আফিয়া সিদ্দিক্বী! হ্যাঁ হ্যাঁ সেই জঙ্গি মেয়েটির কথা বলছি। স্কুলে পড়ার সময় এই জঙ্গি মেয়ের কথা পত্রিকায় পড়েছিলাম। আমেরিকার জন্য হুমকি সেই শান্ত শিষ্ট, ছোটখাট মেয়েটি। ঈমানের তাজা রক্তে টগবগ করে ফোটা প্রতিবাদী সেই মেয়েটি। আমেরিকান কুত্তাদের দ্বারা দিনের পর দিন ধর্ষিত হওয়া লাজুক মেয়েটি।
কুরানের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে কাপড় দেওয়া হবে এমন শর্তে আল্লাহু আকবর ধ্বনি তোলা মেয়েটির কথা বলছি।
তাঁর কিডনি সরিয়ে ফেলা হয়েছে, পুরা শরীর ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছে, তার অন্ত্রের কিছু অংশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে যেন খেতে না পারেন। আল্লাহু আকবর। একি আপনার আমার মুসলিম বোন নয়? এই জরাজীর্ণ শরীরে অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করা, জীবনের সবকিছু হারানো এই মুসলিম বোনের জন্য কি করেছি আমরা? কি করা উচিত ছিল আমাদের? লক্ষ লক্ষ আফিয়া সিদ্দ্বীকা, ফাতেমাদের আমরা কাফেরদের হাতে তুলে দিচ্ছি ধর্ষণের জন্য, কাটাকুটি করার জন্য। আমরা মুসলিম! আমি আমার সব মুসলিম ভাই বোনদের অনুরোধ প্লিজ এই লেখাটি নিজেরা পড়ে অন্য মুসলিম ভাই বোনদের কাছে পৌঁছে দিবেন।
For the sake of ALLAH, for the sake of our oppressed ummah.....
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আফিয়া সিদ্দিক্বীর ব্যাপারে আমি আপনাদেরকে একটা কথা জানাতে চাই, যারা এই মহিলাকে কাছ থেকে দেখেছেন, যারা ইসলামের জন্য তার ভালবাসা ও উৎসর্গের গল্পগাঁথা জানেন, তারা জানেন, ইসলামের জন্য আফিয়ার যে ত্যাগ, তা তিনি করে দেখিয়েছিলেন খুব সহজ আর সাদামাটাভাবে, কিন্ত, অল্প কিছু মানুষই এমন ত্যাগ স্বীকারের ক্ষমতা রাখে। ”
“সে নিরাপত্তার জন্য বিরাট হুমকিস্বরুপ”
-ক্রিস্টোফার লাভিন, সহকারী ইউএস এটর্নি, অগাস্টের ১১ তারিখে এ কথাটি তিনি বিচারককে উদ্দেশ্যে করে বলে ওঠেন যেন আফিয়াকে তার গুলিবিদ্ধ ক্ষতস্থানের চিকিৎসা থেকে বিরত রাখা হয়।
রাসূল (সাঃ) এর সময়ে যারা ইসলামে প্রবেশ করেছিল, তাদেরকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একদলে ছিল সেসব মুসলিম যারা ইসলাম গ্রহণের পর নিজ দেশ বা সমাজের মানুষদের সাথে থেকে গিয়েছিল, এবং সেখানে তাদের ধর্মচর্চা দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদির (নামায,রোযা,কলেমা ইত্যাদি) মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। আরো একদল মুসলিম ছিল, যারা দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হয় নি বরং তারা দ্বীনের খাতিরে হিজরাহ করেছিল, এবং রাসূল (সাঃ) এর সাথে সামরিক মহড়া এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ছুটে এসেছিল।
এমন একাধিক হাদীস আছে যেগুলো থেকে আমরা দেখতে পাই, রাসূল (সাঃ) এই দু’ধরণের মুসলিমদের সাথে একই রকম আচরণ করেন নি। যেমন, মুসলিম এবং আত-তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূল (সাঃ) যখন কোন বাহিনীর নেতা বা আমীর নির্বাচন করতেন, তখন তিনি তাদেরকে দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন শত্রুদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছে তাদের সাথে কী রুপ আচরণ করতে হবে, যেমন হাদীসে এভাবে এসেছে,
“... তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাও যেন তারা তাদের দেশ (ভূমি) ছেড়ে মুহাজিরীনদের ভূমিতে হিজরত করে চলে আসে,এবং তাদেরকে জানিয়ে দাও, যদি তারা এমনটি করে, তাহলে তারা মুহাজিরীনদের সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে। যদি তারা হিজরত করতে সম্মত না হয়, তাহলে তাদেরকে বলে দিও যে সেক্ষেত্রে তারা বেদুইনদের সমান মর্যাদা লাভ করবে, আর তাদের উপর আল্লাহ তা’আলার র অন্যান্য হুকুমগুলো প্রযোজ্য হবে যেগুলো অন্য মুসলিমদের উপরেও প্রযোজ্য হয়...”।
এই পার্থক্যকরণটি খুব সুস্পষ্ট, কেননা এখানে একটি দল যারা নিজের কাঁধে নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব তুলে নিতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছে, আর অপরদিকে অন্য যে দলটি আছে তাদের নিষ্ক্রিয়তা তাদেরকে ইসলামের ব্যাক্তিগত, বাঁধাধরা এবং ঝুঁকিমুক্ত নির্দিষ্ট কিছু কাজের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছে। মূলকথা হল, রাসূল (সাঃ) তৎকালীন মুসলিমদের ইসলামচর্চাকে দু’ভাগে ভাগ করেছিলেনঃ
মুহাজিরীনদের দ্বীন বা দ্বীন আল-মুহাজিরীন, যারা দ্বীনকে সহায়তা এবং বিজয় অর্জনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এবং বেদুইনদের দ্বীন বা দ্বীন আল-‘আরব, যারা কেবল দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়েই থাকতেন।
যদিও বা এ ছবিটি হাজার বছর আগের, তারপরেও এটি একটি চিরন্তন বাস্তবতা যে মুসলিমরা প্রতিটি যুগে এবং প্রতিটি সময়ে এ ধরণের ভাগসমূহে শ্রেণীভুক্ত হয়ে যাবে। কাজেই, যে কেউ লক্ষ করলে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের ইসলাম-পালন-করা-মুসলিমদের(practicing Muslims) মাঝেও এ পার্থক্যটি আবিষ্কার করবে। অতীতের সেই দ্বীন আল-‘আরাবকে তুলনা করা যেতে পারে সে ইসলামের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যে ইসলামচর্চা গতানুগতিক সেই পাঁচটি স্তম্ভ অর্থাৎ কালেমা-নামায-রোযা-যাকাত-হাজ্জ, হালালভাবে জবেহকৃত পশু খাওয়া আর স্থানীয় মসজিদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা-এসবের মাঝে সীমিত।
ভেবে দেখুন, এ ধরণের মুসলিমই যখন পশ্চিমা দেশে খুঁজে পাওয়া দায়, সেখানে সে সব মুসলিমদের দেখা পেলে আপনার চোখ আর মন কি আনন্দে ভেসে উঠবে না, যারা কিনা সেখানে থেকেও এক ধাপ এগিয়ে আছে এবং তারা দ্বীন আল-মুহাজিরীনদের দলে নিজেদের ঠাঁই করে নিয়েছে; যারা কিনা কেবল নিজেদের প্রথাগত ইবাদাতের মধ্যে আবদ্ধ নয়, বরং তাদের চিন্তার জগত পুরো উম্মাহকে জুড়ে বিস্তৃত, তাই তারা উঠে দাঁড়িয়েছে এবং ইসলামের সক্রিয় কর্মীতে পরিণত হয়েছে, রাতদিন তারা সাধ্যের সবটুকু ঠেলে দিয়ে খেটে যাচ্ছে আল্লাহর আরোপিত দায়িত্ব পালনে, তাদের উপর অন্যান্য ব্যস্ততা এসে যতই চেপে বসুক না কেন তারা তাতে ক্ষান্ত হয় না, বরং তাদের হৃদয় স্পন্দিত হয় তার মুসলিম ভাইবোনদের সাথে ঐকতানে, যারা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে জানে এবং পরোয়া করে না তাদের যারা কেবল খায় আর গবাদিপশুর মত বেঁচে থাকে, যেমন বলা হয়ে থাকে,
هكذاالاحرارفيدنياالعبيد
দাসত্বের এই দুনিয়ায় তারাই হল মুক্ত স্বাধীন ...
