সাধারণ একজন লেখালেখি ও ‘ব্যালেন্স’ প্রসঙ্গ
তারিক আল আজিজ
বেশ ক’দিন আগে লিখেছিলাম। আজ আবার লিখতে বসলাম। চিন্তাটা মাথায় ঘুরছে অনেক দিন ধরে। চিন্তাটাকে জমাট হতে সময় দিচ্ছিলাম। আমার একটা লেখা নিয়ে কয়েকটা মেইল বার্তা পেলাম।
এর মাঝে একটা মেইল বার্তা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভাবলাম আমার চিন্তা ঝেড়ে ফেলার সময় এসেছে।
‘মহাসমাবেশ শেষের গল্প’। এটা লিখেছিলাম বিএনপির মহাসমাবেশের দিন শেষের রাতে। পরদিন এক পাঠক বার্তা২৪.নেটে লেখাটা পড়ে আমাকে মেইল করেন।
আরামবাগ থেকে জসিম। তিনি লিখেন- ‘ভাই আপনার বর্ণনা ভালো লেগেছে, তবে শেষের দিকে পড়ে মনে হলো আপনি একটা ব্যালেন্স করলেন’।
এখানে একটু ওই লেখার প্রসঙ্গে বলা দরকার। আমি যেভাবে লিখেছি তাতে লেখার অনেকটা অংশ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের বিপক্ষে গেছে। লেখার শেষ অংশে ছিলো-‘ 'গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পরদিন সকাল।
আমি বাড়িতে। দিনাজপুরে। খাইরুল ভাইয়ের সাথে দেখা। বললেন, আওয়ামী লীগ তো জিতে গেলো। এই হবে ঘুরেফিরে।
একবার বিএনপি একবার আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাটা হলো একটা ডোবা। সবাই সাদা কাপড় নিয়ে নামে। কালো হয়ে উঠে। যার কারণে আর ভোট পায় না।
ক্ষমতাটা কি সত্যিই ডোবা? এই ডোবায় নামতে সবাই এতো তৎপর কেন?'
আমি পাঠকের মেইলের উত্তর দিয়েছি। পাঠক শেষ অংশ নিয়ে ব্যালেন্সের প্রশ্ন তুলেছেন। অর্থাৎ আওয়ামীলীগের বিপক্ষে লিখতে লিখতে শেষ অংশে এসে আমি নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমানের চেষ্টা করেছি। মূলত আমি ব্যালেন্সের কোন চিন্তাই করিনি। যা লিখতে মনে চেয়েছে তাই লিখেছি।
এবারে লেখালেখিতে ব্যালেন্স বা লেখকের ব্যালেন্সকে আরো একটু বড় করে আলোচনায় আসছি। আমার এক বন্ধু শাহেদ। তিনি আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে বেশ লিখেন। ফেসবুকে অনলাইনে পেয়ে একদিন কথা হলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- শুধু আন্তর্জাতিক বিষয়ে লিখেন কেন?
শাহেদ আমাকে যে উত্তর দিলেন তাতে ব্যালেন্সের কথাই চলে এলো।
‘এক্সপার্ট’রা জাতীয় ইস্যু নিয়ে লিখতে নিষেধ করেছেন। জাতীয় ইস্যু নিয়ে লিখলে স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক বিষয় আসবে। সেই ক্ষেত্রে বিতর্কিত হবার সম্ভাবনা আছে। আগে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করার পরই তিনি জাতীয় বিষয় নিয়ে লিখবেন।
শাহেদ এভাবেই ব্যালেন্স মেনে চলছেন।
বাংলাদেশের একজন খ্যতিমান সাংবাদিকের কথা বলি। নাম বলবো না, তিনি বরেণ্য টেলিভিশন সাংবাদিক। টক শো’ সঞ্চালনাও করেন। তার সম্পর্কে আরেক সাংবাদিক ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম। বরেণ্য টিভি সাংবাদিক ছাত্রজীবনে ঘোর ছাত্রলীগ ছিলেন।
পরে নিজেকে নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা চালান। এখনো তিনি নিরপেক্ষ ইমেজ নিয়েই আছেন। এভাবেই তিনি ব্যালেন্স করছেন।
জীবনে ব্যালেন্স আবশ্যক। এটা সবাই জানেন।
‘ব্যালেন্সড লাইফ’ কথাটা জীবনে বহুবার শুনেছি। কখনো বাবা-মা, কখনো শিক্ষক, কখনো বড় ভাইয়েরা বলেছেন। এখনো শুনি। মাঝেমাঝেই মুরুব্বীরা বলেন- ‘শুধু এ কাজ করলে চলবে? সবকাজই করতে হবে’। আমার জীবনে ব্যালেন্সের কথা সবচেয়ে শুনেছি পড়া নিয়ে।
বাবা-মা প্রায়ই বলতেন- ‘শুধু গল্পের বই পড়লে তো চলবে না। আগে পাঠ্য বই ভালো করে পড়তে হবে’।
এখন ব্যালেন্সের বিষয়টা বেশি শুনি ছবি দেখা নিয়ে। অনেকেই এখন ছবি দেখা নিয়ে ব্যালেন্সের প্রসঙ্গ টানেন।
ছবি’র কথাই যখন উঠলো, তখন গ্রিফিথের কথা বলি।
ডি. ডব্লিউ গ্রিফিথ। চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে পরিচিত করতে যার অসামান্য অবদান রয়েছে। তার ছবি ‘বার্থ অব এ নেশন’ এর কথা অনেকেই জানেন। গ্রিফিথ প্রথম জীবনে অনেক বিখ্যাত ও ব্যবসা সফল ছবি উপহার দিয়েছেন। কিন্তু শেষ জীবনে তিনি ধুকে ধুকে মরেছেন।
বয়সকালে তার পেছনে প্রযোজকরা ধর্ণা দিতেন না। তিনি চলচ্চিত্র জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছিলেন। তার এই অবস্থার জন্য অনেকে সময়ের সাথে মানিয়ে না চলার কথা বলেছেন। অনেকে সৃষ্টিশীলতার সমাপ্তির কথা টেনেছেন।
এখানেও আসে ব্যালেন্সের কথা।
সৃষ্টিশীল মানুষকে সময়ের সাথে সাথে ‘আপডেট’ থাকতে হয়। নতুবা মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা আসলেই বেশি। আজকে অনেকের কাছে শুনি দেদারছে লিখছেন। অবাক হই যখন বলেন পড়ার সুযোগ বা সময় পান না। এ ধরণের লেখকরা কি একটা সময় মুখ থুবড়ে পড়বেন না?
