আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শরতের শিউলি

বসন্ত শেষ। ঢলে পড়া সূর্যের আবীরী রঙে প্রকৃতি যেন এইমাত্র নেয়ে উঠছে। পৃথিবী সবুজ শাড়িতে যেন হলির ছটা। বাতাসের বুকে কেবলি ধুলি আর ধুলি। প্রান্তরের ধুলি ভেসে আসছে গ্রাম থেকে গ্রামে।

রাস্তা ঘাটের বেপরোয়া ভাব। গরমে অতিষ্ঠ জন প্রাণী। মাগুরা জেলা শহর। স্টেশনে একটা গাড়ি থামল। ব্যাগ কাঁধে নামল দুজন সন্ন্যাসী।

ওদের চোখে মুখে ক্লান্তির রেখা। শেষ বয়সী সন্ন্যাসীর পা যেন আর চলে না। আরেকজন তরুণ; যৌবনের প্রথম সীমান্তে পা দিয়েছে। কপালে বড় বড় তিলক চিহ্ন ঘামের সাথে নেমে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। পিছনের টিক্কিটি নির্দেশনা দিচ্ছে পথ আর কত বাকি।

আজ মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশী। চারিদিকে লোকের কোলাহল। যেন পাহাড় ডিঙিয়ে একটা মৃত্যুর মশাল ভেসে আসছে। রিকসা শান্তি ক্লিনিক পর্যন্ত এলো না। শান্তি ক্লিনিকের পাশ দিয়ে দলে দলে লোক ছুটছে।

কাল থেকে শুরু হবে মহানাম সংকীর্তন। রাস্তার চারপাশে শুধু দোকান আর দোকান। নাগর দোলার ক্যাচ্ ক্যাচ্ আওয়াজে চারিদিক বিমোহিত। সন্ন্যাসী দুজন মন্দিরে প্রবেশ করল। সাত দোয়া মন্দির।

পিছনে নবগঙ্গা সামনে মাগুরা যশোর রোড। রোডের পাশ দিয়ে আঁকা বাঁকা হয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে বাঁশবাগানের দিকে। বাঁশবাগান আর নদীর তীর ধরে গড়ে উঠছে একটা শ্মশান। শ্মশানের ছাই নবগঙ্গার জলে ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়। নবগঙ্গার সিক্ত শিকর যেন ঈশ্বরের অহংকার দিয়ে সৃষ্টি।

পশ্চিম থেকে পুবে চলে গেছে নবগঙ্গার গতিপথ। শিবানন্দ গুরুজীকে সবাই জায়গা করে দিল। পোটলা পুটলি নামিয়ে মন্দিরের পাশে সন্ন্যাসী দুজন বিশ্রাম নিচ্ছিল। শিবানন্দ গুরুজী তরুণ সন্ন্যাসীকে বলল, "শরৎ, স্নান করার ব্যবস্থা কর। " তরুণ সন্ন্যাসী পুটলি হতে একখণ্ড ধূতি বের করে দিল।

গুরুজী তেল চাইল। কয়েকজন তাকে তেল মালিশ করে দিতে ছিল। একজন মেয়ে ওদের পাশে দাঁড়াল। তার ইচ্ছে গুরুজীকে একটু তেল মালিশ করে জীবনকে ধন্য করার। একজন বলল, "এই, তুই গুরুজীকে ছুসনা।

" মেয়েটি খানিক দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল। গুরুজী নামাবলীখানা হাতে ধরে নদীর দিকে রওনা হলো। মন্দির থেকে পথটি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেছে নবগঙ্গার জলে। সিঁড়ির স্তরে স্তরে বসে আছে আরো কত নাম না জানা সাধু।

গুরুজী স্নান করে এলো। ল্যাংঠা বাবাজির মূর্তির পাশে হাত জোর করে খানিক সময় দাঁড়াল। তারপর ফিরে এসে কাপড় পাল্টাল। একজন এসে বলল, "গুরুজী, প্রসাদের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। " অনেক প্রকার ফলমূল হাজির করা হলো।

গুরুজীর নির্দেশে সেগুলো কাটা হলো। গুরুজী প্রসাদ বানিয়ে কয়েকজনকে দিল। প্রসাদ সেবনের পর লোকজন গুরুজীকে ঘিরে ধরল। তরুণ সন্ন্যাসী বাইরে এসে বেদীর উপর বসল। তার ক্লান্তদেহ যেন নিঃশেষে ঢলে পড়তে চায় বেদীর উপর।

নবগঙ্গার নতুন হাওয়া গায়ে লাগছে। গুরুজীর কথা শুনে সবাই ভাবে বিভোর। সবার চোখ গুরুজীর মুখের দিকে। একজনের হাত দেখে গুরুজী বলল, "তোর মঙ্গল হবে। একদিকে গুরু আরেক দিকে রবি।

বিদ্যা আর বুদ্ধি তোর জীবনকে ধনে জনে ভরে তুলবে। " পাশের মেয়েটির হাত দেখানোর সাধ হলো। কিন্তু আগের কথাটি মনে পড়ায় আর সাহস পেল না। ওর গুরুজীকে স্পর্শ করা নিষেধ। ও বাইরে এসে যুবক সন্ন্যাসীর পাশে বসেই বলল, "ছোট গোসাই, তুই আমার হাত দেখে দিবি?" শরৎ আতংকিত হয়ে উঠল।

পাশে হাত বাড়িয়ে দেওয়া ডাগর চোখের মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটি নিষ্পলক ওর দিকে তাকিয়ে আছে। "আমিতো হাত দেখতে পারি না। " মেয়েটির মনে যেন ও কথা মানল না। "তুই যা বলবি তাই হবে।

" হাত খানা আরো এগিয়ে দিল। শরৎ উপায়ন্ত না দেখে বলল "তুই বড় ভাগ্যবতী হবি। " "হাততো দেখলি না?" "হাত দেখে রেখা গোণা যায় ভাগ্য দেখা যায় না। " মেয়েটি শরতের দিকে গভীর ভাবে তাকাল। কথায় যেন ওর মন ভরল না।

মেয়েটা চলে গেল। কিছু দূরে গিয়ে আবার একটু দাঁড়াল। ভাবল এরা সত্যি মহাপুরুষ। আমাকে স্পর্শ করল না। আমি মন্দ ওরা জানে।

