আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদ্রোহের পর তিউনিশিয়া : সাম্প্রতিকতম খবরাখবর

চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি তিউনিশিয়ার বিদ্রোহ মূলত দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিকতার বিরূদ্ধে গণক্ষোভ, নানাবিধ নাগরিক অসন্তোষ, যার অন্যতম প্রধান দিক বেকারত্ম বা ছদ্ম বেকারত্ব। তিউনিশিয়ার ১কোটি বেশি মানুষের জনসংখ্যার ৪২ শতাংশর বয়স ২৫ এর কম। যুব সম্প্রদায় শিক্ষিত, প্রায় ৪৬ শতাংশই স্নাতক, কিন্তু বেকার বা ছদ্ম বেকার। যেমন ছিলেন বিদ্রোহের আগুন জ্বালা বৌয়াজিজি নিজেই। শিক্ষিত স্নাতক, কিন্তু রুটির জন্য ঠেলা গাড়িতে করে ফল বিক্রি করতেন।

বেকারদের একটা ভালো সংখ্যা কাজ খুঁজতে যেতেন ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালিতে, বে-আইনি ভাবে ডিঙি নৌকায় চেপে। ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় অনেকেই প্রতি বছর সমুদ্রে ডুবে প্রাণ হারান। একটি হিসেবে প্রায় ৬ লক্ষ যুবক কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছেন। সেখানেও মুষ্টিমেয় কিছু দক্ষ শ্রমিক ছাড়া বাকিদের জন্য ইউরোপীয়রা করতে অনিচ্ছুক, এ ধরণের কষ্টকর কাজই থাকে। এসব নিয়ে দেশের যুবসমাজ ব্যাপকভাবে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন।

১৯৮০ থেকেই বিশ্বব্যাঙ্কের নির্দেশে শুরু হয়ে যায় কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস। ভূমিসংস্কার প্রত্যাহত হয়,বড় ভূস্বামী ও বিদেশী কর্পোরেটদের হাতে জমির কেন্দ্রীভবনের পথে শুরু হয় রপ্তানী নির্ভর চাষ। পাশাপাশি চলতে থাকে বেসরকারিকরণ, ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ভরতুকি হ্রাস। ১৯৮৪ তে হয় রুটি দাঙ্গা, রুটির দাম ১০০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় সংগঠিত গণবিদ্রোহ। এর পর থেকে ২৬ বছর একটানা জারী থাকে জরুরী অবস্থা।

দেশটিকে পুলিশ রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা হয়। গড়পড়তা প্রতি ৬৭ জন নাগরিক পিছু একজন করে পুলিশ নিযুক্ত থাকে। দেশের মধ্যে কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সব ধরণের গণতান্ত্রিক অধিকারের গলা চেপে ধরেছিল। শ্রমিকদের একমাত্র স্বীকৃত সংগঠন ইউ জি টি টি-র ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারী করা হয়। শ্রমিক বিদ্রোহগুলিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনপ্রক্রিয়া চালু থাকলেও সেখানে ছিল বেন আলির দল আর সি ডি-র একাধিপত্য। পুলিশি সন্ত্রাস ও সাংবিধানিক ফাঁকফোকরের মধ্য দিয়ে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বেন আলি নিয়ম করে ৯০ শতাংশ ভোট পেয়ে ‘নির্বাচিত’ হতেন। এই বজ্র আঁটুনির পেছনে অবশ্যই ছিল সাম্রাজ্যবাদী মদত। মুখে উদার গণতন্ত্রের কথা বলে আসা এই সব সাম্রাজ্যবাদী দেশ, যাদের পুরোভাগে ছিল ফ্রান্স, বেন আলির এই স্বৈরাচারী শাসনকে দশকের পর দশক ধরে মদত দিয়ে এসেছে। পাশাপাশি আমেরিকা যে তিউনিশিয়ায় শাসকবিরোধি ক্ষোভের আঁচ করছিল উইকিলিকস তা স্পষ্ট করেছে একটি গোপন তারবার্তায় – “টিউনিশিয়ার জনগণ, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকেরা রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব, শাসকবর্গের দুর্নীতি, বিপুল বেকারি, আঞ্চলিক বৈষম্যের ফলে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে এবং চরমপন্থার বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।

শাসকের দীর্ঘকালীন স্থায়িত্ব ক্রমশ বিপন্ন হয়ে উঠছে”। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযোগী মিত্ররা এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছিল যে স্বৈরশাসকদের পরিবর্তন না করলে দেশগুলিতে বিপ্লব হয়ে যেতে পারে ও তা তাদের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। বেন আলির বিরূদ্ধে দেশজোড়া বিদ্রোহ শুরু হবার পরই তারা তাদের পরবর্তী স্বার্থ সুরক্ষিত করার ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সার্বিক গণক্ষোভ বেন আলিকে দেশত্যাগে বাধ্য করলেও তিউনিশিয়ায় বিভিন্ন ধরণের ‘ইন্টারেস্ট গ্রুপ’ বিভিন্ন ভাবে হস্তক্ষেপ করা শুরু করে ও তিউনিশিয়ার রাজনীতি এক জটিল সন্ধিক্ষণে পৌঁছায়। ১৪ জানুয়ারী বেন আলির পতনের পর তিউনিশিয়াতে তিনবার সরকার বদল হয়।

