আসুন উষ্কানী মূলক রাজনৈতিক বক্তব্য পরিহার করি। ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসে সে দেশের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েনসহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে যে বিতর্ক চলছে সে সম্পর্কে আমরা কথা বলেছি, বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট জনাব মাহফুজুল্লাহ'র সাথে । তাঁর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো :
রেডিও তেহরান : জনাব মাহফুজুল্লাহ, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসে ভারতের নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েনের কোন খবর তার নলেজে নেই; তার মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে অবহিত নয়। অথচ মিডিয়ার সচিত্র প্রতিবেদনে ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীদের দেখা গেছে। তাহলে ভারতের নিরাপত্তা রক্ষীরা কিভাবে বাংলাদেশে ঢুকলো-এ প্রশ্ন জনমনে দেখা দিয়েছে ।
তো এ সম্পর্কে আপনি কি বলবেন ?
মাহফুজুল্লাহ : দেখুন, প্রাথমিক পর্যায়ে যে কোনো কূটনৈতিক মিশনের ক্ষেত্রে দু'টি মন্ত্রণালয় জড়িত । এর একটি হচ্ছে-পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অন্যটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় । তবে কোনো দূতাবাসের নিরাপত্তার বিষয়টি দূতাবাস যে দেশে অবস্থিত সেই দেশের সরকারের উপর নির্ভর করে এবং সে দেশের সরকার সেই দায়িত্ব বহন করে । কিন্তু বর্তমানে অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি কেউ কোনো শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে না । বিশেষ করে ভারত যে কাজটি করেছে ! আর সরকার এ সম্পর্কে যতই অস্বীকার করুক গণমাধ্যমে এবং একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এ সম্পর্কিত সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
আর এতবড় একটি বিষয় যদি বাংলাদেশের সরকার না জেনে থাকেন তাহলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি এটি একটি বিরাট হুমকি এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের শামিল । আর ভারতের এ বিষয়টি কখনই সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না । এসব কারণেই জনমনে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ সব বিষয় নিয়ে পত্রপত্রিকায় আলোচনা হচ্ছে ; প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে । রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বিবৃতি আসছে।
ফলে এ মুহুর্তে সরকারের উচিত হবে অনতিবিলম্বে এ বিষয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করা । যদি এক্ষেত্রে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয় তবে জনগণের সন্দেহের দায়ভার বা সন্দেহের তীর সরকারের দিকেই ধাবিত হবে এবং সরকারকেই এর দায় দায়িত্ব বহন করতে হবে।
রেডিও তেহরান : জনাব মাহফুজুল্লাহ, সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে-বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেছেন, বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েনের বিষয়টি দিল্লীর এখতিয়ারভূক্ত । আসলে কূটনৈতিক রীতি নীতি অনুযায়ী কি কোনো দেশ তার দূতাবাস পাহারার জন্য নিজস্ব বাহিনী মোতায়েন করতে পারে কি না ? ভিয়েনা কনভেনশনে এ ব্যাপারে কি বলা হয়েছে?
মাহফুজুল্লাহ : এ বিষয়টি একটি রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে না । কারণ যে কোনো দু'টি রাষ্ট্রের মধ্যেকার কূটনৈতিক সম্পর্ক পারস্পরিক বিশ্বাস ,আস্থা ও অনুমতির উপর নির্ভরশীল ।
আর এটিকে ইংরেজিতে ''Reciprocity'' বলা হয় । যেমন ধরুন দিল্লি যদি কোনো কাজ করে তবে ঢাকা সে কাজ করবে - আবার ঢাকা কোনো কাজ করলে দিল্লী তা করবে । তাছাড়া মিশন স্থাপনের আগে বা পরে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যে বিষয়গুলো নিয়ে ঐক্যমত্য হয় - সে বিষয়ের মধ্যে এটি কখনোই ছিল না । কেউ কেউ হয়তো মার্কিন মেরিনদের উপস্থিতির বিষয়টি সামনে তুলে ধরতে পারেন । সেক্ষেত্রে এ বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন যে সেটিও কিন্তু নির্ধারিত চুক্তির মাধ্যমে হয়েছে ।
আর বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসের নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েনের ব্যাপারে আমরা যতটুকু জানি পূর্বে কোনো চুক্তি ছিল না । চুক্তি না করেই এবং পারস্পরিক অনুমতি না নিয়েই ভারত এককভাবে এ কাজটি করেছে । কাজেই ভারতের হাই কমিশনার যা বলেছেন, সেটি সহজ এবং গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নয় ।
রেডিও তেহরান : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিন্তু আরো একটি কথা বলেছেন- তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে অবস্থিত সব বিদেশী মিশন এবং দূতাবাসের নিরাপত্তার জন্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যদি তাই হয় সেক্ষেত্রে ভারতীয়দের নিজেদের দূতাবাসের নিরাপত্তার জন্যে তাদের নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েনের কি প্রয়োজন ? এতে সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হওয়ার প্রশ্নটি অনেকেই তুলছেন ।
