আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্পিনোজার জীবন ও তাঁর সমসাময়িক জগৎ

আমার ভুবন কান পেতে রয় ... ... দ্বীপ নিভে যায় সকলই ঘুমায় মোর আঁখি রহে জাগিয়া স্পিনোজার জীবন ও তাঁর সমসাময়িক জগৎ এএম হারুন অর রশিদ ১. ভূমিকা বেন্টো বারুচ স্পিনোজার জীবনী পড়তে শুরু করলে সর্বপ্রথম একটা প্রশ্নই মনে আসে_ একজন মানুষের পক্ষে কীভাবে স্পিনোজা হওয়া সম্ভব হয়েছিল অথবা অন্যভাবে প্রশ্ন করা যায়, 'আমরা এই মানুষটির সম্পূর্ণ অপরিচিতির ব্যাপারটা কেমন করে ব্যাখা করি?' তিনি তাঁর সমসাময়িক প্রধান দার্শনিকদের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে দ্বিমত পোষণ করতেন এবং প্রকাশ্যে তিনি সুসংগঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার করে নিজের ইহুদি ধর্ম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর সমসাময়িকদের জীবনযাত্রা পরিত্যাগ করে নিজস্ব জীবন পরিক্রমণের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন, যাকে অনেকে মনে করতেন সাধুসন্তের জীবন এবং এবং অনেকে বলতেন 'এক নির্বোধের অস্তিত্ব'। স্পিনোজা কি একজন সামাজিক বিকৃতি মাত্র ছিলেন, যা অনেকে বলতে চাইতেন অথবা তাকে কি সত্যিই বোঝা যায় তাঁর সময়কার শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং তাঁর সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে? তাঁর জীবনের নানা ঘটনা দিয়ে কি তাঁর সব আচরণ বোঝা যায়, অথবা তাঁর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা কি ব্যাখ্যা করা যায়? এভাবে স্পিনোজার জীবনের এসব কিছু কি আমাদের নিজেদের জীবনের প্রাতিস্বিক অস্তিত্বের নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কাজে কোন ভূমিকাই পালন করতে পারে না? কোন মানুষের জীবনীই সার্থকভাবে ব্যাখ্যা করা বা বোঝা সহজ কাজ নয়_ বিশেষ করে সে মানুষটি যদি হয় বেন্টো বারুচ স্পিনোজা (২ নভেম্বর ১৬৩২-২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৬৭৭)। ২. স্পিনোজার সময় স্পিনোজার দর্শনের নিঃসন্দেহ মৌলিকত্ব সত্ত্বেও, তিনি তাঁর ঐতিহাসিক সময়ে একক, অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন 'প্রতিভাশালীদের শতাব্দী'র মাঝামাঝি সময়ে, যখন ইংল্যান্ডে 'হ্যামলেট' (১৬০১) প্রশ্ন করছিলেন, 'টু বি অর নট টু বি_ দ্যাট ইজ দ্য কোশ্চেন'।

বলা যায়, হ্যামলেটই ছিলেন এ যুগের প্রতিভূ; কেননা তিনি শেক্সপিয়ারের এই দীর্ঘতম নাটকে পদচারণা করে গিয়েছেন মানুষের নানা আচরণে হতবুদ্ধি হয়ে এবং জীবন ও মৃত্যুর তাৎপর্য নিয়ে পুরোপুরি বাক্যহারা হয়ে শুধু প্রশ্নই করে। এটা কোন আশ্চর্য ব্যাপার নয়, নাটকটি শুরুও হয়েছে সেই বিশেষ প্রশ্ন করে, 'ওখানে কে'? স্পিনোজা এই প্রশ্নের যুগেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাই তাঁর যুগকে হ্যামলেটের যুগও বলা যায়। স্পিনোজা পরীক্ষণলব্ধ উপাত্ত সংগ্রহের যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যখন ঘটনার পরীক্ষণ শুরু হয় শুধু আরাম কেদারায় বসে বিতর্ক করার জন্যে নয়। মানুষের মেধা এরই মধ্যে যৌক্তিক বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গিয়েছে, যা বহু আগেই ইউক্লিড জ্যামিতিতে তাঁর সৃজনশীল রচনার মধ্যদিয়ে মানুষকে শিখিয়ে গিয়েছেন। গ্যালিলিও এবং বেকন উভয়ই পরীক্ষণের ওপর জোর দিতেন এবং গ্যালিলিও আর একটি কথাও যোগ করেছিলেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন, বিশ্বপ্রকৃতিকে গণিতের ভাষায় বর্ণনা করা যায় এবং এ ধারণাকেই আধুনিক বিজ্ঞানের সূতিকাগার বলা যায়। বেন্টো স্পিনোজাকে তাই আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মগ্রহণের সমসাময়িকই বলা যায়। এই সময় বিজ্ঞানে মাপন প্রক্রিয়ার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিজ্ঞান ক্রমাগত সংখ্যাভিত্তিক হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞানীরা এ সময় অবরোহী পদ্ধতিকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন যার ফলে পরীক্ষণভিত্তিক যাচাইকরণ হয়ে যায় বিশ্ব সম্বন্ধে চিন্তা করার প্রধান ভিত্তি। স্পিানোজা যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন তখন টমাস হবস এবং রেনে দেকার্ত ছিলেন উদীয়মান দার্শনিক এবং উইলিয়াম হার্ভে ছিলেন মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে রক্ত সঞ্চালনের বর্ণনার অগ্রদূত।

