মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত। দৈনিক জনকণ্ঠ, শুক্রবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১২, ১২ ফাল্গুন ১৪১৮
সঙ্গ প্রসঙ্গের লেখা ॥ বিষয়ের যোগসূত্র মানুষ
মামুন রশীদ
সরদার ফজলুল করিমের খ্যাতি সৃজনশীল লেখক এবং দার্শনিক হিসেবে। শোষণমুক্ত মানবতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন থেকেই তিনি লড়াই করেছেন এবং করছেন। আমাদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। প্লেটোর সংলাপ, প্লেটোর রিপাবলিক, এ্যারিস্টটলের পলিটিক্স, এ্যাঙ্গেলসের এ্যান্টি ডুরিং, রুশোর সোস্যাল কন্ট্রাক্ট প্রভৃতি বইয়ের জন্য তাঁর খ্যাতি পাঠকমহলে।
এর বাইরেও সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন। দর্শন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবেও তাঁর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। একই সঙ্গে শিক্ষক এবং রাজনীতিক- এই দুইয়ের সমন্বয়ে সরদার ফজলুল করিম তাঁর চিন্তার জগতকে বিকশিত করেছেন। সেই বিকশিত চিন্তার সঙ্গে পাঠককে পরিচিত করানোর প্রয়োজনেই তিনি লিখেছেন। তাঁর লেখায় এসেছে নানান বিষয়।
আর সে সব বিষয়ের যোগসূত্র হচ্ছে ‘মানুষ’। মানুষকেই সরদার ফজলুল করিম তুলে এনেছেন, লেখার ভেতরে তিনি মানুষকেই উপস্থাপন করেছেন। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর ‘সঙ্গ প্রসঙ্গের লেখা’ বইটিতেও রয়েছে মানুষ।
সরদার ফজলুল করিমের জীবনজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখার অনেকগুলোই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাতা থেকে চলে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। গ্রন্থভুক্ত হয়নি।
সে রকমই প্রায় হারিয়ে যাওয়া, দুষ্প্রাপ্য যে লেখাগুলো এখনও গ্রন্থভুক্ত হয়নি, সেই লেখাগুলো সংগৃহীত হয়ে তৈরি হয়েছে ‘সঙ্গ প্রসঙ্গে লেখা’ বইটি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ছোট কাগজ আর স্মারকগ্রন্থ থেকে সরদার ফজলুল করিমের অগ্রন্থিত এই প্রবন্ধগুলো সংগ্রহ করে গ্রন্থভুক্ত করার শ্রমসাধ্য কাজটি করেছেন শেখ রফিক।
সঙ্গ প্রসঙ্গে লেখা বইটিতে স্থান পেয়েছে সরদার ফজলুল করিমের সর্বমোট ঊনত্রিশটি প্রবন্ধ। সেই সঙ্গে পরিশিষ্ট অংশে রয়েছে সরদার ফজলুল করিমের ৮৬তম জন্মদিন উপলক্ষে অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদের লেখা ‘সরদার ফজলুল করিম : একজন বরেণ্য সুহৃদ’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ। সরদার ফজলুর করিমের লেখার স্বাদের পাশাপাশি এই প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে তাঁর সম্পর্কে পাঠকের জানার সুযোগ হবে।
অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, ‘আমাদের সরদার ফজলুল করিমও কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব নন। তিনিও এই সমাজ-সচেতন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত বিপ্লবী দার্শনিক। দেশের অগণিত দরিদ্র-নিপীড়িত জনগণের প্রতি তাঁর অসাধারণ মমত্ববোধ তাঁকে তাদের সঙ্গে একাত্মতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। তাই তিনি অকপটে ঘোষণা করতে দ্বিধা করেন না যে, তিনি কৃষকের সন্তান। ’ সরদার ফজলুল করিমের পুরো জীবনের কর্ম জুড়েই রয়েছে মানুষ।
তিনি এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘জীবিত মানুষের চেতনায় নবজন্ম ঘটে মৃত মানুষের’। তাই সরদার ফজলুল করিম তাঁর লেখায় মানুষের ‘মানুষ’ পরিচয়কেই তুলে এনেছেন বারবার। আমাদের আলোচ্য গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোতেও বার বার এই মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যায়। ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতির উদ্দেশে তেমনই একটি প্রবন্ধ। পাকিস্তান গণপরিষদে বক্তৃতা দান ও কার্যবিবরণীর ক্ষেত্রে লেখা ছিল : ‘কেবলমাত্র উর্দু অথবা ইংরেজিতেই পরিচালিত হবে।
