জন্ম নিরোধক বেলুন ‘ডিলাক্স নিরোধ’-এর বিজ্ঞাপন ভারতের শহরে ও গ্রামে- পেয়ার হুয়া, একরারহুয়া, পেয়ার সে ফের কোই ডরতা হ্যায় দিল (প্রেম হয়েছে, সম্মতিও দিয়েছে, তাহলে অন্তরে আর ভয় কিসের?)। সুতরাং পঞ্চাশ পয়সায় তিনটি কিনে এখনই মাঠে নেমে পড়ুন।
মূল্য যত কম, অভাব তত বেশি- অর্থনীতির মূল সূত্রে আঘাত করছে অতি সস্তা জন্মনিরোধক কনডম। এই লক্ষণ কেবল ভারতে নয়, অন্যান্য দেশেও, বাংলাদেশেও।
কনডমের বিচিত্র চাহিদা।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ও শিল্পের চাকা ঘোরাতে। জন্মনিরোধক কনডম প্রচলনের প্রথম পর্যায়ে এর অন্যতম ব্যবহার দেখা যেত বেলুন হয়ে আকাশে ওড়ার মধ্য দিয়ে।
পশ্চিম থেকে অনুদান হিসাবে আসা কনডমকেও এক সময় সন্দেহের চোখে দেখা হত- আমাদের জনবল কমিয়ে দেওয়ার পশ্চিমা ষড়যন্ত্র হিসাবে। নিরোধকবিরোধী ধর্মীয় অনুশাসনও ছিল- ক্যাথলিক ‘আপত্তি’ এখনও রয়েই গেছে। সুতরাং মূল কাজকে পাশ কাটিয়ে অন্য কাজে লাগাতে সমস্যা কী? ভর্তুকি দিয়ে সরবরাহ করা এই বেলুনের ‘বেলুন হিসাবে’ ব্যবহার রোধ করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না।
ছেলেমেয়ে ঘিয়ে রঙের বেলুন ফুলিয়ে সুতোয় বেঁধে আকাশে ওড়াচ্ছে, আর বাবা-মা ও বিবাহযোগ্য ভাইবোন বিব্রত হচ্ছে- এটা ছিল গত শতকের ষাট ও সত্তর দশকের একটি সাধারণ চিত্র। ভর্তুকির বেলুন কিংবা বিনামূল্যে পাওয়া বেলুন দু-চার পয়সায় বিক্রি করতে পারলেও মন্দ কী- সুতরাং মুদি দোকানদারও একটি বাড়তি বাজার পেয়ে যায়। বেলুনটা টেকসই, দামটা কম এবং দোকানদারও বেচতে রাজি- সুতরাং শখ করে প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রও দু-একটা কিনে নিয়েছে।
একবার ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের কাছে ভাওয়াল বনাঞ্চলে আবিষ্কৃত হয় বিপুল পরিমাণ কনডম। বিতরণের ঝামেলা এড়াতেই পরিবার পরিকল্পনা কর্মী জঙ্গলে ফেলে এসেছে।
আর নিশ্চয় পূর্ণ বিতরণ ও ব্যবহারের প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করা হয়েছে। পুরুষ প্রাণী এসবের সঠিক ব্যবহার জানলে অরণ্যে অনেক আগেই প্রাণীর জন্য হাহাকার পড়ে যেত।
এই নিবন্ধটি জন্ম-শাসন কিংবা ঘাতক ব্যাধি এইডস প্রতিরোধে কনডমের ভূমিকা নিয়ে নয়- কনডমের অপব্যবহার ও বিচিত্র ব্যবহার নিয়ে।
বেনারসি উপাখ্যান
ভারতের সিল্ক রাজধানী বারানসি শহরে কনডমের চাহিদা সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। চাহিদা বিবাহিত সক্ষম দম্পতি এবং অবিবাহিত জোড়ের মোট চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি।
কেবল বেনারসি শাড়ির পেছনে প্রতিদিন ব্যবহার করা হচ্ছে ৬ লাখ কনডম। তাঁতে মাকুর চলাচল অবাধ করতে গিয়ে তাঁতিরা ব্যবহার করছে কনডমের পিচ্ছিল লুব্রিক্যান্ট। প্রতিটি তাঁতের প্রতিদিনের চাহিদা চার থেকে পাঁচটি কনডম। পিচ্ছিলকারক এই তরলের একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে দামি শাড়িতে এটা কোনও ধরনের দাগ রেখে যায় না।
প্রথম দিকে কনডমের ব্যবহার চুপিসারে হলেও এখন তা প্রকাশ্য চর্চা হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে।
একটি শাড়িতে, একজন দক্ষ তাঁতি মনে করেন, চৌদ্দটির বেশি কনডম লাগা উচিত নয়।
ভারতীয় বেনারসি শাড়িতে শরীর পেঁচানো একজন বাংলাদেশি সুন্দরী রমণী একবার কি ভেবে দেখবেন তার শাড়িতে রয়েছে চৌদ্দটি কনডমের স্পর্শ।
