সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বাংলাদেশি তিন তরুণকে হত্যার দায়ে আগামী ৩০ জানুয়ারির পর দুই বাংলাদেশি তরুণের শিরশ্ছেদ বুঝি আর এড়ানো গেল না। মৃত্যুদণ্ড এড়াতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্বজনদের সমঝোতার সর্বশেষ উদ্যোগও সফল হয়নি। সব ধরনের চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে।
এর আগে সরকারিভাবে ফটিকছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদে স্বজনহারা ও দণ্ডিতদের পরিবারের মধ্যে দুটি বৈঠকে সমঝোতার চেষ্টা চালানো হয়। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবারও সমঝোতার চেষ্টা চালানো হয়।
কিন্তু সন্তানহারা এক মা ফের সমঝোতার প্রস্তাব তুললে আত্মহত্যার হুমকি দেওয়ায় আর কোনো সমঝোতার পথ খোলা থাকল না।
জানা যায়, কর্মসংস্থান ও জনশক্তি রপ্তানিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ২৫ জানুয়ারি সমঝোতার জন্য বৈঠক ডাকেন। উদ্দেশ্য, দুবাইয়ে তিনজন বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশিকে অন্তত শিরশ্ছেদের দণ্ড থেকে রক্ষা করা। কিন্তু নিহত তিন বাংলাদেশির পরিবার থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। এ অবস্থায় জেলা প্রশাসক স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্বজনহারাদের সমঝোতা বা ক্ষমা প্রদর্শনে রাজি করানোর উদ্যোগ নিতে বলেন।
কিন্তু জেলা প্রশাসকের বেঁধে দেওয়া ২৭ জানুয়ারির মধ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উদ্যোগ নিয়ে সফল হতে পারেননি। এ অবস্থায় শিরশ্ছেদের মাধ্যমে দুই বাংলাদেশির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ কনস্যুলার জেনারেল আবু জাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, নিহতদের পরিবার খুনের বদলে খুন চাইলে তা-ই কার্যকর হবে। স্বজনহারা পরিবার অপরাধীদের ক্ষমা করলেই কেবল এ মৃত্যুদণ্ড এড়ানো সম্ভব। আর তাহলে সরকারিভাবে দেশের ভাবমূর্তিও কিছুটা বাড়ে।
দুবাই থেকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১৯ অক্টোবর দুবাইয়ের আদালত পৃথক দুটি ঘটনায় দুই বাংলাদেশির শিরশ্ছেদের আদেশ দেন। আদালতের রায়ে বলা হয়, করনিকের চাকরি দেওয়ার জন্য একটি ভিসার দাম তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু বিদেশে নিয়ে করনিকের চাকরি না দিয়ে নির্মাণ শ্রমিকের চাকরি দেওয়ায় সৃষ্ট বিরোধের জের ধরে খুন হন জামাল উদ্দিন মো. ইউনুছ (২৩)।
ঘটনাটি ঘটে ২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর। ফটিকছড়ির রোসাংগিরি গ্রামের কামাল উদ্দিনের ছেলে ইউনুছকে তিন টুকরো করে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় নানুপুর ইউনিয়নের মাইজভাণ্ডার গ্রামের হাজি আমির হামজার ছেলে শাহাবউদ্দিনকে পুলিশ আটক করে। শাহাবউদ্দিন দুবাই আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে। সে আদালতকে জানায়, পাওনা টাকা দেওয়ার কথা বলে ইউনুছকে দুবাইয়ের একটি নির্জন স্থানে নিয়ে সে মেরে আহত করে। পরে ফ্রিজিং সুবিধাযুক্ত কাভার্ড ভ্যানের ভেতর চার ঘণ্টার বেশি সময় আটকে রাখা হয়। এর পরও তাঁকে জীবিত দেখতে পেয়ে বুক ও পিঠে ছুরিকাঘাত এবং শেষে জবাই করা হয়।
পরে প্যাকেটে ভরে লাশ মরুভূমিতে ফেলে দেওয়া হয়।
নিহত ইউনুছের বাবা কামাল উদ্দিন গতকাল এ ঘটনার বিবরণ দিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হত্যার ১৫ দিন পর ইউনুছের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আমার আত্মীয়স্বজনরা লাশ শনাক্ত করে। ভিসা দিয়ে শাহাবউদ্দিন আমার ছেলের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। উল্টো সে আমার ছেলেকে খুন করেছে।
আমি তাকে কিভাবে ক্ষমা করব। ' ইউনুছের ভাই সোহেল বলেন, 'আমার ভাইকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। আমরা চাই, খুনির মৃত্যুও এভাবে হোক। '
'ক্ষমা করার আগে আত্মহত্যা করব'
দুবাইয়ে নিহত আইয়ুব ও তৈয়বের মা রোকেয়া বেগমকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আগে যে বাসায় থাকতেন সেখানে তিনি নেই।
