এ বছর শীতকাল শুরু হয়েছে শৈত্য প্রবাহ দিয়ে। ঋতুর প্রথম দিন থেকেই জেকে বসেছে শীত। সূর্যের দেখা নেই চারদিন হলো। উত্তরের হিমেল হাওয়া বইছে খুব। শহরে সাধারণত এত শীত লাগে না তাই শীতের জন্য আলাদা বিশেষ কোন প্রস্তুতি ছিলনা রহমান সাহেবের।
দশ বছরের পুরাতন লেপটা পাতলা কাঁথার মত হয়ে গেছে। সকালের দিকের শীতটা সুঁচের মত গায়ে বিধছে যেন। তার পাঁচ বছরের মেয়েটা গলা পেচিয়ে ধরে ঘুমুচ্ছে।
পত্রিকায় আবহাওয়ার খবরে লিখেছে সামনে নাকি আরো বেশি শীত আসবে। গ্রীন হাউজ এর কল্যানেই নাকি শীতের তীব্রতা এমন মহামারি পর্যায় পৌছেছে।
জানালার পঁর্দার ফাকা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
ইচ্ছে করছেনা আজ অফিসে যেতে। সারা দিন শুয়ে থাকতে পারলে ভাল হতো। কদিন যাবত শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলসেমি আর অবসাদকে পশ্রয় দেওয়া গেল না।
রুটি-রুজির জন্য তার মত মানুষদের এমন অনেক ইচ্ছেকেই মাটি দিতে হয়।
রহমান সাহেব চাকুরী করেন একটি বড় গামের্ন্টেস কোম্পানীর জুনিয়র অফিসার হিসেবে। গত ছয় বছর তিনি একই পদে আছেন। তার প্রমশন হয়নি। বেতনও বাড়ছে খুবই সামান্য।
কোম্পানির বাহ্যিক চাকচিক্য দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এরা কিভাবে মানুষ ঠকিয়ে ব্যাবসা করে ফুলে ফেপে নিজেদের বৃত্ত-বৈভব বাড়িয়ে তুলছে। কর্মকতাদের সুযোগ সুবিধা শূন্যর কোঠায়। রক্তচোষা জোকের মত গরীবের রক্ত চুষে এরা টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে।
অবশ্য এখন শ্রমিকদের সাথে তারা মোটিমুটি ভাল ব্যাবহার করতে বাধ্য হচ্ছে, কেননা বিদেশি বায়িং হাউজ আর অডিট হাউজ গুলো শ্রমিকের সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে খুব সোচ্চার। মালিক পক্ষ তাই লোক দেখানো সুযোগ সুবিধা দেয়।
যার বেশির ভাগই কাগজে থাকে। ফাইল বন্দি থাকে।
কর্মকতাদের প্রতি দিন সকাল আটটা হতে সন্ধা সাতটা পযন্ত কাজ করে যেতে হয়। কখনো বা রাত দশটাও বেজে যায়। শ্রমিকদের ওভার টাইম থাকলেও কর্মকতাদের নেই! ছুটিও নেই।
অফিসে না এলে হাজিরা কর্তন!!
