সত্য প্রকাশে নির্ভিক ও সবচেয়ে এগিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের এতোগুলো যুগ পার হয়ে যাবার পর এখন সময় এসেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করার। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তাদের সময় হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দেখিয়ে যাওয়া পথে হাঁটা। কিন্তু তাতো দূরের কথা সময়ের পরিবর্তনের সাথে সবকিছুই বদলিয়ে গেছে। যখন মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করার কথা তখন কিনা সচেতন নাগরিকদের মুক্তিযোদ্ধাদের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। এমনই ঘটনা ঘটেছে মেরুল বাড্ডায়।
একজন মুক্তিযোদ্ধার মাথা গোজার ঠাঁই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
মেরুল বাড্ডায় প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি অচেনা সন্ত্রাসীদের দিয়ে দখলের পর সেখানে নির্মিত হচ্ছে ভবন। এ ভবন কারা নির্মাণ করছে সরেজমিন পরিদর্শনে তাদের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। এমনকি নির্মাণ কাজের দায়িত্বে থাকা কেউই ভবন মালিকের পরিচয় জানেন না বলে জানান। নাসের ঠিকাদার নামে এক ব্যক্তি মাঝে মধ্যে এসে টাকা দিয়ে যান বলে জানান নির্মাণ শ্রমিকরা।
তবে তিনি সেখানে অবস্থান করেন না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাড্ডা কল্যাণ সমিতি নামে একটি সমিতির প্রধান রাজউকের সাবেক অথরাইজড অফিসার হারুন উর রশীদ এ ভবন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত। রাজউকের এস্টেট শাখার এক মহিলা কর্মচারীও এর আগে এ ভবন নির্মাণের খোঁজখবর নিয়ে গেছেন। নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, তাদের ভবনের মালিক একজন মহিলা বলে ঠিকাদার জানিয়েছেন। অবশ্য বাড্ডা কল্যাণ সমিতির নেতা হারুন উর রশীদ এই প্রতিবেদককেকে বলেন, তিনি এ ভবন নির্মাণের বিষয়ে কিছু জানেন না।
তবে এখন যেখানে রহস্যময় বাড়িটি নির্মাণ হচ্ছে তার পাশে অন্য কোনো প্লট প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা নিতে চাইলে তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন। এ ব্যাপারে রাজউক চেয়ারম্যান ও প্রকৌশলী সর্বোচ্চ সংগঠন আইইবি’র সভাপতি প্রকৌশলী নুরুল হুদা এই প্রতিবেদককেকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা রাজউকে আবেদন করলে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। কোনো অনিয়ম থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নথিপত্র অনুসন্ধানে দেখা যায়, আলোচ্য ভবন নির্মাণাধীন এলাকার জমি ঢাকা মহানগর জরিপে দাগ নং-১৪৬৭৪ ও খতিয়ান নং-১৪৭৮২। আরএস জরিপে দাগ নং-২৮৪৬ এবং খতিয়ান নং-১৫৭৭।
সিএস জরিপ অনুযায়ী দাগ নং-১২০৫ এবং খতিয়ান নং-৪৩৯। প্রতিটি জরিপেই এ জমির মালিক হিসেবে আক্তারুজ্জামানের নাম রয়েছে। আক্তারুজ্জামান এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামান হিসেবে পরিচিত। তিনি সরকারি কর্মকর্তাও ছিলেন। নথিপত্রে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালে বাড্ডা এলাকায় রাজউকের গুলশান-বারিধারা প্রকল্পের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
এ সময় আক্তারুজ্জামানের জায়গাটিও বিজ্ঞাপিত জায়গার মধ্যে পড়লে তিনি নালিশি জায়গায় প্লট বরাদ্দ দেওয়ার জন্য রাজউকের বিধি অনুযায়ী ব্যাংকে ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে আবেদন করেন। পরে রাজউকের নথিতে আক্তারুজ্জমানের জায়গা ১৯৮৯ সালেই যে কোনো সরকারি হুকুমদখলের বাইরে রাখার নির্দেশ সংবলিত কাগজপত্র পাওয়া যায়। এ নির্দেশ অনুযায়ী ১৯৯৯-২০০০ সালে সম্পন্ন হওয়া মহানগর জরিপে ওই জায়গা আবারও আক্তারুজ্জামানের নামে রেকর্ড করে মালিকানা এবং সে অনুযায়ী মাঠ পর্চা দেওয়া হয়। আক্তারুজ্জামান এ জায়গায় টিনশেড ঘর তুলে ভাড়া দেন। এর প্রায় ১০ বছর পর ২০০৯ সালের ১৭ নভেম্বর হঠাৎ করেই একদল অচেনা সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা চালায়।
তারা টিনশেড বাড়ি গুঁড়িয়ে এবং ভাড়াটিয়াদের মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। ভেঙে দেওয়ার পরদিন থেকেই একদল নির্মাণ শ্রমিক ওই জমিতে ভবনের ভিত নির্মাণ শুরু করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামান বাড্ডা থানায় একটি অভিযোগ করেন। বাড্ডা থানা পুলিশ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার কিংবা তাদের পরিচয় উদ্ঘাটন করতে না পারলেও ওই জমিতে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। একই সময় হাইকোর্টে একটি রিট হলে হাইকোর্টও ওই এলাকায় সব ধরনের নির্মাণ কাজে স্থগিতাদেশ দেন।
