আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিত্যদিনের প্যাঁচাল !

দিনটার শুরুই ছিল বিশ্রী ! অফিসে যাচ্ছিলেন কবির সাহেব । ঘরের বাইরে পা বাড়াতেই তার ছয় বছর বয়সী ছোট ছেলেটি চিৎকার করে ছুটে এলো , " আব্বু ! ইইইঁদুর ! " আঁৎকে উঠলেন তিনি । খয়েরী কার্পেটটার ওপর বিশাল এক ধেড়ে ইঁদুর মরে পড়ে আছে । চিম্‌সে একটা বাজে গন্ধ বাড়ি খেল তার নাকে। সামান্যর জন্য বেঁচে গেছেন ।

নইলে এইমাত্র পাড়া দিয়ে ওটার মগজ বার করে দিতেন । ভাবতেই ঘিন্নায় গা রি-রি করে উঠল । মুখে সীমাহীন বিরক্তির ভাব প্রকাশ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন , " যত্তসব ! " বাড়ির প্রত্যেকেই কাণ্ডটা দেখতে ছুটে এসেছিল দরজার কাছে । সবচেয়ে খুশি হল বাচ্চারা । মস্ত বড় এক মড়া ইঁদুর দেখার জন্য উৎসাহের কমতি নেই তাদের ।

এতে যেন গা আরো জ্বলে গেল তার । ধমকে উঠলেন , " যাও ! ভেতরে যাও ! " রাম ধমকটা খেয়েও তাদের উৎসাহে ভাটা পড়ল না । রীতিমত আলোচনা সভা বসিয়ে দিল তারা । কোথায় ওটা পড়ে ছিল - লেজটা কেমন ছিল - দাঁত দুটো কেমন - নখ ছিল কি ? - লোমগুলো খাড়া খাড়া - ইঁদুর দেখে বাবা কি করেছিলো ... ইত্যাদি । কি বেয়াদব ! বিরক্ত হয়ে ভাবলেন তিনি ! বাচ্চাগুলোর কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নাই ! যে সব ঘটনায় ভয়ে তার নিজেরই শরীরের অর্ধেক লোম পেকে যায় , সে সব ঘটনাই যেন এদের বিনোদনের বিষয় ! সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে সবাই গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল ।

বড় বড় আম গাছ দেখতেই বাঁদর দুটো বায়না ধরে বসল , " আব্বু ! গাছে চড়ব ! " চমকে উঠলেন তিনি । এ কি কথা ! পড়ে গেলে যে হাত-পা ভেঙে যাবে ! খুঁত হয়ে যাবে শরীরে ! সহ্য করতে না পেরে দুজনেরই কান ধরে আচ্ছা মত মুচড়ে দিয়েছিলেন সেদিন ! এদের সাথে পেরে ওঠা যায় না । কোনো কিছুতেই এরা ভয় পায় না ! আজকাল তো প্রায়ই ছোট-খাট ধরণের ভুমিকম্প হয় । শীঘ্রই বড় রকমের পরিবর্তন আসছে । কেঁপে ওঠেন কবির সাহেব ।

ভবিষ্যতের চিন্তায় মনের অজান্তেই বুকের বাম দিকে হার্টের ওপর হাত চলে যায় তার । আর বাচ্চাগুলোর যেন কোনো বুদ্ধি-সুদ্ধি নাই । ভুমিকম্পের সময়ও তাদের চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক দেখা যায় । মুখে প্রকাশ না করলেও , সবই বোঝেন তিনি ! বড় মেয়েটা যেদিন ডাক্তারের পরামর্শে চশমা নিয়েছিল , দুশ্চিন্তায় সেদিন ঘুম হয়নি তার । খুঁত হয়ে গেল বেচারার ! বিয়ের বাজারে পিছিয়ে পরবে যে ! কিন্তু পরে লক্ষ করে দেখলেন , মেয়ের সেদিকে খেয়াল নেই মোটে ।

চশমা পেয়ে বরং সে খুবই খুশি । একটু পর পরই আয়নার সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করছে । সহ্য হল না তার , " খুলে ফেল্‌ ! এখন থেকে চশমা ছাড়াই দেখার চেষ্টা করবি ! মেডিটেশন করে চোখ ঠিক করতে পারিস না ? " কবির সাহেব ব্যাবসা করেন । আর পাঁচটা ব্যাবসায়ীর মত তার জীবনও সাত সকালে উঠে ঢুলুঢুলু চোখে বাথরুমে যাওয়া , অফিস করা আর বাসায় ফেরা না । বরং জীবনে বৈচিত্র্য আছে তার ।

