রাজারাকারদের বিচার চাই....... বরেন্দ্র ভূমির বুকের উপর দীর্ঘ ৫৯ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে শিার্থীদের থাকার জন্য আবাসিক হল রয়েছে ১৬টি। এর মধ্যে ছাত্রদের জন্য ১১টি আর বাকী ৫টি ছাত্রীদের জন্য। গবেষকদের জন্য রয়েছে একটি ডরমেটরি।
দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে নাম করণ করা হয়েছে এসব হলগুলোর।
ছাত্রদের হলগুলো হলো- শের-ই-বাংলা ফজলুল হক, শাহ মখদুম, নবাব আব্দুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, শহীদ হবিবুর রহমান, মতিহার, মাদার বখ্শ, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, শহীদ জিয়াউর রহমান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমান হল। ছাত্রীদের হলগুলো হলো-মন্নুজান, রোকেয়া, তাপসী রাবেয়া, বেগম খালেদা জিয়া ও রহমতুন্নেসা হল।
প্রতিটি হলে শিার্থীদের খাওয়ার জন্য রয়েছে ডাইনিং-ক্যান্টিন। সব হলের ডাইনিং-ক্যান্টিনগুলোতে রয়েছে ম্যানেজার, বাবুর্চি, সহকারী বাবুর্চি, টেবিল বয়সহ বিভিন্ন শাখায় কাজ করা প্রায় দু’শতাধিক শ্রমিক।
এখানকার শ্রমিকরা নিজেদের বাড়ী থেকে এসে তাদের কাজে যোগ দিয়ে থাকে।
তাদের কারো বাড়ী ক্যাম্পাস থেকে ১০কি.মি. দূরে আবার কারো বাড়ী হয়তো তার থেকেও অনেক বেশী। ডাইনিং এর শ্রমিকদের সকাল ১০টার মধ্যে তাদের কর্মস্থলে আসতে হয়। আর ক্যান্টিনের শ্রমিকদের কাজে আসতে হয় সকাল ৬টার মধ্যে। তাদের প্রত্যেককে ক্যাম্পাস ছাড়তে হয় রাত ১০টায় । ১৮৮৬ সালের মে মাসে যে কর্মঘন্টার জন্য শ্রমিকরা আন্দোলন করেছিলেন তাতে তারা সফল হয়েছিলেন।
কিন্তু আজও যে সেই কর্মঘন্টার বৈষম্য রয়ে গেছে তা বোঝা যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভোজনালয় শ্রমিকদের দেখলে। কেননা তারা প্রায় ১৪ ঘন্টা কাজ করার পরও পাচ্ছে না কোন সুযোগ। এতে করে তারা বারবার আন্দোলনে নামলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের জন্য কোন ব্যবস্থা করেনি। তাই ১ মে বা এই মাস আসলেই মনে পরে শ্রমিকদের সেই আন্দোলনের কথা।
বাড়ীর কথা জিজ্ঞেস করতেই একটি ছাত্রী আবাসিক হলের এক মহিলা শ্রমিক জানান, তার বাড়ীতে পৌছতে কোন কোন দিন রাত ১২টা বা ১টাও বেজে যায়।
কান্ত শরীর, অশান্ত মন আর ব্যাথা ভরা শরীর নিয়ে যখন আপন ঘরে তিনি পৌছান তখন বাড়ীর সবাই এক অচেনা শক্তির মোহে হারিয়ে গেছে আর এক জগতে। ওই গভীর রাতে বাড়ীর সব সদস্যের শীথ কাঠিগুলো ডান-বাম করার সাধ্য নেই যেন কারো। দরজায় একের পর এক আঘাতে তার স্বামীর দরজাটি খুলে দিয়েই আবার ঘুমিয়ে পরেন। ওই শ্রকিমকের সন্তানরা যেন মা হারা শিশুর মতো সারাটা দিন এ পাড়া ও পাড়া বেড়িয়ে সন্ধায় বোনের রান্না করা খাবার খেয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পরে তা ওরা নিজেরাও জানে না। তাদের মা প্রিয় সন্তানদের ছেড়ে অভাবের ত্বারণায় সামান্য কিছু অর্থের টানে দিন রাত কাটান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ডাইনিং-এ।
তিনি নিজেকে একটুখানি বিছানার চাঁদরে জড়িয়ে দিতে না দিতেই ফজরের আযান কানে এসে যায়। ৪ ঘন্টার এক স্বল্প ঘুমেই যেন তাদের গোটা দিন পার হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু হলের সহকারী বাবুর্চি আবুল খায়ের নিজের জীবনের অতীত ও ভবিষ্যত সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, স্বাধীনতার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সাল। আমাদের সংসারে প্রচন্ড অভাব-অনটন। বাবা ঠিকমত সংসার চালাতে পারতেন না।