গ্রামের বাড়িতে এ প্রতিবেদক গিয়ে দেখতে পান, ঘর তালাবদ্ধ। অভিযুক্তকে ক্ষমা করার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল আজম ও নগরীর আগ্রাবাদের কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলামও রোকেয়া বেগমকে খুঁজে পাননি। অথচ আর সবাই আছেন। বাড়িতে অনবরত কান্নার রোল। নিহত দুই ভাইয়ের ফুফু হাসিনা ও মমতাজ বেগম বলেন, 'আমাদের দুই ছেলেকে জবাই করা হয়েছে।
আর তারা এক ছেলের জীবন বাঁচাতে ক্ষমা চাচ্ছে। আমরা কোনো দিনও ক্ষমা করব না। '
ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল আজম ও কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ক্ষমার কথা বললে আইয়ুব ও তৈয়বের মা রোকেয়া বেগম আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছেন। রোকেয়া বলেছেন, সমঝোতা বা ক্ষমার অনুরোধ নিয়ে আর কেউ তাঁর কাছে গেলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। এরপর আমরা আর কী করতে পারি।
রোকেয়া বেগমের এ কথা আমরা জেলা প্রশাসককে জানিয়ে দিয়েছি। '
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের ছোট ছিলোনিয়া গ্রামের মৃত মো. শফির দুই ছেলে আইয়ুব ও তৈয়বকে ২০১১ সালের ২ মে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাস আল খাইমায় কুপিয়ে ও পরে জবাই করে হত্যা করা হয়। এ হত্যার দায়ে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ দায়রাপাড়ার হারুনুর রশিদকে আটক করে পুলিশ।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহামদ বলেন, 'স্বজনহারা পরিবার দুটিকে আরো বোঝানোর জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দিয়েছি। তাঁরাও ব্যর্থ হয়েছেন।
নিহতদের পরিবার খুনিদের ক্ষমা না করলে আমাদের কিছু করার নেই। '
কর্মসংস্থান ও জনশক্তি রপ্তানিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক জহিরুল ইসলাম মজুমদার জানান, নিহতদের পরিবার থেকে ক্ষমা নিতে পারলে দেশের জন্য ভালো হতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের জবরদস্তির সুযোগ নেই।
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, 'নিহতদের পরিবার থেকে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে তারা ক্ষমা করবে না। এর পরও আমরা বারবার চেষ্টা চালিয়েছি।
'
দুবাইয়ে বাংলাদেশ লেবার কোর্টের পরিচালক নাসরিন জাহান কলের কণ্ঠকে বলেন, 'শিরশ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব বর্তমানে দুবাইয়ে রয়েছেন। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বিষয়টির সুরাহা করতে। '
বাংলাদেশ কনস্যুলার জেনারেল আবু জাফর কালের কণ্ঠকে জানান, দুবাইয়ের ফৌজদারি আদালত পৃথক ঘটনায় দুই বাংলাদেশির শিরশ্ছেদের রায় দিয়েছেন। বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আপিলের রায় হবে ৩০ জানুয়ারি।
এর আগে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষমা আনা সম্ভব হলে সুবিধা হতো।
এদিকে দণ্ডিত শাহাবউদ্দিনের ঘরে গিয়ে দেখা যায় তার মা মমতাজ বেগম পাগলপ্রায়। কথা বলছেন উল্টোপাল্টা। এই হাসছেন, একটু পরই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। এ অবস্থায় নিজ থেকে দায়িত্ব নিয়ে নিহত জামাল উদ্দিন মো. ইউনুছের বাবাকে বোঝানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন নানুপুর ইউপি চেয়ারম্যান ওসমান গনি বাবু ও রোসাংগিরি ইউপি চেয়ারম্যান সফিউল আলম।
গতকাল তাঁরা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ব্যর্থ হয়েছি। '
ধারণা করা হচ্ছে, স্বজনহারাদের পরিবারের পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত ক্ষমা আনা সম্ভব না হলে ৩০ জানুয়ারির পর তিনজন খুনের দুই আসামি হারুনুর রশিদ ও শাহাবউদ্দিনকে আমিরাতে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
Daily Kaler Kantho
শেয়ার করা।
লিনক.।
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।