এমনই এক মানুষকে ঘিরে সারা বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় চলছে, শুকনো, ছোটখাট, কলেজের ছাত্রী, স্ত্রী, তিন সন্তানের মা সেই মানুষটি, নাম তার আফিয়া সিদ্দিক্বী।
আমি খুব করে চাই এ মানুষটির গল্পে যেন আপনি বাঁধা পড়ে যান এবং এও বুঝতে পারেন আমি কেন এ গল্পের মাঝে বাঁধা পড়ে আছি।
আমি চাই আপনি জেনে নিন দ্বীন ইসলামের জন্য এ মহিলাটির ভালবাসা আর উৎসর্গের গল্পগাঁথার কথা। যারা তাকে চেনেন, তারা জানেন, ইসলামের জন্য আফিয়ার যে ত্যাগ, তা তিনি করে দেখিয়েছিলেন খুব সহজ আর সাদামাটাভাবে, কিন্ত, অল্প কিছু মানুষইএমন ত্যাগ স্বীকারের ক্ষমতা রাখে।
আফিয়াকে যারা চেনেন, তাদের মনে আছে, আফিয়া ছিলেন ছোটখাট, শান্ত, ভদ্র এবং লাজুক এক নারী, হৈ-হুল্লোড় কিংবা সভাসমাবেশে খুব কমই তিনি মানুষের চোখে ধরা দিতেন। কিন্তু, প্রয়োজনের সময় তিনি ঠিকই সাড়া দিতেন, আর যে কথাগুলো বলা প্রয়োজন সেগুলো সবাইকে বলতেন। একবার বসনিয়ার এতিম শিশুদের জন্য তহবিল সংগ্রহের দরকার পড়ল, সেখানে স্থানীয় এক মসজিদে আফিয়া তার বক্তৃতায় কঠিন ভাষায় পুরুষদেরকে তিরস্কার করলেন এ কারণে যে পুরুষ হয়ে কেন তারা বসে আছে আর নারী হয়ে আফিয়াকে তহবিল সংগ্রহের কাজ করতে হচ্ছে।
তিনি সবার কাছে আর্তি জানালেন, “পুরুষরা কোথায়? আমাকে আজকে কেন একা দাঁড়িয়ে এসব কাজ করতে হচ্ছে ?”
তিনি ঠিকই বলেছিলেন, একজন মা, একজন স্ত্রী, একজন ছাত্রী হিসেবে এমন এক সমাজে বসবাস করতেন যেখানে এমন পুরুষদের ছড়াছড়ি, ইসলামী কাজকর্মের/দায়িত্বের বেলায় যাদের কোন সাড়াশব্দই ছিল না।
তিনি ছিলেন MIT এর ছাত্রী, তিনি সেখানে স্থানীয় মুসলিম কারাবন্দীদের কাছে কুরআনের কপি ও ইসলামী বই-পুস্তক গাড়িতে করে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। তিনি বাক্সে করে সেগুলো স্থানীয় মসজিদে পৌঁছে দিতেন, এবং তাকে দেখা যেত মসজিদের খাড়া সিঁড়ি বেয়ে পুরো তিন তলা পারি দিয়ে বাক্সগুলো নিজ হাতে পৌঁছে দিতে। সুবহানআল্লাহ, আল্লাহর কি ক্বাদারঃ এই মানুষটি নিজে কত সময় আর শ্রম ব্যয় করেছেন মুসলিম কারাবন্দীদের সাহায্য করতে, আর আজকে তিনি নিজেই একজন কারাবন্দী (আমি আল্লাহর কাছে দু’আ করি যেন তিনি মুক্ত হতে পারেন) !