বাধ্য হয়ে পিতার আর্থিক অনটন লাঘব করতে অল্প বয়সেই পড়ালেখা বাদ দিয়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি। কাজের সন্ধানে দেশের বাড়ি থেকে চলে আসি রাজশাহীতে। এরপর কাজ পেয়ে যাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শহীদ শামসুজ্জোহা হলে। সেখানে সে সময়ে ৪০ টাকা বেতনে ডাইনিং-এ টেবিল বয় হিসেবে কাজ শুরু করি। এরপর এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ডাইনিং গুলোতেই পারি দিয়েছি জীবনের মূল্যবান ৪০টি বছর।
কিন্তু যেই অভাব আর দারিদ্রের তাড়নায় আমি ঘর ছেড়েছি তা আমার পিছু ছাড়েনি আজও। আমার বাবা-মার দরিদ্রতার কারণে যেমন আমি লেখা-পড়া শিখতে পারি নি ঠিক তেমনি ভাবে আমার সন্তারদের লেখাপড়াও শিখাতে পারিনি। পারিনি তাদেরকে ভবিৎষ্যতের নিরাপত্তার হাতিয়ার বানাতে। আর কিছু দিন পর আমি বৃদ্ধ হব হারিয়ে ফেলব আমার কাজ করার মতা। কিন্তু তখন আমাকে দেখার কেউ থাকবেনা।
না হল প্রশাসন? না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? তখন আমাকেও বেঁেছ নিতে হবে আর দু-চারজনের মতো ভিাবৃত্তিকে। যেমনিভাবে আজ ভিাবৃত্তিকে গ্রহন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং এ ৩০-৪০ বছর কাজ করা টেবিল বয় মো আবুল কাশেম, আব্দুস সাত্তার, আব্দুলসহ অনেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরিচিত গোষ্ঠী তারা। তাদের হাতের খাবার খেয়ে অনেকে আজ দেশের সর্বোচ্চ স্থানে আসিন। তারাই ক্যাম্পাসে মা-বাবার মতো করে লালন করেছেন হাজার হাজার শিার্থীকে।
আর তারাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে সুযোগ বঞ্চিত একটি গোষ্ঠি। যারা দিনের পর দিন মানবেতর জীবন যাপন করেও পাচ্ছে না জীবনে সামান্যতম সুযোগ। যারা দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য। এ দীর্ঘ সময়ে প্রশাসনের পাল বদল হয়েছে অনেক বার। প্রশাসনের একের পর এক পরিবর্তন ঘটলেও তাদের ভাগ্য আজও রয়েছে অপরিবর্তিত।
তাই তারা এই অভাগা জীবন থেকে সামান্যতম মুক্তির আশায় নেমেছে তাদের দাবী আদায়ের সংগ্রামে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভোজানালয় শ্রমিক ইউনিয়নের দাবী তাদেরকে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এই সকল ভোজনালয় শ্রমিকরা ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রায় ১৫ ঘন্টা কাজ করলেও তাদের ভাগ্যে জোটে খুব সামান্য পরিমানের বেতন ভাতা। বর্তমানে তাদের বেতন প্রায় ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। এই সামান্য টাকায় বর্তমান সময়ে তাদের নিজেদের সন্তানদের লেখা-পড়ার খরচ তো দূরের কথা তারা সংসার চালাতেই পারছে না।
তবুও এই পেশায় থাকতে হচ্ছে শুধই পেটের দায়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মালি যেখানে মাসিক বেতন পান ১০ হাজার টাকা সেখানে ভোজনালয় শ্রমিকরা তাদের চেয়ে বেশী সময় কাজ করেও তাদের অর্ধেক মজুরিও পার না তারা।
তাদের কেউ কেউ এই পেশার সাথে যুক্ত আছেন প্রায় ৪০ বছর ধরে। এই সুদীর্র্ঘ সময়ে একটানা ১৫ ঘন্টা কাজ করেও তারা কেউই স্বীকৃতি পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী হিসেবে ।