স্পিনোজার স্বল্প জীবনকালে পৃথিবী পেয়েছিল বেস্নইজ পাসকাল, জোহানেস কেপলার, ক্রিশ্চিয়ান হিগেন্স, গটফ্রিড লাইবনিজ এবং আইজ্যাক নিউটনকে। নিউটন জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্পিনোজার জন্মের মাত্র দশ বছর পরে। বিশ্ব সম্বন্ধে স্পিনোজার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি এই নতুন প্রশ্ন করার আবহের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল এবং তাঁর প্রশ্নের উৎসই ছিল মানুষের জ্ঞানের পরিম-লে দৃশ্যমান পরিবর্তন। গ্যালিলিও যেমন সূর্যকেন্দ্রিক ধারণার মাধ্যমে মানুষের চিন্তামানসে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, স্পিনোজা হয়তো তাঁর তুলনায় বেশি বৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনার মনুষ ছিলেন না; কিন্তু তিনি ছিলেন আরও বেশি আঘাতপ্রাপ্ত এক মানুষ এবং তাই আরও বেশি আপসহীন। স্পিনোজা ছিলেন সবচেয়ে বেশি সহ্যশক্তিহীন, প্রচলিত ধর্ম- বিশ্বাসবিরোধী এক দার্শনিক; যিনি সুসংগঠিত ধর্মীয় সৌধকে আক্রমণ করেছিলেন নির্ভয়ে, অকাট্য যুক্তির সাহায্যে_ কিন্তু উপযুক্ত বিনয়ের সঙ্গে।

যেহেতু ধর্মের সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নিবিড়ভাবে জড়িত, তাই ওই সময়ের ক্ষমতাশীল রাজতন্ত্রও স্পিনোজার বৈপ্লবিক চিন্তাধারার ভীতিকর ব্যাপারটা ঠিকভাবেই অাঁচ করতে পেরেছিলেন_ যদিও স্পিনোজার নিজের হল্যান্ডীয় রাজতন্ত্র ছিল ওই যুগের সবচেয়ে বেশি সহনশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা। স্পিনোজা ছিলেন ওই শতাব্দীর এক আশ্চর্য উল্লেখযোগ্য চরিত্র, যার দর্শন অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল_ এমনকি তাঁর ধারণাগুলোর কোন উল্লেখও করা যেত না, যদি না তা তাঁর প্রতি হেয়জনক না হতো। তাই স্পিনোজার সমাধির উপরে একটি শব্দই উৎকীর্ণ ছিল_ কাউটে _ সাবধান। ৩. অ্যামস্টারডাম-১৬৩২ স্পিনোজার বাবা মি-য়েল দ্য স্পিনোজা ছিলেন একজন বিত্তবান পর্তুগিজ ব্যবসায়ী_ তাঁর পিতামহের মতোই। ১৬৩২ সালে স্পিনোজা যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন মি-য়েল ব্যবসা করতেন চিনি, মসলা, শুকনো ফল এবং ব্রাজিলীয় কাঠের।

