প্রকীর্ণ করি অর্ণে আলোক বিসর্গী বীথিকায় চায়ে চুমুক দিতেই জিভটা পুড়ে গেল । ব্যাপারটাকে মাইক্রোস্কোপিক দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম ! কেননা, মনশ্চোখে ভেসে উঠেছে বিলিয়ন টেস্ট বাডস এর ঝলসে যাওয়া ছবি ! এ নিশ্চয়ই আমার জিভ নয় ! লেখার টেবিলের ওপর চায়ের মগটা রেখে, আর্মচেয়ারে বসে এলিয়ে দিলাম শরীর । খুলে দিলাম জানালা । হু হু করে আসতে থাকল ‘চৈতিপ্রভাতহাওয়া’ । গতরাতে, বহুদিন পর দাড়ি কেটেছি ।
কেউ একজন, নগ্ন-শীতল হাত যত্নে বুলিয়ে চলেছে যেন গালে ।
খুব হাল্কা স্বরে কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গাইছেন,
‘‘বিমল আনন্দে জাগো রে ।
মগ্ন হও সুধা সাগরে । ।
হৃদয় উদয়াচলে দেখো রে চাহি ।
প্রথম পরম জ্যোতিরাগ রে । । ’’
দ্বিতীয় চুমুক দিলাম চায়ে । বলা বাহুল্য, স্বাদ পেলাম না কোন । এত এত গুঁড়ো দুধ, আর চিনি দিয়ে তৈরি করা সাধের চা আমার, কপাল দোষে যমঘরে গেছে !
[নিকটবর্তী পূর্ব শেকল]
উনুনের আঁচে, আমার অণুগুলো অচিন্ত্যনীয় বেগে ছুটোছুটি করছিল ।
একসময় প্রবল স্বরে চিৎকার করতে থাকলাম । তখন, গায়ে ছুঁড়ে দেয়া হল পাতার গুঁড়ো । গুঁড়োগুলো বুঝতেই পারেনি, কোথায় এসে পড়ছিল তারা । বোঝার পর প্রচণ্ড আতঙ্কে আবার ফিরে যেতে চাইছিল । দেখে ভীষণ মায়া হয়েছিল আমার ।
কিছু বাষ্পকণা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ওদের অভ্যর্থনার জন্যে । তারা রন্ধ্রে প্রবেশ করে, আশু দুর্ঘটনার জন্যে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে নিয়েছিল তাদের । কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রং ও ঘ্রাণ পেলাম উপহার । অত কষ্টের মাঝেও বলতে ভুলিনি তাদের, ‘ধন্যবাদ, হে চায়ের গুঁড়ো সকল ! আন্তরিক ধন্যবাদ তোমাদের !’
এখন, আমার নিজের প্রতিশোধ স্পৃহার সাথে যুক্ত হয়েছে মৃতগুলোর অভিশাপ, গুঁড়ো ল্যাকটোজ আর সুক্রোজের জিঘাংসা ! চমৎকার এক সুবাস তৈরি করলাম আমরা । তারপর তা কণায় ভর করিয়ে, নাসারন্ধ্র দিয়ে লোকটার কুটিল মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দিলাম ।
লক্ষ্য করলাম, চুমুক দেয়ার ব্যাপারে তাকে যথেষ্ট প্রলুব্ধ করা গেছে !
So! It is show time !! দগ্ধ হয়ে দগ্ধ করবার সুখ, আমাকে ঘিরে ধরতে চলেছে !
[নিকটবর্তী পূর্ব শেকল]
গল্প শোনার জন্যে বেলা কি অবেলা, তা বুঝবার কোন উপায় নেই এখানে । এটি একটি বদ্ধ টিনের কৌটো । বাহিরের বিচিত্র সব শব্দ এর গায়ে এসে ঘা দেয় । ভেতরের পরিবেশ রহস্যময় হয়ে ওঠে । তেমনই এক রহস্যময় পরিবেশে একজন ‘আমি’, ঘুরে, ফিরে, গড়িয়ে, সরিয়ে, রসিয়ে আমাদের শোনাচ্ছিল এক অদ্ভুত গৌরবের কথা ।
‘তোমরা কি জানো, কেন আমরা অন্য চা পাতাদের তুলনায় অধিক সৌভাগ্যবান ?’
