সবুজের বুকে লাল, সেতো উড়বেই চিরকাল [
(এটা আমার ভালো না মন্দ গুণ জানি না। তবে সবার সাথে সমান মেলামেশা করে অভ্যস্থ। সেই সুত্রে কত লোকজনের সাথে চেনা পরিচয়। সেদিন একান্ত পরিচিত একজনের ঘটনা শুনে, মনে এতটাই দাগ কাটলো। তারই অবলম্বনে এই লেখা।
স্থান কাল পাত্র বর্ণনায় কল্পনার সাহায্য নেয়া হয়েছে। )
"যাক, এবার বেচারার একটা গতি হয়েছে..."
এই রকম অনেক কথা বার্তার মধ্যেই আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাপার। অথচ কত দৌড় ঝাপ। কত রকমারি ঝক্কি ঝামেলা।
কত টেনশন। কি হবে কি হবে এমন সাত পাচ চিন্তায় বিনিদ্র রাত্রিযাপন। অবশেষে ভালোয় ভালোয় অতিথিরা একের পর এক বিদায় নিলেন।
বেচারা আর্থরিক অর্থেই বেচারা। দেশ থেকে বহু দূরে কোন এক নীল সাগরের পারে সেই যে কবে ডেরা বেধেছিল, মনেও নেই।
আত্মিয় স্বজন বলতেও কেউ নেই। একাকিত্বকে সঙ্গি করে আপনমনে কাজ করে যাচ্ছিল সে।
অনেক স্বপ্ন আশা নিয়ে বেচারা নীল সাগরের দেশে এসেছিল। হয়তো জানতোই না, বাইরের চাকচিক্কের আড়ালে কি কঠিন আর নির্মম সত্যের সামনা সামনা তাকে হতে হবে।
পাখিরর ছানার মত আগলে ধরে রাখা মায়ের বাধনের অভাব অনুভুত প্রতি মুহুর্ত প্রতিক্ষন।
কালে ভদ্রে দেশের একটু টুকরো ছব দেখলেও বুক হু হু করে উঠতো। ছবির উপরেই হাত বুলিয়ে হারানো স্নেহের পরশ খুজতে চাইতো সে।
অতীতের শত স্মৃতি নিয়েই বর্তমানের সব দুঃখ কস্টকে ভুলে থাকার অকান্ত চেস্টায় কত দিন রাত কেটে গিয়েছিল হিসাব ছিল না।
পুর্ণ জোৎস্নার আলোতে পৃথিবি যখন উদ্ভাসিত হতো, বেচারা সেই আলোয় পুর্ণ অবগাহনে সুচি হতো। ভীষন রকম উদাসে নিজেকে নিজেই হারিয়ে ফেলতো অনেকক্ষনের জন্য।
ভাবুক-কবি কবি ভাব-ইম্প্রাকটিকাল-একে দিয়ে আশা নেই-কাঠখোট্টা-ভোদাই এই রকম কত বিশেষনে বিশেষিত হতো এই বেচারা। স্বভাবতই চালাক চতুর স্বদেশিদের মধ্যে বাত্য হতে বেশিদিন সময় লাগেনি তার।
তাকে ঝুমুর এক আধটু বুঝতে পারতো। বেচারার মঝে মাঝে মনে হতো হয়তো ঝুমুর ওকে ভালোবাসতো। কিন্তু কি করে সেটা সম্ভব? যতদুর জানে, ভিন্ন ভিন্ন দেশের অন্তত ওর বয়ফেন্ড্রের সংখ্যাটি খুব কম করে হলেও ৬-৭ জন।
বেচারার সাথে পরিচয়ের সময়েও তো ঝুমুরের বয়ফ্রেন্ড ছিল। বেচারার সাথে আলাপ্ও করিয়ে দিয়েছিল। বয়ফ্রেন্ডের সামনেই বেচারাকে সাথে নিয়ে কত দিন বাইরে গিয়েছে ঝুমুর ! কই ! কোনদিন ঝামেলা হতে দেখেনি। হয়তো এই দেশে এইই রীতি।
এ জিনিসটা ভালো লাগতো না বেচারার।
প্রেমিক ফেলে বন্ধুর সাথে ঘুরাঘুরি করাটা ঠিক? একদিন বলেও ফেলেছিল। ওর কথা শুনে খিল খিল হাসিতে গড়িয়ে পড়েছল ঝুমুর।
"বুঝলে আবির, তুমি দেখি জীবন সমন্ধে কিছু জানো না। শেখোওনি। বন্ধুর সাথে ঘুরে যেই মজা, সেটা প্রেমিকদের সাথে পাওয়া যায় না।
বুঝলে হাদারাম?"
