Shams
উড্রো উইলসন একবার বলেছিলেন, “কোনও একটি দেশকে যদি বয়কট করে রাখা যায়, তাহলে সে দেশ বাধ্য হবে আত্মসমর্পণ করতে। অন্তত একবার শান্তিপূর্ণ অথচ অর্থনৈতিক, আপাত অসহায় অথচ মারাত্মক অব্যর্থ এই কৌশল প্রয়োগ করে দেখুন, বাহুবলের আর কোনও প্রয়োজনই হবে না। ” আবার এই মন্তব্যেরই বিরোধিতা করে প্রায় এক দশক পরে গ্যাবন-এর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওমর বঙ্গো বলেন, “একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ কিংবা জাতিসংঘ যখন কোনও অর্থনৈতিক অবরোধ বলবত করে তা আসলে কোনও একটি বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের বিশেষ রাজত্বকে প্রায় ধ্বংস করে দেওয়াই নামান্তর। এ তো সরাসরি দাদাগিরি। নিরীহ মানুষগুলিতে বিনা কারণে শাস্তি দেওয়ার সামিল!” এটাই বাস্তব।
অর্থনৈতিক অবরোধ কিংবা বয়কট শব্দটির অর্থ সময়ের সাথে প্রায় একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। এবং আজ এর অভিপ্রেত একমাত্র স্ট্যাটেজিক উদ্দেশ্যপূরণ, আর কিছু নয়।
যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী দেশগুলি (মূলত ইজরায়েল) আজ ইরানকে সাঁড়াশি আক্রমণে ঘিরে ধরেছে বলা যায়। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক অবরোধ জারি করার পর সম্প্রতি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ওবামা সরকার ইরান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সঙ্গে সমস্তরকম অর্থনৈতিক লেনদেনের উপর কড়া অবরোধ ঘোষণা করল। এতদিন যা ছিল নৈতিক পর্যায়ে, এবার তা আইন।
এতে অবধারিতভাবেই ইরানের সরকারি মুদ্রা রিয়ালের মূল্য প্রায় তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এই অর্থনৈতিক অবরোধের জঘন্যতম দিকটি হল: ইরান এমনকি অন্য কোনও দেশকেও নিজের মূল সম্পদ খনিজ তেল বিক্রি করতে পারছে না।
ইরানের উপর এই যে সাম্প্রতিক অবরোধ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রশাসন যে কারণ দেখাচ্ছে, তা নাকি শুধুই ইরানের আয়ের রাস্তাটা আংশিক বন্ধ করে দেওয়া এবং পরোক্ষে এই দেশের পারমাণবিক কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করা। বলাই বাহুল্য, কারণটা অত্যন্ত বোকা-বোকা এবং শিশুসুলভ। উত্তর কোরিয়ার উপরও তো সেই একই চেষ্টা চালানো হয়েছিল, কিন্তু সে দেশের পারমাণবিক উন্নয়ন কি আটকানো গেছে? যুক্তরাষ্ট্র এমনটা আশাই বা করে কী করে?
কিউবার সঙ্গে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক ধরেই বাণিজ্যিক অবরোধ বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
কী হয়েছে তার ফলাফল। ২০১০-এর সেপ্টেম্বরে ওবামা নিজমুখেই তার ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছেন। এর অনেক আগে পাকিস্তানের উপর সমরাস্ত্র ব্যবসায় অবরোধ জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত দীর্ঘ পনেরো বছর এফ-সিক্টটিন ফাইটার! বোম্বার কেনাবেচায় অবরোধ ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র)। কিন্তু তাতে কি পাকিস্তানের অন্য দেশ থেকে সমরাস্ত্র কেনা বন্ধ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে প্রাথমিকভাবে যে উদ্দেশের কথা বলে অর্থনৈতিক কিংবা এই জাতীয় অবরোধ ঘোষণা করা হয়েছে, পরিস্থিতি তাতে বুমেরাং-ই হয়েছে।
১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় যে অর্থনৈতিক অবরোধপ্রক্রিয়া চালু ছিল বহু মানবাধিকার লঙ্ঘনের রিপোর্ট উঠে এসেছ সেখান থেকে। হাইতি (১৯৯০-১৯৯৪), ইরাক (১৯৯০-২০০৩) কিংবা তৎকালীন যুগোশ্লোভিয়ার (১৯৯২) ক্ষেত্রেও একই ঘটনার সাক্ষী থেকেছি আমরা। কিউবা, ইরান, জিম্বাবুয়ে অথবা উত্তর কোরিয়ার মত তথাকথিত ‘অপরাধপ্রবণ’ দেশে অর্থনৈতিক অবরোধে আর কিছু না হোক সেখানকার হতদরিদ্র মানুষের দুর্দশা আরও বেড়েছে বই কমেনি।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যা সার্বিক চেহারা তাতে কেবল অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে করে কোনও দেশের সরকার বদল করা সম্ভব নয়। তা সে যুগোশ্লোভিয়ার মিলোসেভিচ হোক কিংবা ইরাকের সাদ্দাম হোসেন অথবা আফগানিস্তানের তালিবান গোষ্ঠীদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে গিয়ে ন্যাটো বাহিনীর সামনে সরাসরি যুদ্ধ ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না।