বেলা করে ঘুম থেকে ওঠেন । এরপর ধীরে ধীরে অফিসে যান । কোনো কোনো দিন ইচ্ছে না হলে যান না । শুধু বিকেল বেলা একবার ঢুঁ মেরে আসেন । আজকে সকাল থেকেই মেজাজ ভাল না তার ।

খাবার টেবিলে বসতেই স্ত্রীর নিত্যদিনের সংসার চালানোর অভিযোগগুলো হজম করতে হয়েছে । চাল নেই , স্কুলের বেতন বাকি , ডিশের বিল বাকি !!! কথাগুলো শুনতে শুনতে যখন কানে পচন ধরে গিয়েছিল , আপন মনে তিনিও কিছুক্ষণের জন্য ভেবেছিলেন - তার নিজেরই বা মৃত্যুর কয় দিন বাকি ! চুপ করে থাকতে দেখে আরো খেপেছিল গৃহিণী , " আমার কাছে এলে তুমি একেবারে বোবা হয়ে যাও । অন্য কোন মেয়ে দেখলে তো মুখে কথার খই ফোটে । " " উহ্‌ ! ঘরের মধ্যেও এত যন্ত্রণা আমার ভালো লাগে না । " রাগ করে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ই ঘটে বিশ্রী ঘটনাটা ।

পরিবারের জন্য তিনি কম খাটেন না । বিভিন্ন গার্মেন্টস-এর সাথে যোগাযোগ ও মেশিন কেনা বেচার কাজটা মোটেও সহজ নয় । অফিস থেকে ফেরার সময় তিনি অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে যান । হলুদ ঘামের চোটে সাদা শার্টের বগলের নিচে কমলাটে আস্তরণ পড়ে যায় । গা থেকে মেশিনের ধুলো - ঝুলের বিশ্রী গন্ধ ভুর ভুর করে বের হয়ে মিশে যায় সি.এফ.সি. ভরা বাতাসে ।

নিজেকে লেবার মনে হয় তখন । শ্রমিক আর তার মাঝে পার্থক্যই বা কতটুকু ! অফিসে বসে আছেন কবির সাহেব । সিদ্ধান্ত নিয়েছেন , দুপুরবেলা বাড়িতে খাবেন না । আর সবার মত তিনিও হোটেল থেকে খাবার কিনে আনাবেন অফিসের বয়কে দিয়ে । পেট খারাপ হলে হোক ! - আসসালামু আলাইকুম ।

-আসেন বাবু ভাই । কি খবর ? অনেকদিন পর যে ! মন মেজাজ একেবারে ভাল না । তবুও মুখটা হাসি-হাসি রাখার চেষ্টা করেন তিনি । -ঢাকায় ছিলাম না । একটা নতুন প্রজেক্টের কাজে কুমিল্লায় গিয়েছিলাম ।

শুরু হল প্যাঁচাল ! বেশিরভাগ কথাই অনর্থক । না চাইলেও শুনতে হবে । ঝিমোতে থাকেন কবির সাহেব । এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন । প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করে আনলেন ।

পঞ্চাশ টাকার একটি ময়লা নোট ছাড়া কিছুই নেই তাতে । দুপুরের কড়া রোদ জানান দিয়ে গেল - সময় নেই ! গ্ল্যামার গার্মেন্টস থেকে বিকেল চারটার মধ্যে ওভার লক মেশিন দুটো আনাতে হবে । মালিবাগ থেকে গুলিস্তানের পথে হাঁটা ধরলেন তিনি । ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল । স্কুল পালিয়ে প্রায়ই চলে যেতেন নদীর ধারে ।

ওখানে একটা ছোট ব্রিজ ছিল । গাঁয়ের লোকেরা নদী বললেও আসলে ওটা ছিল বড় নদীটার শাখা নদী । আকারে ছিল বেশ ছোট এবং অগভীর । যদিও সে সময় তার কাছে এই অগভীর শাখা নদীটাই ছিল সুবিশাল সমুদ্রের সমান । জোরে বাতাস এলে তার স্রোতও বেড়ে যেত ।

