আলোকিত মানুষ চাই নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে তোলপাড় হলেও রেলওয়ের নিয়োগ-প্রক্রিয়া এখনো বন্ধ করা হয়নি। যাঁর নেতৃত্বে এই অবৈধ বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তিনি রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম)তের কমান্ড্যান্ট এনামুল হক। টাকা কেলেঙ্কারির পর এখনো দুজনই স্বপদে বহাল রয়েছেন।
বিজিবির গেটে টাকাসহ ধরা পড়ার চার দিন পার হলো। অথচ কোনো মামলা, থানায় অভিযোগ দায়ের কিংবা কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করা হয়নি।
তাঁরা ৯ এপ্রিল মধ্যরাতে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায় যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস)। তবে এই তিনজন ও গাড়িচালক টাকার অঙ্ক সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, ৩০ লাখ, কেউ ৭০ লাখ, আবার কেউ বলেছেন তারও বেশি। এখন পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হচ্ছে।
এদিকে রেলের শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে জিএমের অপসারণের দাবি করেছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এই নিয়োগ-বাণিজ্য সম্পর্কে রেলমন্ত্রীকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল। এরপর ৪ এপ্রিল রেলের মহাপরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রেলওয়ে শ্রমিক লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রেলের সবাই মৃধাসহ নিয়োগ-বাণিজ্যের হোতাদের অপসারণ চায়।
মৃধাসহ অন্যরা প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঘুষ নিয়ে বাণিজ্য করছেন। তদন্ত করে সবাইকে শাস্তি দিতে হবে। পদে বহাল রেখে তদন্তে খুব একটা সাফল্য আসবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেল বিভাগের সচিব ফজলে কবির কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ইউসুফ আলী মৃধা মহাপরিচালকের পরই রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চল নিয়ে গঠিত রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রধান তিনি। জিএম পদাধিকারবলে নিয়োগ এবং দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির চেয়ারম্যান। এই পদে বসার আগে তিনি পূর্বাঞ্চলের দ্বিতীয় ঊর্ধ্বতন প্রধান প্রকৌশলীর পদে ছিলেন। আর এনামুল হক নিরাপত্তা বাহিনীর ঢাকা বিভাগীয় প্রধান। তাঁর বিরুদ্ধে রেলে ৩৩৭ জন প্রহরী নিয়োগে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
তদন্ত কমিটি তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত কতটা ফলপ্রসূ হবে, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রেলের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
এদিকে গত শুক্রবার রেলমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, নিয়োগ-বাণিজ্য তদন্তে নিরপেক্ষ কমিটি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি করা হয়নি। রেলমন্ত্রীর এপিএস ও রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএমের বিরুদ্ধে যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, তাতে নিয়োগ-বাণিজ্যের কথা উল্লেখ নেই।
সংসদীয় কমিটি তদন্ত কমিটি করেছে দরপত্র-প্রক্রিয়া তদন্তের জন্য।
জানতে চাইলে ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হকের বিরুদ্ধে করা তদন্ত কমিটির সদস্য ও রেল মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শশী কুমার সিংহ প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে তাঁরা তদন্ত করছেন না। মধ্যরাতের টাকা কেলেঙ্কারির তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে কমিটিকে।
রেলমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার রেলভবনে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, মৃধার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার তাঁর নেই। এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে।
কিন্তু রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, মৃধার শাস্তি যা-ই হোক, তাঁকে ওই পদ থেকে এখনই না সরালে নিয়োগ-বাণিজ্য ও দরপত্র-প্রক্রিয়ার কুকীর্তির অনেক প্রমাণ সরিয়ে ফেলবেন তিনি। আর এনামুলকে সরানোর জন্য জিএম বা রেলের মহাপরিচালকই যথেষ্ট।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, মৃধা ও এনামুল মুখ খুললে মন্ত্রী বেকায়দায় পড়তে পারেন, এই ভয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। টাকাসহ এপিএস ও জিএম ধরা পড়ার পর রেলের কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়োগ-প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য রেলমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা শোনেননি।
রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, যাঁরা চাকরির জন্য টাকা দিয়েছেন, নিয়োগ-প্রক্রিয়া বন্ধ হলে তাঁরা রেলভবনে এসে অপ্রীতিকর কিছু ঘটাতে পারেন।
এই আশঙ্কা বড়কর্তাদের মধ্যে রয়েছে।
রেলমন্ত্রীর দপ্তরের একজন অফিস সহকারী বলেন, ‘ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস পদের সাত-আটজন চাকরিপ্রার্থী গত মাসে খামে ভরে ফারুক তালুকদারকে টাকা দিয়েছেন। তাঁদের একজন আমাকেও ২০০ টাকা বকশিশ দেয়। ’
নিয়োগ: রেলে সাত হাজার ১৪০ পদের নিয়োগ-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবারও ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস পদের ৪০০ নিয়োগপত্র বিলি করা হয়। ট্রলিম্যানের ১৪৩ পদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে।
গত মার্চে নিয়োগপত্র দেওয়া হয় সহকারী ক্যামিস্ট ও ট্রেন নাম্বার চেকার পদে।
নথিপত্র থেকে জানা গেছে, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ২০১০ সালের জুলাইয়ে রেলের ৬৮টি ক্যাটাগরিতে সাত হাজার ২৭৫ জন নিয়োগের অনুমোদন দেয়। তবে সরাসরি নিয়োগযোগ্য না হওয়া লস্কর, পোর্টার ও ওয়েল্ডার পদে ১৩৫ পদের নিয়োগ স্থগিত রাখা হয়।
সূত্র জানায়, তিন ক্যাটাগরি বাদ দিয়ে সাত হাজার ১৪০টি পদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশনা দিয়েছিল সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন করতে পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়।
কিন্তু এই নির্দেশনা না মেনে আবারও সময় বৃদ্ধির আবেদন করে রেল কর্তৃপক্ষ। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় রেলের আবেদন গ্রহণ না করে কারণ দর্শানোর জন্য চিঠি দিয়েছে। এর পরও পেছনের তারিখে নিয়োগপত্র বিলি করা হচ্ছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।