৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বিদেশি পর্যবেক্ষকশূন্য হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে পর্যবেক্ষণ না করার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়ে দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর। ওআইসির কাছে নির্বাচন কমিশন আমন্ত্রণপত্র পাঠালেও তারা কোনো জবাব দেয়নি। চলতি সপ্তাহেই এ বিষয়ে নেতিবাচক জবাব পাঠাতে পারে ওআইসি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরে যুক্তরাজ্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কারিগরি প্রস্তুতি নিয়েও বর্তমান পরিস্থিতিতে পিছিয়ে গেছে।
ঢাকার অন্যান্য দূতাবাসের পক্ষ থেকে কেউই এ বিষয়ে যোগাযোগ করেনি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে। বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনের রীতি অনুসারে, পর্যবেক্ষক হিসেবে বড়সংখ্যক বিদেশির উপস্থিতি থাকে। সর্বশেষ চলতি বছরে অনুষ্ঠিত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ছিলেন ১৯৫ জন বিদেশি পর্যবেক্ষক। এর মধ্যে রাজশাহীতে ৩৮, বরিশালে ৫১, সিলেটে ৫৬ ও খুলনায় ৫০ জন দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ১৫০ জন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছিল ইইউ।
এরপর ৮১ জন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অন্য সংস্থা ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) স্বল্প মেয়াদে ৬০ ও দীর্ঘ মেয়াদে ২০ জন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছিল। কিন্তু এবার নির্বাচন পর্যবেক্ষণে না আসার কারণ হিসেবে বিদেশিরা ৩টি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। ১. গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়া ২. সবার অংশগ্রহণ না হওয়া এবং ৩. সর্বশেষ যে বিষয়টির ওপর তারা জোর দিয়েছেন তা হলো, নির্বাচন হওয়ার আগেই অর্ধেকের বেশি প্রার্থীর বিজয়ী হওয়া। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এত বেশিসংখ্যক বিজয়ী হওয়ায় এ নির্বাচনকে পর্যবেক্ষণযোগ্যই মনে করছেন না তারা।
গতকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন না পাঠানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। রবিবার কমনওয়েলথ ও শুক্রবার ইইউ জানিয়েছে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। এনডিআই এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করবে না। তবে প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতির ওপর একটি সমীক্ষা করবে। আইআরআই সব প্রস্তুতি নিয়েছিল।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পর সেই পর্যবেক্ষণ আর হচ্ছে না। অবশ্য ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আরও কয়েকটি দল নির্বাচন বর্জন করলে এখনকার মতোই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইইউ, কমনওয়েলথ, আইআরআই, এনডিআই ও ইডবি্লউজি।
যুক্তরাষ্ট্রের না : পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কারণ উল্লেখ করে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র জেন সাকি এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, এমন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের জন্য নিজেদের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরার একটি সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় সংসদের অর্ধেকেরও বেশি আসন প্রতিদ্বন্দ্বীহীন হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছে, এমন একটি নির্বাচন আয়োজনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এখনো কোনো সমঝোতায় পেঁৗছাতে পারেনি। এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র এ নির্বাচনের জন্য পর্যবেক্ষক পাঠাবে না।
পরে অনুকূল পরিবেশে আমরা আমাদের পর্যবেক্ষক পাঠাতে তৈরি আছি। এমন পরিস্থিতিতে সংলাপ অব্যাহত রাখা এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য যথোপযোগী সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ ত্বরান্বিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রধান দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়। একটি সহিংসতামুক্ত ও ভীতিমুক্ত পরিবেশে নিজেদের জাতীয় প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ বাংলাদেশের মানুষের প্রাপ্য। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং যারা নেতৃত্ব প্রদানের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন, তাদের আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। সহিংসতা, উসকানিমূলক বক্তব্য ও ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে হবে।
সব রাজনৈতিক দল ও বাংলাদেশি নাগরিকদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনুপ্রাণিত করে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, সব দলের ও বাংলাদেশি নাগরিকদের অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। এ মতামত প্রকাশের সুযোগ প্রদান করা সরকারের দায়িত্ব। একইভাবে এ সুযোগ শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা বিরোধী দলের দায়িত্ব। '
কমনওয়েলথের বক্তব্য : কমনওয়েলথের মহাসচিব কমলেশ শর্মা পর্যবেক্ষণ না করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন।
ইসি থেকে কমনওয়েলথকে পর্যবেক্ষক পাঠানোর অনুরোধ করায় সংস্থাটির মহাসচিব কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে মহাসচিব বলেছেন, 'বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ না থাকায় কমনওয়েলথ এ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সদস্য দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি কমনওয়েলথের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে কমনওয়েলথের সহযোগিতা থাকবে। ' এর আগে কমনওয়েলথের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল ঢাকা সফর করে এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে সংস্থার মহাসচিবের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছেন।
সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমনওয়েলথ।
ইইউর যুক্তি : ইইউর পররাষ্ট্রবিষয়ক ও নিরাপত্তা নীতিমালাসংক্রান্ত জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি ক্যাথরিন অ্যাশটনের মুখপাত্র শুক্রবার এক বিবৃতিতে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা জানান। বিবৃতিতে মুখপাত্র বলেন, 'সর্বশেষ জাতিসংঘের উদ্যোগসহ নানামুখী প্রয়াস সত্ত্বেও সব দলের অংশগ্রহণে একটি স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ব্যর্থতার নিন্দা জানিয়েছেন ইউরোপিয়ান কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাথরিন অ্যাশটন। এ ছাড়া তিনি সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সব রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। সব দলের অংশগ্রহণে একটি স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম করার মতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি হলেই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে তৈরি আছে ইইউ।
' এই জোটের প্রতিনিধি দলের প্রধান উইলিয়াম হানা বলেছেন, 'যেখানে অর্ধেকের বেশি প্রতিনিধি ভোটারের মতামত ছাড়াই বিজয়ী হয়েছেন সেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কোনো উপযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। '
আগ্রহ নেই দূতাবাসগুলোর : ঢাকার কয়েকটি দূতাবাসের পক্ষ থেকে নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তা পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ জন্য ৫ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন ভোটারের উপস্থিতি এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা দেখার পর মতামত দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত আর নেই। উত্তর আমেরিকার আরেকটি প্রভাবশালী দেশের একজন কূটনীতিক এ বিষেয়ে বলেছেন, '৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ প্রশ্ন উত্থাপন করছে।
এ বিষয়টি আমরা আমাদের রাজধানীকে জানিয়েছি। এখন এ নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে কি না সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে আমাদের রাজধানী থেকে। প্রায় একই ধরনের সিদ্ধান্ত এশিয়া ও ইউরোপের অন্য দেশগুলোর। '
সরকারের অবস্থান : সরকারের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক শীর্ষ এক কর্মকর্তা সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, বিদেশি পর্যবেক্ষকের বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কমিশনকে সহায়তা করা হয়ে থাকে।
তবে এবারের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকার মনে করছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না তা ভাবার বিষয়। কারণ প্রতিবেশী ভারতের নির্বাচনেও কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক রাখা হয় না। আবার আফগানিস্তানের নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদন নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা হয়েছে। তাই সরকার নির্বাচনের বিষয়ে দেশীয় পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদনের ওপর সম্পূর্ণরূপে আস্থা রাখতে চাচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।