২০১০ সালের ৩১ জানুয়ারি আক্তারুজ্জামান মৃত্যুবরণ করেন। এর কিছুদিন পর আবারও ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করে দখলদাররা। সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, ভবনটির চারতলা পর্যন্ত নির্মাণ শেষে পাঁচতলার কাজ চলছে। এক নির্মাণ শ্রমিক বলেন, এ ভবনের মালিককে তারা চেনেন না। মাঝে মধ্যে সন্ধ্যার দিকে নাসের কন্ট্রাক্টর নামে এক ব্যক্তি এসে তাদের টাকা দিয়ে যান।
এমনকি এ ভবন নির্মাণে কোনো সুপারভাইজারও নেই। নাসের কন্ট্রাক্টরই তাদের কাজে লাগিয়েছেন বলে জানান। রাজধানীর কোন এলাকায় তার বাড়ি, তাও জানেন না তিনি। একাধিক এলাকাবাসী জানান, নাসের কন্ট্রাক্টরকে তারা কেউ দেখেননি। তবে তার নাম শুনেছেন।
এলাকার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, মেরুল বাড্ডা এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দ দেওয়াসহ এলাকার জমি কেনাবেচা তদারক করেন বাড্ডা কল্যাণ সমিতির হারুন উর রশীদ সাহেব। তার জানার বাইরে এখানে কোনো জমি বেচাকেনা ও বাড়ি তৈরি হয় না। বাড্ডা এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্লটও কল্যাণ সমিতির তালিকা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং পরে তারাই আবার এগুলো বিক্রি করেন। এখনও বিক্রির কাজ চলছে। সুরাইয়া নামে একজন দু'একবার এসে ভবনের নির্মাণ কাজ কেমন চলছে এবং কেউ বাধা দিচ্ছে কি-না তার খোঁজখবর নিয়ে যান।
রাজউকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হারুন উর রশীদ কয়েক বছর আগে রাজউকের অথরাইজড অফিসার ছিলেন। অবসরে যাওয়ার পর থেকে বাড্ডায় থাকেন তিনি। তিনি সেখানে একটি কল্যাণ সমিতি পরিচালনা করেন এবং রাজউকের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের একটি বড় অংশকে ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট পাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সহায়তা করেন। এ কারণে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে তার একটি বড় অনুগত অংশ রয়েছে। সূত্র জানায়, আক্তারুজ্জামানের জায়গাটি রাজউকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হুকুমদখলের বাইরে থাকলেও রাজউকের একটি দুর্নীতিপরায়ণ অংশ ২০০৬ সালে গোপনে এ জমিতে ক্ষতিগ্রস্ত পুনর্বাসন প্রকল্পের ১১নং প্লট দেখিয়ে জনৈক তমিজউদ্দিনের নামে বরাদ্দ দেয়।
তবে এ তমিজউদ্দিনের বিস্তারিত পরিচয় প্লট বরাদ্দের কাগজপত্রে উল্লেখ নেই। শুধু 'তমিজউদ্দিন, মেরুল বাড্ডা' উল্লেখ আছে। এ তমিজউদ্দিনকে কখনও রাজউকে দেখা যায়নি। তার পক্ষে এস্টেট বিভাগের এক নারী উচ্চমান সহকারী কাগজপত্র আদান-প্রদান করেন। এ নারী কর্মচারী বনানীতে থাকেন।
বর্তমানে ১১নং প্লট এবং অদৃশ্য তমিজউদ্দিনকে মালিক দেখিয়েই এ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এমন কি “নো অবযেকশন” লেটার অনুযায়ীও এই ভূমি অধিগ্রহন করতে পারার কথা না।
এ ব্যাপারে আলাপ করলে রাজউক শ্রমিক লীগের সভাপতি শামসুল আলম মিল্কী এই প্রতিবেদককেকে বলেন, বাড্ডায় হারুন উর রশীদ নামে স্থানীয় কল্যাণ সমিতির এক নেতার কথা তিনি জানেন। তিনি রাজউকের সাবেক অথরাইজড অফিসার ছিলেন, এটাও সত্য। তবে বর্তমানে তার সঙ্গে রাজউক কর্মচারীদের কোনো সম্পর্ক বা যোগাযোগ নেই বলে তিনি জানান।
বাড্ডা কল্যাণ সমিতির নেতা হারুন উর রশীদ এই প্রতিবেদককেকে বলেন, এ ভবনের মালিককে তিনি চেনেন না। ভবন নির্মাণ সম্পর্কেও কিছু জানেন না। তবে তিনি জাগয়াটি একসময় মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামানের ছিল বলে স্বীকার করেন এবং তার পরিবারের সদস্যরা এর আশপাশে প্লট নিতে চাইলে সহায়তা করবেন বলে জানান।
এখন সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে তাহলেকি রাজউকের কোন কর্মকর্তাই এই জঘন্য কাজের সাথে জড়িত? না একদম উচ্চ পদস্থ কোন কর্মকর্তা পরোক্ষভাবে এ কাজ করাচ্ছেন? তাহলে কি রাজউ্কের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক গণ এ কাজ সম্পর্কে জ্ঞাত ! বিশেষ ক্ষমতা বলে তারা এমন কাজ করছেন? একজন মুক্তিযোদ্ধা, যাদের জন্য আমরা আজ বাংলায় কথা বলছি তাঁর কি এ পরিনতি হওয়া কাম্য ছিল? তাহলে দেশের সাধারণ জনগনের কি অবস্থা? ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর ছাড়া করেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের আমরা রাজাকার বলি, তাদের ফাঁসি দাবি করি, বিচারের জন্য বিশেষ আন্তর্জাতিক আদালত করি। আর এই যুগে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর ছাড়া করেছে তাদের আমরা কি বলব? তাদের কি শাস্তি দাবি করা উচিত, তাদের বিচার হবে কোন আদালতে এটাই সবার প্রশ্ন?
ঘর ছাড়া হতে হলো মুক্তিযোদ্ধাকে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।