ইরাকে যখন অর্থনৈতিক অবরোধ চলছিল (১৯৯১-২০০১) কমপক্ষে দশ লক্ষ সাধারণ ইরাকির প্রাণ যায় বেঘোরে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যাদের দুর্বলতর করে দেওয়ার উদ্দেশে এই অর্থনৈতিক অবরোধের নীতিগ্রহণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখা গেছে। বিশেষত অর্থনৈতিক অবরোধের সময়টাকে কাজে লাগিয়েই দুর্নীতি, স্মাগলিং, কালোবাজারি, অবৈধ সমরাস্ত্র কেনাবেচা করে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু কেবলই তেল-সমৃদ্ধ দেশের উপর দাদাগিরিরি নেশায় মেতেছে, সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আজ স্বমূর্তিতে কঙ্গো, আঙ্গোলা, সোমালিয়া এবং আরও বেশ কিছু দেশ।
ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক্সের ২০০৩ সালের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে সারা বিশ্বের বিচারে অর্থনৈতিক অবরোধের সাফল্যের হার মাত্র ৩৩%।
আর ২০১০ সালে তাদেরই রিপোর্ট বলছে, যুক্তরাষ্ট্রর ক্ষেত্রে এই মারাত্মক বৈদেশিক নীতিগ্রহণের সাফল্য মাত্র ১৩%।
কোনও সন্দেহ নেই, এই অর্থনৈতিক অবরোধ অনতিবিলম্বেই ইরানসহ তার প্রতিবেশী বেশ কিছু রাষ্ট্রের স্বার্থে চরম আঘাত হানতে চলেছে। খনিজ তেলের এই মহাসঙ্কট শুধু ভারত, চীন কিংবা ইউরোপের উপরই ঘনিয়ে আসবে না, ইরানের সঙ্গে যে সমস্ত দেশের দ্বিপাক্ষিক অথবা বহুপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে, খাঁড়ার ঘা পড়বে তাদের উপরেও।
ইরানের অস্তিত্ব বেশিরভাগটাই দাঁড়িয়ে আছে তার খনিজ তৈলসম্পদের উপর। আইএমএফ-এর সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, ইরানের সারা বছরের যা বাজেট, তার অর্ধেক আসে এই তৈলসম্পদের বাণিজ্য থেকেই।
তাই বলাই বাহুল্য, এই তৈলসম্পদের উপরই যুক্তরাষ্ট্রর লোভটা সবচেয়ে বেশি। নাহলে নিছকই সমাজকল্যাণের উদ্দেশে কোনও একটি দেশের বিশেষ একটি রাজত্বের অবসান ঘটাতে এতখানি হম্বিতম্বি করার বান্দা আর যেই হোক, যুক্তরাষ্ট্র নয়। আর একবার যদি, সে দেশের উপর কব্জা করা যায়, তাহলে সেই সুবিশাল তৈলসম্পদর নিজের হাতের মুঠোয়, যুক্তরাষ্ট্রর এই স্ট্র্যাটেজি বহুদিনের। নিশ্চয়ই ইরাক, আফগানিস্তানের কিংবা লিবিয়ার সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন? খুবই স্বাভাবিক। মার্কিন ডিফেন্স সেক্রেটারি স্বয়ং স্বীকার করেছেন, ইরান পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছে, এমন খবর তাদের কাছে এই মুহূর্তে নেই।
তাহলে কীসের এত নজরদারি? আসলে এই দ্বৈতসত্তাই যুক্তরাষ্ট্রর আসল চরিত্র।
তবে ওবামার এই ইরানস্বপ্ন কিন্তু খুব সহজে পূরণ হওয়ার নয়। কারণ অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ইরান অনেক বেশি শক্তপোক্ত অবস্থানে। ইরানের শতাব্দী লালিত আত্মসম্মান এবং লড়াকু মনোভাবকে কিন্তু কোনোভাবেই ছোট করা দেখা উচিত নয় যুক্তরাষ্ট্রর। আর এরকম পরিস্থিতিতে যুদ্ধ কিংবা আরও একটি অর্থনৈতিক অবরোধ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রর অর্থনৈতিক হালও যথেষ্ট খারাপ করে দিতে পারে।
ঠিক যেমনটা ঘটেছিল ইরাক কিংবা আফগানিস্তান যুদ্ধের সময়। ওবামা আশা করি ভালোই জানেন যে, এই জাতীয় পরিস্থিতিতে যিনি জিতলেন ধাক্কাটা তার বুকেই সবচেয়ে বেশি করে বাজে। যিনি হারলেন তার থেকেও বেশি। কিন্তু তেল নিয়ে কারবার যখন, - এক ছাঁচে ঢালাই ওবামা আর জর্জ বুশ! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।