মেয়েটি শপথ নিল আর কোনদিন মন্দ কাজ করবে না। "ছোট গোসা'র কথা যেন সত্যি হয়। " এ কথা ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ওর সমস্ত বুককে কাঁপিয়ে তুলল। কীর্তন আসরের পশ্চিম পাশে বসছে জুয়ার আসর। সেলিম শেখই জুয়ার আসরের প্রধান নায়ক।

ওর কথার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। পুব পাশে গাজার আসর। ওখানে মাঝে মাঝে মদও চলে। মদ গাজার মজলিসই বেশি জমে উঠছে। গ্রামীণকর্তা হরিহরণ হলো ঐ আসরের প্রধান।

আজ গান উপলক্ষ্যে এক নতুন বাবু ওদের সাথে যোগ দিয়েছে গাজার আসরে। বাবুটি মধ্য বয়সী। টপ ফিগারের। তিনি গাজার কল্কিতে টান দিয়েই বলল, "হারে ভাই,এই মহাপ্রসাদ না পেলে জীবন যে বৃথা। " গ্রামীণকর্তা হরিহরণ মাথাটা একটু খাড়া করল।

হাতের আঙ্গুল নির্দেশ করে বলল, "হারে শালার পো, মহাপ্রসাদ এখনও দেখনি। " ঢুলতে ঢুলতে আরেকজন বলল, "আসলে, শিউলি নটী ছাড়া শুধু মদ ভাঙ্গে পোষায় না। " পাশের আরেকজন ওকে থামিয়ে, "ঠিক বলছিস। শিউলি যেন একেবারে বিলেতী মাল। কাশ্মেরী আপেলের মত সরোষ।

দেখলেই গা তরাস করে ওঠে। শালী জিনিস এক্ষাণ। " বাবুটি হা করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের কথায় তার গা তিরিঙ তিরিঙ করছে। ভোগ বিলাসীরা ভোগের মাধ্যমে খুঁজে পায় তার জীবনের স্বর্গীয় সুখ।

বাবুজি বলল, "শিউলি কে?" মোহিনী লাফ দিয়ে উঠেই, "শালার পো মাল চেনে না। " মোহিনীকে থামিয়ে হরিহরণ বলল, "পকেটে মাল আছে? থাকলে এক ঝাঁকি হয়ে যাক। " আরেকজন কল্কি এগিয়ে দিয়ে, "মোহিনী, আগুনটা ধরিয়ে দে তো। শালী শিউলির গরম নিঃশ্বাসের কথা ভাবতে ভাবতে কল্কিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। " বাবুজি ওদের মুখের পানে তাকিয়ে দু'শো টাকা বের করে দিল।

হরি হরণ বলল, "মোহিনী, যা তো ভাই, শিউলি সুন্দরীকে ঠিক করে নিয়ে আয়। আজ বড় মাথ হবে। শালার রাই-চরণের কৃষ্ণনামের চেয়ে মধুর ঐ শিউলির উত্তপ্ত নিঃশ্বাস। ওর উন্নত দেহ যেন মন মাতানো হরিনাম। আর আমরা সবাই হরির নামের মতুয়া।

কি বলো বসন্ত?" বসন্ত বলল, "ওতো বৃন্দাবনের রাধে। ও আছে বলে আজও কল্কিতে ধোয়া ওড়ে। " শিউলি আসরের পাশে দাঁড়িয়ে নাম কীর্তন শুনছিল আর শরতের কথাটি ভাবছিল। এই সময় মোহিনী এসে ডাকল। শিউলির খারাপ লাগল।

মোহিনী কাছে এসে, "এই শিউলি শোন। " শিউলি দাঁড়িয়ে আছে। "দূর হতে এক বাবু আইছে। তারে খুশি করবি। আয়, শোন।

বেশ মালও পাবি। " শিউলি মোহিনীর দিকে বাঁকা চোখে তাকাল। "এইতো লক্ষ্মী মেয়ে, কথা শুনছে। " "না। আমি আর ওকাম করব না।

কথা দিয়েছি। " "দু'শো টাকা পাবি। " টাকার কথায় শিউলি দমে গেল। দু'শো টাকা। ও একটু ভাবল।

টাকার লোভে তার সমস্ত যৌবন চেতনাকে মাতিয়ে তুলল। ভোগের নেশায় সারা দেহ চিনচিন করে কাঁপছে। দেহ পসারিণীর দেহে চায় আসঙ্গের আনন্দ, মিলনের অনুভূতি। টাকার অঙ্কে ওদের দেহ উত্থলিত হয়। ভোগের নেশা মদের নেশার চেয়েও কঠিন।

"আজ প্রতিজ্ঞা করছি। আজকের দিনটা বাদ গেলে হয় না?" "বাবু কি কাল আসবে। তুই এতো টাকা পাবি?" ''কোথায় যেতে হবে?" "ঐতো, ঐ বাঁশ বাগানের আড়ালে। হরিহরণ বাবুর আড্ডায়। " "তুই যা আমি আইছি।

" রাত ভোর হলো। শিউলি নবগঙ্গার জলে নেমে বলল, "গঙ্গা, তুই আমার সব অপকর্ম মুছে দে। আমি যেন ভাগ্যবতী হতে পারি। " স্নান সেরে মন্দিরের পাশে এসে দাঁড়াল। মন্দিরে লোকজন গিজ গিজ করছে।

শিউলির নজর পড়ল ছোট গোসা'র নিটল নিখুঁত টলটলে দেহের দিকে। গৌরবর্ণের ঝলক দিচ্ছে তার সমস্ত অঙ্গে। সুন্দর দেহ দেখলে দেহ পসারিণীর দেহ ভোগের আনন্দে ভরে ওঠে। ওদের চোখ মুখের জ্যোতি পালটে যায়। হরিণ শিকারি বাঘের মত ওরা মাতাল হয়ে ওঠে।

শিউলি নিষ্পলক শরতের উদোম দেহের পানে তাকিয়ে থাকে। ওর মন ভরে ওঠে ভিন্ন এক স্বাদে গন্ধে। লোকজন ঠেলা ঠেলি করে ঢুকছে। গানের আসরে নতুন গায়ক এসেছে। শিবানন্দ গুরুজী আসরের মাঝে বসে আছে।

শিউলি ধীরে ধীরে গানের আসরের দিকে হেঁটে এলো। ওর দেহে জ্বালা খেলছে উত্তপ্ত অনুভবের। শরৎ বেদীর উপর বসে আছে। শিউলি এসে পাশে দাঁড়াল। শরৎ নদীর দিকে তাকিয়ে আছে।

