২০-২৫ টা করে বল থাকত, বিভিন্ন রঙের। অবশ্য রঙটা শুধু উপরে একটা প্রলেপ হিসেবে থাকত।

মুখে নিয়ে কিছুক্ষণ রাখলেই রঙ উঠে গিয়ে সাদা হয়ে যেত, তখন দেখতে ঠিক একটা টিকটিকির ডিমের মতই লাগত। একই রকম প্যাকেটে বাবলগামও পাওয়া যেত, যেটার প্যাকেটে একটা মেয়ের ছবি ছিল, সে মুখে বিশাল একটা বাবল ফুলিয়ে দুই পাশে হাত দিয়ে রাখা ছিল, যেন বাবলটা এই বুঝি ফেটে যাবে। আমিও বাবল করতে পারতাম, কিন্তু কখনই অত বড় বাবল হয়নি। এক রকম রঙীন সন্দেশ পাওয়া যেত, তিন রঙা। সাধারণত হলুদ, ম্যাজেন্টা আর সবুজ রঙের কম্বিনেশন থাকত।

এই সন্দেশ কিনে তিনটা রঙ আলাদা করার চেষ্টা করতাম। তারপর আলাদা আলাদা করে খেতাম। খেতে অবশ্য একই রকম ছিল। এখন মাঝে মাঝে এই সন্দেশের রঙহীন ভার্সন দেখতে পাই লঞ্চে ফেরিওয়ালার কাছে। তবে খেয়ে দেখা হয় না।

ক্রিম রোল ছিল খুব পছন্দের খাবার। পেঁচানোর রোলের মধ্যে বেশি করে ক্রিম দেয়া থাকত, এক প্রান্তে একটু নারকেল গুড়িও থাকত। ঐ প্রান্ত দিয়েই খাওয়া শুরু করতাম। এখনকার ক্রিমরোল সেরকম মজা হয় না, কিংবা হয়ত আমারই স্বাদ বদলেছে। তবে এখনকার ক্রিমরোলে নারকেল গুড়ি থাকে না, এটুকু বলতে পারি।

বাটারবনও খুব ভালো লাগত। লম্বা একটা বন কেটে মাঝখানে ঘন ক্রিমের স্তর থাকত, তবে বনের একপাশে কাটা থাকত না। ঐ পানসে অংশটুকু আগে খেয়ে নিতাম, যাতে শেষ পর্যন্ত ক্রিমের স্বাদটুকু পাওয়া যায়। এখন মাঝে মাঝে পুরনো স্মৃতি ঝালাই করতে ফুওয়াং-এর বাটারবন খাই, সেই স্বাদ কি আর আছে! লজেন্স খেতাম চারআনা বা আটআনা দিয়ে। সবচেয়ে পছন্দের লজেন্স ছিল তিতাস লজেন্স।

মুদির দোকানে আম্মা কিছু কিনতে পাঠালে দোকানদার এমনি একটা বা দুইটা ধরিয়ে দিত। মাঝে মাঝে পাতলা প্লাস্টিকে মোড়ানো তেঁতুলের আচারও দিত। আরেকটা জিনিস চেয়ে নিতাম, সেটা হল এই তেঁতুলের আচারের বড় প্যাকেটের ভিতর থাকা নায়িকাদের ভিউকার্ড। বেশ কয়েকটা জমিয়েছিলাম এভাবে। আরেকটা আচার খুব পছন্দের ছিল।

এটা অবশ্য কখনই কেনা হত না। এক আংকেলের দোকানে গেলে উনি নিজেই কাগজের ঠোঙায় করে বয়ামে রাখা এই আচার দিয়ে দিতেন, আর আমরা মহানন্দে খেতে খেতে বাসায় আসতাম। এটা ছিল তেঁতুলের আচার, গোল গোল করে বানানো, কালো রঙের। দেখতে কেমন সেটা আর বললাম না, বড়রা ঐ জিনিসের সাথে তুলনা করে ভালোই পচানোর চেষ্টা করত, তবে আমরা পচতাম না। আচারের কথায় যখন আসলামই, তো আরও বলি।