হ্যা। খুব বুঝেছিল আবির। মানে আমাদের বেচারা। ঝুমুরের সাথে পরিচয়ের পর্বে অনেকবার সুযোগ করে দিয়েছিল ঝুমুর। কখনও উদ্ভিন্ন স্তনের অর্ধেক বের করা পোষাকে ঘরে না থাকা বান্ধবির ফাকা বাসায় নিয়ে গিয়ে।
কখনও অন্তর্বাসবিহীন ঘুমের পোষাক না ছেড়েই দেখা করতে চলে আসা। অথচ বেচারা সেই সুযোগ গুলিকে পায়ে ঠেলে দিয়েছিলো।
অথচ আবির এত নির্বিষ ছিল না। পরিচয়ের আগে, ঝুমুরের খোলামেলা পোষাকের ছবি দেখে প্রথমেই ওর চোখ লকলক করে উঠেছিল। মনে কল্পণায় বিবস্র করে অনেক চিত্র একে ফেলেছিলো সে।
মনে কামটুকু উড়ে গিয়েছিল প্রথম দেখাতেই ঝুমুরের আন্তরিক বন্ধুর মত সহজ স্বাভাবিক আচরণে। হ্যা, এ যে বন্ধু। মন খুলে যার সাথে কথা বলা যায়। সুখ দুঃখ ভাগ করে নেয়া যায়। সেই আত্মার আত্মিয়কে লালসার আগুনে পুড়াতে বিলক্ষণ আপত্তি ছিল তার।
তাই এমন নিস্পৃহতা ছিল তার।
সেই পাঠও চুকে যায়। অবশ্য আবির নিজেই এ পাঠ চুকিয়েছিল।
সেদিনের এক্সিডেন্টটা তার জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল। কেড়ে নিয়েছিল তার স্বপ্ন আশা সব কিছু।
এভাবে পঙ্গুত্বকে সঙ্গি করতে হবে সেটি ছিল তার স্বপ্নেরও বাইরে।
চির চাপা স্বভাবের যে ছেলেটি ঝুমুরের কাছে প্রবল প্রগলব ছিল, সেই চোখে তারুণ্য আর আশা ঝিকিমিকি করতো, সেই স্বভাবে কৃষ্ণ ঘন বিষুন্নতা আর চোখে এক রাশ নিরাশা নিয়ে কি করে দাড়াতোও এ ঝুমুরের সামনে। কত ফোন কল ইচ্ছা করে ধরেনি সে।
এযুগ স্থবিরতার তো নয়। তবে আবিরের এমন বদলতে যাওয়ারর কারণটিও অজানা রেখেই নিজের পথ ধরেছিল ঝুমুর।
তবে খুব বেশিদিন অপেক্ষায় রাখেনি ওকে আবির। বলেই দিয়ছিল তার এক্সিডেন্টের কথা।
চঞ্চল নদীতে যখন স্থবিরতা আসে, সেখানে কে চাইবে অবগাহনে গা ভাসাতে?
এর পর বহুদিন গত। চেনাজানার গন্ডি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জন একদম নিজস্ব জগতে একলা পথচলা। লোকজন পঙ্গু বলে ব্যাঙ্গ করবে, কেউ কেউ করুণা দেখাবে এইসব সহ্য করার মত মন ছিল না আবিরের।
এটা নীল সাগরের দেশ। চারিদিক ভাসছে আনন্দ উল্লাসে। অর্থ উড়ছে খোলামকুচির মত। নিজের অসহায়ত্বের কথা ভেবে কত রাত একাকি কেদেছে। অশ্রু মুছবার মত কেউ ছিল না।
পঙ্গুর জন্য কাজ জোগাড় করাও কস্ট সাধ্য ছিল। অনেকদিন অনাহাররে অর্ধাহারে কাটাতে হয়েছিল তাকে। কেউ জানতোও না। জানলেও সমবেদনা জানালেও জানাতে পারতো। হয়তো দয়া করে কিছু খাবার এনেও দিতে পারতো।
ব্যাস ! অতটুকুই। এখানে কেউ কারো নয়।
এর পরেও মানিয়ে নিয়েছিল আবির। অনেক কষ্টে বাস্তবকে মেনে নিয়ে একাকিত্বকেই অনেক আপন করে নিয়েছিল সে।
এমন করেই বাকি দিনগুলি কাটবে, সেই নিয়তি মনে করে দিন যাচ্ছিল তার।
কিন্ত বিধাতা যেন খানিকটা সদয় হয়েছিলেন।
অল্প চেনা এক ভদ্রলোকের পরিচয়ের সুত্রে মনি, আবিরের অন্ধকার আকাশে এক চিলতে আলো হয়ে এসেছিল।
মনির কাহিনী যেন আবিরের দুঃখের আরো বেদনাময় অধ্যায়। ছোট ছোট দুটি শিশু নিয়ে বিধবা। দেশে হায়েনারা ছিড়েখুরে খেতে উদ্যোত।
নিজে কি খাবে? বাচ্চাদের কি খাওয়াবে? ঘরে অক্ষম বাবা মা, ভাইবোন। উপায় ছিল। নিজেকে সেই পথে নিয়ে যাওয়া। ্কিন্তু সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না।
বয়সের অনেক ফারাক।