বেনারসির চাহিদা কমার কোনও লক্ষণ নেই। তাঁতের সংখ্যাও বাড়ছে। কেবল ভারানাস শহরে তাঁতের সংখ্যা দুই লক্ষ।
তাঁতিদের মতে এমন সসত্মা ও নিদাগ লুব্রিক্যান্ট আর নেই। বিবিসি কনডম ও বেনারসি শাড়ি নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রামাণ্য চিত্রও প্রদর্শন করেছে। চিত্রটির নাম কনডম ঘোরায় শিল্পের চাকা। এক সময় বাংলাদেশ থেকেও ভারতে কনডম চোরাচালান হয়েছে। তাঁতিরা বরাবরই আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসাবে বড় ধরনের মজুদ নিশ্চিত করে।
সরকার আইনি হস্তক্ষেপও তেমন কাজে আসছে না।
বারানসির তাঁতি বাঁচাও আন্দোলনের একজন অন্যতম আহ্বায়ক মাহফুজ আলম বলেছেন- সরকারের অফিসাররা সতর্ক হলে শাড়িতে কনডমের ব্যবহার কমবে। তারাই পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে সরাবরাহ করে থাকে কিন' মনিটর করে না।
কর্মীরা এনে দোকানে বিক্রি করে দেয় আর তাঁতিরা দশ টাকায় এক ডজন রেটে দোকান থেকে কিনে নেয়। কাজেই পুলিশ দিয়ে তাঁতিদের হয়রানি করার কোনও মানে নেই।
পুরনো প্রজন্মের তাঁতিরা অবশ্য কনডম হাতে নিতে চায় না। কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে এ নিয়ে কোনও সংস্কার নেই। লাভ হলেই হলো। তাঁতিদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন রমণীরা কনডমের ব্যবহারটা জেনে গেলে হয়তো শাড়ির বাজার ধসে যেতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে ভারতের শিক্ষিত মহিলারা ব্যাপারটা জেনে গেছে।
কিন্তু বাজার সঙ্কুচিত হয়নি।
বাহারি ব্যবহার
কনডম গবেষকদের ধারণা হাজার বছর আগেই কনডম ব্যবহার হয়েছে কিন্তু ভিন্ন উদ্দেশ্যে। অরণ্যচারী মানুষ বনে-বাদাড়ে ঘুমিয়ে পড়লে বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ যাতে এই নাজুক অঙ্গটির ক্ষতি সাধন না করতে পারে সে জন্য শিশ্ন-পেঁচানো ছাল-বাকল ব্যবহার করত। নদী পারাপারের প্রয়োজনে কিংবা মাছ ধরার সময় জোঁকের হাত থেকে এই অঙ্গটি রক্ষার প্রয়োজনে এ ধরনের পোশাকের ব্যবহার হতো।
চারশ বছর আগেও ছাগলের অন্ত্র থেকে তৈরি কনডম যৌন প্রয়োজনেই ব্যবহার করা হতো বলে মনে করা হয়।
গ্যাব্রিয়েল ফ্যালোপ্পিওর লেখা সিফিলিস বিষয়ক একটি অভিসন্দর্ভে উল্লেখ করা হয়েছে লিলেনের খাপ একটি বিশেষ রাসায়নিক দ্রবণে চুবিয়ে যৌনকর্মের সময় তা ব্যবহার করলে সিফিলিসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এই খাপটি ওপরে একটি রিবন দিয়ে বাঁধা হতো। চীনে তৈলাক্ত সিল্ক পেপারে কনডম তৈরি হতো।
১৬৬৬ সালের সমীক্ষায় দেখা গেল ইংরেজদের জন্মহার কমে যাচ্ছে। ক্যাথলিক তাত্ত্বিক লিওনার্দো লেসিয়াস এ জন্য অনৈতিক কনডম ব্যবহারকে দায়ী করলেন।
নারী কনডমের ব্যবহারও বেশ পুরনো। মেয়েরা এক ধরনের বিষ মাখানো কনডম ব্যবহার করে ধর্ষণকারীদের প্রতিরোধ করার জন্য। একবার এ বিষ নাজুক অঙ্গে লাগলে ধর্ষণকারী যন্ত্রণায় আর এগোতে পারত না।
একালের কনডম ল্যাটেক্স ও পলিইউরেথেইন থেকে তৈরি হয়। আর পিচ্ছিল পদার্থের সঙ্গে থাকে শুক্র বিধ্বংসী ননঅক্সিনল-৯।
কনডম ওয়াটার প্রম্নফ, ইলাস্টিক এবং টেকইস।
কনডমের বাহারি ব্যবহারের একটি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পানীয় জল পরিবহন। এটি বহন করা সহজ। একটি সুনির্মিত ফুল সাইজ কনডম প্রায় ১২ লিটার পানি ধারণ করতে পারে। তবে পানিভর্তি কনডম পরিবহনের সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