প্রসঙ্গত মিনার মাহমুদের কথা বলা দরকার।
সাংবাদিকতার জগতের ‘মাসুদ রানা’। সেই মিনার মাহমুদ আত্মহত্যা করলেন। কেন করলেন? সময়কে বুঝতে না পারা বা সৃষ্টিশীলতার সমাপ্তি? তাই তো মনে হয়। লেখক-সাংবাদিকদের ব্যালেন্স যে বড় দরকার।
বাংলাদেশে নেতিবাচক ব্যালেন্সের চর্চা নিয়ে বলি।
আপনি বিএনপিপন্থী হলে কিছু পত্রিকায় আবার আওয়ামীপন্থী হলে অন্য কিছু পত্রিকায় লিখতে পারবেন। কাজেই উঠতি লেখকরা খুব সাবধানে পা ফেলেন। আমার পরিচিত অনেককেই দেখেছি। নিজেকে খুব আড়াল করে রাখেন। যেন রাজনীতি পরিচয়টা বেরিয়ে না আসে।
পত্রিকাগুলো যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জিম্মি তাতে এ সমস্যা খুবই প্রকট মনে হয়। মন খুলে লিখতে না পারার ক্ষোভ অনেকের থেকেই যায়। কিন্তু কিছু করার নেই। ব্যালেন্স করতে হবে। অনেকে ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকায় ভিন্ন ভাবে লিখেন।
‘হাউস পলিসি’ কথাটা থাকলেও ব্যালেন্স কথাটাই এখানে যুৎসইভাবে চলে আসে।
আপনি ব্লগে দেখুন। অনেকেই লিখছেন। অনেকের লেখায় দলবাজি প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। আবার কিছু ভিন্ন মতাবলম্বী ব্লগাররা অন্য মতের লেখা দেখলেই গালি দিয়ে বসেন।
কাজেই যারা লেখালেখিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন তাদের অনেকে একটু আড়ালের আশ্রয় নেন। একটু ব্যালেন্স করেন।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি, সুশীল সমাজের ব্যালেন্সের কথা সচেতন সবাই ভালোভাবেই উপলব্দি করেন। আওয়ামীলীগ-বিএনপি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেকের ব্যালেন্স দেখে আমি খুবই হাসি। জানি, অনেকেই হাসেন।
আমার কথা
আমি সামান্য মানুষ। অলসও বটে। লেখালেখিতে অলসতা আরো বেশি। এই লেখাটাও লিখব লিখব করে দেরী করে ফেললাম।
একটু দ্বিধা নিয়ে নিজের কথা বলছি।
অনেকে আমাকে বলেন- এই যে এত এত ছবি দেখো, পড়ো কিন্তু কিছু করছো না কেন? অর্থাৎ লেখালেখিতে আমি নিয়মিত নই কেন বা আমার কোন বই বেরোয় না কেন। অথবা ছবি বানাতে শুরু করি না কেন।
আমি চিন্তা করি। কখনো হাসি। কখনো মনে মনে কাঁদি।
জীবনকে আমি অনেক বড় ভাবি। আমাকে কিছু করতেই হবে- এই ইচ্ছা নাই। খ্যাতির মোহ’র চেয়ে আমার ভয় বেশি কাজ করে। বিখ্যাত হয়ে গণবিচ্ছিন্ন হতে চাই না।
হাঁ।
ব্যালেন্স আমিও মেনে চলি। নিজের সবকিছুই তো খুলে বলা যায় না। অনেক কিছুই গোপন রাখি। এটাও তো ব্যালেন্স।
লেখা শেষের সময়- রাত ১০টা ৫৫।
৩০.৩.১২।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।