আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লেখালেখি

মার্ক টোয়েন এর একটা উক্তি পড়লাম, লেখক হতে চাইলে প্রথম দুই বছর বিনে পয়সায় লিখো, এর পরও যদি কেউ তোমাকে লেখার জন্য পয়সা দিতে না চায় তবে বুঝে নিবে, তোমার বনে যেয়ে কাঠ কাটার পেশা বেছে নেয়া উচিৎ’। আমার লেখালেখির তো এখনও দুই বছর হয় নি। তাই আরও কিছুদিন লেখার অনুমুতি মার্ক টোয়েন সাহেব আমাকে দিয়েছেন। ভারতের প্রখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহকে একবার এক ইন্টারভিউতে প্রশ্ন করেছিল, আপনি বাণিজ্যিক ছবিতে কেন এলেন? উনি বললেন, ‘দেখুন আমি একটা কাজই পারি, তা হচ্ছে অভিনয় করা। এটাই আমার পেশা।

যে আমাকে অভিনয় করতে ডাকবে আমি যাব। আর সিনেমা দেখে কখনও সমাজ শুধরায় না। বড় জোর নায়কের মত করে চুল রাখে। ‘ পত্রিকার পাতা ওলটালে ‘স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’ সম্পর্কে যে সব লেখা পাওয়া যায় তাঁর শিরোনাম সাধারণত হয়, ‘অমুক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুরাবস্থা’। এরপর যথারীতি থাকে বেশ কিছু নালিশ।

দশজন ডাক্তারের পোস্ট থাকা সত্ত্বেও আছেন মাত্র ৪ জন, এই দিয়ে চলছে, রোগীরা ঔষধ পায় না, হাসপাতাল নোংরা, অ্যাম্বুলেন্স নষ্ট, এক্সরে মেশিন নস্ট ইত্যাদি। সাংবাদিক যদি অন্যান্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নাও যান, শুধু নাম পালটে দেন—তথ্যের খুব একটা হেরফের হবে না। যদি সেই সাংবাদিক আমার মত দুই বছরের জন্য লেখালেখিতে নিজের যোগ্যতা যাচাই করতে এসে থাকেন তবে আমার কিছু বলার নেই। আর যদি তা না হয়, যদি তিনি সত্যিই চান যে দেশের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার যে চিত্র তা সঠিক কারণ সহ জনগণকে জানাবেন তবে অবসর সময়ে আমার এই লেখাটা একটু পড়ে দেখতে পারেন। যেহেতু পত্রিকা পরে সমাজ পাল্টায় না, তাই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ও বিশেষ উন্নতির লক্ষণ দেখা যায় না।

রিপোর্টের পরে একটু দৌড় ঝাপ হয়তো হয়, সেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিছু ডাক্তার এর পোস্টিং হয়। কিছুদিন ঝাড়ু দেয়া হয়। এরপর আবার সেই পুরনো দৃশ্য। মাঝখান থেকে লাভ হয় কিছু কেরানীর। পুনরায় আগের স্থানে বদলী করিয়ে দেয়ার জন্য ডাক্তার সাহেবকে কিছু ‘মিষ্টি খাওয়ার’ পয়সার যোগান দিতে হয়।

স্বাস্থ্য খাতে এতো যে বরাদ্দ বাড়ানো হয় তাঁর এক বিশেষ অংশ যায় মেরামত, নতুন ক্রয়, নতুন স্থাপনা তৈরি এসবে। যা সাধারণত থাকে কাগজে কলমে। চুনকাম করার যে বাজেট ধরা হয় আর যে যাচ্ছেতাই ভাবে তা করা হয়,সেভাবে ঐ টাকায় পুরো জেলার সব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চুনকাম সম্ভব। যে আসবাব কেনা হয়, সেই টেবিল বা চেয়ার থেকে প্রতিদিন ই ঘুণপোকারা নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। সুইপারের পদে যারা আছে, তাঁরা যদি মদ খেয়ে পরে না থাকেন অথবা রুগী অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যস্তনা থাকেন এবং নেহাত যদি কপাল ভালো হয় এবং তিনি যদি কর্মচারীদের নেতা না হন তাহলে সকাল বিকাল বেলা ঝাড়ু দেয়ার ঘটনা ঘটতে পারে।

অ্যাম্বুলেন্স বা ‘এক্সরে মেশিন’ যেটি নস্ট হয়ে পড়ে আছে, সেটি ঠিক করাবার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কয়বার লেখা হয়েছে তা কখনও রিপোর্টে থাকে না। অনেক সময় নষ্ট করে রাখা হয়। কারণ আশে পাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর যেন আয় বাড়ে। কিন্তু সেই নষ্ট মেশিন ঠিক করানোর প্রক্রিয়া যে কি জটিল, সম্ভব হলে একবার রিপোর্ট করেন। কিছু কন্ট্রাকটারেরও উৎসাহ থাকে, মেশিন নস্ট হলে নতুন মেশিন কেনা হবে, নতুন টেন্ডার, কিছু অর্থের সংস্থান।

কখনও যদি পারেন হাসপাতালে পুরো ২৪ ঘন্টা থেকে কতজন রুগী আসে, তাঁর কতজনকে দেখা হল, তাঁদের কি জাতীয় সমস্যা এসব একবার নিজের চোখে দেখেন। জানতে পারবেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের অধিকাংশই সত্যিকারের রুগী না। বেশীর ভাগই আসেন বিনে পয়সায় ঔষধ নিতে। ঔষধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুগী ফেরত যাওয়া শুরু করে, ‘কালকে সকাল সকাল আসতে হবে’। কতদিন যে ‘আয়রন’ আর ‘ভিটামিন’ বড়ি দিয়ে চিকিৎসা করেছি নিজেই বলতে পারবো না।