ইসলামের প্রতি তার যে ত্যাগ সেটা ক্যাম্পাসে খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ঊঠত। বোস্টন ম্যাগাজিনের ২০০৪ সালের একটি প্রবন্ধ উল্লেখ করেছে, “... যারা মানুষকে ইসলামের শিক্ষা দেয়, তাদের জন্য আফিয়া তিনটি গাইড লিখেছেন।
গ্রুপের ওয়েবসাইটে তিনি শিক্ষা দিচ্ছেন কিভাবে একটি দা’ওয়াহ টেবিল পরিচালনা করতে হয়, কিভাবে স্কুলের ইনফরমেশন বুথগুলোকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে ইসলামের শিক্ষা দেওয়া যায় এবং তাদেরকে ইসলাম গ্রহণে রাজি করানো যায়। ” সেই প্রবন্ধটি আফিয়ার গাইডের কথাগুলো উদ্ধৃত করেছে, তিনি সেখানে লিখেছিলেন, “ভেবে দেখুন! কি করে আমাদের এই বিনম্র কিন্তু আন্তরিক দা’ওয়াহর প্রচেষ্টা আজকে একটি সুবিশাল আন্দোলনের রুপ নিয়েছে! একটু ভেবে দেখুন! আর এই আন্দোলনের হাত ধরে আজকে যারা ইসলাম গ্রহণ করছে, তাদের সমাগত পুরষ্কারের বীজ আমরা বপন করছি। বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করুন এবং বড় পরিকল্পনা হাতে নিন। আল্লাহ যেন আমাদেরকে শক্তিশালী করেন এবং কাজে আন্তরিকতা ঢেলে দেন যেন আমাদের এই বিনম্র প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে, এবং ছড়িয়ে পড়তে থাকে যতদিন না এই আমেরিকা একটি মুসলিম দেশে পরিণত হয়। ”
আল্লাহু আকবর … উম্মাহর জন্য তার কতই নাহিম্মাহ (উদ্বেগ) ... তার আকাশ-ছোঁয়া আশা আর পাহাড়সম স্বপ্ন! পুরুষ হয়ে যদি এক নারীর কাছে এমন স্বপ্ন দেখা শিখতে হয় তবে তো আমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত।
তিনি প্রত্যেক সপ্তাহে রবিবারে তার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন স্থানীয় মুসলিম শিশুদের ক্লাস নিতে। আমাকে এক বোন বলেছিলেন, তিনি প্রতিটি সপ্তাহে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে আরো একটি কাজ করতেন তা হল নও মুসলিমদের একটি ছোট্টদলকে তিনি ইসলামের মৌলিক বিষয়দির উপর শিক্ষা দিতেন। এক বোন, যিনি আফিয়ার ক্লাস করতেন, তিনি বলেন, “তিনি নিজে যেমন, তেমনই থাকতেন, বিশেষ কিছু করে কারো নজরে আসতে চাইতেন না বা কারো বন্ধুও হওয়াও শ্রেয় মনে করতেন না। তিনি স্রেফ চলে আসতেন আমাদের কাছে, এবং আল্লাহ সম্পর্কে আমাদেরকে শিক্ষা দিতেন, অথচ ইংরেজি তার মাতৃভাষাও ছিল না!”
আরো এক বোন যিনি তার আফিয়ার হালাক্বায় (ক্লাস) অংশ নিতেন, বলেন, “আফিয়া আমাদেরকে সাথে তার কথাগুলো ভাগাভাগি করতেন, বলতেন, আমাদের মুসলিম পরিচয় নিয়ে আমাদের লজ্জিত হবার কিছু নেই। তিনি বলেছিলেন, “আমেরিকানরা দুর্বলদের প্রতি সম্মান দেখাতে জানে না।
যদি আমরা উঠে দাঁড়াই এবং শক্তিশালী হই, তখন তারা আমাদেরকে ঠিকই সম্মান দেখাবে”। ”
আল্লাহু আকবর ... হে আল্লাহ, আমাদেরকে এই বোনকে মুক্ত কর!