তিনি ছিলেন সেফারডীয় পর্তুগিজ ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন প্রভাবশালী সদস্য, যার সিনাগগের মুখ্য কর্মকর্তা হিসেবেও তিনি কাজ করেছিলেন এবং জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি এর 'মাহামাদ' (পরিচালক)-ও হয়েছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রেবাই সল লেভি মোরটেরা, যিনি ছিলেন এ সময়ের অ্যামস্টারডামের সবচেয়ে প্রভাবশালী রেবাইদের অন্যতম। তাঁর পিতৃব্য অ্যাব্রাহাম ছিলেন এ সময়ের একজন বিখ্যাত রেবাই মেনাস্সহ বেন ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনেক সেফারডীয় ইহুদির মতো স্পিনোজার পরিবার রোমান ক্যাথলিকদের ইনকুইজিশন বা বিচার সভার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রথমে তারা পালিয়ে ফ্রান্সে এবং পরে হল্যান্ডে আসেন এবং অ্যামস্টারডাম শহরে বসতি স্থাপন করেন। পর্তুগালে এই বিচার সভার দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছিল ১৫৩৬ সালে, যা ১৫৮০ সালের দিকে প্রচ- ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে।

এই বিলম্বের সুযোগেই ইহুদিরা প্রথমে অ্যান্টোয়ার্প এবং পরে অ্যামস্টারডামে চলে আসতে পেরেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হল্যান্ড, বিশেষ করে অ্যামস্টারডাম বাস্তবিকই ছিল ইহুদিদের 'প্রতিশ্রুত দেশ'। ইউরোপের যে কোন অঞ্চলের তুলনায় হল্যান্ড ছিল জাতিগত এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার অপেক্ষাকৃত আদর্শস্থানীয় দেশ, যেখানে সেফারডীয় ইহুদিদের খুশি মনেই গ্রহণ করা হতো। হল্যান্ড ছিল একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যার প্রধান কর্মকর্তা (স্টাডহোল্ডার) স্পিনোজার জীবনের বেশির ভাগ সময় ছিলেন একজন বুদ্ধিমান সাধারণ মানুষ। ডাচরাই প্রথম সমাজে ন্যায়বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং আধুনিক পুঁজিবাদের সূচনা করেছিলেন, যেখানে ব্যবসায়কে সম্মানীয় পেশা মনে করা হতো এবং অর্থ-সম্পদকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয়া হতো।

ফলে দেশে এক বৃহৎ বুর্জোয়া জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছিল, যাদের জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল আরাম-আয়েসের অন্বেষণ। ইহুদি সম্প্রদায় যদিও আর্থিকভাবে সম্পদশালী এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, কিন্তু সমাজে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়নও ছিল। মূল সমস্যা ছিল আতিথ্য দানকারী দেশের রীতিনীতি, আইন-কানুন মেনে চলা; যা অবশ্য ইনকুইজিশনের ভীতি থেকে মুক্তি পেয়ে খুব বেশি কষ্টকরও ছিল না। ইহুদিরা নিজেদের ধর্ম-কর্ম তাদের সিনাগগে পালন করত, নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষা পর্তুগিজ ব্যবহার করত এবং ব্যবসায়ে তারা বেশ ভালোই করত; ফলে হল্যান্ডের সঙ্গে স্পেন ও ইংল্যান্ডের যুদ্ধ সত্ত্বেও ইহুদিরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই ছিল বলা যায়। অ্যামস্টারডাম শহরে কোন ইহুদি পল্লী ছিল না এবং বেশির ভাগ ধনী ইহুদিরা বাস করতেন অভিজাত বুর্গভালের কাছাকাছি, যেখানে তারা এক বিশাল সিনাগগ-হাউটগ্রাখ্ট গড়ে তোলে।