আর অমনি সে ঝাঁপিয়ে পড়ত জলে ! এভাবে একবার দুপুর রোদে সারা বেলা ডুব দিয়ে দিয়ে টাইফয়েড বাঁধিয়ে ফেলেছিল । নানি সেদিন কি যে বকা দিয়েছিলেন । খুব ছোটকালে তাকে বিধবা নানির কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । প্রায় সারা বছরই মা গর্ভবতী থাকতেন । শিক্ষিতা হলেও কিছুই বলার ছিল না তার ।

স্বামীর বক্তব্য হল , আল্লা তাকে বংশধর দিচ্ছেন । এ যে আশীর্বাদ ! এতগুলো ছেলেমেয়েকে তিনি কোনো সময়ই দিতে পারতেন না । ঈশ্বরের আশীর্বাদরা তাই কাদা-জলে ঘুরে ফিরে বার মাসই পেটের অসুখ বাঁধিয়ে রাখত । অফিসের কয়েকজন ব্যাবসায়ি দুপুরের এই সময়টা ক্লাবেই তাস খেলে কাটায় । সোজা বাংলায় যাকে বলে " জুয়া " ! কবির সাহেব খেলেন না ।

কখনো তাদের সাথে ক্লাবেও যাননি । অন্য কোনো দিন হলে তিনি এখন বাড়ীতে গিয়ে বিশাল একটা ঘুম দিতেন । আজকে এক প্রকার জেদ ধরেই তিনি বাসায় যাবেন না । " চলেন কবির ভাই ! আমরা খেলব , আপনি শুধু দেখবেন । " মুস্তাফিজ সাহেব ঘাড়ে মৃদু টোকা দিয়ে বললেন ।

গত কয়েকদিন ধরেই তাকে ক্লাবে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তারা । কবির সাহেব ক্লান্ত চোখে তাকালেন । ইচ্ছে করলেই তিনি দুই- এক পেগ মেরে দিতে পারেন না ! মুস্তাফিজ সাহেব তার পার্টনার । এদের কেউ দুপুরে বাসায় খায় না । ক্লাবে ফুর্তি করে কাটায় ।

রাত করে বাড়ি ফেরে । আর স্ত্রী থাকতেও মোবাইল ফোনে প্রায় মেয়ের বয়সী কিশোরীদের সাথে গভীর রাতে কথা বলে । কিন্তু ফুর্তি করলে কি হবে ? ছেলেমেয়েদের সাথে তাদের সম্পর্ক মধুর । প্রতিদিনই বাচ্চাদেরকে একশ টাকা করে পকেটমানি দেয় । সাধ করে ছোট্ট মেয়ের নরম কচি হাতটা ধরে দোকানে নিয়ে যায় ।

আহ্লাদ করে জিজ্ঞাসা করে , " আব্বু ? কি নেবে ? " আর কবির সাহেবের স্বভাবখানা এদের ঠিক উল্টো ! নিজের বাচ্চাদের দেখলেই তাদের দোষ- ত্রুটি ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না তার । এ যেন কড়া শাসন দিয়ে তাদের চুপ করিয়ে রাখা । নিজেকে লুকানোর চেষ্টা ! কারণ বাচ্চাদের সামান্য কিছু আবদারও পূরণ করার মত সামর্থ্য নেই তার। বুকের ভেতর থেকে কেবলমাত্র একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে । দশটার আগেই কবির সাহেব বাড়ি ফিরলেন ।

নিজের গায়ের ঘামের গন্ধেই বমি উগলে এলো তার । হাত-মুখ ধুয়ে নিলেন । গোসল করতে পারলে ভাল হত ! সেই সকাল থেকে স্ত্রী মান করে বসে আছে । কিচ্ছু মুখে দেয়নি । বাড়ি ফিরতেই যত রাজ্যের অভিযোগ পেশ করল ।

ঘরে বাজার নেই , বাড়িআলা ভাড়া চাইতে এসেছিল , টেলিফোন বিল না দিলে লাইন কেটে দেবে ! খাওয়ার পর প্লেটগুলো থেকে উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলে দিতে দিতে বলল , " আচ্ছা , তোমার পার্টনাররা তো সব ভাল অবস্থানে আছে । বউদের ঠিকমত টাকা দেয় । তোমারই কেন কোন আয় ইনকাম নাই ?" হ্যাঁ , সত্যি তাই । তারা বাস্তবেই বউদেরকে সময় মত খরচ দেয় । ঘরের বাজার-সদাই করে ।