বাবার বয়সি একজনের পাতানো বউ হয়েই মনি চলে আসে নীল সাগরের দেশে। কিন্ত এ কি ! বিয়ে নয়। তাকে রক্ষিতা করার ফন্দি যে। তাও ঘরে বৌ আর তার সমান বয়সি বাচ্চা থাকা অবস্থাতেই।
বুড়োর কীর্তি কাহিনী ফাস হতেই, মনিকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে পুলিশ ডেকে রাস্তায় এক শীতের রাতে বের করে দেয়া হয়েছিল।
অসহায় একটা মেয়ে। এই ভীন দেশে অচেনা অজানা রাস্তায় শীতে কাপতে কাপতে একটু আশ্রয়ের খোজে ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা নিয়ে মৃত্যুকেই নিয়তি বলে মেনে নিয়েছিল যেন।
আবিরের মত মনির ব্য্যাপারেও আলাদা হিসাব ছিল বিধাতার।
ঘরের কাজকর্ম আর বাচ্চাদের দেখভাল এই শর্তে একটা পরিবারে আশ্রয় জোটে মনির। কিন্তু সেখানেও যেন রেহাই নেই।
কর্তাকে ফেলে কত্রি বাইরে প্রেমজ্বালা মিটাতে ব্যাস্ত। কর্তার দৃস্টি তাই মনির দিকে। কত দিন একা পেয়ে গায়ে হাত দিতে চেয়েছে। নিজের অসহায়ত্বে নির্ঘুম কান্নায় ভেঙ্গেচুড়ে যাচ্ছিল সে।
ঠিক সে রকম সময় সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকে খবর পেয়ে আবিরের সাথে প্রথম পরিচয় মনির।
কতদিন। কত রাত। কত কথা বলার জন্য দুজনই যেন ব্যাকুল। বন্ধুত্ব থেকে সম্পর্কটা আরো গভিরে যেতে সময় লাগেনি। দুটি নিঃসঙ্গ অসহায় মানুষ তাই হতে পেরেছিল একজন আরেকজনের উপযুক্ত সঙ্গি।
পুরানো কিছু পরিচিত লোকজন ডেকে খুব সাদামাটা করে বিয়েটা ওরা সেরে ফেলেছিল।
নিঃসঙ্গ দিনগুলির সমাপ্তি ঘটাতে আবির নতুন জীবন পেয়েছিল। আর রাস্তা ঘাটে হায়েনার উৎপাত থেকে মুক্তি পেয়ে নারীত্বকে নতুন সম্মাননায় ফিরে পেয়েছিল মনি।
অভাবের সংসার। অথচ খুব অল্প করে ছোট ছোট করে সুন্দুর সাজিয়ে গুছিয়ে তোলার কাজটি মনি খুশির সাথেই করতো।
অনেক আদর সোহাগ ভালোবাসায় কত রাত না ঘহুয়ে দুজন কাটিয়েছে, তার ইয়াত্তা ছিল না।
ভালবাসার প্রথম লগ্নে এতটাই উন্মত্ত ছিল্ল দিজনে যে, দোষত্রুটি গুলি চোখে পড়তে পড়তে অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছিল। মনি জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত হয়ে তিরিক্ষি মেজাজে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
আর পঙ্গুত্বের অসহায়ত্বের কারণে একদিকে উপার্জন বাড়াতে অক্ষম হয়ে মনির জীবন সংগ্রামে বিশ্রাম দেবার সাধ্যও আবিরের ছিল না।
এই ছোটখাট না পাওয়া নিয়ে মত পার্থক্য বাড়তে বাড়তে আজ এমন পর্যায়ে গিয়েছে, যে কত দিন রাত , শীত গ্রীষ্ম ফাগুনের মধুর স্মৃতি ভুলিয়ে এক সময়ের অনেক কাছের দুটি মানুষকে আলাদা করে দিয়েছে আজ।
আবিরের ভয় সেই নিদারুণ একাকিত্ব আর অসহায়ত্বের নরকে পুড়ে মরে দিন রাত পার করার। আর এই অজানা অচেনা শহরে আবারও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবার শারিরিক আর মানসিক ভার বহনের শক্তি মনির নিজেরও থাকবে কি?
জীবন বড় অদ্ভুত। বাস্তবতাও নির্মম। নইলে একে অপরের সুখ দুঃখকে সাথী করে অচেনা দুটি মানুষ অনেক চেনা হয়ে আবার কেন অচেনা হবার পথহের দিকে ছুটবে?
(আবির একটা বাস্তব চরিত্র। ওর পুর্ণ অনুমতি নিয়েই লিখেছি।
)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।