এর কাছাকাছি বাস করতেন বিখ্যাত শিল্পী রেমব্রান্ড এবং হয়তো তাঁর সঙ্গে স্পিনোজার এখানেই দেখা হয়েছিল। প্রবাদ আছে, রেমব্রান্ড স্পিনোজার প্রতিকৃতি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত 'সল এবং ডেভিড' ছবিটিতে; যা তিনি এঁকেছিলেন ঠিক সেই সময়ে যখন স্পিনোজাকে সিনাগগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছবিতে ডেভিডকে স্পিনোজার মতোই মনে হয়, যিনি হার্প বাজিয়ে সলকে শোনাচ্ছেন। (চলবে)এএম হারুন অর রশিদ ১. ভূমিকা বেন্টো বারুচ স্পিনোজার জীবনী পড়তে শুরু করলে সর্বপ্রথম একটা প্রশ্নই মনে আসে_ একজন মানুষের পক্ষে কীভাবে স্পিনোজা হওয়া সম্ভব হয়েছিল অথবা অন্যভাবে প্রশ্ন করা যায়, 'আমরা এই মানুষটির সম্পূর্ণ অপরিচিতির ব্যাপারটা কেমন করে ব্যাখা করি?' তিনি তাঁর সমসাময়িক প্রধান দার্শনিকদের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে দ্বিমত পোষণ করতেন এবং প্রকাশ্যে তিনি সুসংগঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার করে নিজের ইহুদি ধর্ম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর সমসাময়িকদের জীবনযাত্রা পরিত্যাগ করে নিজস্ব জীবন পরিক্রমণের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন, যাকে অনেকে মনে করতেন সাধুসন্তের জীবন এবং এবং অনেকে বলতেন 'এক নির্বোধের অস্তিত্ব'।

স্পিনোজা কি একজন সামাজিক বিকৃতি মাত্র ছিলেন, যা অনেকে বলতে চাইতেন অথবা তাকে কি সত্যিই বোঝা যায় তাঁর সময়কার শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং তাঁর সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে? তাঁর জীবনের নানা ঘটনা দিয়ে কি তাঁর সব আচরণ বোঝা যায়, অথবা তাঁর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা কি ব্যাখ্যা করা যায়? এভাবে স্পিনোজার জীবনের এসব কিছু কি আমাদের নিজেদের জীবনের প্রাতিস্বিক অস্তিত্বের নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কাজে কোন ভূমিকাই পালন করতে পারে না? কোন মানুষের জীবনীই সার্থকভাবে ব্যাখ্যা করা বা বোঝা সহজ কাজ নয়_ বিশেষ করে সে মানুষটি যদি হয় বেন্টো বারুচ স্পিনোজা (২ নভেম্বর ১৬৩২-২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৬৭৭)। ২. স্পিনোজার সময় স্পিনোজার দর্শনের নিঃসন্দেহ মৌলিকত্ব সত্ত্বেও, তিনি তাঁর ঐতিহাসিক সময়ে একক, অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন 'প্রতিভাশালীদের শতাব্দী'র মাঝামাঝি সময়ে, যখন ইংল্যান্ডে 'হ্যামলেট' (১৬০১) প্রশ্ন করছিলেন, 'টু বি অর নট টু বি_ দ্যাট ইজ দ্য কোশ্চেন'। বলা যায়, হ্যামলেটই ছিলেন এ যুগের প্রতিভূ; কেননা তিনি শেক্সপিয়ারের এই দীর্ঘতম নাটকে পদচারণা করে গিয়েছেন মানুষের নানা আচরণে হতবুদ্ধি হয়ে এবং জীবন ও মৃত্যুর তাৎপর্য নিয়ে পুরোপুরি বাক্যহারা হয়ে শুধু প্রশ্নই করে। এটা কোন আশ্চর্য ব্যাপার নয়, নাটকটি শুরুও হয়েছে সেই বিশেষ প্রশ্ন করে, 'ওখানে কে'? স্পিনোজা এই প্রশ্নের যুগেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাই তাঁর যুগকে হ্যামলেটের যুগও বলা যায়।

স্পিনোজা পরীক্ষণলব্ধ উপাত্ত সংগ্রহের যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যখন ঘটনার পরীক্ষণ শুরু হয় শুধু আরাম কেদারায় বসে বিতর্ক করার জন্যে নয়। মানুষের মেধা এরই মধ্যে যৌক্তিক বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গিয়েছে, যা বহু আগেই ইউক্লিড জ্যামিতিতে তাঁর সৃজনশীল রচনার মধ্যদিয়ে মানুষকে শিখিয়ে গিয়েছেন। গ্যালিলিও এবং বেকন উভয়ই পরীক্ষণের ওপর জোর দিতেন এবং গ্যালিলিও আর একটি কথাও যোগ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিশ্বপ্রকৃতিকে গণিতের ভাষায় বর্ণনা করা যায় এবং এ ধারণাকেই আধুনিক বিজ্ঞানের সূতিকাগার বলা যায়। বেন্টো স্পিনোজাকে তাই আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মগ্রহণের সমসাময়িকই বলা যায়।