কিন্তু এসব কিছুর মাঝেও, আফিয়ার সবচেয়ে বেশি অনুরাগ কাজ করত বিশ্বের নানাপ্রান্তের শোষিত ও নিপীড়িত মুসলিমদের প্রতি। বসনিয়ায় যখন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল, তিনি তখন পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকেন নি। বরং, তিনি তৎক্ষণাৎ হাতের কাছে যা পেয়েছেন তা নিয়ে কিছু একটি করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সারাদিন ঘরে বসে থেকে, বসনিয়া গিয়ে ব্যাপক ত্রাণকার্যক্রম চালাবার মত আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখতেন না।
তিনি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তার সাধ্যের মধ্যে যা ছিল তাই করেছিলেন, তিনি মানুষের সাথে কথা বলে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার প্রয়াস চালিয়েছেন, তিনি ডোনেশনের জন্য অনুরোধ করেছেন, তিনি ই-মেইল করেছেন, তিনি স্লাইডশো তে বসনিয়ার অবস্থা উপস্থাপন করেছেন- আমি যেটা বলতে চাচ্ছি তা হল, আফিয়া চোখে আঙ্গুল দিয়ে সবাইকে একটা জিনিষ দেখিয়ে দিয়েছিলেন, যদি আমরা আমাদের নিপীড়িত ভাই-বোনদের জন্য কিছু একটা করতে চাই, আমাদের কিছু-না-কিছু অবশ্যই করার থাকবে। নিদেনপক্ষে, যারা অজ্ঞ, তাদের মধ্যে আমরা সারা বিশ্বের মুসলিম ভাই-বোনদের উপর কি ঘটে চলেছে সে ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি।
হাত গুটিয়ে পেছনে পড়ে থাকা কোন কাজের কথা নয়। একবার আফিয়া স্থানীয় মসজিদে বসনিয়ার এতিমশিশুদের জন্য সাহায্য চেয়ে বক্তব্য রাখছিলেন, তার কথা শুনে শ্রোতাদের তেমন কোন ভাবাবেগ হল না, তারা তার কথা শুনে স্রেফ বসেই ছিল, তখন আফিয়া জিজ্ঞেস করলেনঃ “এইরুমে যতজন মানুষ আছে, তাদের ক’জনের একজোড়ার বেশি বুট আছে?” রুমের প্রায় অর্ধেক মানুষ হাত তুলল, তিনি বললেন, “তো আপনারা এগিয়ে আসুন বসনিয়ার শিশুদের জন্য! যারা একটি কঠিন ঠাণ্ডার আবহাওয়া পার করতে যাচ্ছে!” তার আর্তি এতটাই জোরালো ছিল যে মসজিদের ইমাম পর্যন্ত তার বুটজোড়া খুলে দান করে দেন!
ইসলামের জন্য এ নারীর তীব্র আবেগ আর ভালবাসার গল্পের আরো অনেকটুকু আছে। তবে আফিয়া কেমন ছিলেন তা বোঝার জন্য উপরের উদাহারণগুলো যথেষ্ট, এবং আশা করি নারী হিসেবে তার ত্যাগের যে গল্প তা বোনদের আগে ভাইদেরকে নাড়া দেবে, তাদেরকে ইসলামের সেবায় যা-কিছু-আছে তাই নিয়ে নেমে পড়তে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
মনে রাখবেন, তিনি তার সব কিছু ঢেলে দিয়েছিলেন এমন একটা সময়ে, যখন তিনি ছিলেন একজন মা এবং একজন পিএইচডি ছাত্রী। আর আমাদের হাতে আরো বেশি সময় থাকা সত্ত্বেও তার কাছাকাছিও কিছু করছি না।
আফিয়ার এ প্রতিচ্ছবিকে মনের মধ্যে গেঁথে এবার একটু পেছনের দিকে আসা যাক, যখন আমি তাকে আদালতের শুনানির জন্য হাজির করা আফিয়াকে দেখি। আদালতকক্ষের সামনের বামের দরজাটা হালকা করে খুলে গেল, নীল হুইলচেয়ার বসা দুর্বল, নিস্তেজ, প্রবল-পরিশ্রান্ত এক নারী চোখের সামনে উদ্ভাসিত হল, যে কিনা তার মাথাটি সোজা করে ধরেও রাখতে পারছিল না। তার পরনে ছিল গুয়ানতানামো ধাঁচের গোলাপী কারাপোষাক, আর তার নাজুক মাথা মোড়ানো ছিল সাদা হিজাবে, যেটা দিয়ে তার অস্থিসার হাতদুটো ঢাকা (কারাগারের ইউনিফর্ম হাতাকাটা হয়)।