ওর শরীরের উপর যে নামাবলী তার ভিতর দিয়ে সুগঠিত শরীর দেখা যাচ্ছে। ছোট শিশু যেমন মোয়ার পানে তাকিয়ে থাকে শিউলিও তেমনি তাকিয়ে আছে ছোট গোসা'র দেহের দিকে। ওর চোখে মুখে ভিন্ন জ্যোতি। শিউলি শরতের পাশে বসল। বলল, "ছোট গোসাই, আমি কিভাবে ভাগ্যবতী হব?" হাত খানা ছোট গোসা'র দিকে বাড়িয়ে দিল।

ছোট গোসাই শিউলির দিকে তাকাল। ওর কামনায় ভরে ওঠা চোখের দিকে তাকালে ছোট গোসা'র মনে ভাবের পরিবর্তন হলো। নারী স্পর্শেরে বাইরের যুবক যদি কামনাময়ী নারীর পাশে আসে তবে তারা পুর্ব স্মৃতি ভুলে যায়। ছোট গোসাই শিউলির হাত ধরল। মোহিনী কয়েকজনকে বলে দিল।

কিছু লোক ওর দিকে তাকাল। সে তাকানো কিছুটা ভিন্ন। এরপর শিউলি প্রায়ই শরতের কাছে আসে। শরতের সাথে ওর বেশ ভাব। মোহিনী কিন্তু সহ্য করতে পারল না।

সে হরিহরণ বাবুর কাছে নালিশ জানাল। হরি হরণ কিছুই বলল না। পরদিন আবার শিউলি এল। শরৎ বেদীর উপর বসে ছিল। নবগঙ্গার অপরূপ সৌন্দর্যে শরতের মন প্রাণ জুড়িয়ে গেছে।

নবগঙ্গার তীর যেন স্বর্গের সাধনার স্থান। সাত দোয়া মন্দির যেন পারিজাত বাগানের জলসা। শিউলি শরতের পাশে দাঁড়িয়ে একটু মুচকি হাসল। সে হাসি যেন নরসুন্দরের ক্ষুরের মত ধারাল। শরৎ শিউলির দিকে তাকাল।

বন ঝাউয়ের মত ওর শরীর যেন সামান্য বাতাসে দোল খাচ্ছে। হঠাৎ করে শরতের পাশে সে বসে পড়ল। খিল খিল করে হাসল। সে হাসিতে যেন সারা বুক কাঁপছে। উন্নত বুক নারীর সৌন্দর্য বর্ধন করে।

পুরুষের আবেগকে জ্বালাময়ী আগুনে পরিণত করে। উন্নত বুক সুন্দরীর সৌন্দর্যের প্রতীক। শিউলি বলল, "ছোট গোসাই, আমার ঘরে যাবি?" শরৎ কোন জবাব দিল না। শিউলির দিকে তাকিয়েই থাকল। শিউলিও নাবালিকার মত এমোর ওমোর ঘুরছে।

গানের আসরের লোকও দু'একজন ওদের সামনে জড়ো হয়েছে। কেউ কোন কথা বলছে না। একজন এসে শিউলিকে তাড়িয়ে দিল। শরৎ বুঝতে পারল না কেন ওকে তাড়িয়ে দিল। মেয়েটা তো বড় ভালো।

মন খোলা কথা বলে। মেয়েদের সান্নিধ্য ছাড়া পুরুষেরা মেয়েদের কাছাকাছি এলে মেয়েদের বড় ভালো লাগে। মনে হয় ভগবানের সাধনার চেয়ে ওদের সান্নিধ্য অধিক প্রিয়। নির্ভাবনা মনে একটা ভাবনার সৃষ্টি হয়। শরতের মনে শিউলি মেয়েটা বড় প্রিয় হয়ে উঠছে।

বেদীর উপর বসে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। আকাশ রঙ ছড়াচ্ছে। একটা রঙ মুছে নতুন রঙ ধারণ করছে। আকাশের বুকে সব রঙই যেন সুন্দর। গান তিন দিন চলল।

এর মাঝেই শরতের বসন্ত উঠল। সারা গা ভরে গেল। গুরুজী ভাবল, এ বড় সাংঘাতিক ব্যাপার। গ্রামীণকর্তা হরিহরণ গুরুজীর কাছে এসে সব কথা বলল। "ছোট গোসাই যে পাপ করছে তাতে এ সামান্য কিছু।

সন্ন্যাসী হয়ে নষ্টা মেয়ের সাথে বেহায়াপনা। তুমি গুরুজী সময় থাকতে কেটে পড়। " সন্ধ্যায় গুরুজী কেটে পড়ল। শরৎ গুরুজীর অপেক্ষায় আছে। রাত বেড়ে উঠছে।

গুরুজীর প্রসাদ এখনও মিলছে না। শরতের বেশ ক্ষুধা লাগছে। রাত ঘন এবং গভীর হয়ে সমস্ত পৃথিবীকে ঘিরে ধরছে। আকাশের তারাগুলি মিটমিট চোখে পৃথিবীকে দেখছে। শিউলি বেদীর উপর বসে দেখল আজ মন্দিরে আলো জ্বলেনি।

শিউলি মন্দিরের ভিতর ঢুকল। বাতি জ্বালাল। ছোট গোসাই মন্দিরের এক কোণায় শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে বলল, "ছোট গোসাই, আজ মন্দিরে আলো জ্বালাসনি কেন?" "আমিতো কিছু জানি না। আমার গা খুব ব্যথা করছে।

আজ যেন মন্দিরে কেউ আসবে না। " "তুই খাইছিস?" "গুরুজীতো প্রসাদ নিয়ে আসেনি। " শিউলি কিছু সময় ভাবল। তারপর শরতের কাছে গিয়ে বসল। শরতের মুখ বড় কোমল।

শিউলি বলল, "ছোট গোসাই, আমি তোরে ছোব?" "কেন?" "তোর মনে হয় বসন্ত হইছে। আর এই বসন্তের ভয়ে কেউ মন্দিরে আসে নাই। তুই থাক আমি তোর প্রসাদ নিয়ে আসি। " শিউলি চলে গেল। শরৎ ভাবল গুরুজী আমাকে না বলে চলে গেল? কেউ আমার খবর নিল না? গুরুজী শিখিয়েছে, মানুষের সেবা করাই ধর্ম।