মাহফুজুল্লাহ : হ্যাঁ, এ ধরনের প্রশ্ন দেখা দেয়া খুবই স্বাভাবিক। আমরা অতীতেও লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন দূতাবাসে যখন কোনো হুমকীর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তখন বাংলাদেশ সরকার ঐসব দূতাবাসে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিয়েছে। এখন ভারতের পক্ষ থেকে যে কাজটি করা হয়েছে তার একটিই অর্থ দাঁড়ায়- আর সেটি হচ্ছে ভারত বাংলাদেশের দেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট নয় । আর সে কারণে তারা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের দূতাবাসে নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করেছে। তবে তাদের এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাধীন মর্যাদার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শনের শামিল ।
আমরা দেখেছি এর আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত ছিল ভারতের হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী । তিনি গত এক বছরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমন সব মন্তব্য করেছেন যেসব মন্তব্যের কারণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক সময় বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, তিনি সৌজন্যের সীমা অতিক্রম করেছেন । কাজেই গত এক বছরের ধারাবাহিকতার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা এসব বিষয় দেখতে পাই । আর এসব ঘটনা থেকে বলা যায় ভারত বাংলাদেশের স্বার্থের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন । কখনও কখনও ভারত আমাদের যে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আছে সেটিকে মেনে নিতে চায় না ।
রেডিও তেহরান : বাংলাদেশের দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত আরো একটি আলোচিত বিষয় আমি তুলে ধরতে চাইছি ; বিষয়টি হচ্ছে - উলফা নেতা গ্রেফতারের বিষয় । এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী দুজনই বলেছিলেন- তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না । কিন্তু উলফার নেতারা আদালতে বলেছেন, বাংলাদেশ তাদেরকে গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। দুই দেশের মিডিয়াতেও একই খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে কি এমন হতে পারে যে দেশে বিশেষ কোনো বাহিনী তৎপর রয়েছে যাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুই জানেন না ?
মাহফুজুল্লাহ : হ্যাঁ, আপনি জনমনের যে প্রশ্নের বিষয়টি তুললেন-সেটিকে যেমন উড়িয়ে দেয়া যায় না ঠিক একইভাবে আরেকটি বিষয় উড়িয়ে দেয়া যায় না ।
সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশ হয়তো পুরো বিষয়টি জানতো কিন্তু এখন সরকারের পক্ষ থেকে সেটি অস্বীকার করা হচ্ছে । যেহেতু সরকার ভারতের চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছেন । আর সে জন্যেই তারা এটাকে অস্বীকার করেছেন। আবার অনেকে এ কথা বলছেন যে, বাংলাদেশে বিশেষ বাহিনী তৎপর রয়েছে । তবে আমার কাছে যেটি মনে হয়, বাংলাদেশ সরকার এটি একেবারেই জানতেন না তা মনে করার মতো তেমন কোনো কারণ নেই ।
উলফা নেতারা অসমের আদালতে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন এবং তাদের এসব বক্তব্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে - সেখানে কিন্তু তারা বলেছেন যে, তারা এক ধরনের ফাঁদের শিকারে পরিণত হয়েছেন। তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে।
রেডিও তেহরান : জনাব মাহফুজুল্লাহ, এ ধরনের নানা বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মহল বিশেষ করে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হুমকী সম্পর্কে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন । তো এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন ?
মাহফুজুল্লাহ : দেখুন, এ ধরনের ঘটনাগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তো অবশ্যই উদ্বেগের বিষয় । আর এটি শুধু বিরোধী দলীয় নেত্রীর জন্যে পুরো দেশবাসীর জন্যেই তা উদ্বেগের বিষয়।
আর এসবের সত্যতা যে আছে তা কিন্তু অনেক মিডিয়ার প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাছাড়া বিরোধী দলীয় নেত্রী যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সে সম্পর্কে আমি বলব, তার জন্যে আরো বেশী জরুরী হচ্ছে পুরো বিষয়গুলো নিয়ে সংসদে গিয়ে বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করা । যদি সংসদে তাকে এ সব বিষয়ে বলতে না দেয়া হয় তখন তার উচিত বাইরে এসে জনগণের কাছে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।