প্রথমবার বেন আলির দল আর সি ডি ও বেন আলির সময়কার প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ ঘানৌচি -র নেতৃত্বে পুরোন সরকারের লোকজন ও বিদ্রোহীদের একাংশকে মিলিয়ে একটি ‘ঐক্য সরকার’ তৈরি হয়। শ্রমিক সংগঠন ইউ জি টি টি র কিছু কর্তাব্যক্তিও এতে সামিল হন। পুনরায় গণক্ষোভ শুরু হলে তলাকার শ্রমিকদের চাপে ইউ জি টি টি -র মন্ত্রীরা সহ অন্য কিছু মন্ত্রীও পদত্যাগ করেন। বেন আলির আর সি ডি দলকে ভেঙে দেওয়ার আওয়াজ ওঠে। সরকার ভেঙে যায়, কিন্তু ঘানৌচিকে প্রধানমন্ত্রী করেই নতুন সরকার গঠিত হয়।

ঘানৌচি বিরোধী বিক্ষোভ চলতে থাকে। এরপর বেজি কায়েদ এসেবসি কে প্রধানমন্ত্রী করে নতুন একটা সরকার তৈরি হয়। ফ্রান্সে শিক্ষালাভ করা টেকনোক্র্যাটরাই মূলত এতে মন্ত্রী হিসেবে সামিল হন। এর বিরূদ্ধেও কিছু বিক্ষোভ চলে কিন্তু এর কার্যকালেই শেষপর্যন্ত ২৩ অক্টোবর ২০১১ তে সংবিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের ফলাফল, দলগুলির ইতিহাস, আদর্শ, সমর্থনভিত্তি বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তিউনিশিয়ায় পরিবর্তনের পর বর্তমান ছবিটা স্পষ্ট হতে পারে।

তিউনিশিয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাওয়া আসন সংখ্যা এরকম - • Ennahda Movement 89 Congress for the Republic 29 Democratic Forum for Labour and Liberties 20 Popular Petition 26 Progressive Democratic Party 16 • The Initiative 5 Democratic Modernist Pole 5 Afek Tounes 4 Tunisian Workers' Communist Party 3 People's Movement 2 Movement of Socialist Democrats 2 Free Patriotic Union 1 Democratic Patriots' Movement 1 Maghrebin Liberal Party 1 Democratic Social Nation Party 1 New Destour Party 1 Progressive Struggle Party 1 Equity and Equality Party 1 Cultural Unionist Nation Party 1 Independent lists 8 • Total members 217 প্রথমেই লক্ষ্য করার বিষয় বেন আলির পতনের পর যে ঘানৌচি সরকারকে সামনে রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল তাতে বাদ রাখা হয়েছিল নির্বাচনে সর্বোচ্চ আসনপ্রাপ্ত প্রথম দুই দলকেই। এনাহদা এবং কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক ছাড়াও এতে বাদ ছিলেন তিউনিশিয়ান ওয়ার্কাস কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরা। সর্বোচ্চ ভোট (প্রায় ৪০ শতাংশ) ও আসনপ্রাপ্ত (২১৭ টির মধ্যে ৮৯টি) এনহাদা পার্টি নিজেদের মডারেট ইসলামিস্ট হিসেবেই ঘোষণা করে। এই পার্টির ভিত্তি এনহাদা আন্দোলন ইসলামিক মতাদর্শর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা, এর প্রেরণা হিসেবে সংগঠনের নেতৃত্ব ১৯৭৯র ইরানীয় বিপ্লব এবং মিশরের ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ সংগঠনের কাছে তাদের ঋণ স্বীকার করেন। এসব কারণে এনহাদাকে নিয়ে উদার গণতান্ত্রিক মহলে কিছু সংশয় তৈরি হয়েছে।

এর সমর্থকরা বলেছেন এটি ইসলাম ও আধুনিকতার সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত, সমালোচকেরা এর জয়ে তিউনিশিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ হবার আশঙ্কা করেছেন। কিন্তু মুখপাত্র ঘানৌচি কন্যা বলেছেন, “আমরা ধর্মীয় সংগঠন নই, রাজনৈতিক সংগঠন”। ইসলাম তাঁদের কাছে একটা প্রেরণা, এভাবেই তারা বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। তুলনা টেনেছেন জার্মানির ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রাটদের সঙ্গে। নারীদের পোশাকবিধি, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন, “কাউকেই কোন ব্যাপারে জোর করার প্রশ্ন নেই।