এতসব অন্যায় চললেও কেউ তা দেখার নেই। সরকারও সোচ্চার নয়। মালিকদের স্বৈরাচারী ব্যাবহার তাই মুখ বুজে সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই যে করার নেই।
ঘর থেকে বের হবার সময় রহমান সাহেব ছাতা খুঁজে পেলেন না। অনেক দিন ছাতা ব্যাবহার না করায় ওটা যে কোথায় পড়ে আছে কে জানে? হাত ঘড়ির দিক তাকিয়ে কিছুটা আঁতকে উঠে বাসা থেকে বের হলেন তিনি।
দরজার কাছে তার স্ত্রীর পাশে দাড়ানো পাঁচ বছরের মেয়ে ফাইজা চেচিয়ে বলে“ বাবা আমার জন্য কিছু নিয়ে আসবে কিন্তু..”। রহমান সাহেব মৃদু হেসে বলেন, ঠিক আছে মা। প্রতি দিন ঘরে ফিরলে ফাইজা দৌড়ে আসে। তার চকলেট বা বিস্কিট চাই।
সাত সকালে রাস্তায় তার মত অনেক কর্মজীবী মানুষই বেড়িয়ে পড়েছে।
ভোর রাতে শুরু হওয়া বৃষ্টি একটু কমেছে, তবে পুরোপুরি কমেনি। এখনও তা চলছে নিঃশব্দে। পিচ উঠে যাওয়া কঙ্কালসার রাস্তাটা কাঁদায় সয়লাব। যত্রতত্র জমে থাকা ময়লা কালো পানিকে ছিটিয়ে গায়ে লাগিয়ে দিচ্ছে হুটহাট করে চলে যাওয়া গাড়ি গুলো। রহমান সাহেবর প্যান্ট এর ডান দিকটা আচমকাই ভিজিয়ে দিল একটি প্রাইভেট গাড়ি।
তিনি তাকিয়ে দেখলেন একবার। কিছু বললেন না। ভেতরে ঝকমকে জামা কাপড় পড়ে বসে আছেন একটি পরিবার। শীতের হিমেল অনল তাদের গায়ে লাগছে না। কানের ছিদ্র দিয়ে শীতের কুয়াসারা বুকের ভেতর ঢুকে যেতে পারছে না।
চোখের পাপড়ি গুলোও কুয়াসা ভিজিয়ে দিচ্ছে না।
রহমান সাহেব হাটতে থাকেন। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে তিনি এই পথে হাটছেন। চারপাশের খোলা জায়গা গুলি এখন আর খোলা নেই। ডোবা গুলিও নেই।
বাম পাশের স্যাতসেতে পুরাতন বিল্ডিং গুলোও নেই। সব কিছু বদলে গেছে। প্লট ব্যাবসায়ীদের কল্যানে চারদিকে গড়ে উঠেছে সুরম্য ভবন। ইট কাঠের শহর টাতে কোথাও এখন আর খোলা মাঠ নেই। সবুজ প্রান্তর নেই।
সব কিছুর উন্নতী হয়েছে। শুধু উন্নতী হয়নি তার। তিনি দীর্ঘঃশ্বাস লুকিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করেন। সারীবদ্ধ মানুষ গুলো দাড়িয়ে আছে, সবার চোখে মুখে কাচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার ক্লান্তি। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।
রহমান সাহেবের ঠা-ায় মাথা ব্যাথা করছে। জ্বর না আসলেই হয়। আপন মনে বলেন সে।
খুব টাইট বাজেটে তার সংসার চালাতে হয়। নিজের সামান্য জ্বর ঠা-ায় তাই ঔষুধ খাওয়ার চিন্তাই করেন না।
কবুতরের খোয়াড়ের মত ছোট দুটি কক্ষের বাসায় তাকে বাষ করতে হচ্ছে। গত ছয় বছর ধরে একই বাসায় আছেন সে। শুধু মাত্র দুই হাজার টাকার বাসা এখন পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া হয়েছে। তবে সেই হারে তার বেতন কিন্তু বাড়েনি। ক্রমশই তিনি সবার থেকে পিছিয়ে পড়ছেন।
ভাল করে কাজ করার পরও বসদের মোসাসাহেবী করতে না পারায় তার প্রমশন হয়নি। মাথার চুলে পাক ধরেছে। চুল পাকার মত বয়স হয়নি, শুধু মাত্র অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্যই তার চুলে পাক ধরেছে। অথচ যেকোন সময় যদি তাকে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে শুধু মাত্র আনলিভ এর পয়সা দেওয়া হবে। কোন ধরনের ফা- নেই।
বেতন বাড়ার কোন স্কেল নেই। কোন আইন নেই। আছে শুধু নিকষ কালো অন্ধকার।
অফিসের ডেস্কে বসে আপন মনে কাজ করে যাচ্ছিলেন রহমান সাহেব। তার মোবাইলে হঠাৎ রিং বেজে উঠলো।