মানবেতর জীবন যাপনকারী এই সকল ভোজনালয় শ্রমিকরা বারবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তাদের অসুবিধার কথা বলার পরও তাদের কথায় কান দেয়নি কেউই।
তাদের একক দাবি প্রশাসন মেনে না নিলে তারা একটি সংঠন তৈরী করার উদ্দোগ গ্রহন করে।
তাই তাদের দাবী আদায়ের ল্েয ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভোজনালয় শ্রমিক ইউনিয়ন নামের একটি সংগঠন তৈরী করেন। সংগঠনটি সর্বপ্রথম শ্রমিকদের প থেকে ১৯৭৬ সালে ভোজনালয় শ্রমিকদের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার দাবী জানায়। এরপর ২০১০ সালে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের তোপে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৪৩০তম সভায় বিষয়টি উত্থাপন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর চিত্র রঞ্জন মিশ্রকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটি দুই মাস পরে একটি সুপারিশ পত্র প্রদান করে। কমিটি প্রত্যেক হলে ১জন বাবুর্চি, ২জন সহকারী বাবুর্চি এবং দুজন টেবিল বয়ের পদ সৃষ্টি করে চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী হিসেবে কর্মরতদের নিয়োগের সুপারিশ প্রদান করে। এর দু’বছর অতিক্রম করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভোজনালয় শ্রমিকদের কাউকেই চতুর্থ শ্রেনী কর্মচারী পদে নিয়োগ দেয়নি।
তাই দাবী আদায়ে জন্য সংগঠনটি আবারো সোচ্চার হয়ে ওঠে। ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে একের পর এক আন্দোলনের করে যাচ্ছেন তার।
কিন্তু না! তাদের কথার কোন মূল্য নেই এই প্রশাসনের কাছে। তারা যেন এই ক্যাম্পাসের এক অনাথ শিশু। যাদের দেখা-শোনা করার নেই কেউ।
ভোজনালয় শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হকসাদ আলী অনেকবার সমাবেশ করে বলেন, দেশের ১২ টি পাবালিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোজনালয় শ্রমিক ইউনিয়নের শ্রমিকদের ৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও আমাদের স্বীকৃতি না দেয়ায় এই সামান্য বেতনে পরিবার নিয়ে চলতে পারছিনা। তাই বর্তমান প্রশাসন আমাদের এই দাবি পূর্ন না করলে আমরা ডাইনিং ও ক্যান্টিন বন্ধ করে আমরণ অন্বষণে যেতে বাধ্য হব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘ ৩০-৪০ বছর হল ডাইনিংগুলোতে কাজ করার পর বৃদ্ধ বয়েসে এসে অনেকেই জীবিকা নির্বাহের জন্য বেঁেছ নিয়েছে ভিাবৃত্তিকে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মতিহার হলের আব্দুল, হবিবুর হলের অলি, আব্দুস সাত্তার, সোহরাওয়ার্দী হলের আবুল কাশেমসহ অনেকে।
ক্যাম্পাসের বিভিন্ন মহলের অভিমত, ভোজনায় শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। তাদের সন্তানদের পড়া-শোনা করার মত বেতন ভাতা দেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। আর জীবনের শেষ সময়ে এসে যেন তাদেরকে ভিা বৃত্তির মতো জঘন্য পেশায় যেতে না হয় সে দিকে অবশ্যই প্রশাসনের নজর রাখতে হবে।
উল্লেখ্য ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং কর্মচারীদের চতুর্থ শ্রেনী কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ প্রদানের আইন রয়েছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।