হিজাব প্রভৃতি কেউ পড়তে চাইলে পড়বেন, না চাইলে পড়বেন না”। নির্বাচনের আগের কয়েকমাস ধরে তিউনিশিয়ার উদারপন্থী ও পশ্চিমী পর্যবেক্ষকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তাঁরা গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারকে সর্বোতভাবে রক্ষা করবেন। ‘ইসলামিস্ট’ পরিচয়টি কিছু সংশয় তৈরি করতে পারে ভেবে পার্টির কর্মকর্তারা একে ‘ইসলামিক’ পরিচয়ে পরিচিত করতে চাইছেন। পার্টির প্রতিষ্টাতা এবং সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ঘানৌচি বলেছেন, “মুসলিম বা অ-মুসলিম, সমস্ত নাগরিকই সমান নাগরিক অধিকার পাবেন”। এতদসত্তেও তিউনিশিয়া, বিশেষত যার দৃপ্ত যুবশক্তি স্বৈরাচারের বিরূদ্ধে সাহসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে এত বড় পরিবর্তন আনলেন, তাদের সমর্থন কেন একটি ইসলামিক পার্টির দিকে গেল, তা নিয়ে আরব পরিবর্তনের দিকে চোখ রাখা বাম গণতান্ত্রিক শক্তি খানিকটা সংশয়াচ্ছন্ন নিশ্চয় হয়েছেন।

ম্যাথু ভন রো তাঁর একটি লেখা, ‘হোয়াই তিউনিশিয়ানস ভোটেট ফর দ্য ইসলামিস্টস’ এ এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিউনিশিয়ার বেশিরভাগ নাগরিক মুসলিম হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী যুগের দুই শাসকের সময়ে সমাজে ইসলাম খুব বেশি মর্যাদা পায় নি। মূলত ফরাসী প্রভাবিত ইউরোপীয় রীতিই প্রচলিত থেকেছে উত্তর ঔপনিবেশিক তিউনিশিয়ায়। প্রথম শাসক হাবিব বোরগুইবাকে রমজানের উপবাসের সময়েও টিভি চ্যানেলে ফলের রস খেতে দেখা গেছে। দ্বিতীয় শাসক বেন আলি সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক কন্ঠস্বর রদ করার পাশাপাশি এনহাদাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

এর প্রায় ২৫ হাজার সমর্থককে জেলে পোরা হয়। প্রতিষ্ঠাতা ও পার্টি নেতা ঘানৌচি লন্ডনে পলাতক থাকতে বাধ্য হন। রোর মত অনেকেই মনে করেন এনহাদা ইরাণের মত তিউনিশিয়াকে ধর্মরাষ্ট্র করে তুলুক, এই আকাঙ্ক্ষায় তাকে জনগণ ভোট দেয় নি। বরং এনহাদা নিপীড়ণ পর্বে জনগণের সবচেয়ে কাছাকাছি থেকেছে, বেন আলি জমানায় নিগৃহীত হয়েছে, এটাই তার বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছে। তিউনিশিয়ার যে শক্তির দিকে বিশ্বের বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি আশা নিয়ে তাকাতে চাইবেন সেটা অবশ্যই ১৪ জানুয়ারী ফ্রন্ট।

বেন আলির পতনের দিনটিকে স্মারক করে তৈরি হওয়া এই ফ্রন্ট যা র‍্যাডিক্যাল, পুঁজিবাদ বিরোধি বাম, আরব জাতিয়তাবাদী, সোস্যালিস্ট, শ্রমিক সংগঠন ও স্বাধীন বামপন্থীদের নিয়ে তৈরি হয়। এর দাবীসনদগুলি থেকে এর চরিত্র খানিকটা বোঝা যায়। তারা দাবী করেছে – • জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা • সংবাদমাধ্যম, তথ্য আদানপ্রদান, চিন্তার স্বাধীনতা • সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি • জনগণ ও দেশের ওপর থেকে সমস্ত মার্কিন, ইউরোপীয় ও অন্যন্য শক্তির সমস্ত ধরণের অধিনতার অবসান • বেসরকারিকরণ করা হয়েছে এমন শিল্পসংস্থাগুলির পুনঃজাতিয়করণ • ইজরায়েল এর সাথে সম্পর্কস্থাপন প্রতিরোধ করা • আরব দুনিয়া ও বিশ্বের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনগুলিকে সমর্থন করা তিউনিশিয়ার শ্রমিকদের লড়াইও জারী আছে। ক্রমশ তার তীব্রতা বাড়ছে। ২০১০ এর তুলনায় ২০১১ সালে ধর্মঘট ১৩০% বেড়ে গেছে।

৯২% বেশি কোম্পানিতে ধর্মঘট হয়েছে। আগামীদিনে তিউনিশিয়ার লড়াকু জনগণকে সাম্রাজ্যবাদ ও দেশের ভেতরের প্রতিক্রিয়ার শক্তির সঙ্গে কঠিন লড়াইতে নেমেই গণতন্ত্র ও মেহনতি মানুষের অধিকারের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.