তার উকিল দ্রুত কাছে গিয়ে বসল এবং জামিনের জন্য শুনানি শুরু হল।
রাষ্ট্রপক্ষের কুশলি, সহযোগী ইউএস এটর্নি ক্রিস্টোফার লাভিন, তিন-চারজন এফবিআই এজেন্টকে সাথে নিয়ে হেঁটে আসলেন, তাদের মধ্যে এক মহিলা ছিল যাকে পাকিস্তানীর মত দেখাচ্ছিল (আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হোক এই এজেন্টের প্রতি)। আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিবাদী উকিল বললেন, জামিনের আবেদনে শুনানি দেরি হবার কারণ হল আফিয়ার শরীরের করূণ হাল। আফিয়ার উকিল মূলত বলতে চাইলেন, আফিয়ার এ মুমূর্ষু অবস্থায় জামিন নয়, বরং সবকিছুর আগে তাকে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করানো হোক। লাভিন উঠে দাঁড়িয়ে আপত্তি জানাল, বলল আফিয়া আমেরিকা নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরুপ।
বিচারক সে কথা খুব একটা আমলে নিলেন মনে হল না, এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি বলে চললেন, “এ এমন এক নারী যে বন্দী অবস্থায় বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে”। একথা শুনেই আমি আফিয়াকে দেখলাম এবং লক্ষ করলাম আফিয়া খুব হতাশা আর কষ্ট নিয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন, যেন সমস্ত পৃথিবী তার বিরুদ্ধে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গত, আফিয়া ছিলেন খুব ছোটখাট আর তিনি এতটাই নুয়ে পড়েছিলেন, আমি কেবল তাকে পেছন থেকে হুইলচেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় সামান্যই দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি শুধু এতটুকুই দেখেছি তার মাথা বাম দিকে ঝুঁকে পড়েছে, হিজাবে তার মাথা মোড়ানো এবং ডান হাত বের হয়ে আছে।
তিনি কেন এতটা মনোকষ্টে জর্জরিত আর বিষাদগ্রস্ত ছিলেন তা আমি বুঝতে পেরেছি যখন তার উকিল তার শারীরিক অবস্থা বিশদভাবে তুলে ধরলেনঃ
•আমেরিকার তত্ত্বাবধানে থাকাকালীন সময় থেকে তার ব্রেইন ড্যামেজ হয়েছে।
•আমেরিকান সরকারের রক্ষণাবেক্ষণ কালে তার একটি কিডনী সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
•তিনি খেতে পারছেন না কেননা অপারেশনের সময় তার অন্ত্রের কিছু অংশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে, এটিও হয়েছে আমেরিকান প্রহরায়।
• তার শরীরের প্রলেপের পর প্রলেপ জুড়ে সেলাই করা হয়েছে গুলিবিদ্ধ স্থানের সার্জারি করতে গিয়ে।
• তার শরীরে বুক থেকে শুরু করে পুরো ধড় জুড়ে অস্ত্রোপচারের বিশাল ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।
এ সব যন্ত্রণা নিয়ে, আমেরিকায় কারারুদ্ধকালীন পুরো সময়জুড়ে তাকে একবারও ডাক্তার দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয় নি, আফগানিস্তানে তার অযত্ন-অবহেলায় অপারেশনের পর তার পেটে অবিরত অসহ্য ব্যথা হবার পরেও না।
বরং এই ব্যথার জন্য তাকে দেওয়া হয়েছে আইবোপ্রোফেন নামের একটি ব্যথানাশক ঔষধ, যেটা কিনা মাথাব্যথার জন্য লোকে খায়!