স্কুলের সামনে এক আচারওয়ালা নিয়মিত আসত। তার কাছে থাকত অনেক রকম আচার, তেঁতুল, বরই, চালতা আর আমের সময় আমসত্ত্ব। তেঁতুন আর বরইয়ের আচার তেমন একটা কিনতাম না, এগুলো আম্মার বানানোটাই মজা ছিল বেশি। বাসায় আম্মা যখন বানাতেন, বয়ামে আর ঢুকানোর সময় পেতেন না, কড়াই থেকেই সবাই সাবাড় করে দিতাম। যা হোক, আচারওয়ালা চাচ্চুর কাছ থেকে কিনতাম আমসত্ত্ব আর চালতার আচার।

ঐরকম মজার আচার মনে হয় এখন আর কোথাও পাই না। স্কুলের সামনে আরও ছিল ফুচকাওয়ালা, যে এক টাকায় এক প্লেট ফুচকা দিত, এক প্লেটে থাকত চারটা ফুচকা। স্কুল ছুটির পর তাকে ঘিরেই সবচেয়ে জমজমাট ভিড় থাকত। তা পাশে চটপটিওয়ালাও এত ক্রেতা পেত না। চটপটির অবশ্য দাম একটু বেশি ছিল, এক প্লেট দুই টাকা, পরে বাড়িয়ে তিন টাকা করেছিল।

এই ফুচকা খাওয়ার জন্য টিফিনের টাকা বাঁচাতাম। টিফিনের কথায় যখন চলেই এলাম, তো আরও বলি। একেবারে পিচ্চিকালে আম্মা বাসা থেকে টিফিন দিয়ে দিতেন। এজন্য হাতে কোন টাকা দেয়া হত না। মাঝে মাঝে এক টাকা পেতাম শনপাপড়ি খাওয়ার জন্য।

কিন্তু শনপাপড়িওয়ালাকে ঘিরে যে ভিড় থাকত তা টপকানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই চেষ্টাও করতাম না। টাকাটা হাতে নিয়ে দূর থেকে তাকিয়ে থাকতাম, কেউ আমার সেই অসহায় দৃশ্য দেখে দয়াপরবশ হয়ে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে শনপাপড়ি কিনে দিলে তবে আমার খাওয়া হত। এই অমৃতের মত শনপাপড়িও এখন কোথাও পাই না। এই গল্পও কি আগে বলে ফেলেছি? হুমম, মনে হয়। তো যা বলছিলাম, টিফিনের টাকা বাঁচানোর কথা।

ক্লাস থ্রি-ফোরে থাকতে টিফিনের টাকা পাওয়া শুরু হল। টিফিন বলতে তখন স্কুল ক্যান্টিনে পাওয়া যেত মাঝারী আকারের সিঙ্গারা আর সমুচা, এক টাকা করে, আর মিনি সাইজের বিফ বার্গার, যাতে বিফের টুকরা কোনদিনই পাইনি, তিন টাকা করে। তো আমার টিফিনের জন্য বরাদ্দ ছিল তিন টাকা। কোনদিন বার্গার খেলে আর টাকা জমত না। তবে এটাই সবচেয়ে পছন্দের ছিল।

আর সিঙ্গারা-সমুচা খেয়ে যে এক টাকা দুই টাকা বাঁচত তা দিয়ে ফুচকা খেতাম। তিন টাকাই বাঁচাতে পারলে চটপটি। তবে না খেয়ে সেই টাকা বাঁচাতাম না, কোন সখী হয়ত কোনদিন বাসা থেকে বেশি করে খাবার আনত, সেদিন আমার টিফিন খরচের পুরোটাই রয়ে যেত। স্কুলের বাইরের আরেকটা খাবার খাওয়া হত, আইসক্রিম। পিচ্চিকালে খেতাম উজ্জ্বল সবুজ বা কমলা রঙের ইহা বা ছনি আইসক্রিম।