উনি আমাকে রেখে গেল কেন? আমাকে কি ভুল মন্ত্র শিখিয়েছে? থালায় কিছু ফল নিয়ে শিউলি ফিরে এলো। ওগুলো মন্দিরেই ছিল। শিউলি বলল, "ছোট গোসাই, আমি এগুলো কেটে দেই?" শরৎ কোন জবাব দিল না। শিউলি সব কিছু কেটে প্রসাদ বানিয়ে দিল। ছোট গোসাই কষ্ট করে উঠে বসল।

গুরুজীর শিখানো কতগুলো মন্ত্র পাঠ করল। তারপর মুখে দিল। শিউলি বলল, "ছোট গোসাই, তুই আমাকে একটু প্রসাদ দিবি?" শিউলি হাত তুলল। শরৎ তার হাতে কিছু প্রসাদ দিল। শিউলি প্রসাদে একটা প্রণাম করে একখণ্ড প্রসাদ মুখে দিল।

শরৎ বলল, "জীবের কল্যাণ কামনাই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সাধনা। " "আমি ভাগ্যবতী হব ছোট গোসাই। তোর কথা আমি রাখব। " শিউলি শরতের শিয়রে বসে থাকল। শরৎ আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল।

মোহিনী দেখল মন্দিরে আলো। ধীরে ধীরে জানালার কাছে গেল। দেখল ছোট গোসা'র শিয়রে বসে শিউলি ঘুমের ঢুল খাচ্ছে। ও কিছু না বলে চলে গেল। রাত ভোর হলো।

মন্দিরের সামনে লোকজন ধরে না। ছোট গোসাইকে মন্দির থেকে বের করে দেবে। শিউলি তার সাথে রাত কাটিয়েছে। মন্দিরই অপবিত্র হয়ে গেছে। মন্দিরকে নবগঙ্গার জল দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

মোহিনী মন্দিরের ভিতর ঢুকে বলল, "ছি! ছি!! ছোট গোসাই, তুইও এই কাজ করতে পারলি?" আরেকজন বলল, "যোবন বয়সে সাধু হলে এমনি হয়। " "যাও, এখন ওঘরেই যাও। রঙ্গোতো আর কম দেখালে না। " "মা গঙ্গা আর কত কি দেখাবি। কলি যেন ঘোর কলি হয়ে গেছে।

" বিভিন্ন মতবাদে শরতের কান ঝালা ফালা হয়ে যাচ্ছে। ও বুঝতে পারছে না শিউলি আবার কি দোষ করল। শিউলি না থাকলে যে মন্দিরে একটা লাশ পড়ে থাকতো তা কেউ ভাবছে না। শিউলিকেও তাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু গ্রামীণকর্তা হরিহরণ বলল, "না, শিউলি থাক।

ওতো আমাদেরই মেয়ে। ওর কোন দোষ নেই। " শিউলি শুনল তার জন্য ছোট গোসাইকে মন্দ কথা বলছে। ও ধীরে ধীরে মন্দিরের দিকে হেঁটে এল। কেউ তাকে মন্দিরে ঢুকতে দিল না।

শিউলি অনেক বাধা বিপত্তি ঠেলে মন্দিরে ঢুকে গেল। শরতের কাছে এসে বলল, "ছোট গোসাই, তুই আমার ঘরে যাবি? ওরা তোকে বদনাম দিলেও আমি তোকে কোন দিন বদনাম দেব না। তোর গায় কালি মাখব না। কথা দিলাম। " বাইরে থেকে ধ্বনি হলো, "যাও যাও।

ওর সাথেই যাও। ও ঘরে না গেলে মরবে কেন? মা গঙ্গা, তুই একি শুনালি। ও মোহিনী, তুই একটু এগিয়ে দিয়ে আয়। মন্দিরটা একটু পবিত্র হোক। " মোহিনী একটু এগিয়ে দিয়ে এল।

লোকজনের যেন ঢল নামছে। এই র্কীতি দেখার জন্য ঠেলা ঠেলি শুরু হয়েছে। মুখে মুখে রটে গেছে গোটা এলাকা। শিউলির ঘরে এনে মোহিনী চলে গেল। শিউলি তার ঘরের সুন্দর পাটিটা তাকে পেতে দিল।

বলল, "ছোট গোসাই, তোর এখানে কোন কষ্ট হবে না। আমি তোরে ভালো করে তুলব। " মন্দিরে লোকজন বাড়তে থাকলেও শিউলির কুটিরের দিকে কেউ আসছে না। ছোয়াচে রোগ বলে কথা। মোহিনীকে স্নান করে যেতে হলো।

শরৎ শিউলির ঘরে শুয়ে নীরবে তাকাচ্ছে। শিউলি বাজারের দিকে যাচ্ছে। পথে লোকের ভীর। ভীর ঠেলে ও চলছে। ছোট গোসাই এখনও না খেয়ে আছে।

ভীড়ের পাশ দিয়ে যেতে একজন বলল, "শালী নাগর এক্ষাণ পাইছে। " "ওর কপাল খুলে গেছে। " "ধরলি কি ভাবেরে?" শিউলি কোন কথায় কান দিল না। বাজার থেকে কিছু ফল কিনে বাড়ি ফিরল। ফলগুলো ধুয়ে বটিটা নিয়ে ছোট গোসা’র কাছে এলো।

বলল, "আজ আমি প্রসাদ বানিয়ে দেই। তুই আমারে মন্ত্র শিখে দে। " শরৎ শিউলির দিকে একবার তাকাল। শিউলি শরতের দিকে আর তাকাল না। নীরবে প্রসাদ খেয়ে চলছে।

রাত নেমে এল। সন্ধ্যার ঘন্টা বাজতেই যেন অন্ধকার নামল। শিউলি শরতের শিয়রে বসে আছে। পুব আকাশে চাঁদ উঁকি দিয়েছে। নবগঙ্গা আঁকা বাঁকা হয়ে চলছে দূর সীমানায়।

মাঝি মাল্লারা দাড় টানতে টানতে গানের আওয়াজ তুলছে। আকাশ যেন উপুর হয়ে মিটমিট চোখে পৃথিবীর নীরব দৃশ্য দেখছে। নবগঙ্গার জেলেরা মিট্মিট্ আলো জ্বেলে চিংড়ি মাছ ধরছে। এ নৌকা থেকে ঐ নৌকায় ভেসে চলছে মাঝিদের আওয়াজ। রাত যত গভীর হয় ওদের আলো তত বড় হয়।