এতেই রুগী সুস্থ, মানে কোন অসুখই তাঁর ছিল না, শুধু ওষুধ খাওয়ার সখ। কোথাও কি কখনও বলা হয়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলোতে ‘ইমারজেন্সী মেডিকেল অফিসারে’র কোন পোস্ট নেই। সবগুলো হয় ‘আউটডোর মেডিকেল অফিসারে’র পোস্ট, নয় ‘কনসাল্টেন্ট’। ৮.৩০ থেকে ২.৩০ পর্যন্ত। এরপর কোন রুগী এলে? কে দেখবে? ‘আবাসিক মেডিকেল অফিসারে’র পদ একটা, তাঁরও দেখার কথা শুধুমাত্র ভর্তি থাকা রুগী।

সমাধান হিসেবে অলিখিত যে নিয়ম চলে আসছে তা হচ্ছে ‘রোস্টার’। ইন্টার্ন থাকার সময় যেমন পুরো দিনকে তিন ভাগে ভাগ করে ডিউটি ভাগ করে নিতাম অনেকটা সেরকম। ফলে পুরো সপ্তাহে দাঁড়ায় ২১ টি ডিউটি। আউটডোর ডিউটি কে যদি একটি ডিউটি ধরি দিনের বাকী ষোল ঘন্টা কে আরও দুটি ডিউটি, একজন ডাক্তার এর ২৪ ঘন্টা ডিউটিতে থাকা কে ৩টা ডিউটি ধরে ‘রোস্টার’ করা হয়। প্রত্যেক ডাক্তারই সপ্তাহে কমপক্ষে ৬টি ডিউটি করেন, সপ্তাহে ৬ দিন অফিস করতে হলেও তাই করতে হত।

এই ব্যাপারটাকেই সবাই রিপোর্ট করেন, মাত্র দুইদিন থেকে ডাক্তার সাহেব চলে যান। ব্যতিক্রম কি নেই? অবশ্যই আছে। অনেকেই আছেন মাসে একবারও হাসপাতালে যান না। কখনও টি এইচ এফ পি ও বা সিভিল সার্জনকে বেতনের একাংশ দিয়ে ম্যানেজ করেন। আরও বড় অন্যায় ও ডাক্তাররা করে।

সেই ডাক্তার দের চাচা, মামা ও আছে। যতই রিপোর্ট লিখুন, তাঁদের টিকিও ধরতে পারবেন না। যা করতে পারবেন যে কয়জন ডাক্তার কাজ করছেন, তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করতে পারবেন। যে একজন অজ পাড়াগাঁয়ে পোস্টিং নিয়ে আছেন, অবধারিত ভাবে জেনে রাখুন, তাঁর কোন শক্তিধর চাচা, মামা নেই অথবা তিনি সেই এলাকা কে সেবা দিতেই গেছেন। তাঁর ক্ষমতার সর্বোচ্চ দিয়েই তিনি সেবা দিচ্ছেন।

এমবিবিএস এ আমাদের যতটুকু শেখানো হয়, চিকিৎসা বিজ্ঞান তাঁর চেয়ে অনেক বেশী বিশাল। তাই সবার চেষ্টা থাকে আরও বেশী জানবার। তাঁর জন্য প্রয়োজন উচ্চশিক্ষা। প্রত্যেক ডাক্তারই সেই চেষ্টা করতে থাকেন। অবসর সময়ে পড়াশুনা কিংবা উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষা দেয়া।

এর অংশ হিসেবেই তার প্রয়োজন পরে ট্রেনিং, চেষ্টা করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার। এই ব্যাপারটিকে দেখা হয়, ‘গ্রামে থাকতে চায় না। শুধু শহরে যেতে চায়। ‘ হিসেবে। অনেকে হয়তো এমবিবিএস এই খুশী থাকেন।

কিছু প্র্যাকটিস জমে। একই জায়গায় অনেক দিন থাকলে পরিচিতি তৈরি হয়। সরকারীভাবে এদের জন্য বছর বছর বেতন বৃদ্ধি ছাড়া আর কোন প্রণোদনা নেই। নেই কোন প্রমোশান কোন সিনিওরিটি। উচ্চতর ডিগ্রী না থাকলে, সারা জীবনই থাকতে হবে মেডিকেল অফিসার হয়ে।

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি আছে। অনেক সমস্যাও আছে। আমরা কেন যেন ‘সমস্যা’র চেয়ে ‘সেনশেসান’ খুঁজি বেশী। একজন ডাক্তার ঠিকমত কাজ করছে, এ তো কোন খবর হোল না। প্রত্যেকদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের আউট ডোর এ কতজন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁর কোন রিপোর্ট লেখা হবে না।

লেখা হবে, কখন একদল যুবক এসে সেই ডাক্তার কে মারধর করেছে। আমরা কি চাই তা আগে ঠিক করতে হবে। যদি আমার মত কাঠুরে হবার আগে একটা চেষ্টা করতে এসে থাকেন, লেখক হওয়া যায় কি না, তবে আমার বলার কিছু নেই। আর যদি সত্যিই চাই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি হোক, এর মূল সমস্যা খুঁজতে হবে। তা নইলে কয়েকজন গোবেচারা চিকিৎসককে বদলী করা কিংবা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সম্পর্কে কিছু ‘সেনসেশানাল’ রিপোর্ট।

ব্যাস এই পর্যন্তই কাহিনী এগোবে। আর কিছু হবে না। চলতে থাকবে অভিযোগ আর তাঁর খণ্ডন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।