আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দূরাগত ডাক

আমার ঘরের চাবি পরের হাতে ...... ১ দাদু ও দাদু... ও... দা...দু... ত্যাঁদড় ছেলেটা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। ভীষণ বিরক্ত হলেন শামসুল আলম। তাঁর এ নাতিটা যতই বড় হচ্ছে ততই যেন শিশু হয়ে যাচ্ছে। সকাল বেলায় দুম দুম করে,দরজা ধাক্কিয়ে এমন চেঁচিয়ে ডাকছে যে বুকটা ধড়ফড় করছে। গতকাল,শবে বরাতের রাতে নামাজ পড়ে আসার সময় বৃষ্টি নেমেছিল।

তুমুল বৃষ্টি নয়;একটানা একঘেয়ে ঝির ঝির বৃষ্টি। তিনি বৃষ্টি থামার জন্য কোথাও অপেক্ষা না করে ভিজতে ভিজতেই ঘরে চলে এলেন। ঘরে এসে মনে হল একটু জ্বর জ্বর লাগছে। তা তো লাগবেই বয়স তো আর কম হয়নি,৭০ তো পেরিয়েছে। এই সকাল বেলায় জ্বরটা আরো বেড়েছে।

তিনি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। শোয়া অবস্থায় জিজ্ঞেস করলেন," কি হয়েছে মুরাদ এমন চেঁচাচ্ছিস কেন" "শওকত দাদু মারা গেছে!"শান্ত গলায় বলল মুরাদ। চমকে উঠে,লাফিয়ে বিছানা থেকে ওঠলেন উনি। দরজা খুলেই মুরাদকে বললেন,"কে বলেছে তোকে,কোথায় শুনলি?" "এই তো এখন;জহির চাচ্চু বলে গেল" মুহুর্তেই,কোথায় উড়ে চলে গেল তাঁর জ্বর । কিন্তু বুকের কোথাও কে যেন প্রচন্ড জোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।

তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেননা যে, শওকত মারা গেছে । গতকালই তো দুজন নামাজ পড়ল একসাথে! গোসল সেরে,সাদা পাঞ্জাবীটা গায়ে চড়িয়ে,দরজার কোনায় রাখা লাঠিটা হাতে নিলেন তিনি। শওকত সাহেবকে শেষ দেখাটা দেখে আসবেন। ২ "মরা বাড়ি"তে পৌছতে না পৌছতেই, কান্নার শব্দে তাঁর বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল। এমনিতে তিনি খুব একটা দুর্বল চিত্তের মানুষ নন, কিন্তু মরা বাড়ির কান্না শুনলে তিনি নিজেকে কখনো সামলাতে পারেননি।

শওকত সাহেবের মুখটা দেখে নিয়ে,একটা লাঠিতে ভর দিয়ে উঠানের একপাশে দাঁড়ালেন তিনি। আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে বাইরে চমৎকার আবহাওয়া; উজ্জ্বল রোদে উঠোনটা ঝলমল করছে। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে,কারো বিদায়-বেলায় সে বিষন্ন হয়না। একটা সাদা পর্দা দিয়ে চারপাশটা ঘেরাও করে "গোসল দেয়া" হচ্ছিল শওকত সাহেবকে। ঠিক এ সময় কতগুলো বাচ্চা ছেলে মার্বেল খেলছে উঠানের যে পাশে পুকুর আছে সে পাশে।

এ দৃশ্য দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল শামসুল আলম সাহেবের। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি । এই মাটির পৃথিবীতে থেকে শিশুরা বাস করে কল্পনার এক অদ্ভুত সুন্দর রাজ্যে। মৃত্যুর মত অনিবার্য বাস্তবতাও যাকে স্পর্শ করতে পারেনা। কোত্থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এসে জহির বলল, "বসেন চাচা" তিনি হাত নেড়ে নেড়ে বললেন "লাগবেনা লাগবেনা নিয়ে যাও" অন্য সময় তিনি এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন না।

কিন্তু আজ পারছেন। কারন আজকের দিন টা আলাদা। ভাবনার একটা তীব্র ঘোর তাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারবে আরো অনেক্ষন। ৩ বাদ আসর অনুষ্ঠিত হল জানাজা নামাজ। বেশ ভালই লোক সমাগম হয়েছে।

জানাজা নামাজ থেকে শুরু করে মাটি দেয়া পর্যন্ত সবকিছুতে তিনি অংশ নিয়েছেন। মনটা একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে তাঁর। ফিরে আসার সময় তাঁর মনে হল শরীরটা নিয়ন্ত্রনে নেই। কোনমতে ঘরে এসে সোজা চলে গেলেন ছাদে। ছাদের যেখানে আম গাছটির ছায়া এসে পড়েছে সেখানে চেয়ারটা টেনে এনে বসলেন তিনি।

আলোর তেজ যত কমে আসছে তাঁর মন ততই বিষণ্ণ থেকে বিষন্নতর হচ্ছে। ধীরে ধীরে কখন যে একটি আঁধারি পর্দা ঘিরে ধরেছে সমস্ত চরাচর,তিনি টের-ই পেলেন না। টের পেলেন যখন মসজিদ থেকে ভেসে আসল মাগরিবের আযান। মনটা হুহু করে উঠল তাঁর। এমন কতবার তিনি সন্ধ্যার আযান শুনেছেন।

এরকম বিষণ্ণ,করুন,হৃদয় শূন্য করা আযান তিনি কি আর কখনো শুনেছেন?গাল বেয়ে অকারণ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কিংবা হয়তো অকারণ নয়, হয়তো এর পেছনে লুকিয়ে আছে মানুষের অনাদি কালের অসহায়ত্ব,অনাদি কালের ইতিহাস! অনেক অনেক দূরের লালচে আকাশটার দিকে তাকিয়ে তাঁর বারবার মনে হচ্ছে- দূরাগত ডাক তিনি শুনতে পাচ্ছেন। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। সময় খুব দ্রুত চলে যায়; খুব দ্রুত! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।