এই সময় বিজ্ঞানে মাপন প্রক্রিয়ার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিজ্ঞান ক্রমাগত সংখ্যাভিত্তিক হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞানীরা এ সময় অবরোহী পদ্ধতিকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেন যার ফলে পরীক্ষণভিত্তিক যাচাইকরণ হয়ে যায় বিশ্ব সম্বন্ধে চিন্তা করার প্রধান ভিত্তি। স্পিানোজা যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন তখন টমাস হবস এবং রেনে দেকার্ত ছিলেন উদীয়মান দার্শনিক এবং উইলিয়াম হার্ভে ছিলেন মানুষের শরীরের অভ্যন্তরে রক্ত সঞ্চালনের বর্ণনার অগ্রদূত। স্পিনোজার স্বল্প জীবনকালে পৃথিবী পেয়েছিল বেস্নইজ পাসকাল, জোহানেস কেপলার, ক্রিশ্চিয়ান হিগেন্স, গটফ্রিড লাইবনিজ এবং আইজ্যাক নিউটনকে। নিউটন জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্পিনোজার জন্মের মাত্র দশ বছর পরে।

বিশ্ব সম্বন্ধে স্পিনোজার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি এই নতুন প্রশ্ন করার আবহের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল এবং তাঁর প্রশ্নের উৎসই ছিল মানুষের জ্ঞানের পরিম-লে দৃশ্যমান পরিবর্তন। গ্যালিলিও যেমন সূর্যকেন্দ্রিক ধারণার মাধ্যমে মানুষের চিন্তামানসে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, স্পিনোজা হয়তো তাঁর তুলনায় বেশি বৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনার মনুষ ছিলেন না; কিন্তু তিনি ছিলেন আরও বেশি আঘাতপ্রাপ্ত এক মানুষ এবং তাই আরও বেশি আপসহীন। স্পিনোজা ছিলেন সবচেয়ে বেশি সহ্যশক্তিহীন, প্রচলিত ধর্ম- বিশ্বাসবিরোধী এক দার্শনিক; যিনি সুসংগঠিত ধর্মীয় সৌধকে আক্রমণ করেছিলেন নির্ভয়ে, অকাট্য যুক্তির সাহায্যে_ কিন্তু উপযুক্ত বিনয়ের সঙ্গে। যেহেতু ধর্মের সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নিবিড়ভাবে জড়িত, তাই ওই সময়ের ক্ষমতাশীল রাজতন্ত্রও স্পিনোজার বৈপ্লবিক চিন্তাধারার ভীতিকর ব্যাপারটা ঠিকভাবেই অাঁচ করতে পেরেছিলেন_ যদিও স্পিনোজার নিজের হল্যান্ডীয় রাজতন্ত্র ছিল ওই যুগের সবচেয়ে বেশি সহনশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা। স্পিনোজা ছিলেন ওই শতাব্দীর এক আশ্চর্য উল্লেখযোগ্য চরিত্র, যার দর্শন অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল_ এমনকি তাঁর ধারণাগুলোর কোন উল্লেখও করা যেত না, যদি না তা তাঁর প্রতি হেয়জনক না হতো।

তাই স্পিনোজার সমাধির উপরে একটি শব্দই উৎকীর্ণ ছিল_ কাউটে _ সাবধান। ৩. অ্যামস্টারডাম-১৬৩২ স্পিনোজার বাবা মি-য়েল দ্য স্পিনোজা ছিলেন একজন বিত্তবান পর্তুগিজ ব্যবসায়ী_ তাঁর পিতামহের মতোই। ১৬৩২ সালে স্পিনোজা যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন মি-য়েল ব্যবসা করতেন চিনি, মসলা, শুকনো ফল এবং ব্রাজিলীয় কাঠের। তিনি ছিলেন সেফারডীয় পর্তুগিজ ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন প্রভাবশালী সদস্য, যার সিনাগগের মুখ্য কর্মকর্তা হিসেবেও তিনি কাজ করেছিলেন এবং জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি এর 'মাহামাদ' (পরিচালক)-ও হয়েছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রেবাই সল লেভি মোরটেরা, যিনি ছিলেন এ সময়ের অ্যামস্টারডামের সবচেয়ে প্রভাবশালী রেবাইদের অন্যতম।

