আমার ব্লগে স্বাগতম এসএসসি পরীক্ষা শুরু হল। আমার নিজের মামাতো ভাই এবার পরীক্ষার্থী। আমি নিজে যখন এই পরীক্ষাটি দিয়েছিলাম তখন দেখেছি, আমি নিজে যতটা না চিন্তিত ছিলাম তার চেয়ে আমার অভিভাবকগণ বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। আত্মীয়-স্বজন দেখতে এলেন, পরীক্ষার আগে আমার নানু (নানীকে আমি নানু বলি) এক পীর-সাহেবের কাছ থেকে কলম আর কালির দোয়াতে দোয়া নিয়ে এলেন। আমি তখন বলপয়েন্ট দিয়ে পরীক্ষা দিতাম না।
পরীক্ষা উপলক্ষে নূতন ফাউন্টেন পেনও পেয়েছিলাম। তখন ইয়োথ আর উইলসন বেশ ব্যবহার হত। আমি পরীক্ষা উপলক্ষে পেয়েছিলাম হিরো।
দেশের এই বোর্ড পরীক্ষা ব্যবস্থাটাও আমার কাছে আজব মনে হয়। সারাজীবন নিজের স্কুলে পড়াশোনা করলাম কিন্তু ফাইনাল এসএসসি দিতে হবে অন্য স্কুলে গিয়ে।
আমার মামা পরীক্ষা শুরুর আগেই সিট দেখে আসল। আমার সিট পড়েছিল ঢাকার সেগুন-বাগিচা হাই স্কুলে। এমনিতেই এটি স্কুলের কোন পরীক্ষা নয়, বোর্ড-ভিত্তিক পরীক্ষা। তারউপরে সীট পড়বে অন্য স্কুলে। সেই স্কুল কেমন? স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা কেমন - কিছুই জানা নেই।
অর্থাৎ যত প্রকারের চাপ একটা কোমলমতি পরীক্ষার্থীকে দেওয়া যায়, তার সব ব্যবস্থাই আছে। জানি না, এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে কবে?
এবার মামাতো ভাইয়ের প্রসঙ্গে আসি। তার বেলায়ও একই অবস্থা। সবাই তাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। আমার আম্মি আমেরিকা থেকে পরীক্ষার দিন সকালে বাংলাদেশে ফোন দিয়ে কথা বলল, আমি কথা বললাম।
দু-একদিন আগেই সে বলছিল যে তার কেমন জানি ভয় ভয় করছে। আমরা তাকে অভয় দিলাম। সে অবশ্য স্কুলের মেধাবী ছাত্রদের কাতারেই পড়ে। তার সিট পড়েছে ঢাকার নবাবপুর হাই স্কুলে। প্রথম পরীক্ষা বাংলা প্রথম পত্র।
যথাসময়ে তাকে নিয়ে পরীক্ষাস্থলে হাজির হল তার আম্মু। সাথে আমাদের আরো অনেক আত্মীয়-স্বজনও গেল। দুরু দুরু মন। পরীক্ষা শুরু। পরীক্ষার খাতা দেবার পর যথাসময়ে প্রশ্নপত্র দেওয়া হল।
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখে আমার ভাইটির মাথা গরম!
একি ! গতবৎসরের প্রশ্নপত্র বিলি করা হয়েছে !!
