যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যসুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করায় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ বলে পরিচিত তৈরি পোশাকশিল্প এখন কঠিন সময় পার করছে। যুক্তরাষ্ট্র যদিও বলছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এটি প্রতীকী ব্যবস্থা, এর পরও এর ক্ষতিকর প্রভাব কম নয়।
৪ জুলাই প্রকাশিত লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর এক প্রতিবেদনে এমনটিই বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে পোশাক খাতের এই দুরবস্থার জন্য প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে দোষারোপ করা হয়েছে। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, অন্যান্য বাজারেও শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার হারাতে পারে বাংলাদেশ।
এর ফল হবে মারাত্মক। বলা হয়েছে, বিদেশি বাজার ও দেশি রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে রয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জিএসপি স্থগিতের বিষয়ে গত ২৭ জুন হোয়াইট হাউস একটি বিবৃতি দেয়। ওই বিবৃতিতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের দুরবস্থা ও নানা দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের হতাহতের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হতাশার কারণেই জিএসপি স্থগিত করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এর পরিমাণ বছরে প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। মার্কিন জিএসপি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাত্ক্ষণিকভাবে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না, তবে ব্যাপকভাবে এটি দেশটির ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইতিমধ্যে তা দেশটির একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
বড় দুটি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ক্ষতি হয়েছে।
মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে ঘটে এই দুই দুর্ঘটনা। এর মধ্যে একটি ২০১২ সালের নভেম্বরে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড। ওই ঘটনায় ১১৭ জন শ্রমিক নিহত হন। অপর ঘটনায়, গত ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ভবনধসে এক হাজার ১৩০ জন শ্রমিক নিহত হন।
২০১৪ সালের জানুয়ারির আগে আগে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা।
এই প্রেক্ষাপটে পোশাকশিল্প খাতটি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই শিল্পের ব্যর্থতার দিকগুলোর প্রতি অবহেলা এবং সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক।
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পত্রিকায় বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপির নেতা খালেদা জিয়ার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে পোশাকশিল্পে নানা দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাত থেকে ‘গণতন্ত্র রক্ষারও’ আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা প্রধান দুই দলের পাঁচ বছর মেয়াদি পালাবদলের সঙ্গে পরিচিত। নির্বাচন এলে অর্থনীতিও ঝিমিয়ে পড়ে। বর্তমানে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে আইএমএফ।
জিএসপি প্রত্যাহারের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ওয়াশিংটন টাইমস’ পত্রিকায় খালেদা জিয়ার নিবন্ধের কথা জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী। বিষয়টি ভালোভাবে সামাল দিতে পারেনি বিএনপি।
বরং তারা এক অদ্ভুত দাবি করেছে যে, দলটি কখনোই ওই নিবন্ধ জমা দেয়নি। তবে আওয়ামী লীগ জোর দিয়ে বলেছে, বিএনপি জাতির শত্রু। কারণ, তারা পোশাকশিল্পের ক্ষতি চায়।
এই কাদা-ছোড়াছুড়ির মধ্যে আওয়ামী লীগ তাদের অতীত ভুলে গেছে। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার পোশাকশিল্পের অবাধ্য ইউনিয়ন নজরদারির জন্য একটি বিশেষ পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করেছে।
অথচ ২০০৬ সালে এই ইউনিয়নই দলটির পাশে ছিল।
তৈরি পোশাকশিল্পের একজন ব্যবস্থাপকের মতে, বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের পথ ধরেছে। শ্রমিক অসন্তোষকে উসকে দিচ্ছে তারা। তারা নিজেদের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের ব্যবহার করতে চায়।
জিএসপি প্রত্যাহারের ঘোষণায় আওয়ামী লীগ সরকারের ইউনিয়নবিরোধী অবস্থান উঠে এসেছে।
২০১২ সালে বাংলাদেশের শ্রমিকসংগঠক আমিনুল ইসলাম গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হন। পরে তিনি মারা যান। ঢাকার ও বিদেশি সুশীল সমাজ তাঁর মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোর মতে, ওই ঘটনা পোশাকশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অন্যরা সরকারের কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি পাঠায়। কিন্তু সরকার তাদের চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিতের ব্যাপারে সুপারিশ করেছে।
অনেক সমালোচকের সন্দেহ, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ যুক্তরাষ্ট্রকে জিএসপি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ইউনূসকে পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে দেখা হয়।
২০১৩ সালের এপ্রিলে মার্কিন কংগ্রেশনাল পদক পেয়েছেন তিনি। তিনি শেখ হাসিনার বিরাগভাজন। গ্রামীণ ব্যাংক ভাঙার জন্য সরকার একটি কমিশন করেছে। জিএসপি প্রত্যাহারের পর ওই কমিশনের ডাকা একটি কর্মশালা স্থগিত করা হয়েছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।