আমি একজন ভাবুক, আগ্রহী পাঠক, আর স্বপ্ন মাথায় নিয়ে বাস্তবকে মাড়াই ।
লোক মুখে প্রচার আছে যে কোকিল বাসা বাঁধে না, কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। কোকিলের ডিমে কাক তা দেয়। কাকের ওমে কোকিলের ডিম ফুটে। জন্ম নেয় কচি ছানা।
সে বাচ্চা লালন করে কাক, কিন্তু ছানাটি কাক হয় না , হয় কোকিল। কোকিলের ছানার জৈবিক মা ও প্রতিপালনকারী মায়ের উত্তরাধিকার কিংবা অপত্য স্নেহের দাবী দাওয়া নিয়ে কাক আর কোকিলের মাঝে টানাপড়েন চলে কিনা আমাদের জানা নাই। এরকম কিছু ঘটনা নিয়ে ইদানীং তুমুল নৈতিক বিতর্ক চলছে । জ্ঞানকাণ্ডের ভিন্ন ভিন্ন শাখা ও নতুন তত্ত্বের পরিধি পেরিয়ে সেই তর্ক আমদের বৈঠকখানায় এসে হাজির হয়েছে। নাটক, সিনেমা আর সোপ সিরিজের কাহিনী আকারে তা ইতোমধ্যেই আমদের লাজুক সংসারের আড় ভেঙ্গে দিয়েছে।
ব্যাপারটা আরও খোলাসা করে বলি। বন্ধ্যা যুগলের আকাঙ্খা থাকে একটি সন্তান নেয়ার। কিন্তু স্বামী অথবা স্ত্রী কিংবা উভয়ের অক্ষমতার জন্য সন্তান জন্ম দেয়া অনেক সময় সম্ভব হয়না। তাই সন্তানহীন পরিবারে সন্তান জন্ম দানের চাপা আকাঙ্খা থেকে তৈরি হয় সংকট। এই সংকটের আবার দুইদিকে টান, তাই বলা যায় দুটানা সংকট বা উভয় সংকট।
বর্তমান জৈব- প্রযুক্তির যুগে চিকিৎসাবিদ্যার অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে। প্রযুক্তি সহযোগে বংশবিস্তার পদ্ধতির ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। এখন বন্ধ্যা যুগল সারোগ্যাসির মাধ্যমে সন্তান নিতে পারে। একটি চুক্তির অধীনে কোন নারী বিবাহ বহির্ভূত অন্য পুরুষের সন্তান নিজ গর্ভে ধারণ করলে তাকে সারোগ্যাসি বলা হয়। সারোগ্যাসির ক্ষেত্রে কোন নারী তার গর্ভাশয় ভাড়া দেয় এবং সন্তান জন্ম দেয়া অবধি নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মানার অঙ্গীকার করে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেই ডিম্বাণু প্রদান করে বলে তখন তাকে জেনেটিক মা বলা হয়। অন্যদিকে ডিম্বাণু না দিয়ে শুধু জাইগোট নিয়ে বাচ্চা বহন করলে গর্ভধারণী মা বলা হয়। অপরের বাচ্চা নিজের গর্ভে ধারণ করে একজন সারোগ্যাট মা বিনিময়ে অর্থ ও ভরণপোষণ পায়। তাই গরীব নারীরা অর্থের বিনিময়ে একটি জৈবিক, মনস্ত্বাত্তিক, সামাজিক- সাংস্কৃতিক ঝুঁকি নিচ্ছে। আবার এই বিশেষ সন্তান জন্মদান পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর অবৈধ বাণিজ্য শুরু হয়েছে।
বিশেষ করে ভারতে এ নিয়ে বিতর্কিত জৈব- প্রযুক্তি বাণিজ্য প্রসার পেয়েছে। পন্যায়নের শব্দ ভাণ্ডারে নতুন একটি পদও যুক্ত হয়েছে , যাকে “চিকিৎসা পর্যটন’’ বলা হচ্ছে। সন্তানকামী বিদেশী পর্যটকেরা সারোগ্যাট মা খোঁজার জন্য ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে।
এশীয় মূল্যবোধ ও দক্ষিণএশীয় সংস্কৃতির মানদণ্ডে সারোগ্যাসি গ্রহণযোগ্য কি না তা নিয়ে ইতোমধ্যেই নৈতিক, আইনি, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বাহাস শুরু হয়েছে । এখনও পুরো ব্যাপারটাকে কোন প্রেক্ষিতে বিচার করা হবে তা যেমন অস্পষ্ট, নৈতিক কিংবা আইনি মানদণ্ড কিভাবে নির্ধারণ করা হবে তা নিয়েও জটিলটা দেখা দিয়েছে।
ঠিক এ জায়গায় আমাদের প্রেক্ষিত ঠিক করা এবং একটি বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিকোণ নির্ধারণ করার জন্যই এই লেখার লম্বা সূত্রপাত।
নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সারোগ্যাসি অমানবিক। কারণ এতে একজন সারোগ্যাট মায়ের অবস্থানগত প্রেক্ষিতকে অস্বীকার করা হয়। তার ডিম্বাণু, কষ্ট- বেদনা, মনস্ত্বাত্বিক বিষয়, অপত্য স্নেহ এবং বাচ্চার প্রতি একজন স্বাভাবিক মায়ের টানকে অগ্রাহ্য করা হয়। মানুষের মানবিক বিষয়গুলোকে অর্থ বিনিময়ের সূত্রে, প্রযুক্তি ব্যবহারের নিরেট যান্ত্রিকতার ছকে ফেলে বিচার করা হয়।
একদিকে নারী ও তার প্রসব সামর্থ্য পণ্যের মত বেচা কেনা হয় বলে নারীর মানবিক গুরুত্ব থাকেনা, অন্যদিকে শিশুর যে একজন স্বাভাবিক মা পাওয়ার অধিকার থাকে সেটুকু ছিনতাই হয়ে যায়।