’ গণপরিষদে কার্যবিবরণীর ভাষার ক্ষেত্রে সংশোধন এনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, ‘ কার্যবিবরণী উর্দু অথবা ইংরেজি অথবা বাংলাতে পরিচালিত হোক। তিনি গণপরিষদের সেই বক্তৃতায় আরও বলেছিলেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমার এই প্রস্তাব আমি কোন সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার মনোভাব থেকে পেশ করিনি। পূর্ববঙ্গ হিসেবে বাংলাকে যদি একটি প্রাদেশিক ভাষা বলা হয়, তবে এ কথা সত্য যে, আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা। ৬ কোটি ৯০ লাখ যদি সমগ্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধিবাসীর সংখ্যা হয়, তাহলে তার মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। সভাপতি মহোদয়, আপনিই বলুন, একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার নীতি কি হওয়া সঙ্গত? একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হবে সেই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষা।
আর সে কারণেই আমি মনে করি আমাদের রাষ্ট্রের ‘লিংগুয়া ফ্রাংকা’ বা প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে বাংলা। ’ ভাষা আন্দোলনের শহীদ রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতের নাম আমরা জানি। কিন্তু গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রথম যুক্তি উপস্থাপন করা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে খুব কম মানুষই মনে রেখেছে, খুব কম মানুষই তাঁর সম্পর্কে জানেন। সরদার ফজলুল করিম তাঁকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধটির শুরু করেন আমাদের ইতিহাসের আরেক স্মরণীয় মানুষকে স্মরণের মধ্য দিয়ে। তিনি প্রবন্ধের শুরুতেই বলেন, ‘ইতিহাসকে দিয়ে কথা কওয়াতে চেয়েছিলেন অবিস্মরণীয় একটি মানুষ।
তাঁর নাম হাসান হাফিজুর রহমান। যে হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর সেকালের সাথী যুবলীগের মুহম্মদ সুলতানের সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন ২১-এর প্রথম স্মৃতিবার্ষিকীতেই ‘একুশের সংকলন’। ... হাসানের আর এক অমর কীর্তি : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র নামে ১৫ খণ্ডের দলিল ভান্ডার বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করার কীর্তি। ’... প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থা ও সরকারের কাছ থেকে এই কর্মের জন্য হাসান পেয়েছেন ও পাচ্ছেন বিস্মরণ এবং অকৃতজ্ঞতা। ’ সরদার ফজলুল করিমের এই আক্ষেপ, এই কষ্টের সমাধান হয়নি।
হাসান হাফিজুর রহমান, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আজ আমাদের বিস্মরণেরই অন্য নাম। সঙ্গ প্রসঙ্গের লেখা বইটিতে এমনিভাবে একাত্ম হয়ে আছে ইতিহাস এবং ইতিহাসের মানুষ। শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে নিয়ে দুটি প্রবন্ধ রয়েছে বইটিতে। দুটি লেখাই তিনি লিখেছিলেন শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা স্মারক গ্রন্থে। ‘শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা’ এবং ‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’ শিরোনামের প্রবন্ধ দুটি থেকে শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা সম্পর্কে জেনে নিতে পাঠকের অসুবিধা হয় না।
এমনিভাবে সরদার ফজুলল করিমের এই গ্রন্থে একে একে উঠে এসেছেন মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, আবদুস শহীদ, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, সত্যেন সেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, সত্যেন সেন, সোমেন চন্দ্র, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, হেনা দাস, জাহানারা ইমাম প্রমুখ। এই লেখাগুলোর মাধ্যমে সরদার ফজলুল করিম যেমন তুলে এনেছেন তাঁর ‘মানুষ’, তেমনি এঁদের জীবনের দর্শন, মহৎ কীর্তি যা তাঁদেরকে স্মরণীয় করে রেখেছে। সরদার ফজলুল করিমের প্রবন্ধের ভাষা সবসময় প্রাঞ্জল। যাকে অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমদ বর্ণনা করেছেন এভাবে ‘একজন গবেষক ও সৃজনশীল লেখক হিসেবে সরদার ফজলুল করিম অসামান্য অবদান রেখেছেন। সরদার সাহেবের ভাষা ও রচনাশৈলী এত সহজ, সুন্দর ও আকর্ষণীয় যে কেবল সুধীমহলে নয়, সাধারণ পাঠকের কাছেও অসাধারণ প্রশংসা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
একজন লেখকের জন্য এটা বিরাট সাফল্য। ’ সেই সাফল্যই ধরা রয়েছে সঙ্গ প্রসঙ্গের লেখা বইটিতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।