এসব কিছুর পরেও, সরকারপক্ষের আইনজীবি বেহায়া এবং নির্লজ্জের মত তাকে ডাক্তার দেখানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখার আস্পর্ধা দেখিয়ে গেলেন, যুক্তি দেখিয়ে চললেন আফিয়া “নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরুপ”। যখন বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন আফিয়াকে এভাবে একদম প্রাথমিক চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত রাখা হল, তখন এটর্নি সাহেব তোতলাতে শুরু করলেন এবং বললেন, “আসলে তখন পরিস্থিতি খুব জটিল আকার ধারণ করেছিল”, এবং নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য প্রত্যাশিতভাবেই অত্যন্ত সস্তা একটা কুযুক্তি ধার করলেন, “এটি আফিয়ার নিজের সিদ্ধান্ত যে তিনি পুরুষ ডাক্তারের কাছে নিজেকে দেখাতে চান নি”। আইনজীবি যখনই একথা বললেন, আফিয়া জীর্ণশীর্ণ হাত যেন চিৎকার করে উঠল এবং নাড়াচাড়া করে বিচারককে বলে উঠত চাইল, “না! সে মিথ্যে বলছে!”।
আমার খুব কষ্ট লাগল, তার চোখের সামনে এভাবে মিথ্যা বলতে দেখে তার চেহারায় প্রচণ্ড হতাশার ছাপ দেখা দিল। তার আইনজীবি তখন তার কাছে গিয়ে তার হাতটি ধরে পায়ের উপর বসিয়ে দিলেন এবং হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করলেন।
শুনানি যখন শেষ হল, আমার মাথায় তখন একটি জ্ঞানগর্ভ কথা বারবার মনে পড়তে লাগল, এবং এটি সেই কথা যেখানে ইবন আল-কায়্যিম বলছিলেন, একজন বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করবে না ততক্ষণ, যতক্ষণ না, “ ... শেষ প্রতিবন্ধকটি অবশিষ্ট থাকবে যার ভেতর থেকে শয়তান তাকে তাড়া করে এবং এই বান্দাকে অবশ্যই এই প্রতিবন্ধকের মোকাবেলা করতে হবে। যদি কেউ এই বাঁধা থেকে রক্ষা পায় তাহলে তারা হলেন আল্লাহর নবী এবং রাসূলগণ, যারা সৃষ্টির সেরা। এটি হল শয়তানের সেই প্রতিবন্ধকতা যেখানে শয়তানের বাহিনীকে মু’মিন বান্দার উপর চড়াও হবে এবং বিভিন্ন প্রকারে তার ক্ষতিসাধন করেঃ হাত, জিহবা এবং অন্তর দ্বারা। ঈমানের মাত্রা অনুযায়ী এই পরীক্ষার মাত্রাও ভিন্ন হবে। বান্দার ঈমান যতবেশি হবে, শত্রু ততবেশি করে তার বাহিনীকে বান্দার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবে এবং তার ক্ষতিসাধনে তাদের সাহায্যের যোগান দেবে, এবং তার অনুসারী ও মিত্রদের সহযোগিতায় তাকে গুড়িয়ে দিতে চাইবে।
এই বাঁধাকে এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই, কেননা সে আল্লাহর দিকে আহবানে সে যত দৃঢ়তার পরিচয় দেবে এবং আল্লাহর অর্পিত আদেশ পালনে ব্রতী হবে, শয়তান ততবেশি করে মূর্খলোকদের সাহায্যে তাকে ধোঁকা দিতে তৎপর হবে। কাজেই, বান্দা যদি তার শরীর বর্মে আচ্ছাদিত করে আল্লাহর রাহে, আল্লাহর নামে শত্রুকে মোকাবেলা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়, তবে তার এই ইবাদাহ হবে, সকল ইবাদাতের মাঝে শ্রেষ্ট ইবাদাহ”।
আদালতের সেই দৃশ্যে পরিষ্কারভাবে আমার চোখে ফুটে ওঠে ইবন আল-কায়্যিম এর এই কথাগুলো। আদালতে আফিয়ার শরীরে দুর্বলতা আর নাজুকতার ভাব থাকলেও, সারাটা সময় জুড়ে আমি তার মধ্যে সম্মান ও শক্তির একটি ছাপ দেখতে পাচ্ছিলাম সুস্পষ্ট। আদালতে তার সবকিছু, আইনজীবির মিথ্যা অভিযোগে তার মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদ, যে হিজাবের কথা এ ধরণের ভয়ানক পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষের মাথায় আসারই কথা না, আদালতকক্ষে সে হিজাবে নিজেকে আবৃত রাখার প্রতি তার যে তীক্ষ্ণ মনোযোগ, আদালতের কক্ষে এফবিআই এজেন্ট, ইউএস মার্শাল, রিপোর্টার, অফিসিয়াল-সকলের এই নুয়ে-পড়া-দুর্বল-ছোটখাট-শান্তদর্শন মহিলা যে কিনা তাদের কাছে “নিরাপত্তার হুমকি” তার দিকে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থাকা, এ সব কিছু একটা জিনিষ নির্দেশ করে, আর তা হল এদের সবাই আফিয়ার একটি জিনিষকে নিয়ে শঙ্কিত আর ভীতসন্ত্রস্ত, আর সেটি হল আমাদের এই বোনের ঈমান।
এই হল আমাদের প্রিয় বোনের অবস্থা, যাকে কুফফাররা বন্দী করে রেখেছে ...