নারীবাদীদের মতে, সারোগ্যাসি নারীর একটি বৈধ অধিকার, সে সাথে নারী স্বাধীনতা উপভোগের একটি পন্থাও বটে । কারণ, কিছু নারী আছে যারা মা হতে আশা পোষণ করে কিন্তু সন্তান লালন-পালন করতে চায়না। তারা এই বিকল্প পন্থায় মা হতে পারে। আবার পুরুষের যদি একই রকম সুযোগ থাকে, তাহলে নারীরও সেরকম একটি সমঅধিকার থাকা উচিত বলেও অনেকে মনে করে।
সেক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমতা বিচারের মানদণ্ড জৈবিক সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে একটি অনপেক্ষ অবস্থান থেকে বিচার করার প্রশ্ন আসে।
সারোগ্যাসি একটি আইনি ও নৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। একজন মা যখন সারোগ্যাট চুক্তি করে সে নিজেকে একজন বাণিজ্যিক পোয়াতি ভাবতে পারেনা আবার নিজেকে নন-সারোগ্যাটও ভাবতে পারেনা। অথচ গর্ভধারণী মা কিংবা জেনেটিক মা উভয়ই এই সন্তানকে নিজের সন্তান মনে করেনা। একজন ভাবে সে অন্যের সন্তান নিজ গর্ভে ধারণ করেছে মাত্র।
অন্যজন ভাবে অন্যের গর্ভে বেড়ে উঠা সন্তান তার নিজের নয়। এভাবে একটি সারোগ্যাট শিশু আইনগত ভাবে একটি প্রকৃত মা পায়না। এতে করে শিশুটি অপত্য মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু নৈতিকভাবে সারোগ্যাট মা ও বাচ্চার সম্পর্ক বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ। যে গর্ভবতী হয়, বাচ্চা ধারণ করে এবং প্রসব করে তার সাথে গর্ভস্থ বাচ্চার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়।
কারণ এসব তীব্র ঘটনার ভেতর দিয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক মিতস্ক্রিয়া গর্ভধারনী মা ও শিশুর মধ্যে ঘটে থাকে।
আইনগত প্রেক্ষিত থেকে একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তাহল, চুক্তিবদ্ধ অভিপ্রায়ের উপর ভিত্তি করে মা-সন্তানের সম্পর্ক বিচার করতে হবে। এক্ষেত্রে পিতা-মাতা বলতে আইনি পিতা-মাতাকে বুঝাবে। কিন্তু জেনেটিক পিতা-মাতার সম্পর্ককে অস্বীকার করার জন্য এতে যথেষ্ট যুক্তি নাই। সম্পর্কটি আরও বেশি জটিল আকার ধারণ করে যখন আত্মীয়তা ও উত্তরাধিকার নির্ণয়ের প্রশ্ন আসে।
কে কার আত্মীয় ও কে কার উত্তরাধিকারী হবে তা নিয়ে জটিল আইনী বাধা আছে। একটি সারোগ্যাট শিশুকে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে এখনও বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে আইনগতভাবে স্বীকার করা হয়নি।
সারোগ্যাসি বড় ধরণের সাংস্কৃতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। কারণ বন্ধ্যা যুগলের আকাঙ্খাকে পুঁজি করে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর ব্যবসা চালু হয়েছে। এই ব্যবসায় আবার কালবাজারীর দাপট।
কিন্তু সন্তানতো আর হাতের চুড়ি নয় যে ইচ্ছে মত কেনাবেচা করা যাবে। মানব সন্তানকে পণ্যের মত বেচাকেনা করা সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের লক্ষণ। আবার অন্যদিকে প্রশ্ন উঠেছে, সারোগ্যাসি কি প্রথাগত বিয়ের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্বহীন করে দেবে? মনুষ্য সমাজের একটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেবে?
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির জায়গায়ও একটি বৈপরীত্য ও সংকট দেখা দিয়েছে। সুন্নী মুসলিমরা মনে করে সারোগ্যাসি হারাম। কারণ, এতে কোন পুরুষের বীর্য এমন এক নারীর জরায়ুতে প্রবেশ করানো হয় যার সাথে তার বিয়ে হয়নি।
আবার মাতৃত্ব নিয়েও সন্দেহ আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। প্রকৃত মা কে? জেনেটিক মা নাকি যে গর্ভধারণ করে প্রসব করেছে সে প্রকৃত মা? অন্যদিকে শিয়া মুসলিমরা মনে করে সারোগ্যাসি জায়েজ। কারণ শিয়ারা বীর্য থেকে জাইগোটকে পৃথক হিসেবে বিবেচনা করে। সারোগ্যাসিতে বীর্য নয়, বরং জাইগোট প্রতিস্থাপন করা হয়।
একটি সারোগ্যাট বাচ্চার পরিবার, পরিচিতি ও জাতীয়তা নির্ণয়ের সংকট বিষয়টিকে একবিংশ শতাব্দীর একটি আইনি ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাড় করিয়েছে।
এই সংকট আরও তীব্রতা ধারণ করার আগে এব্যাপারে চিন্তাগত ও দার্শনিক প্রস্তুতি থাকা একটি আধুনিক সমাজের জন্য জরুরী। কারণ মূর্খতা নয়, চিন্তার বিকল্প হচ্ছে অধিকতর উন্নত চিন্তা। আর উন্নত চিন্তার ভীত তৈরি হয় প্রাথমিক প্রস্তুতিমূলক চিন্তা দিয়ে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।