শিউলি বলল, "ছোট গোসাই, তোর ক্যামন লাগছে?" "ভালো। তুই শুয়ে পড়। আমার জন্য জেগে তোর কি লাভ?" "আমি কেবল লাভের জন্য করি না। " "তোর নাম কি?" "শিউলি। তয় সবাই... .. .. .. .. ..।

" "ক। " "না। তোর কাছে ও নাম বলব না। " "তোর কে কে আছে?" "কেউ নেই। " শিউলি খানিক নীরব থাকল।

শরৎ বলল, "তুই বিয়া করিস নাই?" "হয়নি। " "তুই একা থাকিস?" "হ। " শিউলির মন যৌবন এত দিন টাকার গন্ধে ভরে উঠত। আজ যেন একটা গভীর মমতায় ওর বুক ফুলে উঠছে। এত দিন ছোটা ছুটি করলেও আজ আর ছোটা ছুটি করতে ইচ্ছে করছে না।

নিজেকে নীরবে দান করতে ইচ্ছে করছে। মাঝে মাঝেই যেন নিজেকে ভুলে মনের মধ্যে অন্য কিছু ভেসে উঠছে আর মন ধীরে ধীরে তার ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। রাত্রি ভোর হলো। শিউলি ঘুম থেকে জাগল। শরৎ এখনও জাগেনি।

শিউলি ওকে ডাকল না। কিছু ফুল এনে শরৎকে ডাকল। শরৎ ঘুম থেকে জাগল। উঠতে তার দারুণ কষ্ট হলো। শিউলির ভাঙ্গা বেড়ার আড়াল দিয়ে সূর্য রশ্মি প্রবেশ করছে।

কাছের লোকজন বসন্তের ভয়ে সরে গেছে। গঙ্গার গভীর নেশা কেটে জল টলমল করে উঠছে। শিউলি বলল, "ছোট গোসাই, তোর জন্য ফুল আনছি। " শরৎ শিউলির দিকে এক পলক তাকাল। ওর মুখে যেন হাসির জলসা ঘর।

চিরকালের এক শান্তি ওর ঠোঁটে লেগে পড়ছে। ওর চোখে শুভাগমনের আনন্দ। শরৎ বলল, "ফুল দিয়ে কি হবে?" "পুজো করবি। " "যাকে মন্দির থেকে বের করে দেয় তার আর পূজা হয় না। " শিউলি পাশে বসে, "নিজের দোষ অন্যকে দিসনা।

" "দেবী মন্দিরে নাই। " শিউলি এবার নিষ্পলক শরতের দিকে তাকাল। ওর চোখে যেন সংসারের সমস্ত শাসনের ভয়। "তুই আমার ভাঙ্গা ঘরেই পুজো কর ছোট গোসাই। " "তাই করব।

যে আমার রোগ শয্যার শিয়রে অসীম মমতায় রাত্রি জাগে, আমার জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার স্বপ্নের গল্প লেখে সেইতো আমার দেবী। আমার চিরকালের সত্য, ইহকালের ঈশ্বর। " শিউলি নিষ্পলক শরতের দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে পলক নামিয়ে বলল, "ছোট গোসাই, আজ তোরে আমি সাজিয়ে দেই। আমি এত দিন যে ফুল তুলেছি তা ছিড়ে ফেলার জন্য।

আজ আমি পুজোর জন্য ফুল এনেছি। তুই তোর দেবতাকে পুজো না করলে আমি আমার ছোট গোসা’র পুজো করি। " শরৎ কোন কথা বলল না। শিউলি শরৎকে সাজিয়ে দিল। "তুই আমারে ভালোবাসলি কেন? আমিতো চলে যাব।

" শিউলি ক্ষণিক থেমে থেকে, "আমি তোর সাথে যাব। দূরে কোথাও এই নবগঙ্গার তীরে ঘর বাঁধব। " "আমিতো ঘর বাঁধতে পারি না। " "আমি তোর ঘর বেঁধে দেব। " শরৎ শিউলির দিকে তাকাল।

বলল, "সন্ন্যাসীরতো ঘর হয় না। " শিউলি শরতের সন্ন্যাসী বেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, "আমি তোরে আমার ঘরে বেঁধে রাখব। সন্ন্যাসীর স্রোতে ভেসে যেতে দেব না। " শরৎ কোন কথা বলে না।

শিউলির মুখপানে তাকিয়ে থাকে। ওর মুখখানা যেন বড়ো মসৃণ। ওর মনে কোন খেদ নেই। ঘন বর্ষার ধারার মত যৌবন টলমল করছে। কঁচি শশার মত লকলক করছে তার অঙ্গের আবেগ।

দেহ পসারিণীর দেহ, দেহ মিলনে যৌবনাবেগ প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠে। আগলানো যৌবন দেহকে কুড়ে কুড়ে নষ্ট করে দেয়। শিউলির অনাবৃত যৌবন আঁচড় আর আসঙ্গে মলিন হয়ে গেছে। শিউলি বেদীর উপর বসে আছে। কাল থেকে ছোট গোসাইকে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।

বিদেশী বাবুর দু'শো টাকা ফুরিয়ে গেছে। ছোট গোসাইকে ক্ষুধার জ্বালা দেওয়া যাবে না। নবগঙ্গার শীতল বাতাস তাকে এলোকেশী করে তুলছে। বার বার ওর মাথায় একটা প্রশ্ন জেগে উঠছে, জীবন এমন কেন? তার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরপাক খাচ্ছে। মোহিনী এসে বলল, "তুই এখানে বইছিস কেন?" শিউলি উঠল।

মোহিনী বলল, "শোন। বড়ো বাবু আজ আবার তোরে যাইতে কইছে। আমি কইছি, শিউলি আর ও কাম করবে না। দেখ, গেলে হয়তো একটু বেশি দিতে বলতে পারি। তাছাড়া তোর ঘরে রোগী।

" শিউলি নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। মোহিনী আবার বলল, "কিরে, ছোট গোসা’র সাথে আবার শুরু করলি নাকি? ও সব গোসাই দেখে বিশ্বাস নাই। " মোহিনী চলে গেল। শিউলি নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল। মনে মনে ভাবল, ছোট গোসাই যদি আমার যৌবনের দিকে তাকাতো তবে আমার জীবন যৌবন নিয়ে ওর জীবনে ভেসে যেতাম।

শিউলি সিঁড়ি দিয়ে নবগঙ্গার জলে নেমে গেল। হাত জোড় করে বলল, "গঙ্গাদেবী, আমার কথা আমি ফিরে নিচ্ছি। আমার ছোট গোসাইকে আমি বাঁচাতে চাই। সে আমার গণিকার অহংকারই হোক আর তোর কৃপাই হোক। " আবার রাত নেমে এল।