বাচ্চাদেরকে স্কুলে নিয়ে যায় । অন্য মহিলাদের সাথে অশালীন কৌতুক করে । আর রাতেরবেলা খোলা বারান্দায় বসে উঠতি বয়সী মেয়েদের সাথে মিষ্টি আলাপ করে । বলাই বাহুল্য , স্ত্রীরা ব্যাপারটিকে ওভাবে দেখে না । তারাই বরং কথা বলার সুযোগ করে দেয় ।

কারণ তাদের স্বামী যে বায়ারের সাথে জরুরি কথা বলছেন ! এঁরা বড় বড় ইন্‌ডাসট্রিয়ালিস্ট ! বিদেশ থেকে ফোন দেন । এত রাতে ফোন না দিলে কি এদেশের সময়ের সাথে তাল মেলানো সম্ভব ? নরম বিছানায় ছোট বাচ্চাটিকে কোলে টেনে নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমায় তারা ! স্ত্রীর কথাগুলো কবির সাহেবকে ভীষণভাবে পীড়া দিতে থাকে । রাগে দুই কান গরম হয়ে যায় তার । ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে চলে আসেন শোবার ঘরে । বড় মেয়েটা ফোনে কথা বলছে ।

এই একটি মাত্র বান্ধবী তার । কথা বলার সময় তাই স্থান-কালের জ্ঞান থাকে না ! প্রতিটি কথার মাঝেই কলকল করে হেসে উঠে সে । টাইম - স্পেসের ধারণাটা যে কতটা আপেক্ষিক - এ যেন তার প্রকৃত উদাহরণ ! কবির সাহেব ব্যাপারটা খুবই অপছন্দ করেন । টেলিফোনের কথাগুলো হল ইলেকট্রনের প্রবাহ ! একটানা কথা বললে শেষে চোখের সাথে কানটাও হারাবে মেয়েটা । আর বিয়ের সময় ভোগান্তি হবে তার নিজের ! স্ত্রীর সাথে তর্কের পর থেকেই মাথাটা সীমাহীন গরম ! হঠাৎ ছুটে এসে কেড়ে নিলেন ফোনটা ।

আছড়ে ফেলে দিলেন মেঝেতে । হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল বাড়ির সবাই । দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে হাতুড়িটা নিয়ে এলেন । এরপর জোরে জোরে বাড়ি দিতে থাকলেন মেঝেতে পড়ে থাকা ফোনে । ঘুম নেই চোখে ।

পাশেই স্ত্রী শুয়ে আছে । গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কবির সাহেব তাকিয়ে আছেন সিলিং-এ । জানালার পাশের আম গাছটায় বসে এক নিঃসঙ্গ দোয়েল শিস্‌ দিয়ে যাচ্ছে অনবরত । জানান দিচ্ছে , এ সংসারে সে-ও সঙ্গিহীন ! পাখিটার সুরে মিষ্টতা কোথায় ? কানে তালা লেগে গেল যেন ! কবির সাহেব দু হাতে কান চেপে ধরলেন ।

তার স্ত্রী আছে , বাচ্চা আছে , একটা গোছান সংসার আছে । কিন্তু তবু মনে হয় , একই ছাদের নিচে শুয়েও তারা দুজন দুপ্রান্তের মানুষ ! পৃথিবীতে বড় নিঃসঙ্গ সে । বালিশে মুখ গুজে শিশুদের মত ডুকরে কেঁদে উঠলেন মধ্যবয়সী লোকটি । হাহাকার করে উঠল বুক । চোখ বুজে দেখতে পেলেন ছেলেবেলার সেই ব্রিজটা ।

হাফ প্যান্ট পড়ে এরই এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি । জোরে বাতাস এলেই লাফ দিলেন নদীতে । চোখ দুটো টকটকে লাল । বহুদূর থেকে মায়ের ব্যাকুল সুর ভেসে এলো কানে , " ও মুনি ! নদীতে আর ডুবস নে ! অসুক করবে ! " ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.