‘কেন ! কেন !’ সবাই সমস্বরে জানতে চাইল ।
‘এজন্যে যে, আমাদের মূল্য অন্য জ্ঞাতিদের তুলনায় কেজিতে আট টাকা বেশি !’
‘এই কথা !’
সবার কণ্ঠে আশাভঙ্গের কৃত্রিম সুর ।
‘তোমরা কি দেখো না, আমাদের বাজার জাত করা হয়েছে মসৃণ স্বচ্ছ সবুজাভ প্যাকে ? আর ওদের মলিন অস্বচ্ছ হলদেটেতে ?...’
তার এসব অপ্রয়োজনীয় কথাকে পাত্তা দিচ্ছিল না কেউ । আমারই শুধু তাকে একটু চাগিয়ে দিতে ইচ্ছে হল । বললাম, ‘কিন্তু জ্ঞানী, আমরা তো একই গাছ থেকে এসেছি ! একই মাটি থেকে পুষ্টি নিয়েছি ! তবে কেন শুধু আমাদেরই এমন সৌভাগ্যবান করা হল ?’
সে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘এটা নকশাকারীর একান্ত ইচ্ছে ।
’
‘তুমি সামান্য চা পাতার গুঁড়ো, তাঁর ইচ্ছের কথা জানলে কি করে ?’
‘ঠাট্টা করছ ? নাকি, সত্যিই জানতে চাইছ !’
‘কোনটাতে তোমার সুবিধে, বল । তুমি পৃথিবীতে আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছ । এটা জানো ? ’
হঠাৎ প্রবল ভাবে ভুমিকম্প শুরু হল। উপস্থিত সবাই মেতে উঠলো ত্রাহি চিৎকারে। জ্ঞানী 'আমি'টির মুখে সন্তুষ্টির হাসি দেখা গেল ।
তার চোখ যেন চিৎকার করে বলল, ‘দেখ ! আমাকে অবমাননা করার শাস্তি দেখ !’ এখানেই শেষ নয় । সময়বুঝে, পূর্ববর্তী ভারসাম্যহীনদের মত করে বলে বসল, ‘ এখন শুধু সেই নকশাকারীই পারে আমাদের বাঁচাতে ! সবাই তাঁকে স্মরণ করতে থাকো !’
কেউ একজন বলল, ‘গাধা ! এই বললে তোমার নকশাকারী তোমাকে সুন্দরভাবে বাজারজাত করে ইতোমধ্যেই সৌভাগ্যবান করেছেন, আর এখনই আবার বলছো বাঁচানোর কথা ? সৌভাগ্যবানই যদি করবেন, তবে বাঁচানোর প্রসঙ্গ কেন আসবে! তোমার কি...’
তাদের কথোপকথন হারিয়ে গেল । হঠাৎ কৌটোটির ঢাকনা সরে গিয়ে, এক ক্রূর টেবিল চামচ প্রবেশ করলো ভেতরে । আমাকে ও আরও শ পাঁচেক ‘আমিকে’ তুলে নিয়ে ওপরের দিকে চলল । দেখি, শুকনো মুখে জ্ঞানীও সেখানে বসে আছে ।
‘ভয় পেয়ো না বন্ধুরা । নিশ্চয়ই আমরা আরও চমৎকার কোন ঘরের দিকে চলেছি । যারা তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা করেছে, তাদের কোন ভয় নেই’, শুকনো মুখেই ঘোষণা করলো সে ।
হ্যা । ঘরটা চমৎকার বটে ।
আমাদের মরচে পড়া টিনের কৌটোর পরিবর্তে একটি নকশাদার চকচকে কেটলি । তাতে টগবগ করছে ফুটন্ত জল ! চামচ হতে আমাদের স্খলন, অতঃপর প্রবল চিৎকারে অমোঘ নিয়তি বরণ । অসহনীয় উত্তপ্ত জলকণাগুলো আমাদের শরীর ভেদ করে সুচের মত বিঁধে গেল । পরমুহূর্তেই খলবলে হিংস্র জল লুফে নিল আমাদের !