রিসিভ করলেন তিনি। তার স্ত্রী তানিয়া বেগম বলেন, আমার ভাইয়া আসবে বিকেলে। ওর জন্য বড় মাছ নিয়ে এসো। আর শোন যেই শীত পড়েছে তাতে তোমার পাতলা কাথার মত আড়াইশো টাকার কম্বল দিয়ে কাজ হবেনা। একটা ভাল কম্বল না হলে লেপ কিনে নিয়ে এসো।
তানিয়ার কথা শুনে ভারী ক্লান্তি লাগে রহমান সাহেবের। সে শুধু যন্ত্রের মত শব্দ করে বলে, ঠিক আছে। তানিয়া আরো কিছু বলতে যায় কিন্তু রহমান সাহেব ফোন রেখে দেয়।
আজ মাসের ২২ তারিখ। বেতনের টাকাটা মাসের পনেরো দিন যেতেই শেষ হয়ে যায়।
তারপর টেনে-টুনে মাস চালাতে গিয়ে ত্রাহি অবস্থা। পকেট হাতড়ে রহমান সাহেব সর্বসাকুল্যে ছয়শত নব্বই টাকা পেলেন। এই টাকা দিয়ে কিছুই হবে না। বিষণœ মনটা আরো বিষণœ হলো। গত মাসে একদিন অফিসে ২৫মিনিট বিলম্বে পৌছানোর জন্য তার একদিনের বেতন কেটে রাখা হয়েছিল।
ঐ টাকাটার জন্য এখন আফসোস হচ্ছে তার। শীত উপলক্ষে কিছু শীতের কাপড় কেনাও জরুরী। মেয়েটার গত বছরের সুয়েটারটা ঠিকমত গায়ে লাগে না। তানিয়া দুই বছর ধরে একটা চাদর কিনে দিতে বলছে। বেচারাকে সাত সকালে উঠে রান্না করতে হয়।
শীতের কাপড় ওর খুব দরকার। গ্রাম থেকে মা ফোন করে বলেছে, বাবা শীতের চোটে নড়তে পারিনা, একটি মোটা সুয়েটার দিস। তোর কোম্পানি নাকি সুয়েটার বানায়?
হাতা কাটা সুয়েটার গায়ে রহমান সাহেব কাঁপতে থাকে। বাইরে যদিও হঠাৎ করে একচিলতে রোদ উঠেছে। হতাশায় ভেঙে পড়ে সে।
দশ হাজার পিছ সুয়েটারের গেটপাশ লিখছেন তিনি। কোম্পানির মালিক শিল্পপতি আনিস চৌধুরী তার উৎপাদিত সুয়েটারের ব্যাকলট থেকে সরকারের এক মন্ত্রীকে গিফট করছেন দশ হাজার সুয়েটার। এরকম করে প্রতিটি শীতকালেই সমাজের বিশেষ প্রভাবশালীদের সুয়েটার গিফট করেন চৌধুরী সাহেব। সম্পতি তিনি অনেক গুলো শীতবস্থ্য দিয়েছেন প্রধাণমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে। প্রত্রিকায় প্রধাণমন্ত্রীর সঙ্গে তার ছবি ছাপা হয়েছে।
অফিসের দেয়ালে সেই ছবি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
কিন্তু প্রদ্বিপের নিচেই থাকে অন্ধকার। কখনো আনিস চৌধুরীর মনে হয়নি যে তার কোম্পানিতে কর্মরত শ্রমিক আর কর্মকতাদের ও ইচ্ছে হয় একটা সুয়েটার পেতে। চৌধুরী সাহেব মনে করেন একটা সুয়েটার দিলে তার কর্মিরা সুয়েটার চুরি করবে। তিনি এতগুলি লোককে চোর হতে দিতে পারেন না।
রহমান সাহেবের জ্বর জ্বর লাগছে। অফিস শেষ হতে এখনও দুই ঘন্টা বাকি। তিনি বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। ঘড়িটা আজ যে অলস হয়ে গেছে, ঘুরতে চাচ্ছেনা। হাতাকাটা সুয়েটারটায় শীত মানছেনা।
জ্বরের প্রকপে শরীরে কাঁপুনি লাগছে। ডেস্কের পাশে স্যাম্পল সুয়েটার ঝুলছে। সহকর্মি হাবিব সাহেব এস দাড়ায় পাশে। কি ব্যাপার ভাই আপনার চোখ লাল কেন। শরীর দেখি কাঁপছে।
কপালে হাত দিয়ে হাবিব সাহেব বলেন, আরে ভাই জ্বরেতো দেখি আপনার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। হাবিব সাহেব একটা স্যাম্পল সুয়েটার টান দিয়ে এনে সামনে ধরে বলে, এটা পড়েন। যাবার সময় খুলে ফেললেই হবে। প্রয়োজন বাধা মানেনা। মনে দ্বিধা থাকা সত্বেও তাই রহমান সাহেব সুয়েটার গায়ে দেয়।
আরাম লাগছে একটু। আরো দুই ঘন্টা তাকে বসে থাকতে হবে। বাইরের আলোটা দপ করে নিভে গেল। ঘন কুয়াসারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। শৈত্য প্রবাহ যে আর কত দিন থাকে কে জানে?