ছোট গোসা’র ঘা বেড়ে উঠছে। বাইরের বাতাস তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। শিউলি সারাক্ষণ শিয়রে বসে আছে। ঘুমে ঢুল খাচ্ছে আবার মাথা খাড়া করছে। ছোট গোসাই তার হাতখানা ধরে বলল, "শিউলি, আমি যদি মরে যাই?" শিউলির সারা গা আতংকে কেঁপে উঠল।

বলল, "ও কথা বলিস না ছোট গোসাই, আমি কষ্ট পাই। " শিউলি শরতের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। ভাঙ্গা বেড়ার আড়াল দিয়ে মোহিনী তাকে ইশারায় ডাকে। এই নিদারুণ সময় শরৎ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে ঘুম আসে না।

শিউলি অনেক কষ্ট করেও ওর ঘুম আনতে পারছে না। শরতের ঘুমের ভাব আসে। হঠাৎ দরজার বেড়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখল শিউলি বেরিয়ে যাচ্ছে। ও উঠে ভাঙ্গা বেড়ার আড়ালে এসে দাঁড়াল।

বাইরের শীতল বাতাসে গা অসহ্য যন্ত্রণা করছে। দেখল শিউলি দু'টো লোকের সাথে কথা বলছে। তারপর আঁকা বাঁকা পথ ধরে চলছে বাঁশ বাগানের দিকে। শরৎ ভাঙ্গা বেড়ার আড়লে দাঁড়িয়ে থাকল। চাঁদের আলো পুব আকাশ থেকে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে।

শরৎ তাকিয়ে আছে বাঁশ বাগানের দিকে। আলো ঝলমল করছে বাঁশ বাগানের উপর। ঐ এতটুকু আঁধারের নিচে চলছে কত রঙ বেরঙ্গের খেলা। আঁকা বাঁকা পথটি সাপের মত চলছে বাঁশ বাগানের অন্ধকার গুহায়। চাঁদের আলো গুহার মুখে প্রবেশ করলেও ভিতরে প্রবেশ করতে পারছে না।

শরৎ নবগঙ্গার দিকে নজর দিল। সোজা রাস্তাটি নেমে গেছে ঘাটের দিকে। ঘাটের আঁকা বাঁকা সিঁড়ি নেমে গেছে নবগঙ্গার জলে। জোছনার আলোয় ঝলমল করছে নবগঙ্গার নিটোল জল। কখন যেন শরতের চোখে জল এল।

ও দেখল শিউলি ফিরছে। ও আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। শিউলি এসে শরতের মাথায় হাত দিল। কাঁথা গায় অথচ্ গা ঠাণ্ডা এবং থর থর করে কাঁপছে। বলল, "কেমন লাগছে ছোট গোসাই?" শরৎ কোন কথা বলল না।

শিউলি দেখল শরৎ কাঁদছে। ও বিছানা পাতল। কিন্তু ঘুম কিছুতেই এলো না। আবার শরতের কাছে এলো। না আসলে ওর মন যেন আর থাকতে পারছে না।

শরৎকে বুকে জড়িয়ে বলল, "ছোট গোসাই, তোর জন্য আমি আমার সব বিলিয়ে দিতে পারি। ওরা তোকে শান্তি ক্লিনিকে নিয়ে যাবে। হাসপাতালে ভর্তি করে দেবে। তুই তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবি। " শিউলি শরৎকে রেখে নিজের বিছানায় এলো।

ওর ও কান্না পেল। ছোট গোসাই ওর জন্য কাঁদছে। ছোট গোসাইও তাকে ভালোবাসে। শিউলি উঠে এসে ভাঙ্গা বেড়ার পাশে দাঁড়াল। বাঁশ বাগানের মাথায় চাঁদ মাথা উঁচু করে হাসছে।

আঁকা বাঁকা পথটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ও পথ যেন শিউলির জীবনের গতি পথ। ও পথের বাঁকে বাঁকেই ওর কিছু না কিছু রয়ে গেছে। ওর গচ্ছিত সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছে। ছোট গোসাই তাকে ভালোবাসে এ কথা ভাবতেই ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে গেল।

বাঁশ বাগানের ঐ স্বল্প আলোর মাঝেই তার জীবনের অমৃত সূধা শেষ হয়ে গেছে। আকাশের ঐ নীরব আলো আস্তে আস্তে আঁধার হয়ে এলো। শিউলি দাঁড়িয়ে আছে। পুব আকাশে আলো ভেসে উঠছে। ভোর হয়ে এলো।

শরৎ ঘুমে আছে। শিউলি স্নান করে ভেজা কাপড়ে কতগুলি ফুল তুলে আনল। ছোট গোসা'র ঘা বেড়ে উঠছে। শিউলি সব কিছু গুছিয়ে উলূর ধ্বনি দিল। ছোট গোসাই চোখ খুলল।

ওর মুখে চিকন হাসি। ও দেখল শিউলির ভেজা কাপরের জল গড়িয়ে তার হাতে কাছে পৌঁছে গেছে। উলূর ধ্বনির পর নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। শিউলি পূজার পর শরতের কাছে এসে বলল, "প্রসাদ নাও। " শরৎ শিউলির দিকে তাকিয়ে থাকল।

শিউলি বলল, "আমি গঙ্গা স্নান করে আইছি। " শরৎ হাত বাড়িয়ে দিল। শিউলি কিছু প্রসাদ দিল। তার পর বলল, "আজ আমি সাজব। " শিউলি সাজতে লাগল।

দিন যেন বদলে গেছে। শিউলি সেজে শরতের গা ঘেষে বসল। গুণগুণিয়ে গান ধরল। পরে বলল, "একটা গান গাই?" "গা। " "না।

" "কেন?" "আমি যে তোর কৃষ্ণ নাম জানিনা। " "কি গান জানিস?" "ভালোবাসার। " "গা। " শিউলি গান ধরল। "শুধু এইটুকু থাক বাকী হে প্রিয় হে বন্ধু, শুধু এইটুকু থাক বাকী তোমার সাথে আমার মিলন সেই আলপনা আঁকি, শুধু এই আলপনা আঁকি।

" শরৎ নীরবে গান শুনছে। শিউলি গেয়েই চলছে। ওর চোখে কোন পলক নেই। শরৎ নীরব হয়ে গেছে। দিনের আলো বেড়ে চলছে।