তাঁর পিতৃব্য অ্যাব্রাহাম ছিলেন এ সময়ের একজন বিখ্যাত রেবাই মেনাস্সহ বেন ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনেক সেফারডীয় ইহুদির মতো স্পিনোজার পরিবার রোমান ক্যাথলিকদের ইনকুইজিশন বা বিচার সভার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রথমে তারা পালিয়ে ফ্রান্সে এবং পরে হল্যান্ডে আসেন এবং অ্যামস্টারডাম শহরে বসতি স্থাপন করেন। পর্তুগালে এই বিচার সভার দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছিল ১৫৩৬ সালে, যা ১৫৮০ সালের দিকে প্রচ- ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। এই বিলম্বের সুযোগেই ইহুদিরা প্রথমে অ্যান্টোয়ার্প এবং পরে অ্যামস্টারডামে চলে আসতে পেরেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হল্যান্ড, বিশেষ করে অ্যামস্টারডাম বাস্তবিকই ছিল ইহুদিদের 'প্রতিশ্রুত দেশ'।

ইউরোপের যে কোন অঞ্চলের তুলনায় হল্যান্ড ছিল জাতিগত এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার অপেক্ষাকৃত আদর্শস্থানীয় দেশ, যেখানে সেফারডীয় ইহুদিদের খুশি মনেই গ্রহণ করা হতো। হল্যান্ড ছিল একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যার প্রধান কর্মকর্তা (স্টাডহোল্ডার) স্পিনোজার জীবনের বেশির ভাগ সময় ছিলেন একজন বুদ্ধিমান সাধারণ মানুষ। ডাচরাই প্রথম সমাজে ন্যায়বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং আধুনিক পুঁজিবাদের সূচনা করেছিলেন, যেখানে ব্যবসায়কে সম্মানীয় পেশা মনে করা হতো এবং অর্থ-সম্পদকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয়া হতো। ফলে দেশে এক বৃহৎ বুর্জোয়া জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছিল, যাদের জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল আরাম-আয়েসের অন্বেষণ। ইহুদি সম্প্রদায় যদিও আর্থিকভাবে সম্পদশালী এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, কিন্তু সমাজে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়নও ছিল।

মূল সমস্যা ছিল আতিথ্য দানকারী দেশের রীতিনীতি, আইন-কানুন মেনে চলা; যা অবশ্য ইনকুইজিশনের ভীতি থেকে মুক্তি পেয়ে খুব বেশি কষ্টকরও ছিল না। ইহুদিরা নিজেদের ধর্ম-কর্ম তাদের সিনাগগে পালন করত, নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষা পর্তুগিজ ব্যবহার করত এবং ব্যবসায়ে তারা বেশ ভালোই করত; ফলে হল্যান্ডের সঙ্গে স্পেন ও ইংল্যান্ডের যুদ্ধ সত্ত্বেও ইহুদিরা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই ছিল বলা যায়। অ্যামস্টারডাম শহরে কোন ইহুদি পল্লী ছিল না এবং বেশির ভাগ ধনী ইহুদিরা বাস করতেন অভিজাত বুর্গভালের কাছাকাছি, যেখানে তারা এক বিশাল সিনাগগ-হাউটগ্রাখ্ট গড়ে তোলে। এর কাছাকাছি বাস করতেন বিখ্যাত শিল্পী রেমব্রান্ড এবং হয়তো তাঁর সঙ্গে স্পিনোজার এখানেই দেখা হয়েছিল। প্রবাদ আছে, রেমব্রান্ড স্পিনোজার প্রতিকৃতি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত 'সল এবং ডেভিড' ছবিটিতে; যা তিনি এঁকেছিলেন ঠিক সেই সময়ে যখন স্পিনোজাকে সিনাগগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এ ছবিতে ডেভিডকে স্পিনোজার মতোই মনে হয়, যিনি হার্প বাজিয়ে সলকে শোনাচ্ছেন। (চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।