অফিসের নিয়ম হলো ছুটির আগে বেরুনো যাবে না।
গেটে সিকিউরিটি বসে আছে খাতা নিয়ে। সিসি টিভি আছে। গেলে সারা দিনের হাজিরা নেই। এই জেল খানার বন্দি গারদে তাকে বসে থাকতে হবে। আরো দেড় ঘন্টা।
গ্রাজুয়েট রহমান সাহেব চাকুরি করেন। তারমতো এমন অনেক রহমান সাহেব কাজ করছে। এমন উদ্ভট সব আইন কানুন মাথায় নিয়ে। বাস্তবতার কাছে সব কিছু মেনে নিতে হয়। কোথায় যাবে মধ্যেবৃত্ত মানুষগুলো? টাকা ওয়ালা মানুষ গুলো টাকাকে ভালবেসে নষ্ট হয়ে গেছে।
তারা অর্থ ছাড়া কিছু বোঝেনা। আইন আদালত সরকার সবকিছু পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। অসহয় রহমান সাহেবরা শুধু চোখের জ্বল ফেলে। বুকের ভেতর জমায় দীর্ঘ ঃ নিশ্বাস!
হঠাৎ করে এমডি আনিস চৌধুরী অফিসে ঢোকে। রহমান সাহেবের কাছে এসে লাল চোখে তাকিয়ে বলেন, তুমি স্যাম্পল সুয়েটার পড়েছো কেন?
রহমান সাহেব আরো বেশি কাঁপতে থাকেন।
তিনি তোতলাতে থাকেন। কিছুই বলতে পারেন না। তীব্র অপমান সূচক কিছু কথা বলে এমডি চলে যায়। হাবিব সাহেব কাছে এসে বলেন, সরি ভাই। রহমান সাহেব উত্তর না দিয়ে কেবল সুয়েটার টা ছুড়ে ফেলেন।
দাতে কাঁপুনি লাগছে। লজ্জায় অপমানে তার চোখে জ্বল টলমল করে। সে মাথা নিচু করে বসে থাকে। ভালকাজ করার জন্য কেউ কোনদিন তাকে প্রশংসা করেনি। এক মুর্হূতের ভুলের জন্য অপমান হতে হল।
সময় কাটছে না। হাবিব সাহেব আবার এসেছে। হাত ধরে বলে, ভাই আমারে মাফ করে দেন আমি আপনার অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলেছি। রহমান সাহেব দেখেন তার চারপাশে আরো কয়েক জন কলিগরা দাড়িয়ে আছেন। সবার মুখ পাথরের মত।
রহমান সাহেব চিৎকার করে বলেন, আপনারা ডেস্কে যান আমার জন্য কারো লোক দেখানো মায়া কান্নার দরকার নেই।
এডমিন অফিসার এসে দুটি খাম ধরিয়ে দেন হাতে। একটিতে সুয়েটার পড়ে অসদ আচরনের দায় চাকুরীচুত্য, আরেক খামে পুরো মাসের বেতন আর আনলিভের টাকা। ছয় বছর সৎ আর নিষ্ঠার সাথে চাকুরী করার ফল হাতে পেয়ে কিছুুক্ষন ফ্যালফ্যাল করে চারপাশে তাকিয়ে থাকেন রহমান সাহেব । হাবিব সাহেবের চোখে কোনায় জমে থাকা জ্বল ঝরে পড়ে।
অন্যরা নিঃশ্চুব। কোন প্রতিবাদ নেই। রহমান সাহেব আশেপাশে দাড়িয়ে থাকা মানুষ নামের মূর্তিগুলোর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে বাইরে বেড়িয়ে পড়েন। অর্ধযুগের বন্দি শিবির থেকে বেড়িয়ে তিনি বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন। স্বাধীন মানুষের মত রাস্তায় নেমে পড়েন।
ঘড়িতে এখনও পাঁচটা বাজেনি।
রহমান সাহেব সবার জন্য শীতের কাঁপড় কিনেছেন। একটা ভাল কম্বলও কিনেছেন তিনি। বাজার থেকে বড় একটা মাছ কিনে তিনি আজ সিএনজিতে উঠলেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।