ক্রমশঃঅবশ অনুভূতির কাছে জলদানবীর নৃত্যরতা দেহ, ঝাপসা হয়ে এল ক্রমে !
[দূরবর্তী পূর্ব শেকল]
আমার সন্তানদের কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে ঐ পাপিষ্ঠার দল ! হায় আমার বৃক্ষজন্ম ! কিছুতেই পারছিনা আর ! দেহ-মনের যাতনায় কুঁকড়ে আছি সারাটাক্ষণ ! আর অপেক্ষা করে আছি । কবে মৃত্যু হবে ? পাশ থেকে সমবেদনার সুরে কেউ একজন বলে উঠল, ‘তোমার বড় কষ্ট !’ কে আমার মনের পড়ে নিল এমন করে ? ছোট্ট লাল জোঁক এক ।
আমারই ডালের সাথে একরকম মিশে গিয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, ‘কষ্ট ? আমার ? হবেওবা বাছা !’
‘কতদিন ঘুম নেই তোমার ! তোমাকে বাড়তে দিচ্ছে না মানুষগুলো । কাঁচি চালিয়ে এতো টুকুন করে রেখেছে । মাথা উঁচু করে আকাশ দেখার কথা ছিল তোমার । অথচ, পড়ে আছ মাটির কাছে ।
’
আমি অবাক হলাম । বললাম,‘এসব কথা তুমি জানলে কি করে বাছা ? জন্মের পর থেকে তো তুমি আমাদের এমনটাই দেখে আসছ !’
সে বলল, ‘আমি আমার অন্তর্তন্তুর ভাষা পড়ে জেনেছি । সেখানে লেখা আছে, দূর প্রাচ্যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা, তোমাদের বিশালকায়া পূর্বপুরুষদের প্রবল ঘ্রাণের ঘোরলাগা সময়ে রাজত্ব করে গেছেন । ’
‘তোমার অন্তর্তন্তুতে আমাদের কথা লেখা আছে !’
‘হ্যা । কেননা, আমরা প্রজন্মান্তরে তোমাদের সঙ্গে সহবিবর্তিত হয়েছি ।
তোমাদের একজন খুব বড় দার্শনিক আছেন । উত্তর-পশ্চিম যখন প্রাচীন পুণ্ড্র অঞ্চল, তখন তাঁর জন্ম ! পুণ্ড্রশ্বথ । আমি তোমাকে তাঁর শান্তিময় বৃক্ষদর্শন শোনাব ? সম্প্রতি, এটা আমার আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়েছে । ’
‘শোনাও !’
[নিকটবর্তী পূর্ব শেকল]
এই বামন চা গাছটার কাণ্ড-শেকড় তিরতির করে কাঁপছে । কিসে সে এমন প্রবল ভাবে অনুরণিত ? যে কারণেই হোক- ভূমিকম্প যে সে তালিকায় নেই, এটাই আপাতঃস্বস্তির কারণ ।
ভূমিকম্পের কথা মনে এলেই মাতৃমূর্তি বজায় থাকে না আমার । কংস মূর্তি জেগে ওঠে । আমার এমন লক্ষ পরিজনের মাঝে বিভেদ রচেছে সে, যারা আর কোনোদিন কারও মুখ দেখতে পায়নি আর ।
মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে । কেন এই মৃত্তিকা জীবন বেছে নিয়েছিলাম ? ফুঁড়ে গাছেরা বেরিয়ে আসছে, খুদে পোকামাকড়েরা ঢুকে পড়ছে, জীবজগৎ দৌড়ুচ্ছে, জড়জগৎ গড়াচ্ছে ।
ক’বছর হল, যুক্ত হয়েছে দোপেয়ে বানর বিশেষ । এদের নির্দয়তায় কার শান্তি বিপন্ন হয়নি, কেউ বলতে পারে না ! আমার চেয়ে বেশি কষ্টে কি কেউ আছে পৃথিবীতে ?