টুংটুং করে ঘন্টা বাজিয়ে যেগুলো বিক্রি করত। পরে ইগলু আসার পর এই আইসক্রিম তার জনপ্রিয়তা হারায়। ইগলুর সবুজ-কমলা ললি আইসক্রিমই বেশি খাওয়া হত। আর একটা পছন্দের ফ্লেভার ছিল পেপসি। এই পেপসি আইসক্রিম এক সময় রোজ খেতাম।

পরে অবশ্য এটা আর পাওয়া যায়নি। দোকান থেকে বয়ামের আচারের মত আরও কিছু খাবার কিনে খেতাম। বয়ামগুলো যে সামনের তাকে সারি করে রাখত, সেটাই খুব লোভনীয় ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল মুগডালভাজা। এখনকার রঙীন প্যাকেটের ডালভাজা ঐ খোলা ডালভাজার স্বাদের কাছে কিছুই না।

বয়ামে বিস্কিটগুলো যে কি সুন্দর করে সাজানো থাকত, সেটাও খুব ভালো লাগত। আমার পছন্দের ছিল নোনতা বিস্কিট, আর চিনি লাগানো টোস্ট বিস্কিট। প্যাকেটের বিস্কিটের মধ্যে খাওয়া হত লিলিপুট বিস্কিট, ছোট ছোট গোল গোল। আর ক্রিম বিস্কিটের মধ্যে পাইনঅ্যাপেলটা ছিল পছন্দের। মেলায় গেলে যে খাবারগুলো কেনা হত তার মধ্যে ছিল গজা, মুরুলি, নিমকি।

এগুলো কুটুর কুটুর করে খেতে বসলে সারাদিন পার করে দিতে পারতাম। আরও ছিল বাতাসা আর তালমিছরি। মিছরির মধ্যে বিভিন্ন পশু-পাখির ছাঁচে করাটাই বেশি পছন্দের ছিল। এগুলো কেনা হলে সব বোনরা পছন্দ করতে বসতাম পশু-পাখি, যদিও জানতাম খেতে সবগুলো একই। একবার একটা মুরগীর আকারের মিছরি খাওয়ার সময় শুরুতেই কামড় বসিয়েছি লেজের অংশে।

সেই নিয়ে মেজপার সে কি পচানি, আর কিছু পছন্দ হল না, লেজটাই সবচেয়ে মনে ধরল তোমার। আরেকটা জিনিস মামাদের কাছে আবদার করে খেতাম, তা হল মটকা। তিলে খাজার মত, কিন্তু শক্ত, মটর মটর করে কামড়ে খেতে মজাই লাগত। ডালপুরি আর আলুপুরি, আমার খুব বেশি পছন্দের ছিল, এখনও আছে। একটা সময় ছিল যখন রোজ সকাল-বিকাল ছোট বোনটাকে হাত ধরে নিয়ে পাশের পাড়ায় চলে যেতাম আর বাসার সবার জন্য বড় ঠোঙা ভরে পুরি নিয়ে আসতাম।

সেই ঠোঙার অর্ধেক পুরি যেত আমার পেটে। সকালে ডালপুরি, আর বিকালে আলুপুরি। এক পুরিওয়ালা তো আমাকে এমনই পুরিখোর বলে চিনে ফেলেছিল যে আমাকে দেখলে একটা-দুইটা পুরি এমনি বাড়তি দিয়ে দিত। নাহ, এত খাবার-দাবারের কথা বলতে গিয়ে ক্ষুধাই পেয়ে গেল। ঘরে মনে হয় চিকেন হালিম আছে, নিয়ে আসি।

এটা অবশ্য কেনা না, ঘরে বানানো। আপনারাও খাবেন না কি?  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।