যেকোনও ছোট আকৃতির ইলেকট্রনিক সামগ্রীর পানির ভেতরে বা তলদেশে ব্যবহারের জন্য তা কনডমের ভেতর ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। মাইক্রোফোনের ব্যবহার বিশেষভাবে উলেস্নখ করার মতো। বিবিসি এই ব্যবহারকে সুপরিচিত করিয়েছে। কেইপ টাউনে ফুটবল খেলোয়াড়রা মাঠে নামার সময় কনডম নিয়ে নামে। মোজা যথাস্থানে চেপে ধরে রাখার জন্য তারা মোজার ওপর কনডম পরে নেয়।
আফ্রিকায় ফুটবলারদের মধ্যে ব্যবহার আরও বাড়ছে।
জুতোর বর্ণ উজ্জ্বল করতে বেনারসি তাঁতিদের মতো কনডমের লুব্রিক্যান্ট দিয়ে জুতো পালিশ করা হয়। এই পদ্ধতিটি বেশ বাজার পেয়েছে। জুতোর চাকচিক্য ধরে রাখার জন্য ধুলোবালি কিংবা কাদামাটি অতিক্রম করার সময়, জুতোর উপরে দুপায়ে দুই কনডম পরে নিলেই ব্যাস। পার্টিতে ঢোকার সময় কনডম খুলে নিলেই মনে হবে জুতো এইমাত্র ব্রাশ করা হয়েছে।
কঙ্গোতে ৩টি কনডমের দাম ৯ সেন্ট আর জুতোর পালিশের দাম ৬০ সেন্ট।
কম্বোডিয়া কনডমের লুব্রিকেণ্ট যৌনকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার মেয়েরা মুখে মেখে থাকে- তাতে শোনা যায় ব্রণ হয় না। চুলকানিতেও তা কাজে লাগে বলে নাম্বার ওয়ান প্লাস ব্র্যান্ড কনডমের চাহিদা অনেক বেশি।
বিভিন্ন ধরনের প্যাথলজিক্যাল টেস্ট বিশেষ করে ইউরিন টেস্টের সময় কনডমে মূত্র বহনের নজির রয়েছে। এমনকি মৃত্তিকাবিজ্ঞানীরাও কনডমের ভেতর নমুনা মাটি পরীক্ষার জন্য পরিবহন করেছেন বলে শোনা গেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় নগ্ন জল ভ্রমণে বের হলে ক্যানডিরু নামের ক্যাটফিশের আক্রমণ থেকে শিশ্নকে রক্ষা করতে কনডম পরিধানের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। এই কাটফিশ মূত্রগন্ধের ভক্ত। কাজেই সহজেই টার্গেট শনাক্ত করতে পারে।
কনডমের ভেতর চোলাই মদ রাখার নজির ভারতে আছে। ফেনসিডিল পাচার ও সরবরাহে বাংলাদেশে এর ব্যবহার হচ্ছে কি না দেখা দরকার।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বন্দুকের ব্যারেল সুরক্ষার জন্য কনডম ব্যবহার হতো। এর ভেতর বিস্ফোরক রাখার নজিরও আছে।
ট্রান্স ভ্যাজাইনাল আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষায় ডিটেকটরকে কনডমে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। কোকেন চোরাচালানে কনডমের ব্যাপক ব্যবহার ধরা পড়েছে। আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিনের লেখায় সোভিয়েত গুলাগের একটি চিত্র : কয়েদির মুখে কনডম ঢুকিয়ে সিরিঞ্জের সাহায্যে ভেতরে প্রায় তিন লিটার কড়া এলকোহল ঢুকানো হতো।
কনডমের মুখ কৌশলে দাঁতে আটকে রাখতে হতো। ভরে গেলে সহকয়েদিরা তা বের করে পানি মিশিয়ে সাত লিটার কড়া ভদকা তৈরি করত। ব্যাপারটা খুব বিপজ্জনক এবং ফেটে গেলে জীবন সংহারক হলেও কয়েদিরা তা করত। আফ্রিকানদের তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ একবার দাবি জানাল, সব সাদা, ঘিয়ে, ধূসর কনডম নষ্ট করে ফেল। আমরা কালো কালো কনডম চাই।
বাজারে এসেছে ম্যাডোনা কনডম। ম্যাডোনা কনডমে ঘর সাজানোর কাজও হচ্ছে। ২০০৩ সালে চীন তৈরি করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কনডম। হলুদ পিভিসি (পলিভাইনিল ক্লোরাইড) কনডমটির উচ্চতা ৮০ মিটার এবং ব্যাস ১শ মিটার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।