মানুষ সামাজিক জীব। একা একা মানুষ বাস করতে পারেনা। তাকে সমাজে প্রতিবেশীদের সাথে মিলে মিশে বাস করতে হয়। সুখে দুঃখে একে অপরের পাশে থাকতে হয়। প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহারের ফলে মানুষের সামাজিক জীবন শান্তিময় আর সুখের হয়।
আর যদি প্রতিবেশীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়, তাহলে তাদের সাথে ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগেই থাকে, অনেক সময় মারামারি কাটা কাটি মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত হয়। পরিণতিতে সামাজিক জীবনে নেমে আসে অশান্তি। হাদিস শরিফে প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহারে জন্য বার বার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত রসূলে পাক (সা.) বলেন_ আল্লাহর কসম! ওই ব্যক্তি ঈমানদার নয়, ওই ব্যক্তি ঈমানদার নয়, ওই ব্যক্তি ঈমানদার নয়। জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওই ব্যক্তি কে? তিনি উত্তরে বলেন, ওই ব্যক্তি যার অত্যাচার ও অপকার হতে তার প্রতিবেশী লোকেরা নিরাপদে থাকে না।
(বুখারী ও মুসলিম শরীফ)
হযরত রসূলে পাক (সা.) আরও বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন তার মেহমান-অতিথিকে সম্মান করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক ও কিয়ামতের দিনের বিশ্বাস রাখে সে যেন সর্বদা ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (বুখারি ও মুসলিম শরীফ)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল ইয়া রাসূলুল্লাহ! অমুক মহিলা অধিক নামাজ, রোজা ও দান-সদকার কারণে তাকে স্মরণ করা হয়, তবে সে তার জবান দ্বারা তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দিয়ে থাকে। রসূল (সা.) বললেন, সে জাহান্নামী।
ওই ব্যক্তি আরও জিজ্ঞাসা করল ইয়া রাসূলুল্লাহ! অমুক মহিলা অল্প রোজা, অল্প দান-সদকা ও অল্প নামাজের বিষয় মানুষের মধ্যে আলোচনা করে। তবে সে পনীরের টুকরা বিশেষভাবে দান করে থাকে এবং তার জবান দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। রাসূলুল্লাহ বললেন, সে জান্নাতি। অতএব আমাদের উচিত প্রতিবেশীদের অধিকারগুলো যথারীতি আদায় করা। যেমন দান, সদকা, খাওয়ানো, সাহায্য-সহযোগিতা করা, ঋণদান, সেবা-শুশ্রূষা, প্রতিবেশীদের কোনও ধরনের কষ্ট না দেওয়া এবং সর্বাবস্থায় তাদের কুশল কামনা করা ইত্যাদি হক আদায় করা ঈমানের দাবি।
কিন্তু আজকাল আমারা অনেকেই প্রতিবেশীদের খোঁজ খবরই রাখি না। আমাদের আশে পাশে এমন গরীব পরিবারও আছে, যাদের গোস্ত খাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো সেই কোরবানির ঈদের সময়। সারা বছর আর গোস্ত খাওয়া হয়নি। অথচ আপনার আমার বাড়িতে সপ্তাহে তিন চার দিন মাছ গোস্ত নাহলে চলেই না। গ্রামের গরিব মানুষেরা প্রায় সময় খাল বিল থেকে কুড়িয়ে আনা শাক দিয়ে ভাত খায়।
আমাদের উচিত রান্না করা ভালো তরকারি থেকে গরিব প্রতিবেশীকে কিছুটা দেওয়া। হযরত ইবনে আব্বাস (রা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি হযরত রসূল পাক (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ওই ব্যক্তি ঈমানদার নয়, যে ব্যক্তি উদরপূর্তি করে খায় অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে। (বায়হাকী শরীফ)।
নবী করিম [সঃ] বলেন ‘তোমরা যখন তরকারী রান্না করবে তখন শুরবা [ঝোল] একটু বাড়িয়ে দিবে, যাতে তোমার প্রতিবেশীকেও কিছুটা দিতে পারো। [মুসলিম শরিফ]
ভোগের মধ্যে যে আনন্দ আছে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আনন্দ আছে ত্যাগের মধ্যে।
তাইতো কবি বলেন।
''পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলই দাও
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে'
সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। ''
প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহারে ছওয়াবও পাওয়া যায় আবার তার সুফল আমাদের সামাজিক জীবনে আমরা নিজেরাই ভোগ করে উপকৃত হতে পারি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রত্যেকই একে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী।
কেও নিজে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। আমরা প্রত্যেকেরই প্রতিবেশীর সাহায্য নেয়া প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রতিবেশী তখনই আপনার আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে যখন তাদের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক থাকবে। আর যদি তা না থাকে তাহলে কেও কারো সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। তখন আমরা শুধু গুনাহগার হব তা নয় আমরা মানবতার সীমা ছাড়িয়ে পশুত্বের স্তরে নেমে যাব।