আমার মনে পড়ে, আমরা আগে সবসময়ে আগের বৎসরগুলির প্রশ্নপত্র সমাধান করতাম। হয়তবা আমার ভাইটিও করেছিল, তাই প্রশ্ন দেখেই সে বুঝে গিয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার হল, সবার ক্ষেত্রে এটি ঘটে নাই। এমনকি একই রুমে কেউ কেউ ঠিক প্রশ্নপত্রই পেয়েছে, আবার কেউ কেউ গত বৎসরেরটা পেয়েছে। আমার ভাইটি তখন পাশের পরীক্ষার্থীকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল যে, তার প্রশ্নপত্রে আছে কিনা? না, নেই।
সে কর্তব্যরত শিক্ষককে বলল যে, তাকে গত বৎসরের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছে, সে একটি নির্দিষ্ট প্রশ্ন উল্লেখ করে বলল যে, এটি তার প্রশ্নপত্রে নাই যা নাকি অন্যজনের প্রশ্নপত্রে আছে।
কিন্তু বিধি বাম ! শিক্ষক দিল একটা ধমক - প্রশ্ন ঠিকই আছে, খুঁজে দেখ।
আমরা জানি - পরীক্ষা হলে প্রতিটা মিনিট কতটা গুরুত্বপূর্ণ ? আর পরীক্ষাটা যদি বাংলা হয়, তাহলে তো কোন কথাই নেই। তাছাড়া বাংলাদেশে শিক্ষকের সাথে তর্ক করাটাও বেয়াদবি। আমার ভাইটি তর্কাতর্কি বাদ দিয়ে লেখা শুরু করে দিল।
কিন্তু তার মনে একটা খচখচ থেকেই গেল যে, যদি ভুল প্রশ্নপত্র হয় তাহলে তো সে ফেল হয়ে যাবে। তাই মিনিট বিশেক পর সে আবার পরীক্ষা হলে পাহাড়াদনরত শিক্ষককে বলল যে, স্যার আমার মনে হয় প্রশ্নটা ভুল।
নাহ, কোন লাভ নেই। আবার ধমক ! কী আর করা, সে আবার লেখা শুরু করল।
এমন সময় হঠাৎ করেই অন্য কক্ষ থেকে একই অভিযোগ উঠল এবং অন্যকক্ষগুলোতেও এটা আবিষ্কৃত হয়েছে যে, ছাত্র-ছাত্রীর বিরাট একটি অংশ ভুল প্রশ্নপত্র পেয়েছে।
তাদের রুমেও অন্য শিক্ষকরা এসে জিজ্ঞেস করল - কে কে ভুল প্রশ্নপত্র পেয়েছে? কিন্তু হায়, এরই মধ্যে ৫০ মিনিট পার হয়ে গিয়েছে !
বোর্ড-ভিত্তিক এই পরীক্ষাটি অন্য একটা স্কুলে দিতে এসে এমনিতেই মনে টেনশন। এরই মধ্যে যদি ভুল প্রশ্নপত্র বিলি করা হয় এবং ৫০ মিনিট পর তা সংশোধন করা হয়, তাহলে এই বাড়তি টেনশনে তাদের পরীক্ষা ভালো হবে কী? নাটকের এখানেই শেষ নয় ! ঘোষণা করা হল যে, ১৫ মিনিট বেশী সময় দেয়া হবে কারণ বোর্ড কর্তৃপক্ষ নাকি ১৫ মিনিটের বেশী দিবে না। ৫০ মিনিট নষ্ট হওয়ায় কোমলমতি পরীক্ষার্থীদের মনে যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য তো দুই ঘণ্টা বেশি দেওয়া উচিত। তা না করে ৫০ মিনিটের জায়গায় ১৫ মিনিট !! এটা কি সত্যিই বোর্ডের নিয়ম নাকি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তৈরিকৃত নিয়ম? আমার খালা ও মামির ভাষ্যমতে, অনেক শিক্ষার্থীই পরীক্ষা শেষে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়েছে। আমার ভাইটির পরীক্ষাটিও সময়ের অভাবে প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি।
এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাড়তি টেনশনে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে কম সময়ে সবগুলো উত্তর লেখা কোনভাবেই সম্ভব নয়। জীবনের প্রথম চ্যালেঞ্জটিতেই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা একটি দুষিত সিস্টেমের শিকার হল!
এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষায় ভুল প্রশ্নপত্র বিলি হয় কীভাবে? যারা দায়িত্বে আছেন তারা কি বোঝেন না যে, এই পরীক্ষাটি একজন শিক্ষার্থীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তারা কি জানেন না যে, ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতে (বুয়েট, মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয়) অংশগ্রহণের জন্য বোর্ডের এই পরীক্ষাটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ?
সঞ্চয় রহমান
ফেব্রুয়ারী ০১, ২০১২ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।