কি বলার আছে আমার ... ?
মুসলিম বন্দী মুক্ত করার ওয়াজিব দায়িত্বের কথা বলে আমি আমার এ লেখা শেষ করব না। আমি খলিফা আল-মু’তাসিমের উদাহারণ টেনে এনে বলব না দেখুন তিনি কেবল মুসলিম নারীকে উদ্ধার করার জন্য একটা শহর ধসিয়ে দিয়েছিলেন। আমি সালাহ আদ-দীন কিংবা ‘উমার বিন ‘আবদ আল-‘আযীয এর কথা আপনাদেরকে শোনাব না যারা কিনা হাজার হাজার মুসলিম বন্দীদের উদ্ধার করেছিলেন। এ আকর্ষণীয় গল্পগুলো আপনাদের সামনে বলার লোভ আজকে আমাকে সামলাতে হবে, কেন জানেন ? কারণ, দুঃখের কারণ এই নয় যে আফিয়া বন্দী, দুঃখের কারণ হল, পাঁচ লক্ষ মুসলিমের শহরে মাত্র অল্প কিছু মুসলিমও আফিয়ার শুনানির দিনে উপস্থিত থাকার কাজটাকে ঝামেলার ব্যাপার মনে করল। দুঃখ হল এই, পুরো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি মুসলিম সংগঠন বোনের পক্ষে এগিয়ে আসল না, তার পক্ষে একটি শব্দও উচ্চারণ করল না, যেমনটা ইবন আল-কায়্যিম বলেছিলেন,
“যদি গীরাহ (উম্মাহকে আগলে রাখার প্রবল ঈর্ষা) মানুষের হৃদয় ত্যাগ করে চলে যায়, তবে সে হৃদয় থেকে ঈমানও হারিয়ে যাবে”।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এমন একটা সময়ে যখন আমাদের বেশিরভাগই দীন আল-‘আরবদের মত দ্বীনের কেবল নামায-রোযা নিয়েই পড়ে আছে, তখন আফিয়া সিদ্দিক্বীকে কিভাবে সাহায্য করা যেতে পারে, সে শিক্ষা আফিয়া নিজেই দিয়ে গেছেন।
এবং আল্লাহই উত্তম সাহায্যকারী।
মূল লেখা ( Click This Link) থেকে অনুবাদ করেছেন আমাদের এক ভাই। আমাদের এই ভাইয়ের জন্যও দোয়া করবেন ইনশাআল্লাহ।
পরিশিষ্টঃ আবু গারিব কারাগার থেকে আরেক বোন ফাতেমার চিঠি আসার পর ইরাকের ছোট্ট একটি মুজাহিদিনদের দল আবু গারিব কারাগারে হামলা চালায়।
তারা জানত তারা কিছুই করতে পারবে না তারপরও তারা গিয়েছিল। তারা জানত অ্যামেরিকানদের ভারি মর্টার আর আধুনিক আস্ত্রের সামনে তাদের কিছুই নেই তারপরও তারা গিয়েছিল। তারা জানত তারা সবাইই মারা পড়বে তারপরও তারা গিয়েছিল। ফাতেমার সেই চিঠির জবাব দিয়েছিল একটি মুজাহিদিন ওয়েবসাইট। সেই জবাবটিই সবার জন্য রেখে যেতে চাই
"আমরা সত্যিকার অর্থেই মানুষ নই বোন! সত্যিই যদি মানুষ হতাম তাহলে তোমার চিঠি পাবার পর আবু গারিব কারাগার ধুলোয় মিশিয়ে দিতাম"
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।