মানুষের সাহায্য করলে আল্লাহ তা’লা আমাদের সাহায্য করবেন নবী করিম (স.) বলেন।
‘আল্লাহ্ ততক্ষণ তার বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ সেই বান্দাহ্ তার ভাইয়ের সাহায্যে লিপ্ত থাকে। ’ {মুসলিম, তিরমিজি }
আরেকটি হাদিসে আছে “মখলুক হচ্ছে আল্লাহর পরিবার বিশেষ, সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁর এ ব্যক্তি পরিবারের সংগে সদাচরণ করলো, আল্লাহর কাছে তাঁর মখলুকের মধ্যে সেই হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয়। ’ (বায়হাকী)
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আজকাল আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে প্রতিবেশীর উপকার বাস্তবেও করে না আর মনে মনেও প্রতিবেশীর ভাল হোক তা চায় না। একে অপরকে হিংসা করে।
কারো উন্নতি দেখলে মন খারাপ করে। শুধু অন্যের ক্ষতি কিভাবে করা যায় তার পেছনে লেগে থাকে। এটা একটা মারাত্মক মানসিক ব্যাধি। এটা মুসলমানের আচরণ হতে পারে না। হাদিসে আছে যার হাত ও মুখ দ্বারা অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে না সে প্রকৃত মুসলমান নয়।
হাদিসে আরও আছে “হিংসা ইবাদতকে এভাবে জ্বালিয়ে দেয় যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে দেয়।
এক হিংসুকের কিচ্ছা মনে পড়ে গেল। যে তার প্রতিবেশীর উন্নতি সহ্য করতে পারতো না, বরং প্রতিবেশীর ক্ষতি কামনা করতো। এক দিন সেই ব্যাক্তির কাছে এক ফেরেশতা এসে বলল হে অমুক আমি আল্লাহর হুকুমে এসেছি তোমার কাছে। তুমি যা চাইবে তাই দেব তোমাকে।
তবে একটি শর্ত আছে তাহলো তোমাকে যা দেওয়া হবে তার দ্বিগুণ দেওয়া হবে তোমার প্রতিবেশীকে। অর্থাৎ তুমি যদি একটি বাড়ি চাও তা তোমাকে দেওয়া হবে আর তোমার প্রতিবেশীকে দেওয়া হবে দু,টি বাড়ি। তুমি এক কোটি টাকা চাইলে তা তুমি পাবে আর তোমার প্রতিবেশী পাবে দুই কোটি টাকা। তুমি কি চাও বল। তখন সে হিংসুক বলল “আমি চাই যে আমার একটি চোখ কানা করে দেওয়া হোক”।
এখানে হিংসুক ব্যাক্তি নিজের এক চোখ কানা করে হলেও প্রতিবেশীর দুই চোখ কানা করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। এর চেয়ে জঘন্য প্রতিবেশী আর কে হতে পারে।
প্রতিবেশীদের মধ্যে আরেকটি মারাত্মক অপরাধ প্রবণতা প্রচলিত আছে তাহলো গীবত করা। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ বর্ণনা করার নাম গীবত। এই গীবতের কারণে অনেক সময় ঝগড়া ফ্যাসাদ পর্যন্ত হয়ে যায়।
এই গীবত এত বেশি করা হয় যেন এটা কোনোও অপরাধই না। অথচ গীবত করা মহাপাপ। আল্লাহ তালা বলেন। يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ۖ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ وَاتَّقُوا اللَّـهَ ۚ إِنَّ اللَّـهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ ﴿١٢﴾ মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ।
এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
সুরা আল হুজুরাত= ১২
আজকাল আমাদের অবস্থাও হয়েছে সেই হিংসুকের মত। কারো মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে কিভাবে মেয়ের বদনাম করে ছেলে পক্ষকে তাড়িয়ে দেবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় অনেকের মধ্যে। নিজের পকেটের টাকায় গাড়ী ভাড়া দিয়ে বদনাম করতে যায়। তাহলে আমরা কিভাবে নিজেকে মুসলমান হিসেবে দাবী করতে পারি। আমাদের এই স্বভাবের পরিবর্তন হওয়া দরকার।
মুসলমান হিসেবে নিজের চরিত্র গঠন এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভাল আচরণ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী। তাতে আমাদের নিজেদের সামাজিক জীবনও সুখের হবে এবং আল্লাহ তাআলার কঠিন শাস্তি থেকেও আমরা বাঁচতে পারব।
প্রতিবেশীদের সাথে আমাদের সু সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নিম্ন বর্ণিত কাজ গুলোর প্রতি আমাদের খেয়াল রাখা-
* আগে সালাম দেওয়া।
* হাসি মুখে কথা বলা।
* খোঁজ খবর নেয়া কুশলাদী জিজ্ঞেস করা।
* ধার কর্জ দেওয়া।
* অসুখ বিসুখ হলে সেবা করা।
* সামাজিক কাজে অংশ গ্রহণ করা।
* মাঝে মাঝে হাদিয়া দেওয়া।
* গরীব প্রতিবেশীদেরকে আর্থিক সাহায্য করা
* যে কোনো ভাল কাজে সহযোগিতা করা।
* প্রতিবেশীর গীবত না করা।
* ঝগড়া ফ্যাসাদ মীমাংসা করা।
আমরা যদি প্রতিবেশীদের এভাবে চলি তাহলে আশা করা যায় আমাদের সামাজিক জীবন আরোও সুন্দর, আরোও সুখের এবং আরোও আনন্দময় হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।