এ ঘরের দিকে কেউ আসে না। বসন্তের কাছে সবাই ভীতু। আবার রাত্রি নেমে এলে। শরৎ শিউলির কোলে মাথা পেতে শুয়ে আছে। শিউলি বলল, "আমি গণিকা।

আমার মা ছিল হরিহরণ বাবুর রক্ষিতা। আমার বাবা এক বিষাক্ত নেশার বীজ। টাকা আমার ভালোবাসার বিদ্যাপীঠ। আমার অপকর্মই তোর জীবনের পূর্ণ তীর্থ হয়ে থাক। তুইতো আমাকে ভাগ্যবতী বলেছিস।

আমার ভাগ্য এমনই। " মোহিনী ভাঙ্গা বেড়ার আড়াল দিয়ে ডাকল। শরৎও সে ডাক শুনল। শিউলি শরতের মাথা বালিশে রেখে বেরিয়ে গেল। শরতের গা দারুণ ব্যথা করছে।

ওঠার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তবু কষ্ট করে ভাঙ্গা বেড়ার আড়ালে দাঁড়াল। চারিদিকে আঁধার। একটু পরে জোছনা জ্বলবে। দূরে দু'টি মূর্তি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।

"আজ কোন বাবু আইছে?" শিউলি বলল। "হ। এক বাবু আইছে। " শিউলি মোহিনীর সাথে হেঁটে চলল। দূরের ঝিঁ ঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে।

তার ভিড় ঠেলে আর একটা নিদারুণ আওয়াজ শরতের বুকে এসে লাগছে। বুক চিরে বেরিয়ে আসছে গাজার আসরের কলোরব, অশ্রাব্য গালি। শিউলি হয়তো ওর মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। মরা লাশের মত শিয়াল কুকুর টেনে হিঁচড়ে খাচ্ছে ওর গলিত দেহ। একটা গভীর রাতের কান্না শরতের সমস্ত বুককে আঁকড়িয়ে ধরছে।

একটা অসহ্য যন্ত্রণায় ওর সমস্ত দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। শিউলির জন্য একটা মোহ তার সন্ন্যাস জীবনকে মায়াময় করে তুলছে। নবগঙ্গার ঘাট ফাঁকা। বটগাছটি সঙ্গীহীন একা দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের আলো বেশ খানিক জায়গা আলোকিত করে রাখছে।

ভগবান তাঁর শরৎকে চিনল না। গোবিন্দ তাকে গণিকার ঘরে গৃহবন্ধী করে গেল। শরৎ বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাত্রি বেড়েই চলছে। শিউলি ফিরছে না।

শরতের সারা দেহে অসহ্য যন্ত্রণা। জ্বরে সারা গা থর থর করে কাঁপছে। মনে কষ্ট নিয়ে কখনও ঘুম আসে না। শরৎ ভাবল, রাত কেন আসে? রাতের আঁধার এতো নিষ্ঠুর কেন? রাত মানুষকে দেয় শান্তি শরৎকে দিচ্ছে শাস্তি। শিউলি ফিরে এলো।

শরতের গায় হাত দিয়ে দেখল প্রচণ্ড জ্বর। শিউলি বলল, "ছোট গোসাই, তুই বাতাসে গিয়েছিলি?" শরৎ কোন কথা বলল না। "তোর জন্য আমার সব বিসর্জন দিতে পারি আর তুই আমার জন্য বাঁচতে পারবি না?" শিউলি শরৎকে বুকে জড়িয়ে ধরল, চোখের জল মুছিয়ে দিল। শরৎ ভাবল, শিউলির এই অপবিত্র দেহ ভগবানের নামের চেয়েও বেশি পবিত্র, বেশি সত্য। আমার রোগ শয্যার দীর্ঘঃশ্বাস যার জীবনের অহংকার সেই আমার অমৃতময়ী দেবী।

আমার সন্ন্যাস জীবনের সাধনা। গণিকার গয়নাই হোক এ সন্ন্যাস জীবনের তিলক চিহ্ন। আমি তাকে আমার ললাটে এঁকে রাখব। জানব এ আমার অহংকার। আমার পথ চলার নির্দেশনা।

শরৎ শিউলিকে বুকে চেপে ধরল। ওর ললাটে কতগুলি চুমু খেল। শিউলি কোন বাধা দিল না। শিউলিকে অনেকেই বুকে চেপে ধরছে। সে কেবল দলিত, নিঃষ্পেষিত করার জন্য।

কারো বুকে বুক রেখে এত সুখ মেলেনি। আবেগে শিউলির দু'চোখ বুজে এলো। সারা গা থর থর করে কাঁপছে। শিউলি আস্তে আস্তে ঠোঁট মিশিয়ে দিল শরতের ঠোঁটে। রাত ভোর হলো।

শরৎকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। শিউলির ঘরের পাশে একটা ভ্যান এসে থামল। শিউলি শরৎকে গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেল। শিউলি বলল, "ছোট গোসাই, তুই ভালো হয়ে গেলে আমি তোকে নিয়ে যাব। ওরা হয়তো রাত্রে আমাকে আসতে দেবে না।

হরিহরণের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছি। আমার আরো টাকার দরকার। " শরৎ শিউলির দিকে তাকিয়ে থাকল। শিউলির জন্য তাকে বাঁচতে হবে। আবার তাকে ফিরতে হবে গণিকার অহংকার হিসাবে।

দিন চলছে। শরৎ ধীরে ধীরে ভালো হয়ে উঠছে। হাসপাতালের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আজ কত দিন হলো শিউলি আসে না। ওর মুখখানা যেন অচেনা হয়ে গেছে।

এ জানালা দিয়ে বাঁশ ঝাড় দেখা যায় না। যে পথটি আঁকা বাঁকা হয়ে নেমে গেছে নবগঙ্গার জলে তাও। বেদীর পাশে বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে যে ছায়া মূর্তিটি আরেকটি ছায়ার মুখোমুখি হয়ে জীবন বিলিয়ে জীবিকার সন্ধান নিচ্ছে, যার নিজেস্ব সব ক্ষুয়ে গড়ে তুলছে তার ভালোবাসার হৃদয়ের শান্তি, আরেক জীবনের সাধনা তাকে দেখা যাচ্ছে না। শরতের সামনে ভেসে এলো সেই আঁকা বাঁকা পথ। সাপের মত বাঁশ বাগানের ভিতর দিয়ে চলে গেছে।