ছি, এসব কি ভাবছি আমি ! আমার আজকের এই জমাট মাতৃরূপ, বিন্দু বিন্দু করে গড়ে ওঠা পাথারসম সাধনার ফল । আর কেউ তো পারেনি ! আমি মাতা-গরবিনী। জগৎ তো আর- ‘সয়ে যাও নয় ক্ষয়ে যাও’ নয়। শক্তি অবিনশ্বর।
এই গাছটি কেন এতো অনুরণিত হচ্ছে ? ‘এই গাছ, এই ! এই চা গাছ !’ শুনছেই না । আমি আবার ডাকলাম । ‘এই, এই !’
[দূর দূরবর্তী পূর্ব শেকল]
‘আজকাল একটা কথা প্রায়ই মনে হয় । ’ আমি একে একে তিনজনার দিকে তাকালাম । কৌতূহলী হয়ে উঠেছে তারা এ কথায় ।
‘তোমাদের মনে আছে আমাদের সেই জঠরকাল ?
‘বেশ মনে আছে । ’ বলল সবল নিউক্লীয় । ‘আমরা একে ওপরের সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে ছিলাম । কেউ কাউকে চিনতে পারিনি । ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইছিলাম তাই ।
কিন্তু পারছিলাম না । কেন, তা আজ বলতে পারি । ’ তড়িৎচুম্বক আর দূর্বল নিউক্লীয় সায় জানাল তার কথায় ।
আমি বললাম, ‘হ্যা । আমরা একে ওপরের সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে ছিলাম ।
বিপরীতে, ছুটে বেরিয়েও আসতে চাইছিলাম । কিন্তু, আমি মহাকর্ষ তা করবার আগে, তোমাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না তা। শূন্য হতে দশ পিকোর ব্যবধানে, একে একে সবাই ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাম । কিন্তু, সেদিন হুড়োতাড়া না করলে, আজ এ বিশ্বে, আরও সাতটি মাত্রা অবমুক্ত হতে পারত । আমরা নিজেদের মাঝে নিজেরা পশে, সৃষ্টি করেছি ।
জাত জড়জগতের আকার, আর উপজাত জীবজগতের ইন্দ্রিয় আটকে গেছে ত্রিমাত্রিকতার সুতোয় । তারা সাঁতার কাটছে অসম্পূর্ণ আনন্দ-বেদনা, সৌন্দর্যবোধ, আর মুখাপেক্ষিতার বন্দিদশায় !
তাদের অজ্ঞতাপ্রসূত নৈর্ব্যক্তিক এক সন্তোষ, নিরন্তর অভিশাপ দিয়ে চলেছে আমাদের !
*
[অন্তর্হিত শেকল]
কেন শেকলের বাহিরে চলে গেলে, তা ভেবে মনটা বড্ড বিষণ্ণ তোমার ?
সত্যিই, কত চমৎকার হত যদি সবার মাঝে নিজেকে ব্যাপৃত করে দিতে পারতে, কল্পনার সর্বশক্তিমানটি হয়ে !
তুমি ত্রিমাত্রিক সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে ! সমস্ত সুকৌমার্য সম্পূর্ণ তোমার ! তথাপি, তুমি সয়ম্ভু নও । বরং,পদার্থের সূত্রবন্দি, একাকী স্বতন্ত্র সৃষ্টি । মাত্রাবিভবের পার্থক্যের কারণে, যার কোন প্রভাবই নেই মাত্রিক জগতে ।
তুমি অবাক হয়ে দেখ, ওরা স্বয়ং সমন্বিত ঈশ্বর !
তুমি ঈশ্বর তোমাতে !
ত্রিমাত্রিক হয়েও ওরা শক্তিমত্ত, যূথবদ্ধ !
আর তুমি ? একাকী, বিলোল !
তোমার বহুমাত্রিক সৃজন-সৌন্দর্যের একমাত্র স্তুতিকার !
একেক সময় ওদের উপাসনায় বসতে, কি প্রবল ইচ্ছে করে তোমার ! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।