শিউলি তার টাকার পুরুষের হাত ধরে এঁকে বেঁকে চলছে নিজেকে হারানোর জলসায়। শরৎকে ছাড়পত্র দিল। কিন্তু শিউলি এলো না। এ ক’টা দিনেই শরৎকে ভুলে গেল? দেহ উপজীবীনীর কাছে এই কি পরম সত্য? পাশে আছো কাছে আছো, দূরে গেছো মুছে গেছো। ভোগেই ওদের আনন্দ।

দেহ উপজীবীনী ভোগের মাঝে ভরে তোলে তাদের জীবন ও যৌবন। ভোগের নেশায় ওরা পাগল হয়ে ওঠে। ওদের জীবনের কোন সঞ্চয় নেই। দেহ মিলনেই ওদের সুখ, ওদের আনন্দ, ওদের ঐশ্বর্য। আট পৌর শাড়ি যেমন প্রতিদিন ব্যবহার করতে হয় তেমনি প্রতিদিন দেহ মিলন না ঘটলে ওদের দেহের জ্বালা কমে না।

ওরা শান্তি পায় না। টাকার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াই ওদের ধর্ম। ওরা ঈশ্বরের অবাঞ্চিত, ওদের বাঁচার ভিতর কোন অহংকার নেই। শরতের ফিরতে ইচ্ছে করল না। রাত্রি নেমে গেছে।

শরৎ এসে বেদীর উপর বসল। দেখল মোহিনী আসছে। ও মোহিনীকে ডাকল। মোহিনী কাছে এসে, "ছোট গোসাই যে?" "হ। " "তা ব্যাপার কি?" শরৎ একটু ভাবল, ভোগে যদি এতই আনন্দ আমি ভোগ করতে চাই।

হাত থেকে শিউলির দেওয়া আংটি খুলে, "এটা কিনবি?" "কেন, ছোট গোসাই?" "আমি আজ রাতে শিউলিকে চাই। " মোহিনী হাসতে হাসতে, "সে কি ছোট গোসাই? শিউলিতো ও কাজ বাদ দিয়েছে। " "যে কোন মূল্যে হোক আমি ওকে চাই। " "ঠিক আছে আমি যাই। " মোহিনী চলে গেল।

শরৎ দাঁড়িয়ে আছে। ওর সারা শরীর কাঁপছে। ও দেখল ওর দিকে একটা ছায়া মূর্তি হেঁটে আসছে। জোছনার আলোতে ওকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। শরতের মুখের চেহারাও পাল্টে গেছে।

শিউলি কাছে গিয়ে দাঁড়াতে শরৎ পিছন ফিরে দাঁড়াল। "কে?" "আমি। " "ছোট গোসাই! ছি! ছোট গোসাই। তুই এতো নীচ। আমি জানতাম না ছোট গোসাই, তুই আমার পঁচা গলা দেহের দিকে হাত বাড়িয়েছিস।

এত কিছু করে কি করলাম ছোট গোসাই? আমার ভালোবাসা কি এমন? তুই ও আমাকে গণিকার পাল্লায় উঠাতে পারলি? আমি কি এই ভেবে সেদিন তোকে সাজিয়ে ছিলাম? আমার ভালোবাসার দাম দিতে পারলি না। আমি আমার ছোট গোসাইকে ঠকাতে পারি না। আমার এ দেহে কিছু নেই। তবু তোর সাধ মিটাতাম। কিন্তু আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি।

আমার দেহে প্রবেশ করছে এক বিষাক্ত রক্ত, এক মরণ ব্যাধি। আমি তোর সাধ মিটাতে পারলাম না। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস। " শিউলি চলে গেল। শরৎ সে ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল।

তার ভাবনা পাল্টে গেল। ভোগে কোন আনন্দ নেই। রাত বেড়ে চলছে। শরৎ শিউলির ঘরে গেল। শিউলি ভাঙ্গা বেড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।

শরৎ পাশে গিয়ে দাঁড়াল। শিউলি শরতের বুকে ঢলে পড়ল। বলল, "আমি জানতাম না ছোট গোসাই, তোর আবার ভোগের সাধ জাগবে। তবে আমার সব কিছু এমন ভাবে বিলিয়ে দেতাম না। আমার আবার বাঁচতে ইচ্ছে করছে।

ছোট গোসাই, তোর সাধন জীবনে কি এতটুকু সঞ্চয় করতে পারিস নি? যে আমাকে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আনবি। " "শিউলি, ভগবান বড়োই কৃপণ। সে শুধু নিতে জানে দিতে জানে না। " "তুই হেরে গেলি ছোট গোসাই। আমি আমার গণিকার অহংকার দিয়ে তোকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এনেছি।

আর তুই তোর সাধন জীবনের পূণ্যি দিয়ে আমাকে ফিরাতে পারবি না। আমি গণিকা; সে আমার অহংকার, সে আমার উপহার। আমি আমার গণিকার অহংকারে আমার ছোট গোসাইকে ধরণী পাড়ে রেখে গেলাম। এই নবগঙ্গার তীর; এই নবগঙ্গার তীর ছিল আমার জীবনের গল্প, আমার নিত্য দিনের খেলা, আমার পথ চলা, আমার মায়ের ভালোবাসা। আমার ভালোবাসার সাধ মিটল না।

" ছোট গোসাই শিউলির জীবনের অতৃপ্ত আশার দিকে তাকিয়ে থাকল। শরৎ শিউলিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। শিউলির বুক ওর বুকে থর থর করে কাঁপছে। শিউলি বলল, "আমি চলে যাব। আমার জন্য আর কেউ তোকে কলঙ্ক দেবে না।

শরৎ বাকি থাকতেই আমি ঝরে গেলাম। তুই মনে করিস তোর শিউলি শরতের বুকে না ভেসে নবগঙ্গার জলে ভেসে গেল। শরতের কাননে আর কখনও ফুটবে না। আমি বলেছিলাম না, তোর গায় আমার কালি মাখব না। তাই হলো।

" শরৎ নির্বাক। ওর মুখে কোন কথা নেই। শিউলির চোখের জলে শরতের বুক ভিজে গেল। "ছোট গোসাই, আমি বাঁচতে চাই। তোর সাথে ঘর বাঁধতে চাই।

এ নবগঙ্গার তীরে না হয় অন্য কোথায়। " "চল মন্দিরে গিয়ে দয়া চাই। " দু'জনে মন্দিরে গেল। নতশিরে দাঁড়াল।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৪৯ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।